বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে ৩০ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে যাব ফাতিহা পাঠ করতে। প্রথম ভেবেছিলাম শুধু পারিবারিকভাবে ১০-১৫ জন যাব। করোনার কারণে গত তিন বছর পিতার কবরে যাওয়া হয়নি। তাই প্রতি মুহূর্তে মনটা ছটফট করছে। পিতার কবরে যাওয়ার কথা আলোচনা হওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীরা উতালা হয়ে পড়েছেন, তারাও যাবেন। দরকার পড়লে নিজ দায়িত্বে যাবেন। তবু যাবেন। বেটা-ভাইস্তাদের ইচ্ছা তারাও যাবে। শেষ পর্যন্ত আর অমত করিনি। কদিন আর বাঁচব, তাই কারও সাধ অপূর্ণ রাখতে চাই না। টুঙ্গিপাড়া যাব শুনে কেউ কেউ আবার সাহায্যও করতে চেয়েছেন, অনেকে করেছেন। নেতা-কর্মীদের পীড়াপীড়ি দেখে আমিও কারও কারও কাছে সাহায্য চেয়েছি। সবাই দারুণ সাড়া দিয়েছেন। দেখা যাক, আল্লাহ কী করেন। এতকাল ঘণ্টার পর ঘণ্টা পদ্মার পাড়ে কষ্ট করে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছি। এই প্রথম বাংলাদেশের গর্ব-অহংকার পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাব। ২৫ জুন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে গিয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা যেখানে পদ্মা সেতু উদ্বোধনে দেশবাসীকে সম্বোধন করেছেন সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পদ্মা সেতু ছিল সেখান থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে। তাই মোটেই দেখা হয়নি। ঠিক জানি না, কী করে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন আর আমার শুভ পরিণয়ের দিন এক হয়েছে। এও এক সৌভাগ্য। ব্যাপারটা তেমন খেয়াল না করলেও এর মাঝে অনেকেই চিঠি দিয়েছেন, নাসরীনের বন্ধুরা কবিতা লিখেছেন- এসব দেখেশুনে খুবই অবাক হয়েছি। আল্লাহ কী করে কেন যে এত দয়া করেন, এত বড় বড় ঐতিহাসিক দিনের সঙ্গে জড়িয়ে দেন তিনিই জানেন।
দীর্ঘ নির্বাসনের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯০-এ দেশে ফিরেছিলাম। গভীর রাতে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলের সন্তোষে হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজার জিয়ারত করতে আর আমার ১০ মাসের বাচ্চা কুঁড়িমণিকে দেখতে। কুঁড়িমণি জন্মেছিল ১০ ফেব্রুয়ারি ’৯০, আমি আমার মাতৃকোলে ফিরেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর ’৯০। তাই মনে হচ্ছিল মামণির ভাগ্যই আমাকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। তাই স্বদেশের মাটিতে ওকে বুকে নিয়ে বড় প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। ওর ছোট্ট ছোট্ট দুই পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম। অনেক বছর আগে আমার জন্মদায়িনী মা, যিনি আমাকে অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেই মায়ের পা ধুয়েও পানি খেয়েছিলাম। দুই দুই চার পা ধোয়া পানি আমাকে অমৃতের স্বাদ দিয়েছিল। সঞ্জীবনী সুধার মতো সেই পানি আমাকে সব জ্বালা-যন্ত্রণা, অপমান-অসম্মান ও হেলাফেলা সইবার শক্তি দিয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর ’৯০ প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ নেতা-কর্মী নিয়ে প্রথম টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। কে কে যেন সাহায্য করেছিল। বড় ছোট অসংখ্য গাড়ি দিয়েছিল, কয়েক লাখ টাকা দিয়েছিল। তাই যাতায়াতে গায় পায় লাগেনি। সেবার ১৮-২০ ঘণ্টা লেগেছিল টুঙ্গিপাড়া যেতে। প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ সঙ্গে ছিলেন। বড়সড় আরও কে কে যেন গিয়েছিলেন। হয়তো আজ তাঁরা ভুলে গেছেন। আবার সুদিন এলে মনে পড়বে। আজকের অবস্থা তখন টুঙ্গিপাড়ায় ছিল না। পিতার কবরের ৬-৭ হাত পশ্চিমে গোয়ালঘর ছিল। সেই গোয়ালঘরে পিতাকে বহন করা কফিনের বাক্স ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে গামছা ব্যবহার করি। আস্তে আস্তে বস্ত্রটা আমার অঙ্গ হয়ে গেছে। ১৮ ডিসেম্বর অনেক রাত হয়েছিল। সাড়ে ১২টার কম হবে না। রাস্তায় রাস্তায় সাধারণ মানুষ পাগল হয়ে ছিল। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের নেতা-কর্মীরা বড় উন্মাদ হয়ে ছিলেন। সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে গোপালগঞ্জের শহীদ মিনারে সমাবেশ হয়েছিল। কী বলেছিলাম বা বলতে পেরেছিলাম কিছুই মনে নেই। সাড়ে ১২টা-১টার দিকে পিতার কবরে গিয়েছিলাম। বাবা-মার পাশে একেবারে একটা সাদামাটা কবর। চারদিকে তেমন বেড়াও ছিল না। কত সময় কেঁদেছিলাম, কেন কেঁদেছিলাম ওসব খেয়াল নেই। কারণ আমার তখন কোনো বোধশক্তি ছিল না। সেই গভীর রাতেও ১০-১৫ হাজার লোক ছিল। নেতারা কেউ আমার কান্নার তোয়াক্কা করেননি, মূল্য দেননি। তাঁদের আগ্রহ মানুষকে কথা শোনানো। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। জীবিত মানুষ অমন অসাড় হয়- কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার ছোটখাটো স্ত্রী, তিনি নিজেও কাঁদছিলেন আবার আমাকে সামলাবার চেষ্টা করছিলেন। কীভাবে যেন জোরজবরদস্তি টানাটানি করে মঞ্চে নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলাম, মনে রাখবেন পিতার মৃত্যুতে খুনিরা আমাকে কাঁদতে দেয়নি। ১৬ বছর পর পিতার কবরেও আপনারা আমাকে কাঁদতে দিলেন না! বড় অবিচার করলেন, এ সবই আমার কপাল। শুনেছি, ১৮-১৯ জন মহৎপ্রাণ সাহসী মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়ে কবর দিয়েছিলেন। সেদিন হঠাৎই ইউটিউবে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর দেওয়ার দৃশ্য দেখলাম। সব নামিদামি শিল্পী নাটকের মতো করেছেন। সেটা যে কোনো নাটক ছিল না সে রকম গভীরতা দেখলাম না, অনেকটাই গতানুগতিক। যে মেজর লাশ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ওভাবেই মাটিচাপা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা দিতে পারেননি। তেমন প্রতিবাদ নয়, কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার কিছু হতদরিদ্র মানুষ বলেছিলেন, মুসলমানের লাশ গোসল না দিয়ে জানাজা না পড়িয়ে কবর দেওয়া যায় না। খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর কোনো বোন বা চাচি টুঙ্গিপাড়ায় ছিলেন। তিনি জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন। মাওলানা আবদুল হালিম, তিনি সেই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর ১৮ ডিসেম্বর ’৯০ গভীর রাতে দেখা হয়েছিল। যারা পিতাকে কবর দেওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তাদের প্রায় সবাইকে পেয়েছিলাম। একজন মাওলানার জন্য বঙ্গবন্ধু বিনা জানাজায় এপার থেকে ওপার যাননি। তার পরও বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকার আমলে প্রকৃত আলেমরা অবহেলিত নির্যাতিত হলে কেন যেন বুকে বাঁধে। প্রথম যেবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম সেবার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখাশোনা করত বৈকুণ্ঠ, নির্মল, আতিয়ার আরও যেন কে কে। খুব যত্ন করেছিল। পরে যখন গিয়েছি কখনো যত্ন করেছে, কখনো আবার পিতার কবরের পাশে রাস্তায় শুয়ে থাকতে বিছানার ওপর দিয়ে পিতার অনেক আত্মীয়স্বজন গাড়ি চালিয়ে গেছে। আবার কখনো মাজারে মোনাজাত শেষে বৈঠকখানায় বসার সুযোগ পাইনি। তালাচাবি বন্ধ করে রেখেছে। তবু পিতার কবরে যেতে, তাঁর পায়ের কাছে রাত কাটাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তিন-চার বছর আগেও একবার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ও সহকর্মীদের নিয়ে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। সেবারও পিতার পায়ের কাছে বিছানা পেতে শুয়ে ছিলাম। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে থানা সদরে পর্যটনের এক বাংলোয় ছিল। বাংলোর বিল এত বেশি যা শুনে ভিরমি খেতে হয়েছিল। দেওয়ার মতো সামর্থ্যও ছিল না। কে যেন বিল দিয়েছিল। ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে খেয়েছিলাম। মাসখানেক পর ছয়জনের খাবার বিল এসেছিল ৪ হাজার টাকা। পরে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। জানি না, ৩০ আগস্ট কপালে কী আছে। তবে এবার কারও কাছে কোনো ভরসা যাচ্ছি না। আল্লাহকে ভরসা করে যাব। আল্লাহ যা করবেন তা-ই হবে।
‘কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হলো না তো ভাই, তাই লিখি করে ঘাড় নিচু!’ অনেক বছর, ৮০ বছর তো হবেই বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন। আমারও কেন যেন অমনটা লিখতে ইচ্ছা করল। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে ভীষণ দরদ দিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা সবাই দোয়া করবেন বঙ্গবন্ধুকে আল্লাহ যেন জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়।’ হায়রে কপাল! এমনই ভক্ত, এমনই জোশ, জান্নাত আর জাহান্নামের পার্থক্য করে না। জোশে জোশে মুখে যা আসে তা-ই বলেন। মানুষ মাত্রই ভুল করে- এ কথা বলে যদি হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোকেরা ভুলে যায়! আর যদি বঙ্গবন্ধুর জাহান্নাম প্রার্থনা ভুলে যেতে হয় তাহলে এরাই যখন তার জন্য জান্নাত প্রার্থনা করবে বা করে তখন তা-ও তো মানুষ বিশ্বাস না করে ভুলে যেতে পারে। সত্যিই কি পিতার জন্য জান্নাতের জায়গায় জাহান্নাম বুকে মুখে আসতে পারে? কখনো না। এসব একমাত্র শয়তানের মুখে শোভা পায়। আবার দেখুন কত লাখো মানুষের রক্তদানে, কত মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম, কত ঘরবাড়ি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সত্যিই কারও দয়া নয়, অভাবনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জন। সেই স্বাধীনতা, সেই সার্বভৌমত্ব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত করছেন। শেখ হাসিনার সরকারকে ভারতের টিকিয়ে রাখতে হবে কেন? শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখবে বাংলাদেশের জনগণ। এখানে ভারতের, আমেরিকা-চীনের কিছুই করার নেই। যে যা-ই করবেন সবটাই অন্যায় অবৈধ। কদিন আগে এ ভদ্রলোকই বলেছিলেন, ‘অন্য দেশের চাইতে বাংলাদেশে বেহেশতের পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা বেহেশতে আছি।’ উনি কবে বেহেশতে গেলেন, বেহেশতে আন্ডা কত জেনেছিলেন কি না জানি না। বেহেশত থেকে ফিরে ভারতে গিয়ে এমন কথা বললেন! এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে দেশের নিরাপত্তা কোথায়? সরকারের বাইরের মানুষ দেশের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা দেশদ্রোহী, সরকারে থেকে বললে দেশদ্রোহী নয়- এমনটা কী করে হয়? নিশ্চয়ই আমাদের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশদ্রোহী। তাঁকে অনতিবিলম্বে দেশদ্রোহিতার দায়ে গ্রেফতার করে বিচার করা উচিত। আমি ভেবে পাই না এতসব নির্বোধ নিয়ে আমার বোন চলেন কী করে? সেদিন আবার কোনো এক ছোটখাটো নেতা এক সভায় বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করতে গিয়ে ফারুক, রশীদদের আত্মার মাগফিরাতও কামনা করে বসলেন! কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বোন কী করে এসব সহ্য করে নিজের সর্র্বনাশ ডেকে আনছেন তা-ও বুঝি না। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমানসহ অনেকেই বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আওয়ামী লীগের কেউ নন। কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। মন্ত্রী হওয়ার আগে এক দিনের জন্যও ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ করেননি। তাঁর অগ্রজ আবুল মাল আবদুল মুহিত, তিনিও না। তাঁরা কেউ সিএসপি, কেউ বিসিএস। পাকিস্তানের গোলামি, জিয়া-এরশাদের সহযোগী, মন্ত্রী। এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকারের হর্তাকর্তা-বিধাতা। এর কোনো কিছুই ভালো না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা বলেছিলেন, ‘অকটেন-পেট্রোল আমাদের তেমন কিনতে হয় না, অনেকটাই নিজেদের চাহিদা পূরণ হয়।’ আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাঁর কথা মোটেই অতিরঞ্জিত ছিল না। আমাদের নিজস্ব পেট্রোল-অকটেন অনেকটাই চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু তাঁর কথার সঙ্গে সঙ্গেই দু-তিন দিনের মধ্যে আচমকা পেট্রোল-অকটেন-ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জাতিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, জাতীয় নেতাকেও অপ্রিয় করা হয়েছে। পেট্রোলের ব্যারেল যখন ১৭০ ডলার ছিল তখন দাম বাড়ানো হলো না, এখন ৮৬ ডলার প্রতি ব্যারেল। দু-চার দিনের মধ্যে আরও কমবে। রাশিয়া থেকে তেল আনলে ৩০-৪০ ডলার দাম পড়বে। ২২০ লিটারের ব্যারেল ৩০-৪০ ডলার পড়লে আমাদের দেশে ৩০-৪০ টাকা লিটার তেল বেচলেও খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এসব কী হচ্ছে! না বুঝ নেতারা, বেপরোয়া আমলারা দেশে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা যে করছেন না তা-ই-বা বলি কী করে। চাটুকারিতার নমুনা বা উদাহরণ হিসেবে এক যুগ আগে গোলাম মাওলা রনির একটা লেখা এবং পরবর্তীতে আমার মতামত তুলে ধরছি।
‘যা হোক, নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীর পরাজয় এবং তৎপরবর্তী সময়ে নেতাদের অন্তঃকলহ দলকে বহু ভাগে বিভক্ত করে তোলে। তাদের অনেকেই গোপনে সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ এবং প্রকারান্তরে তারই নির্দেশে দলকে ধ্বংস করার তান্ডবে অনেকেই জড়িত ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন দিল্লিতে। নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন সপরিবারে। দলের মধ্যে অনেকে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। অনেকে তাকে ব্যবহার করতে চাইতেন ব্যক্তিগত ক্ষমতা আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে। আবার অনেকে সত্যিকার অর্থেই দলকে ভালোবেসে শেখ হাসিনার সহযোগিতা কামনা করতেন। ড. কামাল হোসেন ও প্রয়াত আবদুর রাজ্জাকই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। অন্যদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনাও নির্বিকার চিত্তে এবং একান্ত অনুভবে তাদের বিশ্বাস করতেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনের কাছে জেনেছি- দিল্লিতে তাদের আর্থিক দৈন্য ছিল চরমে। নিজে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরতেন। বাসায় দুই ধরনের চাল রান্না হতো। স্বামী ড. ওয়াজেদ মোটা চালের ভাত খেতে পারতেন না। তাই কেবল তার জন্য চিকন চালের ভাত। বাকিরা খেতেন নিম্নমানের মোটা চালের ভাত। পরিবারের একমাত্র আয় ভারত সরকারের প্রদেয় যৎসামান্য ভাতা। সেই ভাতা থেকে টাকা বাঁচাতেন শেখ হাসিনা। নিজ পরিবারের মুখে উপাদেয় অন্ন তুলে না দিয়ে যে টাকার সাশ্রয় হতো তা-ই মাস শেষে আবদুর রাজ্জাকের কাছে পাঠাতেন দল চালানোর জন্য। আমার প্রশ্ন- বাঙালিদের মধ্যে কি এমন কোনো নেতা ছিলেন না, যিনি আবদুর রাজ্জাককে দল পরিচালনার জন্য কিছু টাকা দিতে পারতেন? যা হোক, টাকা আসত দিল্লি থেকে, আর নেতারা খরচ করতেন তা দলীয় অন্তঃকলহ বাড়িয়ে দেওয়ার কাজে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। ঐক্য হলো না। বরং দলীয় সভাপতি প্রার্থী এত বেশি হলো যে, দলের ভাঙন নিশ্চিত হয়ে উঠল। এ অবস্থায় শেখ হাসিনাকে বলতে গেলে একরকম জোর করেই আনা হলো। ১৯৮১ সালের ১৭ মে যে দিনটি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন, সেই বর্ষণমুখর দিনটি কিন্তু ফুল বিছানো ছিল না। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি সেদিন এসেছিলেন। দীর্ঘকালীন দল পরিচালনায় তার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বিশেষত ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্মিলনের প্রতীক হিসেবে কোটি কোটি বঙ্গবন্ধুভক্ত শেখ হাসিনা ব্যতিরেকে অন্য কাউকে কল্পনাও করেন না।’
বর্তমানে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর, উসকানিমূলক, তেলমর্দন, চাটুকারিতা দেখে এক দশক আগে ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের এমপি গোলাম মাওলা রনির ‘আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য বনাম দুর্ভাগ্য’ লেখা মনে পড়ল। তখন তিনি নিয়মিত লিখতেন। তখন আওয়ামী লীগ করলেও এখন বিএনপি করেন। চাটুকারিতা আর কাকে বলে! কোনো এক ঐতিহাসিক সিরিয়াল অথবা নাটকে সভাসদদের রাজা বা সম্রাটকে বলতে শুনেছিলাম, ‘আপনার কথা না হুজুর একেবারে বেদেনার দানা।’ এ ক্ষেত্রেও তেমন। আমার বোন শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে ছিলেন, নিশ্চয়ই কষ্টে ছিলেন। দারিদ্র্য যে ছিল না তা-ও নয়। কিন্তু তাঁকে ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরার তেমন কারণ ছিল না। আর তিনি কতটা সেলাই করতে পারেন তা-ও জানি না। চশমা খুলে গেলে আশপাশের লোকজন দেখতে পান না। আশপাশে পড়ে থাকা চশমা হাতড়িয়ে বের করতে পারেন না। তিনি যে সুইয়ে সুতা লাগাতে পারেন সেটাই বা ভাবী কী করে! আর কেন তাঁকে ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরতে হবে? তেমন অবস্থা তো ছিল না। এখন যেটা ২-৩ হাজার টাকা দাম, সে শাড়ির তখন দাম ছিল দুই-আড়াই শ টাকা। তাঁকে ভারত সরকার যে সম্মানি দিত তাতে তাঁর চলতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তা ছাড়া আমার দুলাভাই ড. ওয়াজেদ মিয়া দিল্লির অ্যাটমিক এনার্জিতে বসতেন। প্রতি মাসে ভালো বেতন পেতেন। তাঁর সব টাকাই প্রায় পড়ে থাকত। আমার ছোট বোনজামাই আরিফ আহমেদ দুলালকে বোন এবং দুলাভাই খুবই আদরযত্ন করতেন। একবার নন-অ্যালায়েন্স কনফারেন্সের সময় সরকার তাঁর দেহরক্ষী তুলে নিলে ভীষণ বিব্রত হয়েছিলেন। প্রিয় দুলাল প্রায় ২০ দিন আমার ব্যবহারের গাড়ি নিয়ে দুলাভাইকে পাহারা দিয়েছেন। তাতে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। একবার দুলাভাই আপা এবং জয়-পুতুলের সব পুরনো কাপড় বস্তা ভর্তি করে রংপুরে পাঠাবার চিন্তা করেছিলেন। দুলাল খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘দুলাভাই এগুলো কী করেন? এসব পুরনো কাপড় দেশের মানুষের প্রয়োজন নেই। তারা পড়বে না। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হওয়ায় পেটে ভাত না থাকলেও মানুষের গায়ে কাপড় আছে। কাপড় এখন খুব একটা দুর্লভ নয়, অনেকটাই সুলভ। কেন যে রনি আমার বোনকে ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরার কথা বললেন বুঝতে পারলাম না। তিনি শুনেছেন, আমি দেখেছি। একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে নিয়েছি। এখন তো ৭০-৮০ টাকা চাল। তখন ছিল ৩-৪ টাকা। ভালো চাল ৩-সাড়ে ৩ টাকা বা ৪ টাকা। মোটা চাল দুই-আড়াই টাকা। আমার না হয় রাবণের সংসার ৪০-৫০-১০০ জন খেত প্রতিদিন। কিন্তু বোনের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী, জয়-পুতুল আর কাজের ছেলে রমা। কখনোসখনো কোনো কাজের মহিলা। সব মিলে পাঁচ-ছয় জন। চাল লাগত মাসে ৪৫-৫০ কেজি। ৪ টাকা করে হলে ২০০ টাকা। ২০০ টাকার চালের জায়গায় দুই-আড়াই টাকা সের সাধারণ চাল। ১০-১২ কেজি ভালো চাল আর ৩৫-৪০ কেজি মোটা চাল কিনলে কয় টাকা বাঁচত? ৩০-৪০-৫০ টাকা? প্রিয় বোনের মাসে খাওয়া খরচ হতো দুই-আড়াই হাজার টাকা। হ্যাঁ, সেখান থেকে কষ্ট করে তিনি ৩০০-৪০০ টাকা বাঁচাতে পারতেন। তাতে কি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চলত? তিনি তো আমাকেও মাঝেমধ্যে জোর করে টাকাপয়সা দিয়েছেন। আমি টাঙ্গাইলের কত শাড়ি নিয়ে গেছি সেগুলো পরতেই সময় পাননি, ছেঁড়া শাড়ি পরবেন কী করে? প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি তাঁকে আপন বোনের মতো মনে করতেন। তাঁকে ছেঁড়া শাড়ি পরতে হবে কেন? একা একা থাকতেন বলে কলকাতা থেকে তাঁর জন্য সোনোডাইন রেকর্ড প্লেয়ার পাঠিয়েছি। লাঙ্গুলিয়ার সদু শিকদারের ছেলে হায়দার শিকদার আজমির যেতে ঘাটাইলের লতিফ পাগলকে নিয়ে রেকর্ড প্লেয়ার দিতে গিয়েছিল। তাদের যে যত্ন করেছিলেন তারা আমৃত্যু তা স্মরণ করেছে। তাই এ রকম বলে নেত্রীকে বড় করা হয়নি, বরং ছোট করা হয়েছে। চাটুকারী করা হয়েছে। লেখার ক্ষমতা থাকলেই সত্যকে মিথ্যা বানানো ঠিক নয়। আর কোনো মিথ্যা কখনো সত্য হয় না। আমরা যদি এসব চাটুকার থেকে যথাযথ সতর্ক হতে পারতাম তাহলে আমাদের আর কোনো অসুবিধা থাকত না।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সমুদ্রগড় ও নদীয়ার ফুলিয়া টাঙ্গাইল শাড়ির ছোটখাটো কেন্দ্র। শত শত হাজার হাজার টাঙ্গাইল শাড়ি তারা তৈরি করে। মূলত কলকাতার বড় বাজারে বিমল বসাকের দুলাল বস্ত্রালয়ের মাধ্যমে সারা ভারতে টাঙ্গাইলের শাড়ি সরবরাহ হয়। আসাম থেকে বম্বে, গুজরাট, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ইল্লি-দিল্লি কোনো জায়গা নেই যেখানে তারা শাড়ি সরবরাহ করে না। আমি যখন ভারতে নির্বাসনে ছিলাম তখন শত শত শাড়ি নির্মাতা আমার কাছে আসত। আমি যেমন তাদের ভালোবাসতাম, তারাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। তার মধ্যে যতীশ বসাক ছিল এক অন্যতম নামকরা ব্যবসায়ী। দেশে থাকতে যতীশ জোর করেই আমাকে শত শত শাড়ি দিত। নির্বাসনেও তার অভ্যাস বদল হয়নি। বর্ধমানে গেলেই এক গাঁটরি শাড়ি রেখে যেত। টাকা দিই বা না দিই শাড়ি সে দেবেই। এই বসাকরা যখন দিল্লি যেত আমার বোন শেখ হাসিনাকে তারা দেবী দুর্গার মতো মান্য করত, ভালোবাসত। তারা জোর করেই বোনকে শাড়ি দিয়ে আসত। আমিও কম করে বছরে না হলেও ৪০-৫০টা শাড়ি নিয়ে যেতাম। কোনোবার শাড়ি নিতে আমার ভুল হতো না। এ ছাড়া আমি যে বাড়ি থাকতাম সে বাড়ির বউদি ড. শীলা সেন, বিখ্যাত সাংবাদিক রাজেন্দ্র সারীনের স্ত্রী, সাংবাদিক দীপ্ত সেনের স্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের বোনের মতো মনে করতেন। বছরে তারাও ২০-২৫টা শাড়ি বা তার চাইতে বেশি দিতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইচ্ছা করলে আমার বোন শাড়ির দোকান খুলতে পারতেন। কাকানগর, পান্ডারা রোড, খান মার্কেট এলাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে শাড়ি বিলিয়েছেন। এমন কোনো উৎসব নেই যেখানে আমার বোনের প্রতিবেশীরা শাড়ি উপহার পায়নি। তাঁর বাড়ির আশপাশের কয়েকজন মাদ্রাজি, গুজরাটি অফিসারের স্ত্রীরা তাঁর জন্য পাগল ছিলেন শুধু তাঁর বদন্যতার কারণে। কতজন যে কত সুন্দর সুন্দর ধোসা বানিয়ে আনতেন অভিভূত হতে হতো। তাই তিনি শাড়ি সেলাই করেননি, বরং টাঙ্গাইলের সুন্দর সুন্দর তাঁতের শাড়ি অন্যদের উপহার দিয়েছেন যা শত বছর ভারতীয় মহিলাদের অন্তরে জাগরূক থাকবে।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন