নূরে আলম সিদ্দিকী :ছাত্রনেতা হিসেবে আমি বক্তৃতার জন্য কখনো বক্তৃতা করিনি। আমার চেতনা, আমার ভাষা, আমার বিশ্বাস, আমার অনুভূতির অনুরণনকে উপলব্ধি এবং বিশ্বাসকে আবেগাপ্লুত শব্দচয়ন করে হৃদয়ের আবির মাখিয়ে অসংকোচে তুলে ধরেছি। রাজনীতিতে সরাসরি না থাকলেও বিশ্বাস ও অনুভূতির শাশ্বত সত্যটুকুই আজ আমার লেখনীতে এবং সেদিনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আমার বক্তৃতায় অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বৈশাখের দুপুরের তপ্তরোদের মতো প্রচ- তীব্রতায় প্রকাশিত হতো। সেদিনের রাজনীতি আবর্তিত হতো ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নয়, বরং জনগণের হৃদয়মথিত সমর্থনের জন্য। তখনকার সভায় উচ্চারিত কথা এবং মিছিলের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত ভিসুভিয়াসের জ্বলে ওঠার মতো প্রজ্বলিত হতো। সেদিনের মিছিলের মুখগুলো যেন প্রদীপ্ত সূর্যের মতো সমস্ত অবয়বে উজ্জ্বলতার আবির মেখে জ্বলজ্বল করত। বক্ষে স্পন্দিত বাণী বজ্রনির্ঘোষে উচ্চারিত হতো হৃদয়ের আবেগাপ্লুত চেতনাগুলো, নৃত্যপটীয়সী নর্তকীর মতো বিচিত্র ভঙ্গিমায় হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসত জনগণকে উদ্বেলিত করার অগ্নিদীপ্ত বাসনায়। আমরা ছিলাম অদ্ভুত, আমরা ছিলাম নতুন দিনের দূত। সাম্প্রদায়িকতার খন্ডিত চেতনার আঙ্গিকে যে একটি অভিনব জাতীয় চেতনার উদ্ভব হয়েছিল তারই বিদর্ভ গর্ভ থেকে আমরা বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলাম এবং পেরেছিলামও। পল্টন ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সমুদ্রগর্জনের মতো যখন উচ্চারণ করতাম- ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, যখন আপ্লুত হৃদয়ে মিশ্রিত অনুভূতি প্রচ- বেগে বিস্ফোরিত হয়ে উচ্চারণ করত- ‘এ মাটি আমার সোনা আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা’, আবার যখন বিদগ্ধ চিত্তের উদগত সত্তার অনুরণন বজ্রনির্ঘোষে প্রতিধ্বনিত হতো- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’, তখন বাঙালি জাতীয় চেতনার যে উত্তাল অপ্রতিরোধ্য তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হয়ে আপন ভঙ্গিতে প্রতিভাত হতো, তাতে পল্টনের সব নারী-পুরুষের মন কেবল উদ্বেলিত হতো না উদ্যত উদ্ধত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো বিকশিত হতো। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রতিস্থাপনের সুতীব্র আকাক্সক্ষা সযত্নে বক্ষে লালন করে পল্টন ময়দান থেকে ফিরে যেত।
আমি আমার দীপ্ত হৃদয়ের চোখ দিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম, ম্লানমূক মুখে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানিরা কেমনভাবে ক্রমান্বয়ে বিদগ্ধ চিত্তে বাঙালিতে রূপান্তরিত হতেন। যারা একদিন বুকনিঃসৃত তাজা রক্তে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার খরিদ করেছিল, সেই চড়া দামে কেনা বাংলা ভাষায় কথা বলার সেই অধিকার তাদের হৃদয়ে একটি স্পষ্ট চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে, তা হলো- ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’। আমি হলফ করে বলতে পারি, এ কেবল হৃদয়ের উচ্চকিত স্লোগান ছিল না, এ ছিল উদ্ধত বাঙালি চেতনার পূতপবিত্র বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের অন্তর্নিহিত গর্ভ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রজ্বলিত মশাল হাতে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল বলেই সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলার রক্তঝরা স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আমি একটি প্রচ- প্রতীতির বেদিমূলে দাঁড়িয়ে বিদগ্ধ হৃদয়ের অন্দর থেকে আমার প্রতীতির নীল পদ্মকে তুলে নিয়ে আমার পরের প্রজন্মকে- আমার সন্তানদের বলি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি চেতনার উন্মেষ বিকাশ ও ব্যাপ্তি ছিল একমাত্র শানিত অস্ত্র। জনতার নিরেট ও নিষ্কলুষ ঐক্য আর বাঙালি চেতনার প্রচ- বিস্ফোরণই স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে আকাশের বুক চিরে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল।
একটি জাতীয়তাবাদী চেতনা যে কতখানি উদ্দীপ্ত ও দুর্দমনীয় ছিল তা নিরস্ত্র বাঙালির অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানিদের সশস্ত্র মোকাবিলায় পরাভূত করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল। যখন আমরা জাতীয়তাবাদী স্লোগানগুলো উচ্চারণ শুরু করলাম, তখন আমাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, ‘তুমি কে আমি কে’। তখন আমাদের সহযাত্রী কেউ কেউ চমকে উঠেছিলেন, কেউ কেউ আমাদের উচ্চাভিলাষী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, এখানেই ঘটনার শেষ নয়। বাঙালি যে জাতীয় চেতনা তথা স্বাধীনতা অর্জনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণে আমাদের অনেকেই অতিবিপ্লবী ছিলেন। স্বকপোলকল্পিত বিপ্লবের প্রসব যন্ত্রণায় তারা ছটফট করতেন। নির্বাচনের আগেই তারা সশস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে ছিলেন একান্তই উৎসাহী। আমি আমার বিদগ্ধ অনুভূতি ও চেতনার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ওই সমস্ত অতিবিপ্লবীকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে, কোনো বিপ্লবের স্বীকৃতি ও সফলতার জন্য একটি গণম্যান্ডেট অনিবার্য। ষাটের দশকের শেষ অধ্যায়ে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মানুষের নিভৃত কন্দরের সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে বসাতে পারলেও তখনো বঙ্গবন্ধুর হাতে কোনো ম্যান্ডেট ছিল না। তাই আমরা আমাদের স্বকপোলকল্পিত বিপ্লবী বন্ধুদের প্রত্যয়ে উজ্জীবিত সত্তা নিয়ে বলতাম, ধীরে বন্ধু, ধীরে। সত্তরের নির্বাচনটিতে আমরা বাংলার জাগ্রত জনতার নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট যে পাব, তা সুনিশ্চিত। তাই বঙ্গবন্ধুকে সত্তরের নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং জনগণের নিশ্চিত ম্যান্ডেট অর্জন করতে হবে।
তখন জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রদেয় আসনে জাতীয় পরিষদের ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে আমাদের ভাগে পড়ে ১৬৭ জন। এর মধ্যে ১৫১ আসনে জয়লাভ করলেই ক্ষমতা অর্জনের অধিকার আমাদের করায়ত্ত হতো। নির্বাচনের প্রাক্কালে ইয়াহিয়া খান ইএলএফও (ইলেকশন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) নামে যে অধ্যাদেশটি জারি করেন, তাতে খুব স্পষ্টভাবে উল্লিখিত ছিল- পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই করা যাবে না। আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা বা বাঙালি জাতীয় চেতনার পূর্ণ বিকাশে বিশ্বাসী ছিলাম, ইয়াহিয়া খানের ইএলএফও অধ্যাদেশ আমাদের মধ্যে অতিবিপ্লবীদের সত্তরের নির্বাচন বর্জনের রোমান্টিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিল। নির্বাচন বর্জনের চটকদার স্লোগান তখনকার যুবসমাজ এমনকি সামগ্রিক রাজনীতিকে প্রচ-ভাবে প্রভাবিত করেছিল। দগ্ধীভূত হৃদয় নিয়ে মুজিব ভাই আমাকে দেখে অনেক সময় বলতেন, নির্বাচন-টির্বাচন দিয়ে কাজ হবে না, তোরা সিরাজের (সিরাজুল আলম খান) পথই ধর। অস্ত্র ছাড়া পাকিস্তানিদের কাছ থেকে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না। মুজিব ভাইয়ের এ অনুভূতি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হলেও আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রত্যয়দীপ্ত চেতনাকে তা মারাত্মকভাবে আঘাত করত। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি শক্ত অবস্থান নিতেন নির্বাচনের পক্ষে। আমাদের এলোমেলো ও বিধ্বস্ত চেতনা সুসঙ্ঘবদ্ধ হতো। উজ্জীবিত হৃদয়ে আমরা নির্বাচনের পক্ষে ধেয়ে যেতাম। আজকের প্রজন্মকে আমি সুস্পষ্টভাবে অবহিত করতে চাই যে, পল্টন ময়দান থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার প্রান্তিক জনতাকে- তাদের উদ্বেলিত চিত্তের অনুরণনকে আমরা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, সব ষড়যন্ত্রের বক্ষ বিদীর্ণ করে আমরা জাতীয় পরিষদের ১৫১টি আসন ছিনিয়ে আনতে পারবই। এ বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র ঘাটতি কোনো আশঙ্কা বা সংশয় আমাদের চিত্তকে বিচলিত করেনি- আমাদের বিশ্বাসকে দোটানায় ফেলেনি। আমাদের বিশ্বাসের পাদপীঠে দাঁড়িয়েই আমরা সত্তরের নির্বাচনকে আলিঙ্গন করার সব কর্মপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছিলাম এবং তার গতিপ্রবাহ ছিল দুর্দমনীয়। যে-কোনো বাধা অমিতবিক্রমে অতিক্রম করার সাহস ও শক্তি সেদিন আল্লাহ আমাদের দিয়েছিলেন। তাই অনেক টানাপড়েন, অনেক বাধা-বিপত্তি ইএলএফওর ঘৃণ্য বেড়াজাল সামনে রেখেই আমরা সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
পুনর্বার উল্লেখ করি, আমরা বঙ্গবন্ধুকে বারবার বলতাম, অজানা সমুদ্রে লালিত নীলপত্রের মতো সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৫১ আসন আমরা বঙ্গবন্ধুকে এনে দেবই। কিন্তু সেই হিসাবেও ভুল ছিল। ১৫১ নয়, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রদেয় ১৬৭ আসনের মধ্যে ১৬৫টি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয়। যেটি স্বাধীনতার সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করলেও বঙ্গবন্ধু দক্ষ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভিজ্ঞ নাবিকের মতোই তখনকার রাজনীতি পরিচালিত করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোর প্রতি শাশ্বত জনগণের বুকনিঃসৃত সমর্থন তো ছিলই, আল্লাহর রহমত ছিল অবিরল ধারায়। ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানি স্বৈরাচারী চক্র তখনকার রাজনীতিতে একটার পর একটা ভুল করেই চলল। সে ভুলের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হলো ১ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, ইয়াহিয়া খান একতরফাভাবেই তা স্থগিত ঘোষণা করে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ হিরোশিমা ও নাগাসাকিকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল কিন্তু ইয়াহিয়া খানের পারমাণবিক বোমার শক্তির সমতুল্য ইএলএফও বাংলাকে বিধ্বস্ত করতে পারেনি। বরং তাদের স্বাধীনতালাভের দৃপ্ত আকাক্সক্ষা আরও প্রকট, তীক্ষè ও শানিত করেছিল- উদ্বেলিত, উজ্জীবিত ও উচ্ছ্বসিত করেছিল প্রতিটি বাঙালিকে। একটা অদ্ভুত অনন্যসাধারণ ও অকল্পনীয় ঐক্যে আবদ্ধ করেছিল প্রতিটি বাঙালির চিত্তকে। প্রতিটি মানুষই একেকটি বিস্ফোরিত আগ্নেয়াস্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। বাঙালির সেদিনের সেই ঐক্য, সেই চেতনা, সেই প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল কল্পনাতীত। শত বছরের ইতিহাসে এ ঐক্য কখনো দেখা যায়নি, শতাব্দীর ইতিহাসে আর হয়তো দেখাও যাবে না।
আমরা যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিলাম, সেই সম্পৃক্ততার আঙ্গিকে নিঃশঙ্ক চিত্তে বলতে পারি, বাঙালির সেই ঐক্য এতই প্রচ- ছিল যে, সশস্ত্র পাকিস্তানিদের নয় মাসের মাথায় আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল। প্রচ-ভাবে অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ যখন হিংস্র হায়েনার মতো বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তারা আমলেই নেয়নি এই নিরীহ নিরস্ত্র জাতি এমন করে লড়াই করতে পারে, বিজয়ী হতে পারে। সেদিনের অসম যুদ্ধে বাঙালির নিষ্কলুষ ঐক্য হিংস্র হায়েনার ক্ষুধার্ত আক্রমণকে কি ভীষণভাবেই না রুখে দিয়েছিল।
অগ্নিদগ্ধ সংগ্রামের সেই বিজয় ছিল অর্ধশতাব্দী আগের ঘটনা। বিগত দিনের প্রজ্বলিত ঐতিহাসিক সত্য, বাঙালির পথচলায় বাধা এসেছে বিস্তর কিন্তু গৌরবের বিষয় হলো- এই বাঙালি কোথাও কখনো থমকে যায়নি। পথের অগ্রযাত্রায় হোঁচট খেলেও তাদের অভিযাত্রা থামেনি। ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রদানের পর আমরা যে আন্দোলনের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম, তা এতটাই গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে আকাশের প্রদীপ্ত সূর্যের মতো উদ্ভাসিত আলোকিত স্বাধীনতা অর্জন করাকে সম্ভব করে তুলেছিল। এখানেও পুনরুল্লেখ করতে হয়, স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যয়দৃঢ় ঐক্য ও প্রতীতি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের শানিত অস্ত্র। বিশ্বাসের সূর্যস্নাত ঝলকানিতে এটি এতই তীব্র ছিল যে, তখনকার বাংলার জাগ্রত জনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। বাধা এসেছে আসুরিক শক্তিতে, আর বাঙালি তা মোকাবিলা করেছে ঐক্যবদ্ধ সত্তায় অমিতবিক্রমে। রাশিয়া চীনসহ যেখানেই সফল বিপ্লব ঘটেছে, সেই বিপ্লবের শক্তি ছিল শ্রেণিশাসিত একনায়ককেন্দ্রিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি। আর বাংলার স্বাধীনতা ছিল কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুকে বরণ করার দৃপ্ত মানসিকতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে কালজয়ী তেজস্বিতায় শত্রুদের মোকাবিলা করেছেন এটা যেমন সত্য, তেমনি গ্রামেগঞ্জে নগরে-বন্দরে অযুত-নিযুত সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি সৈন্যদের হিংস্রতা রুখে দিয়েছেন অমিতবিক্রমে। কেউ কখনো কোথাও নতি স্বীকার করেননি। নেতা অবরুদ্ধ হওয়ার পরও তাঁর উদ্বেলিত চিত্ত ছিল প্রচ-ভাবে শানিত। মৃত্যুর পাদপীঠে দাঁড়িয়েও স্বাধীনতার সুতীব্র আকাক্সক্ষা একটি মুহূর্তের জন্যও তার অকুতোভয় হৃদয় থেকে সরে যায়নি।
অন্যদিকে আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের চিত্ত স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় এতটাই উজ্জীবিত ও উচ্চকিত ছিল যে, আমাদের কাছে হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু- এর বাইরে কিছুই চিন্তার গহ্বরে পুঞ্জীভূত ছিল না। আমাদের আন্দোলনের মহানায়ক পাকিস্তানের কারাগারে অবরুদ্ধ। তবু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পথচলায় আমরা তাঁকে আমাদের হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে স্বাধীনতার পরিক্রমণ করেছিলাম। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মাঝে তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকলে কী হতো তা আমি আজও বলতে পারব না। কিন্তু তাঁর আকাশচুম্বী যে ভাবমূর্তি তাঁর অবর্তমানেও আমরা গড়ে তুলেছিলাম, তা ছিল সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কল্পিত মুজিবের আদর্শের অনুসরণ তাঁর সশরীরে উপস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও প্রেরণাদায়ক একটি উজ্জীবিত শক্তি ছিল, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরও মোস্তফা মহসীন, কাজী ফিরোজ রশীদ, মাসুদ খান, মহসিন, ঢাকা কলেজের নজরুল, মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত সমভিব্যহারে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে আমাদের সঙ্গে তাঁকে ৩২ নম্বর ত্যাগ করার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলাম। আমরা ইতোমধ্যেই কলাইতলী হয়ে ফরিদপুর এবং রাজবাড়ী হয়ে চুয়াডাঙ্গার গেদে বর্ডার দিয়ে একটা রুট নির্ধারণ করে রেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর থেকে বেরিয়ে আসতে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল, তাঁকে গ্রেফতার করতে না পারলে পাকিস্তানিদের আক্রোশ আরও বেড়ে যাবে। বিভীষিকাময় আক্রমণের প্রচ- ভয়াবহতার মূল্য জনগণকে পরিশোধ করতে হবে। তাঁকে অবরুদ্ধ করতে পারলে পাকিস্তানিদের ক্রোধ ও আক্রোশ অনেকটা কমে আসবে। এখানে আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে এলে এমনকি সীমান্ত অতিক্রম করলে তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা অনেকখানি খাটো হয়ে যেত। বঙ্গবন্ধুকে কল্পনার সিংহাসনে বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী উচ্ছ্বসিত ভারতবাসী যে প্রাণঢালা সমর্থন দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সশরীরে উপস্থিত থাকলে তাঁদের উচ্ছ্বাস অনেকটাই প্রশমিত হতো। তাই সেদিনের সমস্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ আল্লাহর রহমতপুষ্ট ছিল বলেই আমি বিশ্বাস করি। অবরুদ্ধ শেখ মুজিব আমাদের হৃদয়ের ধড়কানিতে এবং প্রত্যয়ের প্রতিধ্বনিতে রূপান্তরিত হন।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী আমরা পেরিয়ে এসেছি। এই ৫১ বছরে অগ্রগতি ও বিবর্তনের অনেক সিঁড়ি আমরা অতিক্রম করেছি। গোটা জাতিকে উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে আমরা প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছি এবং উন্নত জাতিতে পরিণত করার লালিত স্বপ্ন মননে ধারণ করছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমণে আমি একজন অভিযাত্রী ছিলাম। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে আমার একটি আকাক্সক্ষা থাকা স্বাভাবিক। আমি চাই- অর্জিত স্বাধীনতাকে শুধু সুসংহত করাই নয়, স্বাধীনতার চেতনাকে আরও শানিত করে কোটি কোটি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জাতিকে উন্নতির শিখরচূড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন সততা, জ্ঞান, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের উচ্চকিত হৃদয়। উন্নয়ন, নৈতিকতা এবং মননে রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শে সমুন্নত বিরোধী দলসহ গণতন্ত্রের সত্যিকারের প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা প্রাণভরে দেখে যাওয়ার বড়ই সাধ জাগে মনে। আমার জীবনাবস্থায় উন্নত বাংলাদেশকে দুই চোখ ভরে দেখে যেতে পারব- আল্লাহর কাছে এটিই আমার কামনা।
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন