শেখ হাসিনা ও একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : অনেক বছর আগে একজন যথার্থ বিনয়ী ভদ্রলোক রেজাউল হায়াত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসরে গিয়ে  নিয়মিত লিখতেন। ভদ্রলোক যে অত সুন্দর সাবলীল লিখতে পারেন তা জানা ছিল না। এক যুগ ধরে নিয়মিত লিখি। আমার লেখা মঙ্গলবার, রেজাউল হায়াতের লেখা ছাপা হতো বুধবার। তিনি একবার আমার কোনো এক লেখা থেকে শিরোনাম নিয়েছিলেন। তখনকার দিনে সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ব্যক্তিত্ব ছিল। ঠিক তেমনি আজকের লেখার ভিতরটা আমার, লেখার প্রতিটি শব্দ আমার, কিন্তু শিরোনাম অন্য কারও সদিচ্ছার প্রতিফলন। বেশ কয়েক বছর আগেই লিখতে পারতাম। কিন্তু সেদিন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে দু-তিন জনের পরে পুতুলকে দেখে লেখার ইচ্ছা আরও তীব্র হয়েছে। আমি জীবনে অমন ভুল আরও দু-চার বার করেছি। অনেক সময় তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়ায় পথে কাউকে গাড়িতে তোলার ইচ্ছা থাকলেও তুলতে পারি না। পরে মনে হয় লোকটাকে, বাচ্চাটাকে, ছেলেটাকে বা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিলে ভালো হতো। অনেক সময় অনেক পথ পিছিয়ে গিয়েও ভুল সংশোধন করি। আবার কোনো কোনো সময় পারি না। সেদিনও তেমনি হয়েছিল। কত হবে, পাঁচ -ছয় হাত দূরে বসেছিল। আমি মামা, আমারই তো যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন যেন বয়স হয়েছে বলে আলসি করেই কি না উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি, মা তুমি কেমন আছ? প্রায় আড়াই ঘণ্টা বসে ছিলাম। একবারও নাড়াচাড়া করিনি। কত মানুষ সামনে দিয়ে ওয়াশরুমে গেল-এলো, একবারও উঠিনি, উঠতে মনে হয়নি। তাই কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল এবার সময় হয়েছে, এবার লেখা দরকার। তাই লিখছি কবি নিয়ামত হোসেনের ভাষায়, ‘আমাকে কুচিকুচি করে কাটলেও/রক্ত মাংস সবটুকুই/বাঙালি/হৃদয়ের দুঃখ শোক প্রেম শাস্তি সবটুকুই/বাঙালি।’ সত্যিকারভাবে আমি মনে-প্রাণে, দায়দায়িত্ব পালনে, চিন্তা-চেতনায় একজন আপাদমস্তক বাঙালি। তাই আমার চিন্তা-চৈতন্যে আমার নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় জাগ্রত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমার বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও আমি তাঁকে মায়ের মতো, বড় বোন হিসেবে সম্মান করি। তাঁকে নিয়ে ভাবী। দেশের মানুষ নিয়েও ভাবী। সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন আমার চিন্তা- চেতনা-মননে সদাসর্বদা বিদ্যমান।

ইতিহাস বড় নির্মম, বড় অপ্রতিরোধ্য। ইতিহাস কখনো অস্বীকার করা যায় না। যারা অস্বীকার করে বা করতে চায় তারা নির্বোধ। ইতিহাস কখনো কারও মুখ চেয়ে বসে থাকে না। অনেক সময় ইতিহাসকে এদিক-ওদিক করার চেষ্টা হয়, শক্তিমানেরা তাদের দিকে টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ইতিহাস তার গতি হারায় না, কারও দিকে ঝোল টানে না। ইতিহাস-ইতিহাসের আপন মহিমায় গতিময় ছন্দময়। তার গতি তার ছন্দ তার লয়-তাল কেউ বাধাপ্রাপ্ত করতে পারে না। সেদিন পদ্মার পাড়ে যতটা সময় বসেছিলাম বারবার মনে হচ্ছিল বোন শেখ হাসিনা না থাকলে আজ এ পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন কি হতো? বারবার মনে হয়েছে, না, কখনো না। পদ্মা সেতু যদি আমাদের জন্য এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে তাহলে সেখানে বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব অস্বীকারের কোনো পথ নেই। তাই বলেছি, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন যাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে তারা অসম্ভব বলেছেন। এমন একটি মহাযজ্ঞ হতে পারে তারা বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন চোখের সামনে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। এখন তারা স্বচক্ষে দেখে স্বীকার করবেন। এর পরও অস্বীকার করলে তারা বোধশক্তিহীন, অচল। তাই তাদের বুঝতে না পারার জন্যে দোষারোপ করা যায় না। প্রিয় বোন অনেকটা তেমনই করেছেন। সেজন্য খুশিও হয়েছি। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে অনেকের একটা ঐকান্তিক কামনাই ছিল যাদের ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ এনে অহেতুক দোষারোপ করা হয়েছে তাদের জাতির সামনে দোষমুক্ত বা দায়মুক্ত করা। সেটা অনেকটাই হয়েছে। শুভ উদ্বোধনের সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ডান পাশে, আমাদের প্রিয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাঁ পাশে এবং অন্য নিগৃহীতদের সঙ্গে নিয়ে পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সেই নির্মম হত্যাকান্ড বা গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক পরিকল্পিত জঘন্য হত্যাকান্ডের ইতিহাস। সরকারবিরোধী আওয়ামী লীগের সভায় এ ধরনের একটি হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা হতে পারে সভ্যসমাজ কল্পনাও করতে পারেনি। রাজনৈতিক সমাবেশে আগে পরে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। এ উপমহাদেশে সভা-সমাবেশে গুলিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং অন্য নেতানেত্রীদের মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্য জনসভায় গুলিতে নিহত হয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিহত হয়েছেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বাড়িতে নিজস্ব দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছেন। তবু বলব, এভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বা সরকারি মদদে বিরোধী দল ধ্বংস করার বা বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে খুন করার সাজানো গোছানো সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা খুব একটা হয়নি। আওয়ামী লীগের ২১ আগস্টের সমাবেশে অগণিত লোকসমাগম হয়েছিল। সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষ করে ট্রাকের মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার মুহূর্তে ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কী চিৎকার করে ওঠেন, আপা আপা, আমি ভালো ছবি নিতে পারিনি। নেত্রী আবার ঘুরে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কেয়ামতের আলামত। একের পর এক ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। সভানেত্রী শেখ হাসিনা বসে পড়লে তাঁকে নেতা-কর্মীরা মানবঢাল সৃষ্টি করে ঢেকে ফেলেন। সেখানে সরাসরি ভোটে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বাহাউদ্দিন নাছিম, মুকিব ও অন্য নেতারা জানের পরোয়া না করে তাঁকে আড়াল করে রাখেন। অনেকের গায়ে আঘাত লেগে ছোটখাটো আহত হন। একসময় কোনোভাবে নেত্রীকে ট্রাকের মঞ্চ থেকে নামিয়ে তাঁর বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতেও গ্রেনেড পড়ে, অনেক বুলেট লাগে। কিন্তু তিনি অক্ষত বেঁচে যান। গাড়ির চালক কে ছিলেন বলতে পারব না। এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এসএসএফের লোকেরা তাঁর গাড়ি চালান। কিন্তু তখন গাড়ি চালাত জালাল, নূর হোসেনের ভাই আলী হোসেন। সেদিন পল্টন থেকে সুধা সদন পর্যন্ত মনে হয় জালালই নিয়ে গিয়েছিল। একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ির জন্য কত শত জীবন বেঁচে গেছে, একটা দল বেঁচে গেছে, একটা দলীয় রাজনীতি, একটা ইতিহাস বেঁচে গেছে। নেত্রী দেশে ফিরলে নেত্রীকে জার্মান আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি দেওয়ার আলোচনা উঠেছিল। অনিল দাশগুপ্ত তখন অনেক বড় নেতা। আমাকে পিতার মতো মান্য করত। ওরা কয়েকজন আমার সঙ্গে গাড়ির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করায় খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিছুদিন পর ওরা একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি পাঠায়। সে গাড়ি যে একটি জাতিকে বাঁচিয়ে দেবে, একটি দেশের ইতিহাস রক্ষা করবে তা কখনো ভাবিনি। জার্মানে লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ বুলেটপ্রুফ গাড়িটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতা থাকতে প্রায় সময়ই ব্যবহার করতেন। ২১ আগস্ট তিনি যদি গাড়িটি নিয়ে সভায় না যেতেন তাহলে কী হতো। তিনি কি আদৌ সুধা সদনে ফিরতে পারতেন? নরঘাতকদের গুলিতে গাড়িটির এক পাশের আগে-পিছে দুটি চাকারই বাতাস বেরিয়ে গিয়েছিল। তার পরও তাদের সুধা সদনে ফিরতে তেমন অসুবিধা হয়নি। আমার এ রকম একটি ঘটনা বারবার মনে পড়ে। এটা সেই ছোটকালের কথা। ১৯৫০-’৫৫ সালের দিকে হয়তো তার আগেও হতে পারে আমাদের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কায়সার চৌধুরীর দাদা আবদুল হামিদ চৌধুরী। তাঁর মধুপুরের কাছে আলোকদিয়ায় বিশাল খামারবাড়ি ছিল। হাজার-দুই হাজার বিঘার ওপর জমি বিরোধী পক্ষ বারবারই গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করেছে। হঠাৎ একবার কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে আবদুল হামিদ চৌধুরীকে আক্রমণ করে। একপর্যায়ে তিনি তাঁর প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে কালিহাতী বাড়ির দিকে ছোটেন। আলোকদিয়া থেকে কালিহাতী থানা প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার। রাস্তায় রাস্তায় লাঠিসোঁটা বল্লম নিয়ে পথ অবরোধের চেষ্টা হয়। একপর্যায়ে যুবক আবদুল হামিদ চৌধুরীর দিকে বল্লম ছুড়ে মারা হয়। একটি বল্লম ঘোড়ার পেটে এফোঁড়-এফোঁড় হয়ে যায়। কিন্তু ওইভাবেই ঘোড়াটি প্রায় ১৬-১৭ কিলোমিটার ছুটে কালিহাতী পর্যন্ত এসেছিল। যে কারণে আবদুল হামিদ চৌধুরী সেবার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেখিনি, কিন্তু শুনেছি। কালিহাতী থানায় এসে পড়ে গিয়ে ঘোড়াটি যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে তখন আবদুল হামিদ চৌধুরী বাপ-মা হারানোর মতো আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন। তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে ঘোড়াটি দাফন করেছিলেন। কেন যেন সেই কবে কোন কালে আমাদের এলাকার শ্রেষ্ঠ ধনী, বিদ্বান, সামর্থ্যবান আবদুল হামিদ চৌধুরীর প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল একটি ঘোড়া। ঠিক তেমনি ২০০৪ সালে একটি বুলেটপ্রুফ মার্সিডিস আওয়ামী লীগ নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার বোন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেদিনের সেই দুর্বিষহ সময়ের কথা ইদানীং হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। ভাবার সুযোগও তেমন একটা পান না। সরকারিভাবে পৃথিবীর আর কোথাও এমন জঘন্য হত্যার পরিকল্পনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে।

 

আমি ১৯ আগস্ট ২০০৪ সালে দিল্লিতে গিয়েছিলাম। বিকালেই প্রণবদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ইলিশ মাছ, টাঙ্গাইলের চমচম আর তাঁতের শাড়ি এটা ছিল দিল্লির জন্য আমার সব সময়ের উপহার। কত মানুষ পদ্মার ইলিশ খেয়েছে, খেয়েছে টাঙ্গাইলের চমচম। হঠাৎ হঠাৎ সেসব শুনে দারুণ পুলকিত হতাম। সেদিন হঠাৎই চিলমারীর শওকত আলী সরকার বীরবিক্রমের মেয়ে সাঈদা শওকত জেনী বলছিল, আমি আপনার টাঙ্গাইলের চমচম খেয়েছি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর বাড়িতে। সে সত্যি বলেছে। আমি মাঝেমধ্যে ও-বাড়িতে চমচম পাঠাই। কারণ মাননীয় মন্ত্রীর স্ত্রী আমার ছোট বোন। ঠিক তেমনি দিল্লিতেও হঠাৎই যখন কেউ কেউ বলতেন, আমি আপনার আনা পদ্মার ইলিশ খেয়েছি, চমচম খেয়েছি। খুব ভালো লাগত। প্রণবদার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি একজন মায়ের মতো অসাধারণ মহিলা। টাঙ্গাইলের চমচম পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অনেকটুকু খেয়ে ফেলেছিলেন। এমনিই ডায়াবেটিসের রোগী। আর যায় কোথায়? সুগার লেভেল যা ছিল তার তিন গুণ বেড়ে গিয়েছিল। সরাসরি ধলাকুয়া আর আর পার্ক মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি। কারণ প্রণবদা তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

 

২১ আগস্ট বিকালে তালকাটরা রোডে গিয়েছিলাম। ৬টা-সাড়ে ৬টা হবে। কথাবার্তা বলে বেরিয়ে এসেছিলাম। গাড়িতে উঠতে যাব তখন লোকজন দৌড়ে এসে ডেকে নেয়। প্রণবদার ঘরে গেলে উ™£ান্তের মতো বলেন, ‘বাঘা, ঢাকায় হাসিনার মিটিংয়ে বোমা পড়েছে। তুমি এখনই খবর নেও।’ প্রণব মুখার্জির ১৩ নম্বর তালকাটরার বাড়ি থেকে না হলেও ৫০ জনকে ফোন করেছিলাম। কাউকে পেয়েছি, কাউকে পাইনি। সঠিক খবর কেউ দিতে পারেনি। তবে নেত্রী ভালো আছেন, অক্ষত আছেন এটুকু মোটামুটি জানতে পেরেছি। সুধা সদনেও অনেকবার ফোন করে ধরতে পারিনি।

 

দেশের সুস্থ রাজনীতির জন্য সব সময় সবার সম্মান রক্ষা করে চলার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝি, বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন জিয়াউর রহমান সঠিক দায়িত্ব পালন করলে কোনোমতেই বঙ্গবন্ধু নিহত হতেন না। আমি আগাগোড়াই জানি, জেনারেল শফিউল্লাহ সব সময়ই ছিলেন মেরুদন্ডহীন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান তেমন ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কি ছিলেন না এখনো তার বিচার হয়নি। কিন্তু খুনিরা তার কাছে যখন গিয়েছিল তখন তাদের যদি তিনি ধমক দিতেন আমার মনে হয় না কর্নেল ফারুক, রশীদ, ডালিমদের প্রস্রাব করে কাপড় নষ্ট করা ছাড়া অন্য উপায় থাকত। আর সত্যি বলতে কি, তিনি যখন শুনেছিলেন কয়েকজন দুষ্ট আর্মি অফিসারের মাথায় অমন ভূত ঘুরছে তখন তিনি নিজেই তাদের গ্রেফতার করতে পারতেন অথবা সরকারকে বলে দিতে পারতেন। সে কাজটি করলে হয়তো জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হতো না। হ্যাঁ, জিয়া পরিবারের এখনকার এ শান-শওকত, জৌলুশ হয়তো থাকত না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, দেশবাসীর কাছে জিয়া পরিবারের এখনকার চাইতে অনেক বেশি সম্মান থাকত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার আমরা কে কী ব্যাখ্যা করব। এমন একটি সুপরিকল্পিত জঘন্য হত্যার নকশা যারা আঁকে তাদের কি কোনোভাবে বন্ধু ভাবা যায়? এমন গর্হিত কাজ করার কোনো মানে হয়? সরাসরি হত্যার নীলনকশা যারা আঁটে তাদের কেউ ক্ষমা করতে পারে? পারে না। রাজনীতিতে এসব করা খুবই অন্যায়। রাজনীতিতে মানুষকে ভরসা করা, সাধরণ মানুষের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা শিখতে হয়, সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দিতে হয়। সাধারণ মানুষের ওপর সীমার বাইরে খবরদারি করতে হয় না, মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি তো একেবারেই নয়।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com    সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডিবির মশিউর সাময়িক বরখাস্ত

» মোটরসাইকেলে চালকসহ দুইজনের বেশি বহন না করার নির্দেশ

» ইসলামী শাসনব্যবস্থা ছাড়া বৈষম্য দূর হবে না : মামুনুল হক

» নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে বিদেশি অংশীজনরা অপেক্ষা করছে : খসরু

» বিস্ফোরক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান

» তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

» রাশিয়ার নতুন ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চলবে: পুতিন

» গুজব প্রতিরোধে সহায়তা চায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

» পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত

» এআই নিয়ে কাজ করবে গ্রামীণফোন ও এরিকসন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

শেখ হাসিনা ও একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : অনেক বছর আগে একজন যথার্থ বিনয়ী ভদ্রলোক রেজাউল হায়াত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসরে গিয়ে  নিয়মিত লিখতেন। ভদ্রলোক যে অত সুন্দর সাবলীল লিখতে পারেন তা জানা ছিল না। এক যুগ ধরে নিয়মিত লিখি। আমার লেখা মঙ্গলবার, রেজাউল হায়াতের লেখা ছাপা হতো বুধবার। তিনি একবার আমার কোনো এক লেখা থেকে শিরোনাম নিয়েছিলেন। তখনকার দিনে সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ব্যক্তিত্ব ছিল। ঠিক তেমনি আজকের লেখার ভিতরটা আমার, লেখার প্রতিটি শব্দ আমার, কিন্তু শিরোনাম অন্য কারও সদিচ্ছার প্রতিফলন। বেশ কয়েক বছর আগেই লিখতে পারতাম। কিন্তু সেদিন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে দু-তিন জনের পরে পুতুলকে দেখে লেখার ইচ্ছা আরও তীব্র হয়েছে। আমি জীবনে অমন ভুল আরও দু-চার বার করেছি। অনেক সময় তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়ায় পথে কাউকে গাড়িতে তোলার ইচ্ছা থাকলেও তুলতে পারি না। পরে মনে হয় লোকটাকে, বাচ্চাটাকে, ছেলেটাকে বা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিলে ভালো হতো। অনেক সময় অনেক পথ পিছিয়ে গিয়েও ভুল সংশোধন করি। আবার কোনো কোনো সময় পারি না। সেদিনও তেমনি হয়েছিল। কত হবে, পাঁচ -ছয় হাত দূরে বসেছিল। আমি মামা, আমারই তো যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন যেন বয়স হয়েছে বলে আলসি করেই কি না উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি, মা তুমি কেমন আছ? প্রায় আড়াই ঘণ্টা বসে ছিলাম। একবারও নাড়াচাড়া করিনি। কত মানুষ সামনে দিয়ে ওয়াশরুমে গেল-এলো, একবারও উঠিনি, উঠতে মনে হয়নি। তাই কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল এবার সময় হয়েছে, এবার লেখা দরকার। তাই লিখছি কবি নিয়ামত হোসেনের ভাষায়, ‘আমাকে কুচিকুচি করে কাটলেও/রক্ত মাংস সবটুকুই/বাঙালি/হৃদয়ের দুঃখ শোক প্রেম শাস্তি সবটুকুই/বাঙালি।’ সত্যিকারভাবে আমি মনে-প্রাণে, দায়দায়িত্ব পালনে, চিন্তা-চেতনায় একজন আপাদমস্তক বাঙালি। তাই আমার চিন্তা-চৈতন্যে আমার নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় জাগ্রত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমার বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও আমি তাঁকে মায়ের মতো, বড় বোন হিসেবে সম্মান করি। তাঁকে নিয়ে ভাবী। দেশের মানুষ নিয়েও ভাবী। সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন আমার চিন্তা- চেতনা-মননে সদাসর্বদা বিদ্যমান।

ইতিহাস বড় নির্মম, বড় অপ্রতিরোধ্য। ইতিহাস কখনো অস্বীকার করা যায় না। যারা অস্বীকার করে বা করতে চায় তারা নির্বোধ। ইতিহাস কখনো কারও মুখ চেয়ে বসে থাকে না। অনেক সময় ইতিহাসকে এদিক-ওদিক করার চেষ্টা হয়, শক্তিমানেরা তাদের দিকে টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ইতিহাস তার গতি হারায় না, কারও দিকে ঝোল টানে না। ইতিহাস-ইতিহাসের আপন মহিমায় গতিময় ছন্দময়। তার গতি তার ছন্দ তার লয়-তাল কেউ বাধাপ্রাপ্ত করতে পারে না। সেদিন পদ্মার পাড়ে যতটা সময় বসেছিলাম বারবার মনে হচ্ছিল বোন শেখ হাসিনা না থাকলে আজ এ পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন কি হতো? বারবার মনে হয়েছে, না, কখনো না। পদ্মা সেতু যদি আমাদের জন্য এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে তাহলে সেখানে বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব অস্বীকারের কোনো পথ নেই। তাই বলেছি, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন যাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে তারা অসম্ভব বলেছেন। এমন একটি মহাযজ্ঞ হতে পারে তারা বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন চোখের সামনে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। এখন তারা স্বচক্ষে দেখে স্বীকার করবেন। এর পরও অস্বীকার করলে তারা বোধশক্তিহীন, অচল। তাই তাদের বুঝতে না পারার জন্যে দোষারোপ করা যায় না। প্রিয় বোন অনেকটা তেমনই করেছেন। সেজন্য খুশিও হয়েছি। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনে অনেকের একটা ঐকান্তিক কামনাই ছিল যাদের ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ এনে অহেতুক দোষারোপ করা হয়েছে তাদের জাতির সামনে দোষমুক্ত বা দায়মুক্ত করা। সেটা অনেকটাই হয়েছে। শুভ উদ্বোধনের সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ডান পাশে, আমাদের প্রিয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাঁ পাশে এবং অন্য নিগৃহীতদের সঙ্গে নিয়ে পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সেই নির্মম হত্যাকান্ড বা গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক পরিকল্পিত জঘন্য হত্যাকান্ডের ইতিহাস। সরকারবিরোধী আওয়ামী লীগের সভায় এ ধরনের একটি হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা হতে পারে সভ্যসমাজ কল্পনাও করতে পারেনি। রাজনৈতিক সমাবেশে আগে পরে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। এ উপমহাদেশে সভা-সমাবেশে গুলিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং অন্য নেতানেত্রীদের মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্য জনসভায় গুলিতে নিহত হয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিহত হয়েছেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বাড়িতে নিজস্ব দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছেন। তবু বলব, এভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বা সরকারি মদদে বিরোধী দল ধ্বংস করার বা বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে খুন করার সাজানো গোছানো সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা খুব একটা হয়নি। আওয়ামী লীগের ২১ আগস্টের সমাবেশে অগণিত লোকসমাগম হয়েছিল। সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষ করে ট্রাকের মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার মুহূর্তে ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কী চিৎকার করে ওঠেন, আপা আপা, আমি ভালো ছবি নিতে পারিনি। নেত্রী আবার ঘুরে দাঁড়ান। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কেয়ামতের আলামত। একের পর এক ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। সভানেত্রী শেখ হাসিনা বসে পড়লে তাঁকে নেতা-কর্মীরা মানবঢাল সৃষ্টি করে ঢেকে ফেলেন। সেখানে সরাসরি ভোটে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বাহাউদ্দিন নাছিম, মুকিব ও অন্য নেতারা জানের পরোয়া না করে তাঁকে আড়াল করে রাখেন। অনেকের গায়ে আঘাত লেগে ছোটখাটো আহত হন। একসময় কোনোভাবে নেত্রীকে ট্রাকের মঞ্চ থেকে নামিয়ে তাঁর বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতেও গ্রেনেড পড়ে, অনেক বুলেট লাগে। কিন্তু তিনি অক্ষত বেঁচে যান। গাড়ির চালক কে ছিলেন বলতে পারব না। এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এসএসএফের লোকেরা তাঁর গাড়ি চালান। কিন্তু তখন গাড়ি চালাত জালাল, নূর হোসেনের ভাই আলী হোসেন। সেদিন পল্টন থেকে সুধা সদন পর্যন্ত মনে হয় জালালই নিয়ে গিয়েছিল। একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ির জন্য কত শত জীবন বেঁচে গেছে, একটা দল বেঁচে গেছে, একটা দলীয় রাজনীতি, একটা ইতিহাস বেঁচে গেছে। নেত্রী দেশে ফিরলে নেত্রীকে জার্মান আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি দেওয়ার আলোচনা উঠেছিল। অনিল দাশগুপ্ত তখন অনেক বড় নেতা। আমাকে পিতার মতো মান্য করত। ওরা কয়েকজন আমার সঙ্গে গাড়ির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করায় খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিছুদিন পর ওরা একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি পাঠায়। সে গাড়ি যে একটি জাতিকে বাঁচিয়ে দেবে, একটি দেশের ইতিহাস রক্ষা করবে তা কখনো ভাবিনি। জার্মানে লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ বুলেটপ্রুফ গাড়িটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতা থাকতে প্রায় সময়ই ব্যবহার করতেন। ২১ আগস্ট তিনি যদি গাড়িটি নিয়ে সভায় না যেতেন তাহলে কী হতো। তিনি কি আদৌ সুধা সদনে ফিরতে পারতেন? নরঘাতকদের গুলিতে গাড়িটির এক পাশের আগে-পিছে দুটি চাকারই বাতাস বেরিয়ে গিয়েছিল। তার পরও তাদের সুধা সদনে ফিরতে তেমন অসুবিধা হয়নি। আমার এ রকম একটি ঘটনা বারবার মনে পড়ে। এটা সেই ছোটকালের কথা। ১৯৫০-’৫৫ সালের দিকে হয়তো তার আগেও হতে পারে আমাদের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কায়সার চৌধুরীর দাদা আবদুল হামিদ চৌধুরী। তাঁর মধুপুরের কাছে আলোকদিয়ায় বিশাল খামারবাড়ি ছিল। হাজার-দুই হাজার বিঘার ওপর জমি বিরোধী পক্ষ বারবারই গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করেছে। হঠাৎ একবার কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে আবদুল হামিদ চৌধুরীকে আক্রমণ করে। একপর্যায়ে তিনি তাঁর প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে কালিহাতী বাড়ির দিকে ছোটেন। আলোকদিয়া থেকে কালিহাতী থানা প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার। রাস্তায় রাস্তায় লাঠিসোঁটা বল্লম নিয়ে পথ অবরোধের চেষ্টা হয়। একপর্যায়ে যুবক আবদুল হামিদ চৌধুরীর দিকে বল্লম ছুড়ে মারা হয়। একটি বল্লম ঘোড়ার পেটে এফোঁড়-এফোঁড় হয়ে যায়। কিন্তু ওইভাবেই ঘোড়াটি প্রায় ১৬-১৭ কিলোমিটার ছুটে কালিহাতী পর্যন্ত এসেছিল। যে কারণে আবদুল হামিদ চৌধুরী সেবার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেখিনি, কিন্তু শুনেছি। কালিহাতী থানায় এসে পড়ে গিয়ে ঘোড়াটি যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে তখন আবদুল হামিদ চৌধুরী বাপ-মা হারানোর মতো আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন। তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে ঘোড়াটি দাফন করেছিলেন। কেন যেন সেই কবে কোন কালে আমাদের এলাকার শ্রেষ্ঠ ধনী, বিদ্বান, সামর্থ্যবান আবদুল হামিদ চৌধুরীর প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল একটি ঘোড়া। ঠিক তেমনি ২০০৪ সালে একটি বুলেটপ্রুফ মার্সিডিস আওয়ামী লীগ নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার বোন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেদিনের সেই দুর্বিষহ সময়ের কথা ইদানীং হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। ভাবার সুযোগও তেমন একটা পান না। সরকারিভাবে পৃথিবীর আর কোথাও এমন জঘন্য হত্যার পরিকল্পনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে।

 

আমি ১৯ আগস্ট ২০০৪ সালে দিল্লিতে গিয়েছিলাম। বিকালেই প্রণবদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ইলিশ মাছ, টাঙ্গাইলের চমচম আর তাঁতের শাড়ি এটা ছিল দিল্লির জন্য আমার সব সময়ের উপহার। কত মানুষ পদ্মার ইলিশ খেয়েছে, খেয়েছে টাঙ্গাইলের চমচম। হঠাৎ হঠাৎ সেসব শুনে দারুণ পুলকিত হতাম। সেদিন হঠাৎই চিলমারীর শওকত আলী সরকার বীরবিক্রমের মেয়ে সাঈদা শওকত জেনী বলছিল, আমি আপনার টাঙ্গাইলের চমচম খেয়েছি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর বাড়িতে। সে সত্যি বলেছে। আমি মাঝেমধ্যে ও-বাড়িতে চমচম পাঠাই। কারণ মাননীয় মন্ত্রীর স্ত্রী আমার ছোট বোন। ঠিক তেমনি দিল্লিতেও হঠাৎই যখন কেউ কেউ বলতেন, আমি আপনার আনা পদ্মার ইলিশ খেয়েছি, চমচম খেয়েছি। খুব ভালো লাগত। প্রণবদার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি একজন মায়ের মতো অসাধারণ মহিলা। টাঙ্গাইলের চমচম পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অনেকটুকু খেয়ে ফেলেছিলেন। এমনিই ডায়াবেটিসের রোগী। আর যায় কোথায়? সুগার লেভেল যা ছিল তার তিন গুণ বেড়ে গিয়েছিল। সরাসরি ধলাকুয়া আর আর পার্ক মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি। কারণ প্রণবদা তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

 

২১ আগস্ট বিকালে তালকাটরা রোডে গিয়েছিলাম। ৬টা-সাড়ে ৬টা হবে। কথাবার্তা বলে বেরিয়ে এসেছিলাম। গাড়িতে উঠতে যাব তখন লোকজন দৌড়ে এসে ডেকে নেয়। প্রণবদার ঘরে গেলে উ™£ান্তের মতো বলেন, ‘বাঘা, ঢাকায় হাসিনার মিটিংয়ে বোমা পড়েছে। তুমি এখনই খবর নেও।’ প্রণব মুখার্জির ১৩ নম্বর তালকাটরার বাড়ি থেকে না হলেও ৫০ জনকে ফোন করেছিলাম। কাউকে পেয়েছি, কাউকে পাইনি। সঠিক খবর কেউ দিতে পারেনি। তবে নেত্রী ভালো আছেন, অক্ষত আছেন এটুকু মোটামুটি জানতে পেরেছি। সুধা সদনেও অনেকবার ফোন করে ধরতে পারিনি।

 

দেশের সুস্থ রাজনীতির জন্য সব সময় সবার সম্মান রক্ষা করে চলার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝি, বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন জিয়াউর রহমান সঠিক দায়িত্ব পালন করলে কোনোমতেই বঙ্গবন্ধু নিহত হতেন না। আমি আগাগোড়াই জানি, জেনারেল শফিউল্লাহ সব সময়ই ছিলেন মেরুদন্ডহীন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান তেমন ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কি ছিলেন না এখনো তার বিচার হয়নি। কিন্তু খুনিরা তার কাছে যখন গিয়েছিল তখন তাদের যদি তিনি ধমক দিতেন আমার মনে হয় না কর্নেল ফারুক, রশীদ, ডালিমদের প্রস্রাব করে কাপড় নষ্ট করা ছাড়া অন্য উপায় থাকত। আর সত্যি বলতে কি, তিনি যখন শুনেছিলেন কয়েকজন দুষ্ট আর্মি অফিসারের মাথায় অমন ভূত ঘুরছে তখন তিনি নিজেই তাদের গ্রেফতার করতে পারতেন অথবা সরকারকে বলে দিতে পারতেন। সে কাজটি করলে হয়তো জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হতো না। হ্যাঁ, জিয়া পরিবারের এখনকার এ শান-শওকত, জৌলুশ হয়তো থাকত না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, দেশবাসীর কাছে জিয়া পরিবারের এখনকার চাইতে অনেক বেশি সম্মান থাকত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার আমরা কে কী ব্যাখ্যা করব। এমন একটি সুপরিকল্পিত জঘন্য হত্যার নকশা যারা আঁকে তাদের কি কোনোভাবে বন্ধু ভাবা যায়? এমন গর্হিত কাজ করার কোনো মানে হয়? সরাসরি হত্যার নীলনকশা যারা আঁটে তাদের কেউ ক্ষমা করতে পারে? পারে না। রাজনীতিতে এসব করা খুবই অন্যায়। রাজনীতিতে মানুষকে ভরসা করা, সাধরণ মানুষের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা শিখতে হয়, সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দিতে হয়। সাধারণ মানুষের ওপর সীমার বাইরে খবরদারি করতে হয় না, মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি তো একেবারেই নয়।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com    সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com