খোদ রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা দূরে থাক, লেনিনের মতো জেলেনস্কির গণসমর্থনের শিকড় ইউক্রেনের মাটির অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত, এটি পুতিন অনুধাবন করেননি। তাঁর ধারণা ছিল জেলেনস্কি কোনোরকমের ঘাড় ত্যাড়ামি করলে তাঁকে শায়েস্তা করতে পুতিনের বেগ পেতে হবে না। কিন্তু বিধিবাম! জেলেনস্কি বা ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করল। ন্যাটোর দেশগুলোর সঙ্গে জেলেনস্কির ইউক্রেনের যোগাযোগ ও সংযুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় ক্রমেই দৃশ্যমান হতে লাগল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, পুতিনের মতো বিশ্বস্বীকৃত কূটনীতিক এবং অত্যন্ত দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের এ প্রত্যয়দৃঢ় দৃপ্ত ও উদ্গত মানসিকতা অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে পারলেন না। পুতিন ভাবতেই চাইলেন না, আকাশে উড়ন্ত পাখিকে খাঁচায় পোরা কেবল দুরূহই নয়, দুঃসাধ্যও বটে। পুতিন ভেবেছিলেন কথায় কাজ না হলে চাবুক মেরে জেলেনস্কিকে ঠান্ডা করে দেবেন। বাস্তবে যখন জেলেনস্কির আনুগত্য তিনি পেলেনই না, তাঁকে কোনোভাবেই যখন তিনি বাগে আনতে পারলেন না, তখন পুতিন ভাবলেন ডান্ডা মেরে জেলেনস্কিকে তিনি ঠান্ডা করে দেবেন। রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে জেলেনস্কির ইউক্রেন খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করলে সাত দিনের মাথায় জেলেনস্কি অবনত মস্তকে পুতিনের বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু পুতিনের সেই স্বপ্নভঙ্গ আজ হয়েছে। সাত দিন কেন, সাত বছরেও পুতিন জেলেনস্কিকে পরাস্ত ও ইউক্রেনকে পদানত করতে পারবেন না। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সামরিক সহযোগিতা এবং প্রবল শক্তিধর আমেরিকার প্রণোদনা তো বটেই, ইউক্রেনের জনগণের হৃদয়মথিত সমর্থনে জেলেনস্কি অমিত শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। জেলেনস্কির অমোঘ নেতৃত্ব ইউক্রেনের যে জাতীয় সত্তার জন্ম দিয়েছে তা অভাবনীয়। জাতিসত্তায় উজ্জীবিত কোনো রাষ্ট্রকেই কেউ কখনো সমরাস্ত্র বা সামরিক শক্তিতে পরাভূত করতে পারে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, তদানীন্তন পাকিস্তানে সত্তরের নির্বাচনে শতকরা ৯৮ ভাগ জনসমর্থনে আপ্লুত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তির দাম্ভিকতায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী প্ররোচনায় ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশনটি যখন একতরফাভাবে সামরিক শক্তির দাম্ভিকতায় উন্মত্ত হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন, তখন ইয়াহিয়া খানের অন্তরে ছিল যে, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শুধু প্রতিবাদ করবে কিন্তু সামরিক শক্তি একটু প্রয়োগ করলেই জনতার রোষ অবদমিত করা সম্ভব হবে। ইয়াহিয়া খানের এ দুঃস্বপ্ন, দুঃসাহস ও কল্পিত নীলনকশা বুমেরাং হয়েছে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জাগ্রত জনতা উদ্বেলিত সত্তায় বাঙালি জাতীয় চেতনায় প্রত্যয়দৃঢ় শপথে উজ্জীবিত হয়েছিল। বাঙালি জাতীয় চেতনায় শানিত মননে তারা সেদিন শুধু প্রতিবাদ করেনি, শুধু প্রতিরোধ করেনি, পৃথিবীর অন্যতম সশস্ত্র ও হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সম্মুখযুদ্ধে মোকাবিলা করে কেবল স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার নয়, পরাধীনতার পক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাংলার উদ্গত উদ্যত উদ্ধত কালজয়ী জাগ্রত জনতার কাছে পরাভূত হয়েছিল, আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। পরাক্রমশালী পাকিস্তানের হিংস্র সশস্ত্র বাহিনী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল, যত ক্ষুরধার অস্ত্রই হোক না কেন, উদ্বেলিত জনতার শানিত চেতনার কাছে তা পরাভূত হতে বাধ্য। এ সত্যটি কালে কালে যুগে যুগে একইভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিফলিত হলেও স্বৈরাচারী শাসনকর্তারা এটা আমলে নেন না, উপলব্ধিও করেন না।
ইয়াহিয়া খানের মতো প্রচ- শক্তিধর সামরিক ব্যক্তিত্ব গণরায়ে অভিষিক্ত তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে নয় মাসের অসম যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের বিদগ্ধ চিত্তের আপ্লুত সমর্থন যে-কোনো তীক্ষ অস্ত্রের চেয়ে শানিত এবং জনতার অভিব্যক্তির শানিত অস্ত্রই বিজয়ের একমাত্র হাতিয়ার।
আবার যদি ইউক্রেনের দিকে ফিরে তাকাই, তবে এ শাশ্বত সত্যের অভিব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হবে। দাম্ভিকতার অন্ধ প্রকোপে ইয়াহিয়া খান সেদিন বাঙালির অমিত শক্তি উপলব্ধি করতে পারেননি। আর তাই অবধারিত পরাজয় ও আত্মসমর্পণের গ্লানি ইয়াহিয়া খানকে মেনে নিতে হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত ক্ষমতাধর পুতিন পারমাণবিক শক্তির অন্ধ উন্মাদনায় আজ বুঁদ হয়ে আছেন। জনতার সমর্থন-আপ্লুত একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তার শক্তি কতটা প্রবল ও প্রখর হতে পারে হয়তো পুতিন আজকে তা পরোয়াই করেন না। কিন্তু কৌতুকাভিনেতা জেলেনস্কি ইউক্রেনের উদ্ভাবিত নতুন জাতীয় সত্তার উদ্ভাবনী শক্তিতে কতখানি শক্তিধর, কতখানি অমিতবিক্রম- তা যদি পুতিন আজও আমলে না আনেন, তবে তাঁকে মোটা দাগে খেসারত দিতে হবে। এটা অনেকটাই নিশ্চিত।
ইতোমধ্যে যুদ্ধের বিষবাষ্পে পৃথিবী জর্জরিত। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেই অর্থনীতির ভিত থরথর করে কেঁপে ওঠে। সেই ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে আর তার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদেরও। বাংলাদেশ এ যুদ্ধে কোনো পক্ষই অবলম্বন করেনি। তবু যুদ্ধের যে একটি মারাত্মক কুফল রয়েছে, তার রুদ্ররোষ থেকে বাংলাদেশও রক্ষা পায়নি। যুদ্ধ বাধল ইউক্রেনে আর সমস্যাসংকুল হলো সমগ্র ইউরোপ এবং তার প্রচ- উত্তাল তরঙ্গ এসে আঘাত হানল বাংলাদেশে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস থেকে শুরু করে ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামহীন ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস, নির্ধারিত আয়ের মানুষগুলো জীবনের চাকা ঘোরাতে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা জীবন বিপর্যস্ত করলেও মানুষ তা কালক্রমে সামলে নিতে পারে। কিন্তু আজকের এই যে অসহনীয় অর্থনৈতিক অস্থিরতা, এটা ভূমিকম্প, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে ভয়ংকর।
বাকচতুরতা, দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে এ মুহূর্তে সরকারকে একটি উদার ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চাটুকার মোসাহেবদের বাক্যবৃষ্টিতে সিক্ত হওয়া নয়, অভিজ্ঞতার সূর্যালোকে সরকারকে সর্বজনীন দুর্যোগ মোকাবিলার একটা পথ খুঁজতে হবে। জাতীয় ঐক্য তৈরি করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ আজকে জাতীয় আকাক্সক্ষা। এ আকাক্সক্ষা পূরণে সবার, বিশেষ করে যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের নিষ্কলুষ চিত্তে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রেট ব্রিটেনবাসী এবং এটলির লেবার পার্টি যে ঐক্য ও ঔদার্যের দৃষ্টান্ত রেখেছে, তা রাজনৈতিকভাবে সমস্যাসংকুল যে-কোনো দেশের জন্য অনুকরণীয়। উইনস্টন চার্চিল কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনে অবসরে চলে গিয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ লেবার পার্টি তাঁকে অনুরোধ করে জরুরি অবস্থাকালীন গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মোকাবিলায় কর্ণধার হিসেবে নিয়োজিত করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অতখানি ভয়াবহ নয়। সর্বদলীয় সরকার গঠনের রাজনৈতিক সুপারিশও আমি করছি না। তবে এ মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রয়োজন অত্যধিক। এ দেশে একদল বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা বুদ্ধির বেসাতি করেন। বঙ্গবন্ধু এঁদের ‘বুদ্ধিবৃত্তির সওদাগর’ বলতেন। মানিক ভাই এঁদের ‘অঘটন ঘটনের কারিগর’ বলতেন। আমি এঁদের জ্ঞানপাপী হিসেবে জানি। তবু দেশে নিষ্কলুষ জ্ঞানপ্রদীপ্ত মানুষের অভাব নেই। তাঁদের কাছ থেকেই সুচারু পরামর্শ গ্রহণ করে সরকারকে সংকট মোকাবিলার ব্যাপারে দৃপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আরেকটি কথা, আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে আমাদের সরকার হয়তো জেলেনস্কিকে সরাসরি সমর্থন প্রদান করতে পারবে না। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যতিক্রম হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে কূটনৈতিক বন্ধন, নানাবিধ শিল্প ও বৈদ্যুতিক পরিকল্পনায় রাশিয়ার যে অংশীদারি তা উড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা অবাস্তব। সরকারকে এ ক্ষেত্রে যে সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা সরকার সার্থকভাবেই করতে পেরেছে। কিন্তু ইউক্রেনের জনগণ এবং জেলেনস্কির জাতীয়তাবাদী চেতনার যে শাশ্বত বহিঃপ্রকাশ, তা বাংলার জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে এবং পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করা জাতি হিসেবে ইউক্রেনের মুক্তিপাগল স্বাধীনতাপ্রিয় উদ্গত উদ্ধত উদ্বেলিত জনতার প্রতি আমাদের উদ্বেলিত চিত্তের সমর্থন একান্তই শাশ্বত। আমরা জেলেনস্কিকে আর কৌতুকাভিনেতা হিসেবে দেখি না, বরং একটি জাতীয় চেতনার উদ্ভাবক হিসেবে এবং একটি জাতীয় চেতনাকে প্রতিস্থাপিত করে তার লড়াকু সেনাধ্যক্ষের মতোই দেখি। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের সরকার নিশ্চুপ নিঃশব্দ থাকলেও বাংলার শাশ্বত জনগণের হৃদয়মথিত আশীর্বাদ জেলেনস্কি ও ইউক্রেনের জাগ্রত জনতার প্রতি থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস এমনকি আফগানিস্তানে আমেরিকার যে পরিণতি ও বিপর্যয় হয়েছিল ইউক্রেন থেকে সরে না এলে পুতিনের ভাগ্যললাটেও সেই কালিমা লাগতে পারে। এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। অস্ত্রের চেয়ে জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি অনেক শক্তিশালী ও তীক্ষ। আপাতদৃষ্টিতে পুতিন এখন যে খন্ড খন্ড বিজয় অর্জন করছেন সেটা নিতান্তই সাময়িক। কালে কালে পরাজয় তো বটেই ইতিহাসেও তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে।
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন