ছোটবেলায় পাটখড়ির আগায় বাঁশের কাঠিতে মাকড়সার জাল দিয়ে ফাঁদ বানাতাম। সেই ফাঁদে ফড়িং ধরতাম। তবে এই জাল কেন এত শক্ত কখনো চিন্তা করিনি। অবাক করা বিষয় হলো, আট পা ওয়ালা অমেরুদন্ডী শিকারী এই কীটের তৈরি জাল ইস্পাতের তারের চেয়েও বেশি শক্ত। আর এই জাল মূলত তারা শিকারের জন্যই তৈরি করে।
জালকে ঘিরেই যেন তাদের সব। জালে টোকা দেওয়ার মাধ্যমেই তারা মন দেওয়া-নেওয়া করে। কোনো পুরুষ মাকড়সা স্ত্রী মাকড়সার সঙ্গে ভাব করতে চাইলে মিহি টোকা দেয় জালে। তখন জালে সুতার ঢেউয়েই ভাষা বুঝে ফেলে স্ত্রী মাকড়সা।
তার দিক থেকেও পাঠিয়ে দেয় দোল তরঙ্গ। তারা এই ঢেউ থেকেই একে অপরের মনের ভাষা বুঝে ফেলে। তবে মিলনের পর অধিকাংশ স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাকে মেরে ফেলে। একেকটা মাকড়শা তাদের নিজ নিজ ভাষায় জালে টোকা দেয়।
তবে বিপত্তিটা বাঁধায় ‘পোর্শিয়া’ নামের অন্য এক প্রজাতির মাকড়সা। ঠিক সিনেমার ভিলেনদের মতো। এরা অন্য প্রজাতির মাকড়সাদের ভাষা রপ্ত করে হুবহু প্রয়োগও করতে পারে।
সুযোগ বুঝে কোনো মাকড়শার জালের সুতোয় ঠিক তার ভাষার পাল্টা প্রতিক্রিয়াতেই টোকা দেয়। তারপর কাছে টেনে নিয়ে ধোঁকা বুঝতে পারা মাকড়শাটিকে নিমিষেই কাবু করে ফেলে। পরে তাকেই শিকার বানিয়ে খেয়ে ফেলে।
রহস্য ঘেরা এই কীটের খুব কম পরিচিত একটি প্রজাতি হলো স্বাক্ষর মাকড়শা। অ্যারানিয়েডি পরিবারের এই মাকড়সার বৈজ্ঞানিক নাম আরজিওপি আনাসুজা। এসব মাকড়শা জালের চারদিকে স্বাক্ষরের মত জিগ-জাগ প্যাটার্ন তৈরি করে থাকে বলেই স্বাক্ষর মাকড়শা নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
এই মাকড়শা বাংলাদেশে তুলনামূলক কম দেখা গেলেও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ, উত্তর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া জার্মান, জাপানসহ কয়েকটি দেশে বেশ দেখা যায়।
স্বাক্ষর মাকড়শার জাল প্রায় অদৃশ্য তবে মোটা সুতোর মত জিগ-জাগ প্যাটার্নগুলোর কারণে জাল দেখা যায়। তারা তাদের সম্পর্কে বড় প্রাণীদের অবস্থান জানান দিয়ে সতর্ক করার জন্য এগুলো তৈরি করে।
যাতে জালের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে কেউ নষ্ট করে না ফেলে। এই প্রজাতির মাকড়শাদের জালের কেন্দ্র তুলনামূলক ফাঁপা থাকে। যেখানে বসে শিকারের জন্য ওঁত পেতে থাকে।
এদের পা আটটি হলেও এমনভাবে পা জোড়ায় জোড়ায় রাখে দেখে মনে হয় চারটিই পা। যখন তাদের পা একসঙ্গে থাকে, তাদের পায়ের লোম একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় ও সূর্যের সাথে প্রতিফলিত হয়ে জ্বলজ্বল করে। এভাবে থাকার কারণ হলো মৌমাছির মতো পোকাদের উজ্জ্বল রং আকর্ষণ করে।
আর তাদের পা সূর্যকে প্রতিফলিত করে ও তাদের উজ্জ্বল রঙের শরীর দেখে পোকারা ফুল মনে করে বোকা বনে যায়। আর কাছে যেতেই ফাঁদে আটকে গিয়ে পরিণত হয় স্বাক্ষর মাকড়সার খাবারে। স্বাক্ষর মাকড়সা তার আকারের দ্বিগুণ পোকা খেতেও সক্ষম।
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৭৫ প্রজাতির স্বাক্ষর মাকড়সা চিহ্নিত করতে পারলেও সবগুলোই দেখতে প্রায় একই ধরনের। সাধারণত বনের রৌদ্রজ্জ্বল অংশে থাকতে পছন্দ করে। জাল ছড়ায় মাটি থেকে এক দেড় মিটার উপরে।
যাতে যেসব কীট কম দূরত্বে উড়ে বেড়ায় তারা জালে আটকা পরে। এই মাকড়শার অধিকাংশই স্ত্রীর চেয়ে পুরুষ অনেক ছোট। স্ত্রী মাকড়শা ৮-১২ মিলিমিটার ও পুরুষ মাকড়শা সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ মিলিমিটার হয়ে থাকে।
মিলনের পর স্ত্রী স্বাক্ষর মাকড়সা পুরুষদের মেরে ফেলে। এছাড়া পুরুষ মাকরসা স্ত্রী মাকড়সার জালের পাশে একটি জাল বোনে। যা সঙ্গী জাল নামে পরিচিত।
মিলনের পরে স্ত্রীটি এই সঙ্গী জালে তার ডিম পাড়ে ও নিজেদের একটি থলিতে মুড়ে দেয়। যেখানে ৪০০-১৪০০টি পর্যন্ত ডিম থাকে। শরৎকালে এদের ডিম ফোটে কিন্তু বসন্ত পর্যন্ত ভেতরে আটকে থাকে।
মাকড়সা হলো নরখাদক ও থলির দেওয়াল ভেদ করার মতো শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত তারা থলিতে বেঁচে থাকার জন্য একে অপরকে খায়। এসব মাকড়শার বিষ থাকলেও মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।
যদিও এদের বিষ বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যবর্ধক পণ্যের উপাদান ও মেডিকেল থেরাপির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে বলা জানা যায়।
সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম