ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ : পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান উৎসব। খুশি এবং কল্যাণের সওগাত নিয়ে প্রতি বছরই ঈদ আসে। উৎসব এবং আনন্দপ্রিয় জাতি হিসেবে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নির্দেশ সবই মহাআড়ম্বরে আয়োজন করে ঈদুল আজহা নিজেদের মতো পালন করে থাকি। এ উৎসবে পশু কোরবানি মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান ও রীতি। কোরবানির উৎসব আয়োজন ও মহাসমারোহে উদ্যাপন আমাদের জাতিগত কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ধর্মেরই অংশ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। ঈদযাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতায় সংক্রমণ বাড়বে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের। তাই সবার কাছে বিনীত অনুরোধ থাকবে- যারা এখন যে জায়গায় আছেন, সেখানেই ঈদ পালন করবেন। এই সময়ে প্রচ- ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে বাড়ি যাওয়ার কোনো মানে নেই। বর্তমানে যদিও করোনা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, তবু তা শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের অবস্থা এখনো অনেক ভালো, সেখানে করোনার তেমন সংক্রমণ নেই। তাই ঈদে যে কেউ শহর থেকে করোনা বয়ে নিয়ে গ্রামে গিয়ে ভালো পরিবেশকে আবার করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলা ঠিক হবে না। ব্যাপক লোকজন গ্রামে গেলে সেখানে করোনা ছড়িয়ে যাবেই। শোনা যায়, অনেক জেলায় এমনকি গ্রামেও করোনার সংক্রমণ বাড়া শুরু হচ্ছে। একদিকে গ্রামে করোনা বয়ে নেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, আবার কেউ যেন গ্রামে ঈদ করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহরে এসে অন্যদের সংক্রমিত না করতে পারেন সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। ইতোমধ্যে পশুর হাটগুলোয় জনসমাগম বেড়ে গেছে। সবাই এখন যে-যার মতো হাটে ভিড় করছেন। এখান থেকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই যারা এখন কোরবানির পশু কিনতে বিভিন্ন হাটে যাচ্ছেন তারা এক হাট থেকে অন্য হাটে খুব বেশি ঘোরাফেরা করবেন না। ভিড় এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। বাচ্চা, বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যারা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগেন তারা হাটে অবশ্যই যাবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় অনলাইন হাটগুলো থেকে পশু কিনতে পারলে। তাহলে ঝুঁকি কম থাকবে। করোনা পরিস্থিতিতে এবারের ঈদের আয়োজনে যুক্ত হবে সতর্কতা। সতর্কতার দোহাই দিয়ে গতবারেও অনেকেই কোরবানির হাট বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। তবে কোরবানির হাটের প্রয়োজনীয়তাও আছে। কারণ কোরবানির সঙ্গে শুধু ধর্মীয় বিধানই জড়িত নয়, এর সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিও জড়িত।
ঈদে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো কোরবানির সময়ে সচেতন থাকা। পশু জবাই করতে হবে, এটা আমাদের ধর্মীয় বিধান। ঈদ হবে, কোরবানিও চলবে। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে যেন কেউ স্বাস্থ্যবিধিকে খাটো করে না দেখে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অনেকের উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা বা শিথিলতা করোনার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঈদের আনন্দ করতে হবে। সবার প্রতি অনুরোধ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুন্দরভাবে পশু কোরবানির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় মুখে মাস্ক পরবেন এবং একজন আরেকজন থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন। সেই সঙ্গে কোরবানির স্থানের পাশে মাস্ক, সাবান ও পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সময় কোরবানির সঙ্গে জড়িত কসাই বা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও লক্ষ্য রাখবেন। কোরবানির স্থান দ্রুততার সঙ্গে পরিচ্ছন্ন করে পশুর রক্ত, বর্জ্য বা গোবর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করতে হবে এবং নাড়িভুঁড়ি, চামড়াসহ যাবতীয় উচ্ছিষ্ট নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। কোরবানির পশুর ভাগ নিতে আসা দরিদ্র মানুষের সারিতেও যেন স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ঈদের নামাজ তো পড়তেই হবে, তবে এটি আমাদের শহরের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জের খোলা ময়দানে হলেই ভালো। সবাই যেন মাস্ক পরে এবং একজন আরেকজন থেকে নিরাপদ দূরত্বটা বজায় রাখে। অবশ্য সব শহরে খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা কঠিন। তারা মসজিদে নামাজ পড়লেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তি এবং শিশুরা ঈদের নামাজে না গেলেই ভালো হয়। সেই সঙ্গে যারা বাইরে নামাজ পড়তে যাবেন, তারা ঘরে অজু করে যাবেন, সঙ্গে করে নিজের জায়নামাজ নিয়ে যাবেন। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে। সব মসজিদে ঢোকার মুখে হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান ও পানির ব্যবস্থা রাখা উচিত। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমসহ মসজিদের দায়িত্বরতদের অবশ্যই ঈদের নামাজের আগে মসজিদের মেঝে ও ঢোকার দরজাগুলোকে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে অন্তত কয়েকবার জীবাণুমুক্ত করতে হবে। নামাজ শেষ করে দ্রুত মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি, কদমবুচি এবং পরস্পর হাত মেলানো পরিহার করতে হবে।
ঈদের নামাজের পর কেউ বাইরে কোথাও ঘোরাফেরা করবেন না। এ সময় শহরের পার্কে বা চিড়িয়াখানা এবং গ্রামের অনেক জায়গায় ঘোরাফেরা করা উচিত হবে না। সর্বোপরি, করোনা থেকে বাঁচার একটাই রাস্তা- স্বাস্থ্যবিধি মানা। টিকা অবশ্যই নিয়ে নিতে হবে, এ ব্যাপারে যেন সবাই সচেষ্ট হন। ঈদ এবং কোরবানির সব বিধান ঠিকভাবে অবশ্যই পালন করতে হবে। ঈদও চলবে, নামাজও চলবে। তবে সবাইকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এসব নিয়ম মানলে আমরা এ মহামারির দিনে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকতে পারব। ঈদের আনন্দে গা না ভাসিয়ে ত্যাগের মহিমায় জীবন যেন আলোকিত হয় সেদিকেই সবাইকে নজর রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাকালে আমাদের উদাসীনতায় ঈদুল আজহা এবং তার আনন্দ যেন পরিণত না হয় বিষাদে।
লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। সূূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন