বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখার জন্য যাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহুজনকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন আমাদের অতি আপনজন মহিউদ্দিন আহমেদ (মধু)। গাফ্ফার ভাইয়ের মহাপ্রয়াণের অল্প কদিন পরই মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিদায়ের ব্যথা আমাদের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে তাঁর যে অবদান সে তুলনায় তাঁর প্রয়াণের খবরটি আমাদের সংবাদমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়নি দেখে আমার মতো অনেকেই হতাশ। আমরা আশা করেছিলাম, শহীদ মিনারে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য রাখা হবে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, কিন্তু তা করা হয়নি। ১৯৭১-এ বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশের পক্ষে স্বার্থহীনভাবে আনুগত্য দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সদ্যপ্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন অন্যতম। আরও ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের অডিট-প্রধান লুৎফল মতিন। আরও দু-চার জন ছিলেন যাঁদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেবের নামটি স্পষ্ট মনে পড়ছে। সে সময় বিবিসি বাংলা বিভাগে কর্মরত রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত) এবং ফজলে রাব্বি মাহমুদের সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বহু বছরের বন্ধুত্ব ছিল বলে তিনি প্রতিনিয়ত তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন নিয়ে কথা বলতেন মার্চের আগে থেকেই।

 

১৯৭১-এ পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কিছু কূটনীতিকের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এ কথা অনেকেই জানেন না যে, এঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে দরকষাকষি করে তবেই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছিলেন, নিজেদের জন্য সব সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পর। অনেকেই আবার অপেক্ষা করছিলেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কি না। প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফল মতিন এবং সাহাবুদ্দিন সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রমী। মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন মনে-প্রাণে একজন মুজিব সৈনিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অবিচল। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে আমাদের আন্দোলনের কয়েকটি কেন্দ্রবিন্দুর একটি ছিল পাকিস্তান দূতাবাসের সামনের ফুটপাথ। দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন ভাই বসতেন দূতাবাসের বেসমেন্টে, যেখান থেকে জানালা দিয়ে আমাদের তিনি দেখতে পেলেই আমাদের জন্য গরম কফি পাঠিয়ে দিতেন, বরফপড়া শীতে তখন যা আমাদের চাঙা করে দিত। মার্চেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এসে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে মহিউদ্দিন ভাই বিচারপতি চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন তিনি এখনই বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে চান। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন যাতে মহিউদ্দিন ভাই পাকিস্তান দূতাবাসের গোপন দলিল প্রদান করতে পারেন, যা মহিউদ্দিন ভাই করে গেছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব তাঁর লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইতে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি দশ-ই এপ্রিল বিবিসিতে যখন সাক্ষাৎকার দিতে যাই তখনই অবশ্য মহিউদ্দিন বলেছিলেন, তিনি আমার দিক থেকে নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। পয়লা আগস্ট ‘একশন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত সভায় রওনা হওয়ার অল্পক্ষণ আগে পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত এ কথা ফোনে জানান। এখানে পাকিস্তান সরকারে কর্মরত কূটনীতিকদের মধ্যে সমগ্র ইউরোপে মহিউদ্দিন আহমেদই প্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন।’ (পৃষ্ঠা-৮৬)।

মার্চের প্রথম থেকেই আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লবি করা শুরু করি, যখন ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের কাছে দেওয়ার জন্য যেসব তথ্য আমরা ছাপাতাম সেগুলো তৈরি করার জন্য মহিউদ্দিন ভাই প্রদত্ত গোপন তথ্যগুলো বেশ কাজে আসত। ’৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে তিন দিনের জন্য আমি এবং আফরোজ চৌধুরী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায় অনশন শুরু করার পর দ্বিতীয় দিনেই মহিউদ্দিন ভাই গভীর রাতে অনশনস্থলে গিয়েছিলেন আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। সেখানে উপস্থিত সে সময়ের ছাত্রনেতা (বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ প্রধান) সুলতান শরিফ মহিউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখানে এলেন, ভয় হলো না?’ মহিউদ্দিন ভাইয়ের জবাব ছিল, ‘কী আর হবে বড়জোর চাকরিটা যাবে, এর জন্য তো আমি প্রস্তুত।’ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের পয়লা আগস্ট ট্রাফালগ্যার স্কোয়ারে র‌্যালির সময়। কিন্তু তার আগে কয়েক মাস বাংলাদেশের পক্ষে গোপনে যা করে গেছেন তা কম লোকই জানেন। তিনি বাড়ি ভাড়া বা ভাতা নিয়ে কোনো দাবিই করেননি, যা অনেকেই করেছেন। তখন তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের বালহাম এলাকায় ৩৭ বেলামি স্ট্রিটে আরেক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা জাকিউদ্দিনের বাড়িতে মাত্র একটি কক্ষ নিয়ে অতিকষ্টে বসবাস করতেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর লন্ডন গমনের সময় তিনি বিশেষ দায়িত্বরত ছিলেন এবং সার্বক্ষণিক বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। তার আগে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন খোলার ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়েছিল, কেননা ব্রিটিশ সরকার তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ব্রিটিশ সংস্থা একশন বাংলাদেশের সচিব মেরিয়েটা প্রকপে ১৯৭২-এর প্রথম দিকে বাংলাদেশ সফর শেষে লন্ডন ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করার পর তাঁর স্মৃতিতে ট্রাফালগ্যার স্কোয়ারে এক গির্জায় যে স্মরণসভা হয়েছিল তা অনুষ্ঠিত করতে মহিউদ্দিন ভাই এবং সে সময়ে লন্ডনে আমাদের মিশনপ্রধান ফারুক আহমেদ চৌধুরী সাহেব নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে মেরিয়েটার প্রিয় দুটি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার জন্য মহিউদ্দিন ভাই এবং ফারুক ভাই আমাকে এবং রুনি সুলতানাকে অনুরোধ করলে আমরা সে অনুষ্ঠানে দুটি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলাম। নভেম্বরে লন্ডন ভ্রমণরত ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশি এবং ভারতবাসীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য যে বিশাল অনুষ্ঠান করেছিলেন, মহিউদ্দিন ভাই তাতেও বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে সহযোগিতাক্রমে। স্বাধীনতার পর কয়েকটি স্বাভাবিক পদোন্নতির পর তিনি বাংলাদেশের জাতিসংঘ মিশনে উপপ্রধান পদপ্রাপ্ত হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সে সময় জাতিসংঘে ভ্রমণরত বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য নিউইয়র্কে মহিউদ্দিন ভাইয়ের অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এ ছবি কেন আপনার অফিসে?’ অকুতোভয়, তেজি এবং স্পষ্টভাষী মহিউদ্দিন ভাই জবাব দিয়েছিলেন ‘আমার অফিসে কার ছবি থাকবে সেটা তো আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সেই সংসদ সদস্যরা দেশে ফিরে খালেদা জিয়াকে জানালে, খালেদা মহিউদ্দিন ভাইকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। জীবিকার তাগিদে তিনি তখন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। এভাবে বছর দুয়েক পার হওয়ার পর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাঁর পক্ষে রায় দিলে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি ফিরে পেয়ে সেই মন্ত্রণালয়েরই একজন সচিবের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন এবং ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মামলায় সাহায্য করেছিলেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক। আমি তখন ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলাম বলে আমিও সে মামলায় মহিউদ্দিন ভাইয়ের পক্ষে কিছু করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অবসরের পর তিনি কোনো বিশেষ সুবিধা না চেয়ে পত্রিকায় লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর বেশির ভাগ লেখাই ছিল বিলেতপ্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের ওপর এবং ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন কঠোরভাবে অসাম্প্রদায়িক, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগী, ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপসহীন। খালেদা জিয়ার সময়ে তিনি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পদে আর সচিব ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা রিয়াজ রহমান। একদিন সেই রাজাকার জামাতা সচিব মহিউদ্দিন ভাইয়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর কটাক্ষ করলে মহিউদ্দিন ভাই প্রকাশ্যেই তার উচিত জবাব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর লিভার সিরোসিস রোগ ধরা পড়লে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য দিতে রাজি হয়েছিলেন, তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেনও কিন্তু চিকিৎসকরা আশা দিতে পারেননি বলে চিকিৎসা ছাড়াই ফিরে আসেন। এরপর বেশ কয়েক বছর সুস্থ ছিলেন। কদিন আগে আমার ছোট মেয়ে ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরীর কঠোর বঙ্গবন্ধুভক্ত নানাশ্বশুর, বহুকাল আগের পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মোহসিন সাহেব থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর জেনেই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম গত ১৬ জুন। সেটিই ছিল তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। পুরো সময়টাই তিনি ১৯৭১-এ লন্ডনের স্মৃতিচারণা করেছেন। 

মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রস্থান অসাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য যে শূন্যতা সৃষ্টি করল, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ’৭১ সালে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, আমিসহ তাঁদের বেশ কয়েকজনই এখন ঢাকায় রয়েছেন, যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, লুৎফল মতিন, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান রঞ্জু, ডা. জোয়ার্দ্দার, ডা. কামরুজ্জামান, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পুত্র আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুইয়া এবং ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

 

আবার অনেকে তাঁর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন জাকারিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া খানম, স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান আজিজুল হক ভুইয়া, স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং ব্যারিস্টার শফিউদ্দিন বুলবুল। যাঁরা বেঁচে আছেন এবং মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রয়াণের কথা শুনেছেন তাঁরা হয়ে পড়েছেন বাকরুদ্ধ। তাঁদের অনেকেই ২১ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জানাজায় অংশ নিয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন না, কিন্তু তাঁর স্মৃতি কখনো মøান হবে না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» নির্বাচিত সরকারই দেশ পুনর্গঠন করতে পারে: তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

» ইয়াবাসহ দুইজনকে গ্রেফতার

» বদলে যাচ্ছে ফেসবুক মেসেঞ্জার

» সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

» রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার প্রয়োজন : সেলিমা রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখার জন্য যাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহুজনকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন আমাদের অতি আপনজন মহিউদ্দিন আহমেদ (মধু)। গাফ্ফার ভাইয়ের মহাপ্রয়াণের অল্প কদিন পরই মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিদায়ের ব্যথা আমাদের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে তাঁর যে অবদান সে তুলনায় তাঁর প্রয়াণের খবরটি আমাদের সংবাদমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়নি দেখে আমার মতো অনেকেই হতাশ। আমরা আশা করেছিলাম, শহীদ মিনারে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য রাখা হবে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, কিন্তু তা করা হয়নি। ১৯৭১-এ বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশের পক্ষে স্বার্থহীনভাবে আনুগত্য দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সদ্যপ্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন অন্যতম। আরও ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের অডিট-প্রধান লুৎফল মতিন। আরও দু-চার জন ছিলেন যাঁদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেবের নামটি স্পষ্ট মনে পড়ছে। সে সময় বিবিসি বাংলা বিভাগে কর্মরত রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত) এবং ফজলে রাব্বি মাহমুদের সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বহু বছরের বন্ধুত্ব ছিল বলে তিনি প্রতিনিয়ত তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন নিয়ে কথা বলতেন মার্চের আগে থেকেই।

 

১৯৭১-এ পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কিছু কূটনীতিকের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এ কথা অনেকেই জানেন না যে, এঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে দরকষাকষি করে তবেই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছিলেন, নিজেদের জন্য সব সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পর। অনেকেই আবার অপেক্ষা করছিলেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কি না। প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফল মতিন এবং সাহাবুদ্দিন সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রমী। মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন মনে-প্রাণে একজন মুজিব সৈনিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অবিচল। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে আমাদের আন্দোলনের কয়েকটি কেন্দ্রবিন্দুর একটি ছিল পাকিস্তান দূতাবাসের সামনের ফুটপাথ। দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন ভাই বসতেন দূতাবাসের বেসমেন্টে, যেখান থেকে জানালা দিয়ে আমাদের তিনি দেখতে পেলেই আমাদের জন্য গরম কফি পাঠিয়ে দিতেন, বরফপড়া শীতে তখন যা আমাদের চাঙা করে দিত। মার্চেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এসে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে মহিউদ্দিন ভাই বিচারপতি চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন তিনি এখনই বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে চান। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন যাতে মহিউদ্দিন ভাই পাকিস্তান দূতাবাসের গোপন দলিল প্রদান করতে পারেন, যা মহিউদ্দিন ভাই করে গেছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব তাঁর লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইতে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি দশ-ই এপ্রিল বিবিসিতে যখন সাক্ষাৎকার দিতে যাই তখনই অবশ্য মহিউদ্দিন বলেছিলেন, তিনি আমার দিক থেকে নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। পয়লা আগস্ট ‘একশন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত সভায় রওনা হওয়ার অল্পক্ষণ আগে পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত এ কথা ফোনে জানান। এখানে পাকিস্তান সরকারে কর্মরত কূটনীতিকদের মধ্যে সমগ্র ইউরোপে মহিউদ্দিন আহমেদই প্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন।’ (পৃষ্ঠা-৮৬)।

মার্চের প্রথম থেকেই আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লবি করা শুরু করি, যখন ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের কাছে দেওয়ার জন্য যেসব তথ্য আমরা ছাপাতাম সেগুলো তৈরি করার জন্য মহিউদ্দিন ভাই প্রদত্ত গোপন তথ্যগুলো বেশ কাজে আসত। ’৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে তিন দিনের জন্য আমি এবং আফরোজ চৌধুরী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায় অনশন শুরু করার পর দ্বিতীয় দিনেই মহিউদ্দিন ভাই গভীর রাতে অনশনস্থলে গিয়েছিলেন আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। সেখানে উপস্থিত সে সময়ের ছাত্রনেতা (বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ প্রধান) সুলতান শরিফ মহিউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখানে এলেন, ভয় হলো না?’ মহিউদ্দিন ভাইয়ের জবাব ছিল, ‘কী আর হবে বড়জোর চাকরিটা যাবে, এর জন্য তো আমি প্রস্তুত।’ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের পয়লা আগস্ট ট্রাফালগ্যার স্কোয়ারে র‌্যালির সময়। কিন্তু তার আগে কয়েক মাস বাংলাদেশের পক্ষে গোপনে যা করে গেছেন তা কম লোকই জানেন। তিনি বাড়ি ভাড়া বা ভাতা নিয়ে কোনো দাবিই করেননি, যা অনেকেই করেছেন। তখন তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের বালহাম এলাকায় ৩৭ বেলামি স্ট্রিটে আরেক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা জাকিউদ্দিনের বাড়িতে মাত্র একটি কক্ষ নিয়ে অতিকষ্টে বসবাস করতেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর লন্ডন গমনের সময় তিনি বিশেষ দায়িত্বরত ছিলেন এবং সার্বক্ষণিক বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। তার আগে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন খোলার ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়েছিল, কেননা ব্রিটিশ সরকার তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ব্রিটিশ সংস্থা একশন বাংলাদেশের সচিব মেরিয়েটা প্রকপে ১৯৭২-এর প্রথম দিকে বাংলাদেশ সফর শেষে লন্ডন ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করার পর তাঁর স্মৃতিতে ট্রাফালগ্যার স্কোয়ারে এক গির্জায় যে স্মরণসভা হয়েছিল তা অনুষ্ঠিত করতে মহিউদ্দিন ভাই এবং সে সময়ে লন্ডনে আমাদের মিশনপ্রধান ফারুক আহমেদ চৌধুরী সাহেব নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে মেরিয়েটার প্রিয় দুটি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার জন্য মহিউদ্দিন ভাই এবং ফারুক ভাই আমাকে এবং রুনি সুলতানাকে অনুরোধ করলে আমরা সে অনুষ্ঠানে দুটি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলাম। নভেম্বরে লন্ডন ভ্রমণরত ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশি এবং ভারতবাসীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য যে বিশাল অনুষ্ঠান করেছিলেন, মহিউদ্দিন ভাই তাতেও বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে সহযোগিতাক্রমে। স্বাধীনতার পর কয়েকটি স্বাভাবিক পদোন্নতির পর তিনি বাংলাদেশের জাতিসংঘ মিশনে উপপ্রধান পদপ্রাপ্ত হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সে সময় জাতিসংঘে ভ্রমণরত বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য নিউইয়র্কে মহিউদ্দিন ভাইয়ের অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এ ছবি কেন আপনার অফিসে?’ অকুতোভয়, তেজি এবং স্পষ্টভাষী মহিউদ্দিন ভাই জবাব দিয়েছিলেন ‘আমার অফিসে কার ছবি থাকবে সেটা তো আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সেই সংসদ সদস্যরা দেশে ফিরে খালেদা জিয়াকে জানালে, খালেদা মহিউদ্দিন ভাইকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। জীবিকার তাগিদে তিনি তখন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। এভাবে বছর দুয়েক পার হওয়ার পর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাঁর পক্ষে রায় দিলে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি ফিরে পেয়ে সেই মন্ত্রণালয়েরই একজন সচিবের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন এবং ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মামলায় সাহায্য করেছিলেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক। আমি তখন ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলাম বলে আমিও সে মামলায় মহিউদ্দিন ভাইয়ের পক্ষে কিছু করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অবসরের পর তিনি কোনো বিশেষ সুবিধা না চেয়ে পত্রিকায় লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর বেশির ভাগ লেখাই ছিল বিলেতপ্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের ওপর এবং ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন কঠোরভাবে অসাম্প্রদায়িক, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগী, ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপসহীন। খালেদা জিয়ার সময়ে তিনি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পদে আর সচিব ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা রিয়াজ রহমান। একদিন সেই রাজাকার জামাতা সচিব মহিউদ্দিন ভাইয়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর কটাক্ষ করলে মহিউদ্দিন ভাই প্রকাশ্যেই তার উচিত জবাব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর লিভার সিরোসিস রোগ ধরা পড়লে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য দিতে রাজি হয়েছিলেন, তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেনও কিন্তু চিকিৎসকরা আশা দিতে পারেননি বলে চিকিৎসা ছাড়াই ফিরে আসেন। এরপর বেশ কয়েক বছর সুস্থ ছিলেন। কদিন আগে আমার ছোট মেয়ে ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরীর কঠোর বঙ্গবন্ধুভক্ত নানাশ্বশুর, বহুকাল আগের পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মোহসিন সাহেব থেকে মহিউদ্দিন ভাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর জেনেই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম গত ১৬ জুন। সেটিই ছিল তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। পুরো সময়টাই তিনি ১৯৭১-এ লন্ডনের স্মৃতিচারণা করেছেন। 

মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রস্থান অসাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য যে শূন্যতা সৃষ্টি করল, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ’৭১ সালে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, আমিসহ তাঁদের বেশ কয়েকজনই এখন ঢাকায় রয়েছেন, যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, লুৎফল মতিন, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান রঞ্জু, ডা. জোয়ার্দ্দার, ডা. কামরুজ্জামান, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পুত্র আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুইয়া এবং ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

 

আবার অনেকে তাঁর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন জাকারিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া খানম, স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান আজিজুল হক ভুইয়া, স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং ব্যারিস্টার শফিউদ্দিন বুলবুল। যাঁরা বেঁচে আছেন এবং মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রয়াণের কথা শুনেছেন তাঁরা হয়ে পড়েছেন বাকরুদ্ধ। তাঁদের অনেকেই ২১ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জানাজায় অংশ নিয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন না, কিন্তু তাঁর স্মৃতি কখনো মøান হবে না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com