পৌনে এক শতাব্দীর আওয়ামী লীগ

সোহেল সানি :প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে অর্জিত বাঙালির ভাষা-স্বাধীনতা, সংবিধান ও দেশ-জাতিগঠনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন আর আর তাঁর কন্যার রূপকল্প। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির একবুক জ্বালা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সোনা বাংলা বিনির্মাণে সব অর্জন অবিস্মরণীয় ও অকল্পনীয়। বাঙালির জীবনে সে তো রূপকথার গল্পের ন্যায়। পদ্মাবতী খরস্রোতার নদীর বুকে পদ্মাসেতু উৎসব ধ্বনি প্রতিধ্বনির আকাশে-বাতাসে যে অনুরণন, তা তো  আওয়ামী লীগের মহা অর্জন। সেই আওয়ামী লীগের  ভূমিষ্ঠকালীন বেদনা, মাতৃত্বকালীন প্রসব বেদনার ন্যায় অসহনীয় কষ্টের।

 

আগেই দলের রূপকার করাচি হতে স্টিমারযোগে সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে গতিরোধ করা হয় নারায়ণগঞ্জে। তাকে মানহানিকর অবস্থায় ফিরে যেতে হয় করাচিতে। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুসলিম লীগের নাম “জাতীয়তাবাদী লীগ” রাখার প্রস্তাব করে সদস্য পদ থেকেই বহিষ্কৃত হন। পাকিস্তান প্রস্তাবক সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তিনি। সেই তাঁকেই “ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর” বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান।

 

মুসলিম লীগের সভাপতি খলীকুজ্জমান চৌধুরী সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীদের লীগে প্রবেশ বন্ধ করে দেন।

 

পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পরের বছর ভাষাসংগ্রাম শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে। উপনির্বাচনে বিজয়ী শামসুল হকের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয় পরিষদ সদস্য পদ। তার আগে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের ওই একই আসনে মওলানা ভাসানী বিজয়ী হলেও তাঁর সদস্য পদ কেড়ে নিয়ে নির্বাচনেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

 

এরকম এক বৈরী পরিস্থিতিতে দল গঠনে ডাকা হয় “মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন”। ঢাকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় খান সাহেব ওসমান আলীর অনুপ্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের রহমতগঞ্জ ইনস্টিটিউটে সেখানেও বাধা। তারপর পাইকপাড়া। সেখানেও বিপত্তি। সরকারি পেটোয়া বাহিনীর রক্তচক্ষুর আড়ালে ঢাকা মিউনিসিপাল করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী বশীর হুমায়ুন বললেন, “সম্মেলন করুন আমার রোজগার্ডেন-এ। সরকারি চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্মেলনের দু’দিন আগেই রাতের আঁধারে শওকত আলী গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে ভাসানীকে পৌঁছে দেন রোজগার্ডেনে।

 

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুনের ঢাকার স্বামীবাগের বিখ্যাত রোজ গার্ডেন। প্রায় তিনশত কর্মীর ওই সম্মেলনে প্রথমে পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত পরিবেশন করেন মওলানা রাগীব আহসান। শামসুল হক “মূল দাবি” নামে একটি  প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ কেবল মুসলমানের নয়, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। ……  মানবতার চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এক কাতারে সমবেত হইতেই মুসলিম লীগ কর্মী-সম্মেলন আহ্বান জানাইতেছে। “পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে দল গঠনের ঘোষণা দেয়া হলে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় কর্মীরা। সম্মেলন চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

 

সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এককালীন সভাপতি অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে নবগঠিত দলকে স্বাগত জানিয়ে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করে চলে যান। তখন চলছিল পাকিস্তানে চরমতম রাজনৈতিক সংকট। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে প্রথমে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববাংলাকে বেছে নেয়া হয় দল গঠনের জন্য। পাকিস্তান প্রস্তাবক স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলগঠনের মূল ভরসা। বাংলার প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় সর্বস্ব হারিয়ে করাচিতে আসেন। তাঁর ওপর পড়লো পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আড়চোখ। অথচ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলায় কেবল নিরঙ্কুশ জয় পায়। সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ববাংলায় নিষিদ্ধ করলেন যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সেই তিনি গণপরিষদের সদস্য হন সোহরাওয়ার্দীরই ছেড়ে দেয়া কলকাতার আসনের উপ-নির্বাচনে। এরপর ১৯৪৯ সালের ৯ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলা আসেন। তিনি পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কপার্স মামলা পরিচালনার কথা বলে। তিনি একান্ত অনুগামী শওকত আলীর পরামর্শে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের পুরানো ঢাকায় “নূরজাহান বিল্ডিং” এসে ওঠেন। পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীর মুসলিম লীগের নবীন কর্মীরা দলের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা জানান নেতাকে। সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে ইতিপূর্বে টাঙ্গাইলে ফেরা আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ঢাকায় ঘাটি বাঁধতে বলেন। শাহজাহানের বাসায় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে দলগঠন নিয়ে শলাপরামর্শ হয়। মওলানা ভাসানী আসামের ধুবড়ী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং আলী আমজাদ খানের বাসায় ওঠেন। যাহোক বৈঠকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমেদ, ঢাকার শওকত আলী, আলী আমজাদ খান, খন্দকার আব্দুল হামিদ ও ইয়ার মোহাম্মদ খানও ছিলেন। বৈঠকে প্রস্তুতি কমিটি গঠন নিয়ে শুরুতেই বিরোধ হয়। আলী আমজাদ খানকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করা হলে শওকত আলী ও খন্দকার আব্দুল হামিদ বিরোধিতা করেন। পরে মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। খান সাহেব ওসমান আলীর আশ্বাসের বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে না পারলেও তাঁরই  দিকনির্দেশনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। নিজে সভাপতির আসন অলংকৃত করে অবাঙালি মাহমুদুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি করা হয়

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। শামসুল হককে  সাধারণ সম্পাদক করে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। পাঁচজন সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, আলী আহমেদ খান ও আব্দুস সালাম খান। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও আরেকজন ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সহ যুগ্ম সম্পাদক করা হয় এ কে রফিকুল হোসেনকে। পরের দিন আরমানীটোলায় জনসভা করা হলো। কিন্তু সরকারের ঈশারায় সেই ২৪ জুনের জনসভায় বাদশা বাহিনীর দল হামলা চালালো। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দ্বিতীয় জনসভাও আরমানীটোলায়। ওদিন ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে আরমানীটোলা থেকে  আওয়ামী মুসলিম লীগ বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে গর্ভনর হাউজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গ্রেফতার হন ভাসানী, শামসুল হকসহ অনেক নেতা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ মুজিব করাচিতে নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছে চলে গেলেও এসেই গ্রেফতার হন।

 

১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে ঢাকার ৯০ নবাবপুর একটা রুমে দুইটা টুল একটা টেবিল, দুইটা চেয়ার নিয়ে অফিস খুলে বসেন। ওখানে দলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ভবঘুরে মোহাম্মদউল্লাহ (পরে রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি) কাজ চাইলে শেখ মুজিব তাকে দপ্তর সম্পাদক করেন।

 

ছাত্রলীগই কার্যত আওয়ামী লীগের মাতৃসংগঠন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার কারণে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ এই দল।

 

পাকিস্তানি শাসকবর্গ এবং মুসলিম লীগ নতুন দলটির আবির্ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীকে ‘ভারতীয় চর’ বলে প্রচার চালিয়ে বাঙালিদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪০ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি দলকে দ্রুত একটি শক্তিমান সংগঠনে পরিণত করতে থাকে।

 

নতুন দলটির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার (যার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন ও সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন) সন্ত্রাস, গোলযোগ সৃষ্টি এবং দমন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। তারা আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে নতুন দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। তবুও দলটি বিকশিত হতেই থাকে। প্রতিরোধের মুখে পড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগ্রামী দল হিসেবে আরও দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। চলতে থাকে তাদের গণমুখী আন্দোলন-সংগ্রাম।

 

আগেই বলেছি মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর এবং শেখ মুজিবকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সর্বপর্যায়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে। শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবিতে কারাগারের ভিতর অনশন শুরু করেন। এতে আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান। একই বছর পুনরায় ভাসানী ও শামসুল হক গ্রেফতার হন। কারাগারে শামসুল হকের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

“প্রথম কাউন্সিল”

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষণায় আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকারসহ পূর্ব বাংলার জন্য লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে কৃষি জমির বণ্টন, তে-ভাগা নীতির বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সমবায় ও যৌথ কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সব দেশি ও বিদেশি মৌলিক শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকারও ছিল এ ঘোষণায়। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে পূর্ব-বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে অন্য দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগ শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। পরে এই ফ্রন্টে আরও যুক্ত হয় গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ঘোষণায় পূর্ববাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দাবি আদায়ের কথা বলা হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৭টি আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। এর মধ্যে ১৪৩টি আসন পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। কৃষক-শ্রমিক পার্টি লাভ করে ৪৮টি আসন। মুসলিম লীগ মাত্র ১০টি আসন পায়।

 

একই বছরে ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় ফজলুল হক মন্ত্রীসভা। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে এতে যোগ না দিলেও পরে আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রী করা হয়। যুক্তফ্রন্ট তথা আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্য এই নির্বাচনী বিজয় যুগান্তকারী ঘটনা হলেও পরবর্তীতে ফ্রন্ট ও দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

কেন্দ্রীয় সরকার এই সুযোগে ৯২-ক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতাও নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়।

“দ্বিতীয় কাউন্সিল”

মওলানা ভাসানী ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন পল্টন ময়দানের সমাবেশ এবং ২৩ জুন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পূর্ব বাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ আগের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। দলের হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার শক্তিশালী সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর (১৯৫৫) ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক ও অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়।

 

এ অধিবেশনেই দলকে অসাম্প্রদায়িক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বাতিলের দাবিতে ১৯৫৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রস্তাব তোলে। প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৭ সদস্যের মধ্যে ২০০ জন এতে স্বাক্ষর দেন। বাধ্য হয়ে আবু হোসেন সরকার ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার পতন১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১২ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার। বৈদেশিক সিয়াটো চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে।

 

প্রসঙ্গত: সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর দ্বন্দ্বের আগে যুক্তফ্রন্টের দ্বন্দ্ব ও কোন্দল পাকিস্তানের রাজনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, পূর্বপাকিস্তান আইন পরিষদের নেতা হবেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নেতা হবেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইল দক্ষিণ আসনের নির্বাচনে জমিদার খুররম খানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েও অকৃতকার্য হওয়ার পরই ঘোষণা করেছিলেন তিনি কোনদিন নির্বাচন করবেন না। সে কথা তিনি রেখেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৩ টি আসন পেলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৮ আসন পাওয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির শেরেবাংলাকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের সুযোগ দেন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী নেতৃত্ব।

 

কিন্তু বিস্ময়করভাবে শেরেবাংলা তার দলের পাঁচজনকে নিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৫ দিনের মাথায় শেরেবাংলা আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। আর সেই সময় পাকিস্তানী চক্রান্তে আদমজীতে লাগানো হয় দাঙ্গা। বিহারী-বাঙালী দাঙ্গা। বহু প্রাণ ঝরে পড়ে ওই দাঙ্গায়। মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২- ক ধারা জারি করে শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রের অধীনে নেয়া হয়। পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে গা দেন বাঙালী নেতারাও। শেরেবাংলা পূর্বপাকিস্তানের গর্ভনর হয়ে কৃষক-শ্রমিক পাটি ও আওয়ামী লীগকে দিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব আইন পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তাতে সরকারের পতন ঘটে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে আওয়ামী লীগ। মুখ্যমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান। আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন, হাশিমুদ্দিন আহমেদ, কংগ্রেস দলের মনোরঞ্জন ধর, গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী মন্ত্রিসভায় স্থান পান। বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। একবার আওয়ামী লীগ আরেকবার কৃষক-শ্রমিক পার্টি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের ২৩ জন আইন পরিষদ সদস্য শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করে মন্ত্রিত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাদগ্রহণ করে আবু হোসেন সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শেরেবাংলার সরকারে যোগ দিয়ে এর মধ্যে হাশিমুদ্দিন মন্ত্রী হন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ চিফ হুইপ এবং খালেক নেওয়াজ খান হুইপ হন। সর্বশেষ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তখন সারা পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ক্ষমতায়। ডাঃ খান সাহেবের রিপাবলিকান পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন ইস্কান্দার মির্জা। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক খাজা নাজিমুদ্দিনের পতনের পর বাঙালি মোহাম্মদ আলী, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফিরোজ খান নুন ও আই আই চুন্দ্রিগর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেন। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ১৩ মাসের অধিক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী বিরোধ এ সময় চরমে পৌঁছে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। ভাসানী সিয়াটো চুক্তি মানছিলেন না। দলের নেতৃত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তাঁর অনুসারীরা ভাসানীকে উস্কে দিচ্ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে অলি আহাদ উঠে আসার জন্য বিশেষভাবে কলকাঠি নাড়ছিলেন।
এক পর্যায়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে অলি আহাদ প্রশ্ন তুলেন যে, গঠনতন্ত্রে স্পষ্টত বলা রয়েছে যারা মন্ত্রী হবেন তারা কেউ দলীয় পদে থাকবেন না। মূলত, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছিল যে মন্ত্রিত্ব রেখে শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দেবেন, কিন্তু সে ধারণার মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিব মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেয়ায়। এরপরই শুরু হয় নতুন চক্রান্ত।

 

প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর এক ইউনিট ফর্মুলা ও সিয়াটো চুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগে চরম বিরোধ দেখা দেয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রকৃতঅর্থে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ‘৫৫ সালে যখন দলকে না জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর আইনমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। শুধু তিনিই নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন শেরেবাংলাও। করাচিতে সাংবাদিকরা নবনিযুক্ত আইনমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে প্রশ্ন করেন যে, মন্ত্রীত্বগ্রহণ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো পরিপন্থী কিনা? সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, “আওয়ামী লীগ আবার কি, আমিই আওয়ামী লীগ, আমিই মেনিফেস্টো আমিই গঠনতন্ত্র।” আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও সোহরাওয়ার্দীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কোন নেতা টু-টা শব্দটি উচ্চারণ না করলেও দলীয় নেতৃত্বে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। কাউন্সিলে সিয়াটো চুক্তি বিপক্ষে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হলে সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে পড়ে ৫০০ ভোট, অপরদিকে ৩৫ টি ভোট পড়ে চুক্তির বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করে বসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বরাবরে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রটি শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতে বলা হয়। অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদককে না দিয়ে সংবাদ অফিসে চলে যান। জহুর হোসেন চৌধুরীর হাতে তুলে দেন পদত্যাগপত্রটি। যা পরের দিন প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগে অলি আহাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। বৈঠকে অলি আহাদকে বহিষ্কার করা হয়।

 

১৯৫৩ সালে আব্দুর রহমান বহিষ্কার হলে অলি আহাদ প্রচার সম্পাদক হন। ‘৫৫ সালের কাউন্সিলে কোরবান আলীর স্থলে অলি আহাদ সাংগঠনিক হন। অলির পক্ষে  ১১ জন নেতা পদত্যাগ করেন। আইন পরিষদের এসব নেতা  সদস্য হলেন শ্রম সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, মহিলা সম্পাদিকা সেলিনা বানু, ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম, প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান অন্যতম। আওয়ামী লীগ ভাসানীর পদত্যাগ পদ ফিরিয়ে দিয়ে কাউন্সিল ডেকে আবারও সভাপতি করে। ১৬ জুন অসুস্থ ভাসানী হাসপাতাল থেকে এক বিবৃতিতে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। ১৭ জুন অপর এক বিবৃতিতে ২৫ ও ২৬ জুলাই তিনি ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান ‘গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ ডাকেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব ১৩ জুলাই বিবৃতিতে এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যোগদান না করার আহ্বান জানান। ২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। কেন্দ্র ও প্রদেশের সভাপতি হন ভাসানী এবং কেন্দ্রে সাধারণ সম্পাদক করা হয় মাহমুদুল হক ওসমানীকে। প্রদেশে সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদ আলী।

 

এরপর আইন পরিষদ অধিবেশনে ঘটে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা। স্বভাবতই আসে সামরিক শাসন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন তিনি। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন : সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আগে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান একটি শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে গণতন্ত্রের লেশমাত্রও ছিল না। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা এবং এই প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করার জন্য উভয় প্রদেশে ৪০ হাজার করে ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নির্বাচনের বিধান ছিল এই শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান এবং নূরুল আমীনের মতো মুসলিম লীগ নেতাও আইয়ুবের প্রবর্তিত এই শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন (নয় নেতার বিবৃতি, ২৫ জুন ১৯৬২)।

 

১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে গণতন্ত্রের মানুষ পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রহস্যময় মৃত্যু ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদসহ দলের প্রবীণ নেতারা  বিরোধিতা করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ৬ মার্চ প্রায় এক হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মাওলানা তর্কবাগীশকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

 

ঐতিহাসিক ছয় দফা : ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় কনভেনশনে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। এতে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি’ বলে আখ্যায়িত করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, ‘শেখ মুজিবের এসব দাবি অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করতে হবে।

 

শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেনে আহ্বান করেন সামরিক শাসনোত্তর দলের বৃহত্তম কাউন্সিল অধিবেশন। প্রায় পনেরোশ’ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই অধিবেশনেই ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়। এ কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। কাউন্সিল অধিবেশনের পর শেখ মুজিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় দফার প্রচারণায় নেমে পড়েন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করার জন্য সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। গর্জে ওঠে ছাত্রজনতা। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। কারাগার হতে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন শেখ মুজিব। ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন।

 

জেনারেল ইয়াহিয়া খান বসেন প্রেসিডেন্টের গদিতে। অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। যে নির্বাচনে ছয় দফার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলাফলের পর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮টি আসন লাভকারী পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের মূল হোতা।

 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের কাছে শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করে গেলেও পাকিস্তানে গিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেন। “৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান  ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুঁসে উঠে মার্চ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

 

৩ মার্চ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ডাকসু কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের প্রাক্কালে বাংলাদেশ স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বার্তা প্রেরক হিসাবে এম হান্নান এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধের।

 

যে সরকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থ মন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে গঠিত হয়। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী, হুইপ আব্দুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন।

 

এছাড়াও শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স- বিএলএফ) নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্ব ছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নয় মাসের যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় তা অর্জিত হয় তা বঙ্গবন্ধুর নামে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। “৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে দেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল করেন- ‘৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু সভাপতি হয়ে সাধারণ সম্পাদক করেন জিল্লুর রহমানকে। ‘৭৪ সালের কাউন্সিল করে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। এইচ এম কামরুজ্জামানকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক করেন।

 

এরপর বাকশাল প্রতিষ্ঠার কথা আগেই তুলে ধরেছি। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন প্রমুখ নেতা কারাগারে বন্দী থাকায় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় দলের অনুমোদনের জন্য আবেদন পত্র যাবে কার নামে? সেই প্রশ্ন দেয়। সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান নিহত হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। মহিলা সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আইন মন্ত্রণালয় বরাবরে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেন।

 

কিন্তু দলীয় মেনিফেস্টোতে বঙ্গবন্ধুর নাম থাকায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিতে হয় নতুন মেনিফেস্টো ছাপাবার। পীড়াদায়ক হলেও সেদিন আওয়ামী লীগকে “বঙ্গবন্ধুর” নাম বাদ দিয়েই মেনিফেস্টো ছাপিয়ে পুনরায় আবেদন করতে হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়ির ছাদে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবনের বৈঠক করা হয়।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও মিজানুর রহমান চৌধুরী যৌথভাবে দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হলেও ১৯৭৮ সালে আবার কাউন্সিল করা হয়। এতে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পাল্টা কমিটি গঠিত হয়। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) আত্মপ্রকাশ করে।

 

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, তাঁকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ভূমিকাই প্রথম। আওয়ামী যুবলীগের যখন চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু এবং ছাত্রলীগের সভাপতি যখন ওবায়দুল কাদের। গত ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একথা বলেন।

 

১৯৮১ সালের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দিলে তাঁকেসহ বেশকিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক মিলে আবার বাকশাল পুনর্জীবন করেন। আবদুর রাজ্জাক বহিষ্কার হলে  যুগ্ম-সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯২ সালের কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে জিল্লুর রহমানকে নির্বাচিত হন।

 

১৯৯৭ সালের কাউন্সিলেও শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও আবদুল জলিল এবং ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নির্বাচিত হন।

 

২০১৩ সালের কাউন্সিলেও এ দুজনই যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। পরের দুটি কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরই মধ্যে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় আগামী ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল নিয়েও তোরজোড় শুরু হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয় এবং সেটা ২১ বছর পর।

 

২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে চরম নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেলেও আইভি রহমান, মোশতাক আহমেদ সেন্টুসহ ২৪ জন নিহত হয়। ২৯ বার বিভিন্ন হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ওয়ান ইলেভেন সরকারের রোষানলে পড়ে দুবছর কারাবন্দী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোটের আসন ছাড়াই দলগতভাবেই টু-থার্ট মেজরিটি নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করে সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে ফেরা সম্ভব হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তার মূলমন্ত্র স্বাধীনতায় প্রবর্তন করেছে, যাতে লেপ্টে রয়েছে এক সাগর শহীদের রক্ত ও  মা-বোনেরা সম্ভ্রম। শেখ হাসিনার সুদক্ষ শাসনে পৃথিবীর বুক দেশ বাংলাদেশ এক  উন্নয়নের রোল মডেল। আইনের শাসনও প্রাতিষ্ঠানিকরূপলাভ করেছে। বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের। ফাঁসিতে ঝুলেছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। শেখ হাসিনার প্রশংসা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনায়কের মুখে। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে বাংলাদেশের একেকটি অগ্রগতির দিকে। পদ্মাসেতুর দিকে  বিশ্বব্যাংকের অনুকম্পায় নয়, পদ্মাসেতু আজ দৃশ্যমান আমার টাকায়, আমাদের টাকায়। পদ্মার দুপারের চোখ ২৫ জুনের দিকে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী উৎসবের দিকে। পৃথিবীর চোখে বাংলার বুকে পদ্মাসেতু যেনো “অষ্টম আশ্চর্য”। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, আর সেই স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্মে নেয় আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা ও  মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তাঁর নির্দেশিত পথে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক বাংলাভাষা ভিত্তিক একটি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের।

 

ইতিহাসের কী অপূর্ব যোগসূত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা আজ এক ও অভিন্ন সত্তা।

 

আওয়ামী লীগের এ জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি দলটির স্বপ্নদ্রষ্টা গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। প্রায় সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চাইলে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে তিনি সমুজ্জ্বল, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবেই সবার মাথার ওপর। এবং তাঁর ভাষণ জাতিসংঘের স্বীকৃতিতেই আজ বিশ্বের ভাষণ, শোষিতের মুক্তিসংগ্রামের ভাষণ। আওয়ামী লীগ শুভ জন্মদিনে অনিঃশেষ অভিনন্দন তোমায়। তুমি বেঁচে আছো বলেই তো বাংলাদেশের মুখে আজ হাসির ফোয়ারা!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» নির্বাচিত সরকারই দেশ পুনর্গঠন করতে পারে: তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

» ইয়াবাসহ দুইজনকে গ্রেফতার

» বদলে যাচ্ছে ফেসবুক মেসেঞ্জার

» সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

» রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার প্রয়োজন : সেলিমা রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

পৌনে এক শতাব্দীর আওয়ামী লীগ

সোহেল সানি :প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে অর্জিত বাঙালির ভাষা-স্বাধীনতা, সংবিধান ও দেশ-জাতিগঠনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন আর আর তাঁর কন্যার রূপকল্প। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির একবুক জ্বালা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সোনা বাংলা বিনির্মাণে সব অর্জন অবিস্মরণীয় ও অকল্পনীয়। বাঙালির জীবনে সে তো রূপকথার গল্পের ন্যায়। পদ্মাবতী খরস্রোতার নদীর বুকে পদ্মাসেতু উৎসব ধ্বনি প্রতিধ্বনির আকাশে-বাতাসে যে অনুরণন, তা তো  আওয়ামী লীগের মহা অর্জন। সেই আওয়ামী লীগের  ভূমিষ্ঠকালীন বেদনা, মাতৃত্বকালীন প্রসব বেদনার ন্যায় অসহনীয় কষ্টের।

 

আগেই দলের রূপকার করাচি হতে স্টিমারযোগে সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে গতিরোধ করা হয় নারায়ণগঞ্জে। তাকে মানহানিকর অবস্থায় ফিরে যেতে হয় করাচিতে। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুসলিম লীগের নাম “জাতীয়তাবাদী লীগ” রাখার প্রস্তাব করে সদস্য পদ থেকেই বহিষ্কৃত হন। পাকিস্তান প্রস্তাবক সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তিনি। সেই তাঁকেই “ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর” বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান।

 

মুসলিম লীগের সভাপতি খলীকুজ্জমান চৌধুরী সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীদের লীগে প্রবেশ বন্ধ করে দেন।

 

পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পরের বছর ভাষাসংগ্রাম শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে। উপনির্বাচনে বিজয়ী শামসুল হকের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয় পরিষদ সদস্য পদ। তার আগে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের ওই একই আসনে মওলানা ভাসানী বিজয়ী হলেও তাঁর সদস্য পদ কেড়ে নিয়ে নির্বাচনেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

 

এরকম এক বৈরী পরিস্থিতিতে দল গঠনে ডাকা হয় “মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন”। ঢাকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় খান সাহেব ওসমান আলীর অনুপ্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের রহমতগঞ্জ ইনস্টিটিউটে সেখানেও বাধা। তারপর পাইকপাড়া। সেখানেও বিপত্তি। সরকারি পেটোয়া বাহিনীর রক্তচক্ষুর আড়ালে ঢাকা মিউনিসিপাল করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী বশীর হুমায়ুন বললেন, “সম্মেলন করুন আমার রোজগার্ডেন-এ। সরকারি চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্মেলনের দু’দিন আগেই রাতের আঁধারে শওকত আলী গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে ভাসানীকে পৌঁছে দেন রোজগার্ডেনে।

 

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুনের ঢাকার স্বামীবাগের বিখ্যাত রোজ গার্ডেন। প্রায় তিনশত কর্মীর ওই সম্মেলনে প্রথমে পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত পরিবেশন করেন মওলানা রাগীব আহসান। শামসুল হক “মূল দাবি” নামে একটি  প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ কেবল মুসলমানের নয়, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। ……  মানবতার চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এক কাতারে সমবেত হইতেই মুসলিম লীগ কর্মী-সম্মেলন আহ্বান জানাইতেছে। “পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে দল গঠনের ঘোষণা দেয়া হলে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় কর্মীরা। সম্মেলন চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

 

সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এককালীন সভাপতি অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে নবগঠিত দলকে স্বাগত জানিয়ে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করে চলে যান। তখন চলছিল পাকিস্তানে চরমতম রাজনৈতিক সংকট। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে প্রথমে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববাংলাকে বেছে নেয়া হয় দল গঠনের জন্য। পাকিস্তান প্রস্তাবক স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলগঠনের মূল ভরসা। বাংলার প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় সর্বস্ব হারিয়ে করাচিতে আসেন। তাঁর ওপর পড়লো পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আড়চোখ। অথচ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলায় কেবল নিরঙ্কুশ জয় পায়। সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ববাংলায় নিষিদ্ধ করলেন যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সেই তিনি গণপরিষদের সদস্য হন সোহরাওয়ার্দীরই ছেড়ে দেয়া কলকাতার আসনের উপ-নির্বাচনে। এরপর ১৯৪৯ সালের ৯ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলা আসেন। তিনি পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কপার্স মামলা পরিচালনার কথা বলে। তিনি একান্ত অনুগামী শওকত আলীর পরামর্শে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের পুরানো ঢাকায় “নূরজাহান বিল্ডিং” এসে ওঠেন। পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীর মুসলিম লীগের নবীন কর্মীরা দলের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা জানান নেতাকে। সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে ইতিপূর্বে টাঙ্গাইলে ফেরা আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ঢাকায় ঘাটি বাঁধতে বলেন। শাহজাহানের বাসায় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে দলগঠন নিয়ে শলাপরামর্শ হয়। মওলানা ভাসানী আসামের ধুবড়ী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং আলী আমজাদ খানের বাসায় ওঠেন। যাহোক বৈঠকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমেদ, ঢাকার শওকত আলী, আলী আমজাদ খান, খন্দকার আব্দুল হামিদ ও ইয়ার মোহাম্মদ খানও ছিলেন। বৈঠকে প্রস্তুতি কমিটি গঠন নিয়ে শুরুতেই বিরোধ হয়। আলী আমজাদ খানকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করা হলে শওকত আলী ও খন্দকার আব্দুল হামিদ বিরোধিতা করেন। পরে মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। খান সাহেব ওসমান আলীর আশ্বাসের বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে না পারলেও তাঁরই  দিকনির্দেশনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। নিজে সভাপতির আসন অলংকৃত করে অবাঙালি মাহমুদুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি করা হয়

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। শামসুল হককে  সাধারণ সম্পাদক করে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। পাঁচজন সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, আলী আহমেদ খান ও আব্দুস সালাম খান। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও আরেকজন ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সহ যুগ্ম সম্পাদক করা হয় এ কে রফিকুল হোসেনকে। পরের দিন আরমানীটোলায় জনসভা করা হলো। কিন্তু সরকারের ঈশারায় সেই ২৪ জুনের জনসভায় বাদশা বাহিনীর দল হামলা চালালো। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দ্বিতীয় জনসভাও আরমানীটোলায়। ওদিন ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে আরমানীটোলা থেকে  আওয়ামী মুসলিম লীগ বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে গর্ভনর হাউজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গ্রেফতার হন ভাসানী, শামসুল হকসহ অনেক নেতা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ মুজিব করাচিতে নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছে চলে গেলেও এসেই গ্রেফতার হন।

 

১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে ঢাকার ৯০ নবাবপুর একটা রুমে দুইটা টুল একটা টেবিল, দুইটা চেয়ার নিয়ে অফিস খুলে বসেন। ওখানে দলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ভবঘুরে মোহাম্মদউল্লাহ (পরে রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি) কাজ চাইলে শেখ মুজিব তাকে দপ্তর সম্পাদক করেন।

 

ছাত্রলীগই কার্যত আওয়ামী লীগের মাতৃসংগঠন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার কারণে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ এই দল।

 

পাকিস্তানি শাসকবর্গ এবং মুসলিম লীগ নতুন দলটির আবির্ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীকে ‘ভারতীয় চর’ বলে প্রচার চালিয়ে বাঙালিদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪০ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি দলকে দ্রুত একটি শক্তিমান সংগঠনে পরিণত করতে থাকে।

 

নতুন দলটির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার (যার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন ও সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন) সন্ত্রাস, গোলযোগ সৃষ্টি এবং দমন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। তারা আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে নতুন দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। তবুও দলটি বিকশিত হতেই থাকে। প্রতিরোধের মুখে পড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগ্রামী দল হিসেবে আরও দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। চলতে থাকে তাদের গণমুখী আন্দোলন-সংগ্রাম।

 

আগেই বলেছি মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর এবং শেখ মুজিবকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সর্বপর্যায়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে। শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবিতে কারাগারের ভিতর অনশন শুরু করেন। এতে আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান। একই বছর পুনরায় ভাসানী ও শামসুল হক গ্রেফতার হন। কারাগারে শামসুল হকের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

“প্রথম কাউন্সিল”

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষণায় আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকারসহ পূর্ব বাংলার জন্য লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে কৃষি জমির বণ্টন, তে-ভাগা নীতির বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সমবায় ও যৌথ কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সব দেশি ও বিদেশি মৌলিক শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকারও ছিল এ ঘোষণায়। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে পূর্ব-বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে অন্য দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগ শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। পরে এই ফ্রন্টে আরও যুক্ত হয় গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ঘোষণায় পূর্ববাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দাবি আদায়ের কথা বলা হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৭টি আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। এর মধ্যে ১৪৩টি আসন পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। কৃষক-শ্রমিক পার্টি লাভ করে ৪৮টি আসন। মুসলিম লীগ মাত্র ১০টি আসন পায়।

 

একই বছরে ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় ফজলুল হক মন্ত্রীসভা। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে এতে যোগ না দিলেও পরে আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রী করা হয়। যুক্তফ্রন্ট তথা আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্য এই নির্বাচনী বিজয় যুগান্তকারী ঘটনা হলেও পরবর্তীতে ফ্রন্ট ও দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

কেন্দ্রীয় সরকার এই সুযোগে ৯২-ক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতাও নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়।

“দ্বিতীয় কাউন্সিল”

মওলানা ভাসানী ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন পল্টন ময়দানের সমাবেশ এবং ২৩ জুন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পূর্ব বাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ আগের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। দলের হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার শক্তিশালী সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর (১৯৫৫) ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক ও অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়।

 

এ অধিবেশনেই দলকে অসাম্প্রদায়িক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বাতিলের দাবিতে ১৯৫৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রস্তাব তোলে। প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৭ সদস্যের মধ্যে ২০০ জন এতে স্বাক্ষর দেন। বাধ্য হয়ে আবু হোসেন সরকার ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার পতন১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১২ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার। বৈদেশিক সিয়াটো চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে।

 

প্রসঙ্গত: সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর দ্বন্দ্বের আগে যুক্তফ্রন্টের দ্বন্দ্ব ও কোন্দল পাকিস্তানের রাজনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, পূর্বপাকিস্তান আইন পরিষদের নেতা হবেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নেতা হবেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইল দক্ষিণ আসনের নির্বাচনে জমিদার খুররম খানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েও অকৃতকার্য হওয়ার পরই ঘোষণা করেছিলেন তিনি কোনদিন নির্বাচন করবেন না। সে কথা তিনি রেখেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৩ টি আসন পেলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৮ আসন পাওয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির শেরেবাংলাকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের সুযোগ দেন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী নেতৃত্ব।

 

কিন্তু বিস্ময়করভাবে শেরেবাংলা তার দলের পাঁচজনকে নিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৫ দিনের মাথায় শেরেবাংলা আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। আর সেই সময় পাকিস্তানী চক্রান্তে আদমজীতে লাগানো হয় দাঙ্গা। বিহারী-বাঙালী দাঙ্গা। বহু প্রাণ ঝরে পড়ে ওই দাঙ্গায়। মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২- ক ধারা জারি করে শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রের অধীনে নেয়া হয়। পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে গা দেন বাঙালী নেতারাও। শেরেবাংলা পূর্বপাকিস্তানের গর্ভনর হয়ে কৃষক-শ্রমিক পাটি ও আওয়ামী লীগকে দিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব আইন পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তাতে সরকারের পতন ঘটে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে আওয়ামী লীগ। মুখ্যমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান। আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন, হাশিমুদ্দিন আহমেদ, কংগ্রেস দলের মনোরঞ্জন ধর, গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী মন্ত্রিসভায় স্থান পান। বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। একবার আওয়ামী লীগ আরেকবার কৃষক-শ্রমিক পার্টি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের ২৩ জন আইন পরিষদ সদস্য শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করে মন্ত্রিত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাদগ্রহণ করে আবু হোসেন সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শেরেবাংলার সরকারে যোগ দিয়ে এর মধ্যে হাশিমুদ্দিন মন্ত্রী হন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ চিফ হুইপ এবং খালেক নেওয়াজ খান হুইপ হন। সর্বশেষ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তখন সারা পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ক্ষমতায়। ডাঃ খান সাহেবের রিপাবলিকান পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন ইস্কান্দার মির্জা। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক খাজা নাজিমুদ্দিনের পতনের পর বাঙালি মোহাম্মদ আলী, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফিরোজ খান নুন ও আই আই চুন্দ্রিগর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেন। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ১৩ মাসের অধিক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী বিরোধ এ সময় চরমে পৌঁছে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। ভাসানী সিয়াটো চুক্তি মানছিলেন না। দলের নেতৃত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তাঁর অনুসারীরা ভাসানীকে উস্কে দিচ্ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে অলি আহাদ উঠে আসার জন্য বিশেষভাবে কলকাঠি নাড়ছিলেন।
এক পর্যায়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে অলি আহাদ প্রশ্ন তুলেন যে, গঠনতন্ত্রে স্পষ্টত বলা রয়েছে যারা মন্ত্রী হবেন তারা কেউ দলীয় পদে থাকবেন না। মূলত, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছিল যে মন্ত্রিত্ব রেখে শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দেবেন, কিন্তু সে ধারণার মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিব মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেয়ায়। এরপরই শুরু হয় নতুন চক্রান্ত।

 

প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর এক ইউনিট ফর্মুলা ও সিয়াটো চুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগে চরম বিরোধ দেখা দেয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রকৃতঅর্থে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ‘৫৫ সালে যখন দলকে না জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর আইনমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। শুধু তিনিই নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন শেরেবাংলাও। করাচিতে সাংবাদিকরা নবনিযুক্ত আইনমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে প্রশ্ন করেন যে, মন্ত্রীত্বগ্রহণ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো পরিপন্থী কিনা? সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, “আওয়ামী লীগ আবার কি, আমিই আওয়ামী লীগ, আমিই মেনিফেস্টো আমিই গঠনতন্ত্র।” আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও সোহরাওয়ার্দীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কোন নেতা টু-টা শব্দটি উচ্চারণ না করলেও দলীয় নেতৃত্বে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। কাউন্সিলে সিয়াটো চুক্তি বিপক্ষে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হলে সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে পড়ে ৫০০ ভোট, অপরদিকে ৩৫ টি ভোট পড়ে চুক্তির বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করে বসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বরাবরে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রটি শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতে বলা হয়। অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদককে না দিয়ে সংবাদ অফিসে চলে যান। জহুর হোসেন চৌধুরীর হাতে তুলে দেন পদত্যাগপত্রটি। যা পরের দিন প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগে অলি আহাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। বৈঠকে অলি আহাদকে বহিষ্কার করা হয়।

 

১৯৫৩ সালে আব্দুর রহমান বহিষ্কার হলে অলি আহাদ প্রচার সম্পাদক হন। ‘৫৫ সালের কাউন্সিলে কোরবান আলীর স্থলে অলি আহাদ সাংগঠনিক হন। অলির পক্ষে  ১১ জন নেতা পদত্যাগ করেন। আইন পরিষদের এসব নেতা  সদস্য হলেন শ্রম সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, মহিলা সম্পাদিকা সেলিনা বানু, ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম, প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান অন্যতম। আওয়ামী লীগ ভাসানীর পদত্যাগ পদ ফিরিয়ে দিয়ে কাউন্সিল ডেকে আবারও সভাপতি করে। ১৬ জুন অসুস্থ ভাসানী হাসপাতাল থেকে এক বিবৃতিতে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। ১৭ জুন অপর এক বিবৃতিতে ২৫ ও ২৬ জুলাই তিনি ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান ‘গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ ডাকেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব ১৩ জুলাই বিবৃতিতে এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যোগদান না করার আহ্বান জানান। ২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। কেন্দ্র ও প্রদেশের সভাপতি হন ভাসানী এবং কেন্দ্রে সাধারণ সম্পাদক করা হয় মাহমুদুল হক ওসমানীকে। প্রদেশে সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদ আলী।

 

এরপর আইন পরিষদ অধিবেশনে ঘটে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা। স্বভাবতই আসে সামরিক শাসন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন তিনি। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন : সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আগে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান একটি শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে গণতন্ত্রের লেশমাত্রও ছিল না। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা এবং এই প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করার জন্য উভয় প্রদেশে ৪০ হাজার করে ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নির্বাচনের বিধান ছিল এই শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান এবং নূরুল আমীনের মতো মুসলিম লীগ নেতাও আইয়ুবের প্রবর্তিত এই শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন (নয় নেতার বিবৃতি, ২৫ জুন ১৯৬২)।

 

১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে গণতন্ত্রের মানুষ পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রহস্যময় মৃত্যু ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদসহ দলের প্রবীণ নেতারা  বিরোধিতা করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ৬ মার্চ প্রায় এক হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মাওলানা তর্কবাগীশকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

 

ঐতিহাসিক ছয় দফা : ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় কনভেনশনে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। এতে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি’ বলে আখ্যায়িত করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, ‘শেখ মুজিবের এসব দাবি অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করতে হবে।

 

শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেনে আহ্বান করেন সামরিক শাসনোত্তর দলের বৃহত্তম কাউন্সিল অধিবেশন। প্রায় পনেরোশ’ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই অধিবেশনেই ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়। এ কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। কাউন্সিল অধিবেশনের পর শেখ মুজিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় দফার প্রচারণায় নেমে পড়েন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করার জন্য সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। গর্জে ওঠে ছাত্রজনতা। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। কারাগার হতে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন শেখ মুজিব। ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন।

 

জেনারেল ইয়াহিয়া খান বসেন প্রেসিডেন্টের গদিতে। অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। যে নির্বাচনে ছয় দফার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলাফলের পর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮টি আসন লাভকারী পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের মূল হোতা।

 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের কাছে শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করে গেলেও পাকিস্তানে গিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেন। “৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান  ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুঁসে উঠে মার্চ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

 

৩ মার্চ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ডাকসু কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের প্রাক্কালে বাংলাদেশ স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বার্তা প্রেরক হিসাবে এম হান্নান এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধের।

 

যে সরকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থ মন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে গঠিত হয়। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী, হুইপ আব্দুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন।

 

এছাড়াও শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স- বিএলএফ) নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্ব ছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নয় মাসের যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় তা অর্জিত হয় তা বঙ্গবন্ধুর নামে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। “৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে দেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল করেন- ‘৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু সভাপতি হয়ে সাধারণ সম্পাদক করেন জিল্লুর রহমানকে। ‘৭৪ সালের কাউন্সিল করে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। এইচ এম কামরুজ্জামানকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক করেন।

 

এরপর বাকশাল প্রতিষ্ঠার কথা আগেই তুলে ধরেছি। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন প্রমুখ নেতা কারাগারে বন্দী থাকায় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় দলের অনুমোদনের জন্য আবেদন পত্র যাবে কার নামে? সেই প্রশ্ন দেয়। সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান নিহত হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। মহিলা সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আইন মন্ত্রণালয় বরাবরে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেন।

 

কিন্তু দলীয় মেনিফেস্টোতে বঙ্গবন্ধুর নাম থাকায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিতে হয় নতুন মেনিফেস্টো ছাপাবার। পীড়াদায়ক হলেও সেদিন আওয়ামী লীগকে “বঙ্গবন্ধুর” নাম বাদ দিয়েই মেনিফেস্টো ছাপিয়ে পুনরায় আবেদন করতে হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়ির ছাদে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবনের বৈঠক করা হয়।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও মিজানুর রহমান চৌধুরী যৌথভাবে দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হলেও ১৯৭৮ সালে আবার কাউন্সিল করা হয়। এতে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পাল্টা কমিটি গঠিত হয়। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) আত্মপ্রকাশ করে।

 

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, তাঁকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ভূমিকাই প্রথম। আওয়ামী যুবলীগের যখন চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু এবং ছাত্রলীগের সভাপতি যখন ওবায়দুল কাদের। গত ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একথা বলেন।

 

১৯৮১ সালের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দিলে তাঁকেসহ বেশকিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক মিলে আবার বাকশাল পুনর্জীবন করেন। আবদুর রাজ্জাক বহিষ্কার হলে  যুগ্ম-সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯২ সালের কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে জিল্লুর রহমানকে নির্বাচিত হন।

 

১৯৯৭ সালের কাউন্সিলেও শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও আবদুল জলিল এবং ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নির্বাচিত হন।

 

২০১৩ সালের কাউন্সিলেও এ দুজনই যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। পরের দুটি কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরই মধ্যে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় আগামী ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল নিয়েও তোরজোড় শুরু হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয় এবং সেটা ২১ বছর পর।

 

২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে চরম নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেলেও আইভি রহমান, মোশতাক আহমেদ সেন্টুসহ ২৪ জন নিহত হয়। ২৯ বার বিভিন্ন হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ওয়ান ইলেভেন সরকারের রোষানলে পড়ে দুবছর কারাবন্দী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোটের আসন ছাড়াই দলগতভাবেই টু-থার্ট মেজরিটি নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করে সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে ফেরা সম্ভব হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তার মূলমন্ত্র স্বাধীনতায় প্রবর্তন করেছে, যাতে লেপ্টে রয়েছে এক সাগর শহীদের রক্ত ও  মা-বোনেরা সম্ভ্রম। শেখ হাসিনার সুদক্ষ শাসনে পৃথিবীর বুক দেশ বাংলাদেশ এক  উন্নয়নের রোল মডেল। আইনের শাসনও প্রাতিষ্ঠানিকরূপলাভ করেছে। বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের। ফাঁসিতে ঝুলেছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। শেখ হাসিনার প্রশংসা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনায়কের মুখে। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে বাংলাদেশের একেকটি অগ্রগতির দিকে। পদ্মাসেতুর দিকে  বিশ্বব্যাংকের অনুকম্পায় নয়, পদ্মাসেতু আজ দৃশ্যমান আমার টাকায়, আমাদের টাকায়। পদ্মার দুপারের চোখ ২৫ জুনের দিকে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী উৎসবের দিকে। পৃথিবীর চোখে বাংলার বুকে পদ্মাসেতু যেনো “অষ্টম আশ্চর্য”। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, আর সেই স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্মে নেয় আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা ও  মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তাঁর নির্দেশিত পথে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক বাংলাভাষা ভিত্তিক একটি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের।

 

ইতিহাসের কী অপূর্ব যোগসূত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু এবং আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা আজ এক ও অভিন্ন সত্তা।

 

আওয়ামী লীগের এ জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি দলটির স্বপ্নদ্রষ্টা গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। প্রায় সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চাইলে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে তিনি সমুজ্জ্বল, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবেই সবার মাথার ওপর। এবং তাঁর ভাষণ জাতিসংঘের স্বীকৃতিতেই আজ বিশ্বের ভাষণ, শোষিতের মুক্তিসংগ্রামের ভাষণ। আওয়ামী লীগ শুভ জন্মদিনে অনিঃশেষ অভিনন্দন তোমায়। তুমি বেঁচে আছো বলেই তো বাংলাদেশের মুখে আজ হাসির ফোয়ারা!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com