দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনতে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ প্রবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। বলা হচ্ছে, এটা জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে এটি কার্যকর করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। চলতি বাজেট অধিবেশনে এটি পাসের পর পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করে দ্রুত কাজ শুরু করতে চায় সরকার। তবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এর আওতাভুক্ত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বাজেট অধিবেশনে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ পাস করতে চায় সরকার। এটি পাসের পর অথরিটি গঠন করা হবে, এরপর নিয়োগ করা হবে জনবল। পরে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়াসহ সব কার্যক্রম শেষে আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে এটি শুরু করা হবে। তবে প্রথমদিকে এটি পরীক্ষামূলকভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চালু হবে, বিস্তৃত করা হবে পরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সর্বজনীন পেনশনের একটি সিস্টেম তৈরি করতে হবে। এখানে লোক নিয়োগের বিষয় রয়েছে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। এরপর বৃহৎ আকারে শুরু হবে। আমাদের টার্গেট আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে করা। এটি যে ধরনের কাজ তাতে এমনিতেই দুই বছর লাগে। আগামী বছরের জুনের আগে এটি শুরু হবে। ভারত ২০০৪ সালে উদ্যোগ নিয়ে ২০১২-১৩ সালে আইন করতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত সেটি খুব বেশি কার্যকর করতে পারেনি। এটি চালু করতে সময় লাগবে।
‘আর চালু করলেই প্রথমদিকে লোকজন আসবে না। মানুষকে আগে বিষয়টি বোঝাতে হবে। তারপর মানুষ এমনিতেই আসবে। যারা উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত, তাদের এটি তেমন দরকার নেই। কিন্তু আমাদের টার্গেট তো দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যাদের শেষ বয়সে কিছু করার থাকে না। তাদের বিশ্বাস আনাতে সময় লাগবে। তারা তাৎক্ষণিক সুবিধার কথা ভাববেন। আমরা টাইমফ্রেম অনুযায়ী কাজ করছি।’
এদিকে গত ৯ জুন সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আমি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলাম। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি যে, সরকার আগামী অর্থবছর সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যও একই সুযোগ রাখা হচ্ছে। আপনারা জানেন বাংলাদেশের অনেক অর্জন। সেই অর্জনের সঙ্গে আজ যুক্ত হলো আরও একটি অর্জন। সেটা হলো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, সরকারের শেষ বছরে সর্বজনীন পেনশনের উদ্যোগ নিলে যদি নতুন সরকার আসে, তাহলে তাদের জন্য এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। আমাদের ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে। কিন্তু ট্যাক্স দিয়ে নাগরিকরা যেন সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ উন্নত বিশ্বে নাগরিকরা ট্যাক্স দেন, রাষ্ট্র তাদের সেবা দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে ট্যাক্স দেওয়ার পর সেবা পাবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কারণ ট্যাক্সও দিচ্ছে, আবার সন্তানের স্কুলের টিউশন ফিও এখানে দিতে হচ্ছে। ট্যাক্স দেওয়ার পরও ডাক্তার দেখাতে গেলে তাকে ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য বলা হয়।
কারা সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হবেন
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক এ পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন। সময়কাল ও মাসিক চাঁদার অনুপাত অনুযায়ী পেনশনধারীরা অবসরকালে মাসিক পেনশন সুবিধা পাবেন।
কে কত জমা করতে পারবেন, পেনশন কত পাবেন
কেউ যদি ১৮ বছর বয়সে পেনশন হিসাবে এক হাজার টাকা করে চাঁদা জমা শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা জমা দেন তাহলে অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা হারে পেনশনের টাকা পাবেন।
আবার কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে পেনশন হিসাবে টাকা জমা দিতে শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা জমা করেন, তাহলে অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন। সেক্ষেত্রে মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা করে পাবেন পেনশনধারীরা। তবে চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে একজন মানুষ তার সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০০, ১০০০, ১৫০০, ২০০০, ২৫০০, ৩০০০, ৩৫০০ ও ৪০০০ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারবেন।
জানা যায়, বর্তমানে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করছি। আমাদের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তির অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ভরশীলতার হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে।
পেনশনে থাকা অবস্থায় মারা গেলে কী হবে?
‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ এর খসড়ায় বলা হয়েছে, কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই নিবন্ধিত চাঁদাপ্রদানকারী মারা গেলে জমা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়সের আগে মারা গেলে তার নমিনি বাকি সময়ের মাসিক পেনশনের টাকা পাবেন। পেনশন স্কিমে জমা করা অর্থ কোনোভাবেই কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমা অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তোলা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।
এছাড়া সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া সাপেক্ষে নিম্নআয়ের নাগরিক অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ অনুদান হিসেবে দিতে পারবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন বিষয়ে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, উদ্যোগটা খুবই ভালো। তবে নিশ্চিত করতে হবে সবাই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। চাঁদার ব্যাপারে যেটা বলা হয়েছে এক হাজার টাকা, সেটা তো অনেক মানুষ দিতে পারবে না। সুতরাং দরিদ্র পিছিয়ে পড়া মানুষ যারা, তারা তো অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। যদি টাকা থাকেও তারা ব্যাংকে যেতে পারে না, কীভাবে সেটি দেবে তা নিশ্চিত করতে হবে, নইলে তারা দিতে পারবে না। এটা বাংলাদেশের অনেকেই দিতে পারবে না এবং দেওয়ার পদ্ধতিও কঠিন। সুতরাং এটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, যাদের অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে তারা দিতে পারবে। কিন্তু সর্বজনীন মানে তো সবাইকে নিতে হবে। অথবা এটাকে যারা নিম্নআয়ের, তাদের আলাদা করা যেতে পারে। এই জায়গায় একটা পুনর্বিবেচনার বিষয় আছে। এটার জন্য যে তহবিল গঠন করা হবে সেটা যেন সঠিক ব্যবস্থাপনায় হয়। এখানে যেন ভিন্ন কিছু না হয়। অনেক সময় অনেক ভালো উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে যে রকম হওয়ার কথা, সেরকম হয় না। কিছু অসৎ মানুষ এটাকে অন্যপথে নিয়ে যায়।জাগো নিউজ