আসুন আমরা লজ্জা পাই!

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): লজ্জা নারীর ভূষণ। এ কথাটির মর্মার্থ ছোটবেলায় বুঝতাম না। ভাবতাম ভালোই তো, সুন্দর কথা। এখন মনে হয় এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও বিদ্বেষপূর্ণ কথা। নারী জাতিকে ঘর এবং কালো বোরকার ভিতরে আবদ্ধ রাখা একটা কদার্য, অসভ্য পুরুষ কর্তৃত্ববাদিতার বহিঃপ্রকাশ। নারী হলেই তাকে লজ্জা পেতে হবে, আর পুরুষের লজ্জার বালাই থাকার প্রয়োজন নেই।  একচেটিয়া ইনডেমনিটি বা অব্যাহতি আর কী। কিন্তু এদিন আর সেদিন নেই। অদম্য নারীরা আজ শেকল ভাঙার সংগ্রাম করছে এবং তাতে অগ্রগতি অনেক। তবে হেফাজত নেতা প্রয়াত আহমদ শফীর হাজার লাখো অনুসারী এখনো হুঙ্কার ছাড়ছে। জামায়াত হেফাজতের তীর্থস্থান তালেবানি আফগানিস্তান। সেখানে তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সব নারীকে আবার অন্ধকারে বন্দি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশি তালেবানরা তাতে উৎসাহিত। কিন্তু আমার কথা অন্য জায়গায়। সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদেরই তো লজ্জিত হওয়ার কথা, যারা অনৈতিক কাজ করে, মিথ্যা কথা বলে, ঘুষ খায়, জোতচুরি-পুকুরচুরি থেকে শুরু করে দেশের জনমানুষ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় এবং ষড়যন্ত্র করে। হীনব্যক্তি স্বার্থে, হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে যারা চক্রান্ত ও মিথ্যাচার করে, লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে সামান্যতম লজ্জার রেশ নেই; উন্নত বাংলাদেশের ভিত্তি ও সোপান পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পকে ঘিরে তার একটা ঘৃণ্য বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। আরও ইস্যু আছে, তবে এটাই আজকের আলোচ্য বিষয়। পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু শুরুতে ২০১২-২০১৩ সালের অতি পরিচিত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এবং বাহ্যিকভাবে সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি কোমর বেঁধে মাঠে নামলেন, পদ্মা সেতু শেখ হাসিনা সরকারের সময় কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য কূটতন্ত্র প্রয়োগসহ যত মিথ্যাচার যেখানে যা করা দরকার করতে হবে। পদ্মা সেতু ঠেকাতে সেদিন তিনারা জিহাদে নামলেন। এনারা সবাই বিদেশি শক্তিবর্গের অতি প্রিয় সুবোধজন। তবে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, ঝড়-তুফান, সাইক্লোন, বন্যায় কোনো দিনও তিনাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। অথচ রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যেকেই সম্মানীয় পন্ডিত। এনারা এক সময়ে মনে করলেন, রাজনীতি যারা করেন তারা সবাই দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য এবং দেশবিরোধী। তাই রাজনীতিবিদদের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। সুতরাং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনারা একবার বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে পড়লেন। কেউ প্রত্যক্ষভাবে আবার কেউ পরোক্ষভাবে। বললেন, জরুরি আইন দুই বছর কেন, দেশের কল্যাণে প্রয়োজন হলে অনির্দিষ্টকাল চলতে কোনো অসুবিধা নেই। খুব ভালো ভালো কথা শুনে প্রথমে মানুষ তাদের স্বাগত জানালেন। কিন্তু কিছু দিন যেতেই মানুষের কাছে তাদের আসল স্বরূপ ধরা পড়তে থাকে। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলকে ভেঙে চুরমার করতে উদ্যত হলেন। অভিজ্ঞ, পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে ঢোকালেন। গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করার জন্য জনসম্পর্কহীন কিছু ব্যক্তির দ্বারা কয়েকটি কিংস পার্টি তৈরি করলেন। ঘোষণা দিলেন এবার তিনারা সব ঠিক করে ফেলবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবলিত রাজনীতিকেই তিনারা প্রধান প্রতিবন্ধক ধরে নিলেন। সুতরাং শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় করার জন্য শুরু হয় খামখেয়ালি, অবৈধ ও বেআইনি সব ঔদ্ধত্য  আচরণ। এক সময়ে বন্দি করলেন শেখ হাসিনাকে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা, জনসম্পর্কহীন ও রাজনৈতিক শেকড়বিহীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা এ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও দেশের ভালো হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের বেলায়ও সেটিই ঘটল। ধুলা দূর করতে গিয়ে তিনারা পুরো বাংলাদেশকে ধূলিময় করে ফেললেন। জনমানুষ ক্ষেপে গেল। সংবিধানের ব্যারিস্টারি ব্যাখ্যা মানুষ ছুড়ে ফেলে দিল। বিপদ বুঝতে পেরে তিনারা চুপ করে নীরবে বিদায় নিলেন। কিন্তু লজ্জা পেলেন না। বিশাল জনম্যান্ডেট নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের শুরুতে ক্ষমতায় এলো। দুঃসাহসী প্রকল্প পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রকল্প নিলেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বড় বড় কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদানে চুক্তিবদ্ধ হলো। প্রকল্প থেকে শুরু করে সব কাগজপত্র তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিল, পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতি বছর শতকরা ১.২ হারে বৃদ্ধি পাবে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগের সেন্টার অব গ্র্যাভেটি বা ভরকেন্দ্র হবে পদ্মা সেতু। তারপর বর্ধিত হয়ে এটি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর সহজ সংযোগ ঘটাবে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোজিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও কানেকটিভিটির হাব বা কেন্দ্র হবে পদ্মা সেতু এবং তার দুই পাড়ের এলাকা। সেখানে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের আধুনিক সিটি ও শিল্পাঞ্চল। নতুন প্রজন্মের জন্য বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ থেকে শেখ হাসিনাকে আর বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সুতরাং তিনারা ওই সেই পুরনো ব্যারিস্টার, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মহান সৈনিকগণ প্রমাদ গুনলেন। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বড় কিছু নয়, শেখ হাসিনাকে হটাতে হলে পদ্মা সেতু ঠেকাতে হবে। কী করা যায়। ভাবতে ভাবতেই উত্তম এক পন্থা আবিষ্কার করলেন। দুর্নীতি বাংলাদেশে যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং যে দেশে এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে অবৈধ এবং তদ্বীয় কালো টাকাকে জরিমানা দিয়ে সাদা করতে পারে, সে দেশে কারও লুকায়িত কোনো উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার মতো সহজ অন্য কিছু আর হতে পারে না। সংগত কারণেই মানুষও সহজে সেটি বিশ্বাস করতে চাইবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক চীনের একটি ভুয়া অদক্ষ, অযোগ্য কোম্পানিকে মূল সেতুর কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। ফলে বিশ্বব্যাংকের ভয়ানক গোস্সা হয়। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। বাংলাদেশের ওই তিনারা এবং বিশ্বব্যাংক একজোট হয়ে গেল। অভিযোগ তুললেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভয়ানক, বিশাল দুর্নীতি হয়েছে। প্রত্যেক দিন টেলিভিশনের পর্দায় এবং দৈনিক পত্রিকায় তিনারা একেকজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিস্তর বক্তব্য ও লেখালেখি করতে লাগলেন। তথাকথিত টিআরপি বাড়াতে টেলিভিশনগুলো উল্লসিত হয়ে অনবরত তিনাদের কথা প্রচার করতে লাগল। তিনারা বলতে থাকলেন, এত বড় দুর্নীতি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, সংশ্লিষ্টদের লজ্জা পাওয়া উচিত। আরও কতকিছু। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, জেলে ঢোকাতে হবে। ঝি-কে মেরে বউকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল আর কী। একজন মন্ত্রীর চাকরি গেল, একজন সচিবকে জেলে যেতে হলো। তাতেও তিনারা সন্তুষ্ট নন। ২০১৩ সালের জুন মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ চুক্তি বাতিল করে দিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৩ সালের ২ জুলাই সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তিনি কারিগরি টিমের প্রধান ছিলেন। নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্পের সব প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক একটা প্রাঞ্জল চিত্র তিনি লেখায় তুলে ধরেন। লেখাটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন কোনো প্যাকেজের কোনো প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো শর্টকাট বা নিয়মবিধির সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটেনি এবং ঘটার সুযোগও ছিল না। সব পর্যায়ে মাল্টি ডাইমেনশনাল চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রাখা হয়। বিশ্বব্যাংক সব পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে এবং অনুমোদন দিয়েছে। জামিলুর রেজা চৌধুরীর লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন বিশ্বব্যাংক কেন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, যার একটি কারণ ওপরে উল্লেখ করেছি। জাতির এই কঠিন দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার মূর্তিতে হাজির হন। বললেন, পদ্মা সেতু হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারও থেকে ঋণ নেওয়া হবে না। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। দেশের এত বড় সর্বনাশ করার পরেও বাংলাদেশের তিনারা সামান্যতম লজ্জা অনুভব করলেন না। এবার বলা শুরু করলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করলে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ধস নামবে এবং আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং দুর্ভিক্ষ হবে। বিশেষজ্ঞ পন্ডিতি কর্তৃত্বে রীতিমতো ভয় দেখালেন। বললেন, সর্বনাশ, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করা ঠিক হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তো শেখ মুজিবের মেয়ে। তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। অদম্য মনোবল, অসীম আত্মবিশ্বাস, কঠিন সততা ও দেশের মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধুর কন্যা সুদৃঢ় সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু হবে। শুরু হয়ে গেল নির্মাণ কর্মযজ্ঞ। আবার প্রমাণিত হয়, জাতির ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রের টপ নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক সাহস এবং মানুষের প্রতি দরদ থাকলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় এবং ইতিহাস সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রের মোড় ঘুরে যায়। তারপর শত বছরেও সেই জাতিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। ১৯৭১ সালের ভয়াবহ সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন এবং নিজের জীবন তুচ্ছ করে যদি যথাসময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা না করতেন তাহলে বাংলাদেশ কোনো দিন স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছেন তাদের বিচার করেছেন এবং পাহাড়সম ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলেই বাংলাদেশ আজ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু চিরদিন জাতীয় গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে থাকবে। গত ২৪ মে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ২৫ জুন পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে সারা দেশের মানুষ উৎফুল্ল ও আনন্দিত। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। শেখ হাসিনা আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে জাগ্রত করেছেন বলেই পদ্মা সেতু হয়েছে এবং বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর ঘোষণার পর ২৪ মে সন্ধ্যায় একটা জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল ওই তিনাদের সেই সময়ের সব বক্তব্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখিয়েছে। মানুষ পুনরায় দেখতে পেয়েছে তিনারা পদ্মা সেতু নির্মাণ ঠেকাতে তখন কত বড় মিথ্যাচার করেছেন। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাক্ষাৎ প্রমাণ। কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি লাভালিনকে জড়িয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় কানাডার ফেডারেল আদালতে মামলা হয়। দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানির পর কানাডার ফেডারেল আদালত ২০১৭ সালে রায় দেন এই মর্মে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আদালত উল্লেখ করেন, সবই ছিল সাজানো গালগল্প কিন্তু দুঃখজনক হলো চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য পদ্মা সেতুর উদ্বোধন প্রায় তিন বছর পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশে যদি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি থাকত তাহলে তিন বছরে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার সবকিছু ওই বাংলাদেশি তিনাদের কাছ থেকে আদায় করা যেত। কিন্তু সেটা তো হবে না। অন্তত এ ব্যাপারে একটা যথার্থ শ্বেতপত্র তৈরি করে সবকিছু জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। বিশ্বব্যাংক বৈশ্বিক সংস্থা, তারা নিজ বিবেচনায় অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং পন্ডিতজনরা দেশের বিরুদ্ধে এত বড় মিথ্যাচার (যা কানাডার আদালতে প্রমাণিত) করার পরেও মানুষের সামনে মুখ দেখায় কী করে ভেবে পাই না। আসলে তিনারা হলেন বুদ্ধিজীবী ও পন্ডিত ব্যক্তি। তাদের লজ্জা পেতে নেই।  কারণ তিনারা হলেন আমাদের সম্মানীয়। বরং আমরা আমজনতা, আমাদের হারানোর কিছু নেই।  তাই আসুন তিনাদের এহেন রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য আমরা অনুতপ্ত হই, লজ্জা পাই।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো : যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা

» জাতি ক্রান্তি লগ্নে, ভালো নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই: ইসি সানাউল্লাহ

» ৫০ হাজার ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা গ্রেফতার

» ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা

» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা জরুরি : তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আসুন আমরা লজ্জা পাই!

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): লজ্জা নারীর ভূষণ। এ কথাটির মর্মার্থ ছোটবেলায় বুঝতাম না। ভাবতাম ভালোই তো, সুন্দর কথা। এখন মনে হয় এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও বিদ্বেষপূর্ণ কথা। নারী জাতিকে ঘর এবং কালো বোরকার ভিতরে আবদ্ধ রাখা একটা কদার্য, অসভ্য পুরুষ কর্তৃত্ববাদিতার বহিঃপ্রকাশ। নারী হলেই তাকে লজ্জা পেতে হবে, আর পুরুষের লজ্জার বালাই থাকার প্রয়োজন নেই।  একচেটিয়া ইনডেমনিটি বা অব্যাহতি আর কী। কিন্তু এদিন আর সেদিন নেই। অদম্য নারীরা আজ শেকল ভাঙার সংগ্রাম করছে এবং তাতে অগ্রগতি অনেক। তবে হেফাজত নেতা প্রয়াত আহমদ শফীর হাজার লাখো অনুসারী এখনো হুঙ্কার ছাড়ছে। জামায়াত হেফাজতের তীর্থস্থান তালেবানি আফগানিস্তান। সেখানে তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সব নারীকে আবার অন্ধকারে বন্দি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশি তালেবানরা তাতে উৎসাহিত। কিন্তু আমার কথা অন্য জায়গায়। সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদেরই তো লজ্জিত হওয়ার কথা, যারা অনৈতিক কাজ করে, মিথ্যা কথা বলে, ঘুষ খায়, জোতচুরি-পুকুরচুরি থেকে শুরু করে দেশের জনমানুষ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় এবং ষড়যন্ত্র করে। হীনব্যক্তি স্বার্থে, হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে যারা চক্রান্ত ও মিথ্যাচার করে, লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে সামান্যতম লজ্জার রেশ নেই; উন্নত বাংলাদেশের ভিত্তি ও সোপান পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পকে ঘিরে তার একটা ঘৃণ্য বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। আরও ইস্যু আছে, তবে এটাই আজকের আলোচ্য বিষয়। পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু শুরুতে ২০১২-২০১৩ সালের অতি পরিচিত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এবং বাহ্যিকভাবে সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি কোমর বেঁধে মাঠে নামলেন, পদ্মা সেতু শেখ হাসিনা সরকারের সময় কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য কূটতন্ত্র প্রয়োগসহ যত মিথ্যাচার যেখানে যা করা দরকার করতে হবে। পদ্মা সেতু ঠেকাতে সেদিন তিনারা জিহাদে নামলেন। এনারা সবাই বিদেশি শক্তিবর্গের অতি প্রিয় সুবোধজন। তবে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, ঝড়-তুফান, সাইক্লোন, বন্যায় কোনো দিনও তিনাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। অথচ রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যেকেই সম্মানীয় পন্ডিত। এনারা এক সময়ে মনে করলেন, রাজনীতি যারা করেন তারা সবাই দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য এবং দেশবিরোধী। তাই রাজনীতিবিদদের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। সুতরাং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনারা একবার বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে পড়লেন। কেউ প্রত্যক্ষভাবে আবার কেউ পরোক্ষভাবে। বললেন, জরুরি আইন দুই বছর কেন, দেশের কল্যাণে প্রয়োজন হলে অনির্দিষ্টকাল চলতে কোনো অসুবিধা নেই। খুব ভালো ভালো কথা শুনে প্রথমে মানুষ তাদের স্বাগত জানালেন। কিন্তু কিছু দিন যেতেই মানুষের কাছে তাদের আসল স্বরূপ ধরা পড়তে থাকে। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলকে ভেঙে চুরমার করতে উদ্যত হলেন। অভিজ্ঞ, পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে ঢোকালেন। গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করার জন্য জনসম্পর্কহীন কিছু ব্যক্তির দ্বারা কয়েকটি কিংস পার্টি তৈরি করলেন। ঘোষণা দিলেন এবার তিনারা সব ঠিক করে ফেলবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবলিত রাজনীতিকেই তিনারা প্রধান প্রতিবন্ধক ধরে নিলেন। সুতরাং শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় করার জন্য শুরু হয় খামখেয়ালি, অবৈধ ও বেআইনি সব ঔদ্ধত্য  আচরণ। এক সময়ে বন্দি করলেন শেখ হাসিনাকে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা, জনসম্পর্কহীন ও রাজনৈতিক শেকড়বিহীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা এ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও দেশের ভালো হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের বেলায়ও সেটিই ঘটল। ধুলা দূর করতে গিয়ে তিনারা পুরো বাংলাদেশকে ধূলিময় করে ফেললেন। জনমানুষ ক্ষেপে গেল। সংবিধানের ব্যারিস্টারি ব্যাখ্যা মানুষ ছুড়ে ফেলে দিল। বিপদ বুঝতে পেরে তিনারা চুপ করে নীরবে বিদায় নিলেন। কিন্তু লজ্জা পেলেন না। বিশাল জনম্যান্ডেট নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের শুরুতে ক্ষমতায় এলো। দুঃসাহসী প্রকল্প পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রকল্প নিলেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বড় বড় কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদানে চুক্তিবদ্ধ হলো। প্রকল্প থেকে শুরু করে সব কাগজপত্র তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিল, পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতি বছর শতকরা ১.২ হারে বৃদ্ধি পাবে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগের সেন্টার অব গ্র্যাভেটি বা ভরকেন্দ্র হবে পদ্মা সেতু। তারপর বর্ধিত হয়ে এটি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর সহজ সংযোগ ঘটাবে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোজিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও কানেকটিভিটির হাব বা কেন্দ্র হবে পদ্মা সেতু এবং তার দুই পাড়ের এলাকা। সেখানে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের আধুনিক সিটি ও শিল্পাঞ্চল। নতুন প্রজন্মের জন্য বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ থেকে শেখ হাসিনাকে আর বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সুতরাং তিনারা ওই সেই পুরনো ব্যারিস্টার, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মহান সৈনিকগণ প্রমাদ গুনলেন। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বড় কিছু নয়, শেখ হাসিনাকে হটাতে হলে পদ্মা সেতু ঠেকাতে হবে। কী করা যায়। ভাবতে ভাবতেই উত্তম এক পন্থা আবিষ্কার করলেন। দুর্নীতি বাংলাদেশে যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং যে দেশে এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে অবৈধ এবং তদ্বীয় কালো টাকাকে জরিমানা দিয়ে সাদা করতে পারে, সে দেশে কারও লুকায়িত কোনো উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার মতো সহজ অন্য কিছু আর হতে পারে না। সংগত কারণেই মানুষও সহজে সেটি বিশ্বাস করতে চাইবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক চীনের একটি ভুয়া অদক্ষ, অযোগ্য কোম্পানিকে মূল সেতুর কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। ফলে বিশ্বব্যাংকের ভয়ানক গোস্সা হয়। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। বাংলাদেশের ওই তিনারা এবং বিশ্বব্যাংক একজোট হয়ে গেল। অভিযোগ তুললেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভয়ানক, বিশাল দুর্নীতি হয়েছে। প্রত্যেক দিন টেলিভিশনের পর্দায় এবং দৈনিক পত্রিকায় তিনারা একেকজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিস্তর বক্তব্য ও লেখালেখি করতে লাগলেন। তথাকথিত টিআরপি বাড়াতে টেলিভিশনগুলো উল্লসিত হয়ে অনবরত তিনাদের কথা প্রচার করতে লাগল। তিনারা বলতে থাকলেন, এত বড় দুর্নীতি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, সংশ্লিষ্টদের লজ্জা পাওয়া উচিত। আরও কতকিছু। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, জেলে ঢোকাতে হবে। ঝি-কে মেরে বউকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল আর কী। একজন মন্ত্রীর চাকরি গেল, একজন সচিবকে জেলে যেতে হলো। তাতেও তিনারা সন্তুষ্ট নন। ২০১৩ সালের জুন মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ চুক্তি বাতিল করে দিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৩ সালের ২ জুলাই সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প বৃত্তান্ত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তিনি কারিগরি টিমের প্রধান ছিলেন। নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্পের সব প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক একটা প্রাঞ্জল চিত্র তিনি লেখায় তুলে ধরেন। লেখাটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন কোনো প্যাকেজের কোনো প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো শর্টকাট বা নিয়মবিধির সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটেনি এবং ঘটার সুযোগও ছিল না। সব পর্যায়ে মাল্টি ডাইমেনশনাল চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রাখা হয়। বিশ্বব্যাংক সব পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে এবং অনুমোদন দিয়েছে। জামিলুর রেজা চৌধুরীর লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন বিশ্বব্যাংক কেন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, যার একটি কারণ ওপরে উল্লেখ করেছি। জাতির এই কঠিন দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার মূর্তিতে হাজির হন। বললেন, পদ্মা সেতু হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারও থেকে ঋণ নেওয়া হবে না। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। দেশের এত বড় সর্বনাশ করার পরেও বাংলাদেশের তিনারা সামান্যতম লজ্জা অনুভব করলেন না। এবার বলা শুরু করলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করলে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ধস নামবে এবং আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং দুর্ভিক্ষ হবে। বিশেষজ্ঞ পন্ডিতি কর্তৃত্বে রীতিমতো ভয় দেখালেন। বললেন, সর্বনাশ, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করা ঠিক হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তো শেখ মুজিবের মেয়ে। তিনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। অদম্য মনোবল, অসীম আত্মবিশ্বাস, কঠিন সততা ও দেশের মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধুর কন্যা সুদৃঢ় সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু হবে। শুরু হয়ে গেল নির্মাণ কর্মযজ্ঞ। আবার প্রমাণিত হয়, জাতির ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রের টপ নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক সাহস এবং মানুষের প্রতি দরদ থাকলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় এবং ইতিহাস সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রের মোড় ঘুরে যায়। তারপর শত বছরেও সেই জাতিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। ১৯৭১ সালের ভয়াবহ সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন এবং নিজের জীবন তুচ্ছ করে যদি যথাসময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা না করতেন তাহলে বাংলাদেশ কোনো দিন স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছেন তাদের বিচার করেছেন এবং পাহাড়সম ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলেই বাংলাদেশ আজ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু চিরদিন জাতীয় গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে থাকবে। গত ২৪ মে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ২৫ জুন পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে সারা দেশের মানুষ উৎফুল্ল ও আনন্দিত। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। শেখ হাসিনা আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে জাগ্রত করেছেন বলেই পদ্মা সেতু হয়েছে এবং বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর ঘোষণার পর ২৪ মে সন্ধ্যায় একটা জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল ওই তিনাদের সেই সময়ের সব বক্তব্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখিয়েছে। মানুষ পুনরায় দেখতে পেয়েছে তিনারা পদ্মা সেতু নির্মাণ ঠেকাতে তখন কত বড় মিথ্যাচার করেছেন। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাক্ষাৎ প্রমাণ। কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি লাভালিনকে জড়িয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় কানাডার ফেডারেল আদালতে মামলা হয়। দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানির পর কানাডার ফেডারেল আদালত ২০১৭ সালে রায় দেন এই মর্মে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আদালত উল্লেখ করেন, সবই ছিল সাজানো গালগল্প কিন্তু দুঃখজনক হলো চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য পদ্মা সেতুর উদ্বোধন প্রায় তিন বছর পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশে যদি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি থাকত তাহলে তিন বছরে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার সবকিছু ওই বাংলাদেশি তিনাদের কাছ থেকে আদায় করা যেত। কিন্তু সেটা তো হবে না। অন্তত এ ব্যাপারে একটা যথার্থ শ্বেতপত্র তৈরি করে সবকিছু জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। বিশ্বব্যাংক বৈশ্বিক সংস্থা, তারা নিজ বিবেচনায় অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং পন্ডিতজনরা দেশের বিরুদ্ধে এত বড় মিথ্যাচার (যা কানাডার আদালতে প্রমাণিত) করার পরেও মানুষের সামনে মুখ দেখায় কী করে ভেবে পাই না। আসলে তিনারা হলেন বুদ্ধিজীবী ও পন্ডিত ব্যক্তি। তাদের লজ্জা পেতে নেই।  কারণ তিনারা হলেন আমাদের সম্মানীয়। বরং আমরা আমজনতা, আমাদের হারানোর কিছু নেই।  তাই আসুন তিনাদের এহেন রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য আমরা অনুতপ্ত হই, লজ্জা পাই।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com