গুম-খুন ছিল নিত্য ব্যাপার নেতৃত্বে ডিবি হারুন

ফাইল ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক :  আওয়ামী আমলে গুম-খুন, মামলা-হামলার ঘটনা ছিল নিত্যব্যাপার। গাজীপুর শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানে অর্থনৈতিক দুঃশাসন বেশি চালিয়েছে পুলিশ ও ফ্যাসিবাদী দলটির নেতাকর্মীরা। ঘুস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, শিল্পপতিসহ বিত্তশালীদের মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে হাতানো হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এসব অপকর্মের হোতা ছিলেন গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদ, যিনি পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হন। ‘ভাতের হোটেলওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এই জেলাকে টাকার খনি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

 

গাজীপুরে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন এসপি হারুন। বিভিন্ন ফাঁদে আটকানো, পাড়া-মহল্লায় জুয়ার আসর বসানো, আবাসিক হোটেল ও ফ্ল্যাটে যৌনবৃত্তির কমিশন এবং মাদক কারবার থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করতেন তিনি। এরই পাশাপাশি চালাতেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়সহ অসংখ্য অপকর্ম।

 

এসপি হারুন সরাসরি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। রাষ্ট্রপতি হামিদকে তিনি নানাভাবে সম্বোধন করতেন। একই এলাকায় গ্রামের বাড়ি এবং নিজেরা পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন বলে হারুন দাবি করতেন। তিনি মাঝেমধ্যেই বলতেন—তার আদায় করা টাকার একটি বড় অংশ রাষ্ট্রপতি হামিদকেও দিতে হতো।

 

শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল বেপারী বলেন, জীবনের সুখ-শান্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, এলাকায় জনপ্রিয়তা—সবই ছিল তার জীবনে। কিন্তু এসপি হারুন গাজীপুরে যোগদানের পরই পাল্টে যায় পুরো চিত্র। তিনি বাছাই করে করে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের আটক করতেন। শুধু তার কাছ থেকেই কয়েক কোটি টাকা আদায় করেন পুলিশের এই কুখ্যাত কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে নগদ টাকা দিতে না পারায় জমি বিক্রি করে টাকা দিতে বাধ্য করেন হারুন। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নাম করে টাকা আদায় করতেন তিনি।

 

তিনি জানান, শ্রীপুর উপজেলা থেকেই কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী জমি বিক্রি করে হারুনের চাহিদা পূরণ করেছেন। একই কায়দায় গাজীপুরের সব উপজেলা এবং পৌর এলাকায় তালিকা বানিয়ে আটক করে টাকা আদায় করতেন হারুন। এসব অপকর্ম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অন্তত ১৫টি টিম গড়ে তোলেন এসপি হারুন। তারা সন্ধ্যার পর দল বেঁধে মাইক্রোবাস নিয়ে বের হতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রভাবশালীদের ধরে মাইক্রোবাসে তোলা হতো এবং ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে সারা রাত ঘুরিয়ে চাহিদা অনুযায়ী টাকা নেওয়ার পর ছেড়ে দিত।

 

তিনি আরো জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল হারুনের এ ধরনের চাঁদাবাজির বিষয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হককে জানালে তিনি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কিছু বলার ক্ষমতা রাখেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

প্রকাশ্যে জুয়ার আসর

গাজীপুরের হোতাপাড়া, মনিপুর, রাজেন্দ্রপুর, বোর্ডবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসিয়ে প্রতিটি থেকে এক রাতের জন্যই ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা আদায় করতেন এসপি হারুন। এ বিষয়ে তার একটি বিশেষ বাহিনী সারা জেলায় কাজ করত। জুয়াপ্রবণ এসব এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিলে আসরগুলো ভেঙে দেওয়া হতো; কিন্তু সন্ধ্যার পর আবার সেখানে জুয়াড়িদের আড্ডা বসত এসপি হারুনের নির্দেশে।

 

আবাসিক হোটেলে যৌন ব্যবসা

গাজীপুরে এসপি হারুনের রাজত্ব ছিল দীর্ঘদিনের। জেলার সব আবাসিক হোটেলে গড়ে তোলা হয় অবাধে যৌনাচারের নিরাপদ আস্তানা। প্রতি রাতের জন্য এসপি হারুনকে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হতো। কোনো হোটেলের মালিক অসামাজিক কার্যকলাপ করাতে রাজি না হলেও রাতপ্রতি তাদের নির্ধারিত পুলিশের বখরা পরিশোধ করতে হতো। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে এলাকার নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অনেকবার এসপি হারুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেন; কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

 

জঙ্গি নাটকে সাত শিক্ষার্থী হত্যা

গাজীপুরের এসপি হারুনের সময় নগরীর হাড়িনাল লেবুবাগান এলাকায় একটি বাড়িতে সাত শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে নিহত শিক্ষার্থীদের জঙ্গি আখ্যায়িত করা হয়। তবে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার শিক্ষার্থীরা সবাই গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ভর্তি হওয়ার জন্য ওই বাড়িতে থেকে কোচিং করতেন। সেদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই ঘটনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন নিহত এক ছাত্রের বাবা।

 

কালিগঞ্জ উপজেলার জামায়াতের কর্মী খায়রুল ইসলামসহ কয়েকজনকে আটক করার পর ইসলামী বই এবং কিছু পানীয়র বোতলে পেট্রোল ভরে বোমা বানিয়ে তাদের সামনে দিয়ে জঙ্গি আটকের নাটক সাজানো হয়।

ব্যাগের মধ্যে ইয়াবা দিয়ে প্রতারণা

গাজীপুরের পূবাইল এলাকার এক বৃদ্ধ (নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, এসপি হারুনের আমলে তিনি কিছু জমি বিক্রি করেন। বায়না হওয়ার দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথেই সাদা পোশাকে কয়েকজন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তার পথ আটকায় এবং ব্যাগ তল্লাশি করে। পরে ওই ডিবি পুলিশের সদস্যরা ব্যাগ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট বের করে বৃদ্ধকে দেখায় এবং বলে, আপনি ইয়াবা ব্যবসায়ী, তাই আপনি গ্রেপ্তার। এক পর্যায়ে বৃদ্ধের সঙ্গে থাকা জমির বায়নার পাঁচ লাখ টাকা তারা নিয়ে বৃদ্ধকে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেও তাকে নানাভাবে ভয় দেখানো হয়। পরে এ বিষয়ে এসপি হারুনের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বৃদ্ধের টাকা ফেরত দেন।

 

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়

গাজীপুর শহরের চাল ব্যবসায়ী বাবুলকে সন্ধ্যার দিকে আটক করে ডিবি পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সারা রাত ঘোরানো হয়। ভোরবেলা তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করে জয়দেবপুর বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারের প্রভাবশালী রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীকেও মামলার ফাঁদে ফেলে কয়েক কোটি টাকা আদায় করে নিলে তার জীবনটা তছনছ হয়ে যায়।

 

এসপি হারুনের হাতিয়ার ছিল মুচি জসিম। কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার সন্ত্রাসী মুচি জসিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। এসপি হারুন তাকে দিয়ে চন্দ্রার শফিপুর-কালিয়াকৈর শিল্প এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এতে জসিম আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং শিল্প এলাকাজুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। গড়ে তোলেন হারুন সমর্থিত বিশেষ বাহিনী। এসপি হারুন গাজীপুর থেকে বদলি হওয়ার পরপরই জসিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে পুলিশ।

আওয়ামী দানব মোজাম্মেল হক

আওয়ামী দানবদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলেন ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে দিয়ে রায় করিয়ে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্তের মাধ্যমে অবিচারের নজির সৃষ্টি করেন। ভুক্তভোগীরা সবাই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়ার সময় যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাতে মোজাম্মেলের মেয়ে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সে সময় তার তদবিরও কাজে লাগেনি। এই ক্ষোভে ১/১১ সরকারের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মোজাম্মেল প্রথম আঘাত করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯৮৮ জনকে চাকরি দেওয়া হয়, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে ফরমায়েশি রায় নেওয়া হয়। তবে জুলাই বিপ্লবের পর ভুক্তভোগীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ১ জুন আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারী।

 

এছাড়া মোজাম্মেলসহ আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা।

 

আওয়ামী দুঃশাসনের আরেকটি বড় অপকর্ম হলো এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প, যা গাজীপুরবাসীর গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে ভুল নকশায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিগত ১২ বছরেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করে সে সময়ের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রকল্পের ঠিকাদার পরিবর্তন করেছেন। অপ্রশস্ত মহাসড়কে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দিয়ে শুধু জনগণের ভোগান্তিই বাড়িয়েছে। কখন প্রকল্প শেষ হবে—পরিষ্কার করে তা কেউ বলতে পারেন না।

বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা

গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান জানান, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় গাজীপুর মহানগরের আটটি থানা এবং জেলার চারটি উপজেলায় গায়েবি মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছিল। কোন থানায় কত মামলা দায়ের করতে পারে এবং কতজনকে গ্রেপ্তার করতে পারে—এ বিষয়ে চলত অলিখিত প্রতিযোগিতা। জেলার সব বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়িতে অভিযান চলত প্রতিনিয়ত।

 

বিশেষ করে দিনের ভোট রাতে নেওয়া এবং অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময়; সব শেষে আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচনকালে ধরপাকড় ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। বিগত আওয়ামী দুঃশাসনকালে অন্তত এক হাজারের বেশি মামলা দায়ের হয় এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার।

 

জামায়াত-শিবিরের কোনো কর্মসূচি করতে দেওয়া হতো না। কোথাও কোনো মিটিংয়ের খবর পেলে পুলিশ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজাত। আগে থেকে তৈরি করা পেট্রোল বোমা, ককটেল এবং বাজার থেকে ইসলামি বই নিয়ে নেতাকর্মীদের দাঁড় করিয়ে জঙ্গির মিডিয়া ট্রায়াল দেওয়া হতো। এতে মুখ্য ভূমিকা ছিল হারুনের।

গাজীপুরে জুলাই শহীদ ১৮ জন

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পৃথক স্থান ও সময়ে গাজীপুরে ১৮ আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন। টঙ্গী বোর্ডবাজার বাসন সড়ক, জয়দেবপুর চৌরাস্তা কোনাবাড়ী এবং শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় আওয়ামী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তারা শহীদ হন। তাদের মধ্যে কোনাবাড়ী শিল্প এলাকায় গত বছরের ৫ আগস্ট কলেজছাত্র হৃদয় হত্যাকাণ্ডের বিচার বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে চলছে।

 

১৮ শহীদ হলেন—নাসির ইসলাম, মোহাম্মদ সামিউল আমার নূর, মোহাম্মদ কবির, অহিদ মিয়া, মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, জাকারিয়া হাসান, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নাফিসা হোসেন মাওয়া, জাকির হোসেন রানা, মোহাম্মদ ইলিম হোসেন, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মোহাম্মদ তুহিন, আবদুল্লাহ আল মামুন, সানজিদ হোসেন মৃধা, এসএম হোসেন, মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, শাকিল হোসেন ও মোহাম্মদ জসিম।

বেপরোয়া জাহাঙ্গীর আলম

বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমানোর জন্য পুলিশের পাশাপাশি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্য ডিবিপ্রধান হারুনের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 

পল্টনে মহাসমাবেশে ট্রাকযোগে রঙিন লাঠি নিয়ে যে বাহিনী প্রথম হামলা করে, তার নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। একই বাহিনী দিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে হামলা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীরের দুর্নীতিকে সমর্থন না করায় সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করার পেছনে তার মূল ভূমিকা আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

 

এ মামলায় প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ ও ক্যাশিয়ার বলে খ্যাত মনির হোসেন দীর্ঘদিন পলাতক থেকে দেশ ছেড়েছেন বলে জানা যায়। ক্ষতিপূরণ দেবে বলে জনগণের শত শত বাড়িঘর ভেঙে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পরে জনগণকে আর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে বেশকিছু রিট দায়ের করা হয়েছিল। এছাড়া সিটি করপোরেশনে উন্নয়নমূলক কাজের সবকিছুই নিজস্ব বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহাঙ্গীর।

 

সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জাহাঙ্গীর ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে গাজীপুরে দুদক মামলা করেছে। এতে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

 

দুদক গাজীপুরের উপপরিচালক বায়েজিদুর রহমান খান জানান, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে তদন্ত করে অপরাধ-সংশ্লিষ্ট সব প্রমাণ ও তথ্য যাচাই শেষে এজাহার প্রস্তুত করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে ২৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার কাজ দেখিয়ে বিল উত্তোলনের তথ্য মিলেছে, যা আদতে সম্পূর্ণ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।

 

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল হাসান জানান, ‘গাজীপুর সিটি একটি গণমুখী, জবাবদিহিমূলক ও সেবাপ্রধান প্রতিষ্ঠান। অতীতের যে কোনো অভিযোগ বা অনিয়মের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় কাজ করছে, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অংশ হিসেবেই আমরা বিবেচনা করি। বর্তমান প্রশাসন সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল এবং নাগরিকদের উন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ন্যায্যতা ও নিয়ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গাজীপুরের জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা।

জাহাঙ্গীরের নামে দুদকের আরেক মামলা

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান বাদী হয়ে দুদক গাজীপুর সমন্বিত কার্যালয়ে এ মামলা করেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চলমান পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হবে: ডা. জাহিদ

» আর কোনও স্বৈরাচারকে দেখতে চায় না দেশের মানুষ : আমান উল্লাহ

» জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে বাইপাস করলে রাজপথে যুদ্ধ হবে: মামুনুল হক

» জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রয়াত ২০ সদস্যকে স্মরণ

» প্রযুক্তির যুগে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক তথ্যের আদানপ্রদান : উপদেষ্টা রিজওয়ানা

» জাতীয়ভাবে টাইফয়েড টিকাদান নিয়ে জরুরি ৫ প্রশ্নের উত্তর

» দেশের প্রতিটি মানুষ গাজার পাশে দাঁড়াতে আকুল: শায়খ আহমাদুল্লাহ

» দীর্ঘদিন পরে এবার সত্যিকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে: প্রেস সচিব

» সব উপদেষ্টাই তো বিদেশি নাগরিক: রুমিন ফারহানা

» বিএনপিকে চুপিসারে ক্ষমতায় আনতে চায় সরকার: রেজাউল করীম

উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা,

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

গুম-খুন ছিল নিত্য ব্যাপার নেতৃত্বে ডিবি হারুন

ফাইল ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক :  আওয়ামী আমলে গুম-খুন, মামলা-হামলার ঘটনা ছিল নিত্যব্যাপার। গাজীপুর শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানে অর্থনৈতিক দুঃশাসন বেশি চালিয়েছে পুলিশ ও ফ্যাসিবাদী দলটির নেতাকর্মীরা। ঘুস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, শিল্পপতিসহ বিত্তশালীদের মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে হাতানো হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এসব অপকর্মের হোতা ছিলেন গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদ, যিনি পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হন। ‘ভাতের হোটেলওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এই জেলাকে টাকার খনি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

 

গাজীপুরে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন এসপি হারুন। বিভিন্ন ফাঁদে আটকানো, পাড়া-মহল্লায় জুয়ার আসর বসানো, আবাসিক হোটেল ও ফ্ল্যাটে যৌনবৃত্তির কমিশন এবং মাদক কারবার থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করতেন তিনি। এরই পাশাপাশি চালাতেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়সহ অসংখ্য অপকর্ম।

 

এসপি হারুন সরাসরি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। রাষ্ট্রপতি হামিদকে তিনি নানাভাবে সম্বোধন করতেন। একই এলাকায় গ্রামের বাড়ি এবং নিজেরা পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন বলে হারুন দাবি করতেন। তিনি মাঝেমধ্যেই বলতেন—তার আদায় করা টাকার একটি বড় অংশ রাষ্ট্রপতি হামিদকেও দিতে হতো।

 

শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল বেপারী বলেন, জীবনের সুখ-শান্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, এলাকায় জনপ্রিয়তা—সবই ছিল তার জীবনে। কিন্তু এসপি হারুন গাজীপুরে যোগদানের পরই পাল্টে যায় পুরো চিত্র। তিনি বাছাই করে করে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের আটক করতেন। শুধু তার কাছ থেকেই কয়েক কোটি টাকা আদায় করেন পুলিশের এই কুখ্যাত কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে নগদ টাকা দিতে না পারায় জমি বিক্রি করে টাকা দিতে বাধ্য করেন হারুন। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নাম করে টাকা আদায় করতেন তিনি।

 

তিনি জানান, শ্রীপুর উপজেলা থেকেই কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী জমি বিক্রি করে হারুনের চাহিদা পূরণ করেছেন। একই কায়দায় গাজীপুরের সব উপজেলা এবং পৌর এলাকায় তালিকা বানিয়ে আটক করে টাকা আদায় করতেন হারুন। এসব অপকর্ম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অন্তত ১৫টি টিম গড়ে তোলেন এসপি হারুন। তারা সন্ধ্যার পর দল বেঁধে মাইক্রোবাস নিয়ে বের হতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রভাবশালীদের ধরে মাইক্রোবাসে তোলা হতো এবং ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে সারা রাত ঘুরিয়ে চাহিদা অনুযায়ী টাকা নেওয়ার পর ছেড়ে দিত।

 

তিনি আরো জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল হারুনের এ ধরনের চাঁদাবাজির বিষয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হককে জানালে তিনি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কিছু বলার ক্ষমতা রাখেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

প্রকাশ্যে জুয়ার আসর

গাজীপুরের হোতাপাড়া, মনিপুর, রাজেন্দ্রপুর, বোর্ডবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসিয়ে প্রতিটি থেকে এক রাতের জন্যই ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা আদায় করতেন এসপি হারুন। এ বিষয়ে তার একটি বিশেষ বাহিনী সারা জেলায় কাজ করত। জুয়াপ্রবণ এসব এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিলে আসরগুলো ভেঙে দেওয়া হতো; কিন্তু সন্ধ্যার পর আবার সেখানে জুয়াড়িদের আড্ডা বসত এসপি হারুনের নির্দেশে।

 

আবাসিক হোটেলে যৌন ব্যবসা

গাজীপুরে এসপি হারুনের রাজত্ব ছিল দীর্ঘদিনের। জেলার সব আবাসিক হোটেলে গড়ে তোলা হয় অবাধে যৌনাচারের নিরাপদ আস্তানা। প্রতি রাতের জন্য এসপি হারুনকে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হতো। কোনো হোটেলের মালিক অসামাজিক কার্যকলাপ করাতে রাজি না হলেও রাতপ্রতি তাদের নির্ধারিত পুলিশের বখরা পরিশোধ করতে হতো। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে এলাকার নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অনেকবার এসপি হারুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেন; কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

 

জঙ্গি নাটকে সাত শিক্ষার্থী হত্যা

গাজীপুরের এসপি হারুনের সময় নগরীর হাড়িনাল লেবুবাগান এলাকায় একটি বাড়িতে সাত শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে নিহত শিক্ষার্থীদের জঙ্গি আখ্যায়িত করা হয়। তবে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার শিক্ষার্থীরা সবাই গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ভর্তি হওয়ার জন্য ওই বাড়িতে থেকে কোচিং করতেন। সেদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই ঘটনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন নিহত এক ছাত্রের বাবা।

 

কালিগঞ্জ উপজেলার জামায়াতের কর্মী খায়রুল ইসলামসহ কয়েকজনকে আটক করার পর ইসলামী বই এবং কিছু পানীয়র বোতলে পেট্রোল ভরে বোমা বানিয়ে তাদের সামনে দিয়ে জঙ্গি আটকের নাটক সাজানো হয়।

ব্যাগের মধ্যে ইয়াবা দিয়ে প্রতারণা

গাজীপুরের পূবাইল এলাকার এক বৃদ্ধ (নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, এসপি হারুনের আমলে তিনি কিছু জমি বিক্রি করেন। বায়না হওয়ার দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথেই সাদা পোশাকে কয়েকজন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তার পথ আটকায় এবং ব্যাগ তল্লাশি করে। পরে ওই ডিবি পুলিশের সদস্যরা ব্যাগ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট বের করে বৃদ্ধকে দেখায় এবং বলে, আপনি ইয়াবা ব্যবসায়ী, তাই আপনি গ্রেপ্তার। এক পর্যায়ে বৃদ্ধের সঙ্গে থাকা জমির বায়নার পাঁচ লাখ টাকা তারা নিয়ে বৃদ্ধকে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেও তাকে নানাভাবে ভয় দেখানো হয়। পরে এ বিষয়ে এসপি হারুনের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বৃদ্ধের টাকা ফেরত দেন।

 

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়

গাজীপুর শহরের চাল ব্যবসায়ী বাবুলকে সন্ধ্যার দিকে আটক করে ডিবি পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সারা রাত ঘোরানো হয়। ভোরবেলা তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করে জয়দেবপুর বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারের প্রভাবশালী রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীকেও মামলার ফাঁদে ফেলে কয়েক কোটি টাকা আদায় করে নিলে তার জীবনটা তছনছ হয়ে যায়।

 

এসপি হারুনের হাতিয়ার ছিল মুচি জসিম। কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার সন্ত্রাসী মুচি জসিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। এসপি হারুন তাকে দিয়ে চন্দ্রার শফিপুর-কালিয়াকৈর শিল্প এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এতে জসিম আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং শিল্প এলাকাজুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। গড়ে তোলেন হারুন সমর্থিত বিশেষ বাহিনী। এসপি হারুন গাজীপুর থেকে বদলি হওয়ার পরপরই জসিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে পুলিশ।

আওয়ামী দানব মোজাম্মেল হক

আওয়ামী দানবদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলেন ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে দিয়ে রায় করিয়ে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্তের মাধ্যমে অবিচারের নজির সৃষ্টি করেন। ভুক্তভোগীরা সবাই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়ার সময় যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাতে মোজাম্মেলের মেয়ে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সে সময় তার তদবিরও কাজে লাগেনি। এই ক্ষোভে ১/১১ সরকারের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মোজাম্মেল প্রথম আঘাত করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯৮৮ জনকে চাকরি দেওয়া হয়, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে ফরমায়েশি রায় নেওয়া হয়। তবে জুলাই বিপ্লবের পর ভুক্তভোগীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ১ জুন আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারী।

 

এছাড়া মোজাম্মেলসহ আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ঝুট ব্যবসা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা।

 

আওয়ামী দুঃশাসনের আরেকটি বড় অপকর্ম হলো এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প, যা গাজীপুরবাসীর গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে ভুল নকশায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিগত ১২ বছরেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করে সে সময়ের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রকল্পের ঠিকাদার পরিবর্তন করেছেন। অপ্রশস্ত মহাসড়কে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দিয়ে শুধু জনগণের ভোগান্তিই বাড়িয়েছে। কখন প্রকল্প শেষ হবে—পরিষ্কার করে তা কেউ বলতে পারেন না।

বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা

গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান জানান, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় গাজীপুর মহানগরের আটটি থানা এবং জেলার চারটি উপজেলায় গায়েবি মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছিল। কোন থানায় কত মামলা দায়ের করতে পারে এবং কতজনকে গ্রেপ্তার করতে পারে—এ বিষয়ে চলত অলিখিত প্রতিযোগিতা। জেলার সব বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়িতে অভিযান চলত প্রতিনিয়ত।

 

বিশেষ করে দিনের ভোট রাতে নেওয়া এবং অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময়; সব শেষে আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচনকালে ধরপাকড় ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। বিগত আওয়ামী দুঃশাসনকালে অন্তত এক হাজারের বেশি মামলা দায়ের হয় এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার।

 

জামায়াত-শিবিরের কোনো কর্মসূচি করতে দেওয়া হতো না। কোথাও কোনো মিটিংয়ের খবর পেলে পুলিশ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজাত। আগে থেকে তৈরি করা পেট্রোল বোমা, ককটেল এবং বাজার থেকে ইসলামি বই নিয়ে নেতাকর্মীদের দাঁড় করিয়ে জঙ্গির মিডিয়া ট্রায়াল দেওয়া হতো। এতে মুখ্য ভূমিকা ছিল হারুনের।

গাজীপুরে জুলাই শহীদ ১৮ জন

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পৃথক স্থান ও সময়ে গাজীপুরে ১৮ আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন। টঙ্গী বোর্ডবাজার বাসন সড়ক, জয়দেবপুর চৌরাস্তা কোনাবাড়ী এবং শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় আওয়ামী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তারা শহীদ হন। তাদের মধ্যে কোনাবাড়ী শিল্প এলাকায় গত বছরের ৫ আগস্ট কলেজছাত্র হৃদয় হত্যাকাণ্ডের বিচার বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে চলছে।

 

১৮ শহীদ হলেন—নাসির ইসলাম, মোহাম্মদ সামিউল আমার নূর, মোহাম্মদ কবির, অহিদ মিয়া, মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, জাকারিয়া হাসান, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নাফিসা হোসেন মাওয়া, জাকির হোসেন রানা, মোহাম্মদ ইলিম হোসেন, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মোহাম্মদ তুহিন, আবদুল্লাহ আল মামুন, সানজিদ হোসেন মৃধা, এসএম হোসেন, মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, শাকিল হোসেন ও মোহাম্মদ জসিম।

বেপরোয়া জাহাঙ্গীর আলম

বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমানোর জন্য পুলিশের পাশাপাশি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্য ডিবিপ্রধান হারুনের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 

পল্টনে মহাসমাবেশে ট্রাকযোগে রঙিন লাঠি নিয়ে যে বাহিনী প্রথম হামলা করে, তার নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। একই বাহিনী দিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে হামলা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীরের দুর্নীতিকে সমর্থন না করায় সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করার পেছনে তার মূল ভূমিকা আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

 

এ মামলায় প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ ও ক্যাশিয়ার বলে খ্যাত মনির হোসেন দীর্ঘদিন পলাতক থেকে দেশ ছেড়েছেন বলে জানা যায়। ক্ষতিপূরণ দেবে বলে জনগণের শত শত বাড়িঘর ভেঙে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পরে জনগণকে আর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে বেশকিছু রিট দায়ের করা হয়েছিল। এছাড়া সিটি করপোরেশনে উন্নয়নমূলক কাজের সবকিছুই নিজস্ব বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহাঙ্গীর।

 

সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জাহাঙ্গীর ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে গাজীপুরে দুদক মামলা করেছে। এতে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

 

দুদক গাজীপুরের উপপরিচালক বায়েজিদুর রহমান খান জানান, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে তদন্ত করে অপরাধ-সংশ্লিষ্ট সব প্রমাণ ও তথ্য যাচাই শেষে এজাহার প্রস্তুত করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে ২৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার কাজ দেখিয়ে বিল উত্তোলনের তথ্য মিলেছে, যা আদতে সম্পূর্ণ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।

 

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল হাসান জানান, ‘গাজীপুর সিটি একটি গণমুখী, জবাবদিহিমূলক ও সেবাপ্রধান প্রতিষ্ঠান। অতীতের যে কোনো অভিযোগ বা অনিয়মের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় কাজ করছে, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অংশ হিসেবেই আমরা বিবেচনা করি। বর্তমান প্রশাসন সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল এবং নাগরিকদের উন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ন্যায্যতা ও নিয়ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গাজীপুরের জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা।

জাহাঙ্গীরের নামে দুদকের আরেক মামলা

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নামে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান বাদী হয়ে দুদক গাজীপুর সমন্বিত কার্যালয়ে এ মামলা করেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা,

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com