বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ এবং ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগীরা। ক্রেতারা জানতেও পারছেন না তারা টাকা দিয়ে কী ওষুধ কিনছেন। ওষুধ বাণিজ্যের নৈরাজ্য রোধে ক্রেতা সচেতনতার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সচেতনতা বাড়াতে নেই প্রচারের সুযোগ। উপরন্তু আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওষুধ সম্পর্কিত প্রচারের ব্যবস্থাটি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররাও নতুন ওষুধ সম্পর্কে জানেন না। অপ্রয়োজনীয় ওষুধে সয়লাব হয়ে আছে দেশের বাজার। তাই অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। উপরন্তু ভেজাল ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী ওষুধের গুণগত মান ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ক্রেতাদের জানার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত। ওষুধ সম্পর্কে প্রচারের বিষয়টি আইন করে বন্ধ থাকায় ওষুধের মূল্য নির্ধারণ, গুণগত মান এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে ক্রেতারা কিছুই জানতে পারেন না। অন্যদিকে কমিশন প্রলুব্ধ অনেক ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এবং টেস্ট লিখে দিচ্ছেন রোগীকে। এতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও পর্যাপ্ত সুফল পাচ্ছেন না রোগী। এসব নিয়ম-নীতির ফাঁক গলে বাজারে ঢুকে পড়ছে নিম্নমানের ভেজাল ওষুধ। রাজধানীর মিটফোর্ডের ওষুধ মার্কেটের একটি চক্রের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মানহীন ওষুধ। ওষুধ সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচারে আইনগত বাধা এবং ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় ওষুধ নীতির বাধ্যবাধকতার কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতাদের জানাতে পারে না। ফলে কোম্পানিগুলো বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ডাক্তারদের প্রভাবিত করে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখাচ্ছেন ব্যবস্থাপত্রে। সূত্র জানায়, কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান এবং দেশের বাজারে ৯৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ওষুধশিল্প নিজ দেশেই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ওষুধের উপাদান এবং কার্যকারিতা নিয়ে কোনো প্রচার না থাকায় ক্রেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন ওষুধের বদলে নিম্নমানের ও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
মিটফোর্ড থেকে সারা দেশে : দেশের বৃহত্তম পাইকারি ওষুধের বাজার ঢাকার মিটফোর্ডে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে মাঝে-মাঝেই অভিযান চালায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। মিটফোর্ডের কিছু প্রতিষ্ঠান এবং সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে সারা দেশে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জালের মতো বিস্তৃত ভেজাল ও নকল ওষুধের নেটওয়ার্কে শত শত কোটি টাকার বিপণন হচ্ছে। শুধু জরিমানা ও অপ্রতুল শাস্তি দিয়ে এই ভেজাল, নকলের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যাচ্ছে না। কার্যকর তদারকির অভাবে একই চক্র বারবার সংঘবদ্ধ অপকর্মে জড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে।
ভেজালের বিস্তারে দেড় লাখ দোকান : ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার। এর মধ্যে গত দুই বছরে নতুন নিবন্ধন পেয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। তবে নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ওষুধের দোকান রয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব নেই তাদের কাছে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির এক সাবেক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির প্রায় সমান পরিমাণ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের দোকান রয়েছে। এই সংখ্যা দেড় লাখের বেশি হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহু ফার্মেসি। এসব দোকানের মাধ্যমেই ক্রেতাদের কাছে ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত এসব দোকান বিস্তৃত। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ১৮ নভেম্বর এক প্রশ্নোত্তরে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, দেশে ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান রয়েছে ১২ হাজার ৫৯২টি। তিনি বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১ হাজার ৭১৫টি মামলা দায়ের এবং ৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৪৬টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করা হয়েছে।
তবুও ভেজাল চলছেই : সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযানে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধের চালান ধরা পড়ায় ভেজাল ওষুধ নিয়ে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি সামনে এসেছে। গত ৩০ মার্চ দেশের সর্বাধিক সেবন করা দুটি ট্যাবলেটের বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় ওয়েস্ট ফার্মাসিউটিক্যাল নামের আয়ুর্বেদি ওষুধ তৈরির কারখানায় তৈরি করা হচ্ছিল মোনাস-১০ ও প্যানটেনিক্স-২০ ট্যাবলেট। ঠাণ্ডা-শ্বাসকষ্ট আর গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় বহুল প্রচলিত এ ওষুধ দুটি তৈরি করা হচ্ছিল আটা-ময়দা আর রং ব্যবহার করে। এরপর সেসব নকল ওষুধ আনা হতো রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ মার্কেটে। পরে মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসে ছড়িয়ে দেওয়া হতো সারা দেশে। রাজধানীর চকবাজারের একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে মোনাস-১০ ও প্যানটেনিক্স-২০ নকল ওষুধের চালানটি আটক করে ডিবি লালবাগ বিভাগ। এ সময় আলী আক্কাস শেখকে গ্রেফতারের পর তার তথ্যমতে ফকিরাপুল এলাকা থেকে কারখানাটির মালিক গিয়াস উদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। দুজনের জবানবন্দি অনুযায়ী, রাজধানীর চকবাজার, ফকিরাপুল ও চুয়াডাঙ্গায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ১০ লাখ ৩৪ হাজার ২৮০ পিস নকল প্যানটেনিক্স-২০ ট্যাবলেট ও ১৮ হাজার পিস নকল মোনাস-১০ ট্যাবলেট। এর আগে ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মোড়কে ৩ হাজার ৬৪১ ভেজাল ওষুধ জব্দ করে র্যাব। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েডের মতো ওষুধও।
ঝুঁকিতে মফস্বলের মানুষ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বৃহত্তম ওষুধের বাজার মিটফোর্ড কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের মফস্বল শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। ঔষধ প্রশাসনের নজরদারির অভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও ব্যবহার করতে হচ্ছে মফস্বলের ক্রেতাদের। এতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া বাজার প্রচলিত ওষুধগুলোর নকল ও ভেজাল তৈরি করে মফস্বলের ফার্মেসিগুলোতে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। এই নকল চক্রের হোতারা মাঝে-মধ্যেই র্যাব-পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ছে। জেল খেটে আবারও ফিরে আসছে একই পেশায়।
ওষুধ নীতিতে যা আছে : ১৯৮২ সালের ১২ জুন গেজেট আকারে প্রকাশিত ওষুধ নীতিতে বলা হয়, ওষুধ এবং স্বাস্থ্য বিষয়াবলির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের দ্বারা সাধারণ মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওষুধ এবং ওষুধ সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা যাবে না।
উল্টো ফল, ডাক্তারদের পোয়াবারো : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রচারের সহজ ব্যবস্থা না থাকলেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিপণন ও প্রচারণা খাতের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিশন হিসাবে চলে যাচ্ছে বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে এক শ্রেণির ডাক্তারের পকেটে। রোগীদের প্রেসক্রিপশনে নিজেদের ওষুধ লিখে দিতে ডাক্তারদের ফ্ল্যাট, বিদেশ ভ্রমণ, ফ্রিজ, টেলিভিশন থেকে শুরু করে নানা আকর্ষণীয় উপঢৌকন দেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। বিনিময়ে ডাক্তাররা সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন।
বাড়াতে হবে তদারকি : স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছে। তবে এই অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে দুর্বল তদারকির কারণে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে যেখানে বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরতা ছিল প্রায় শতভাগ, সেখানে ৫০ বছর পর বিশ্বের ১৪৭ দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন এক নির্ভরতার নাম। শুধু সাধারণ নয়, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এখন ভ্যাকসিন, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করছে। ইতোমধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশে নিবন্ধন পেয়েছে। এর মাধ্যমে সেসব দেশে আরও বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানির পথ প্রশস্ত হয়েছে। দেশের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজারের ৯৭% শতাংশই স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর দখলে। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশের পুরো চাহিদা মিটিয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে প্রতি বছর। এই গৌরবময় প্রেক্ষাপটের মধ্যেও এক শ্রেণির নকলবাজ ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে সাধারণ মানুষকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল ওষুধের নেটওয়ার্ক। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের জোরালো নজরদারি না থাকায় বেপরোয়া ভেজালকারীরা বারবার ফিরে আসছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনের নজরদারি না বাড়ালে এ অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি মিলবে না। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন