তানজীনা ইয়াসমিন :
এই বালিশে এখনো তার গন্ধ লেগে আছে,
দাঁত হারানো চিরুনীটায় চুল জড়িয়ে আছে
আমি কি সেই স্পর্শ ঝেড়ে ঘর গোছাতে পারি?
গন্ধ মুছে বালিশটাকে রোদ তাপাতে পারি?
মানুষ যদি হারিয়ে যাবে স্মৃতি যায় না কেন?
কাছের আধার দূরের মনে আলো জ্বালে কেন?’
অন্দর মহলে ঢোকার মুখে কাঠের ফ্রেমে খোদাই করা পঙক্তি। চন্দন কাঠের ঘ্রাণ নাকে ধাক্কা দেয়। কাঠে খোদাই করে লিখে রূপালি কালিতে রঙ বসানো কি?
মন বিষণ্ণ করা লেখাটা মহলের প্রবেশপথে আগন্তুককে থমকে দেয়, কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাবিত করে। আহা! এত হাহাকার? কোন সে মানুষ যার জন্য কারো বুকের আস্ত জমিন সমেত এই জনমুখর মহল খাঁ খাঁ করে।
মঈন লেখাটা থেকে চোখে সরাতে পারে না।
কেউ একজন ঘরে প্রবেশ করেছে। কাঠের ছড়ির মতো কিছুর আঘাত মোজাইকের মেঝেতে কর্কশ আওয়াজ তুলছে। আওয়াজ চেষ্টাকৃত কর্কশতর করে তোলা হচ্ছে মঈনের দৃষ্টি ফেরাতে। মঈনের দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
খান ইউসুফের ঘন ভ্রূতে ভাঁজ পড়ল।
এই লোক তো আদবই জানে না! কে কাকে যাচাই বাছাই ছাড়া অন্দরে ঢুকতে দেয় কেউ দেখার নাই। মা মরলে সন্তান ছেউড়া হয়, মাতৃহীনা এই বাড়ি এখন ছেউড়া বাড়ি।
-কি চাই?
মঈনের ধ্যান ভাঙলো। ঘাড় ফিরিয়ে মানুষটাকে দেখলো। বেশ অভিজাত এক মানুষ। আপাদমস্তক আভিজাত্য আর তাচ্ছিল্য গলে গলে পড়ছে।
-স্লামাল্লেকুম, আসলে আপনি কি চান সেটাই জানতে এসেছি।
খান ইউসুফের চোখ অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। সত্য যুগ হলে মঈন এক্ষণ এই দৃষ্টিতে ছাই হয়ে যেতো। কলি যুগ হওয়ায় মঈনের সিগারেটের তৃষ্ণা পেলো। এবং সাথে সাথে মনে হলো বেশতী সিগারেট আনা হয়নি। এই অঞ্চলে কি বেনসন লাইট পাওয়া যায় কিনা এই প্রশ্ন সামনে দাঁড়ানো ক্ষয়িষ্ণু দেওয়ান সাহেবকে করা হলে তিনি রাগে ইনক্রেডিবল হালক হয়ে যাবেন। সিল্কের পাঞ্জাবি ছিনে ফানা ফানা হবে। থাক।
-আপনি থানায় জিডি করেছিলেন আপনার প্রাণহানির আশঙ্কায়। সেই সূত্রেই এসেছি।
– আমার প্রাণহানি না, আমার বংশধরের।
মঈন অবাক হয়। সবাই জানে খান ইউসুফ নিঃসন্তান।
– আপনার বংশধর! তাঁরা কোথায় আছেন?
– আপনে কে? ডিবি?
-নাহ, ঠিক তা না, কিন্তু গোয়েন্দা কাজের অভিজ্ঞতা আছে অনেক। তাই…
-আউট! এক্ষণ বাইর হন। আমার ফেলুদা আসছে!! সংগে তপসে আর লাল মোহনবাবু আনেন নাই! ফাত্রামীর জায়গা পান না, খান মজলিসে ঢুকছেন শখের গোয়েন্দা! অ্যাই কে এখানে কে একে ঢুকতে দিছে? রুস্তম?
-স্যার শুনুন, আমি যাচ্ছি। কাউকে ডাকতে হবে না প্লিজ। জিডি করলেই থানা কাউকে পাঠায় না। আমি নিজে শুনে এসেছি। যাক চলে যাচ্ছি। শুধু একটু বলবেন, এই কবিতাটা কার লেখা? শুনেই চলে যাব।
খান সাহেব থমথমে মুখে উত্তেজনা প্রশমন করছেন। হাতের ছড়ি উপর খোলা মুঠো ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ঘোরাচ্ছেন।
-জেনে কি হবে?
-প্লিজ স্যার…
খান সাহেব ভ্রূ কুঁচকে অস্ফুট কণ্ঠে বির বির করলেন।
-কিছু বললেন?
খান সাহেবের কণ্ঠ আবার চড়ে গেল।
-আমার লেখা! হইছে। এখন যান যান।
খান সাহেব হাত উঁচিয়ে গুড়ের মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন।
মঈন গায়ে মাখে না। বরং বিস্মিত চোখে তাকায়,
-আপনার?
-ক্যান? আশ্চর্য ক্যান? দেওয়ানি করলে সাহিত্য করা যায় না? রবীন্দ্রনাথ বজরায় বইসে গান কবিতা লিখতে পারে, আমরা খালি হুক্কা টানি আর মুজরা দেখি? কবিতা লিখতে হইলে ঝোলা জামা স্যান্ডেল পায়ে রাস্তায় ঘুরতে হবে? চুল দাড়ি লম্বা করতে হবে?
-না না আপনি কবিদের এত খাটো করে দেখছেন কেন! আমি তো অনেক কবির কবিতাই পড়ি, এত গভীর বোধ…!
-এর সাথে তদন্তের কি সম্বন্ধ?
মঈন সশ্রদ্ধ চোখে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-আর কিছুই লেখেননি?
মইনের থাকার বন্দোবস্ত হলো বাইরের কাচারি ঘরে। দেওয়ানি না থাকলেও গার্মেন্টস, ইটের ভাটা, মাছের ঘেরে এদের কম আয় না। বাড়িতে লোক লস্কর পেয়াদা সব আছে। শুধু বাড়ির হকদার বাসিন্দা কেউ নাই। দেহরক্ষীও আছে দেওয়ান সাহেবের। তবুও জিডি কেন?
জিডির কারণ এই মহল বন্ধা মহল। এতে সবাই বাস করতে পারে। মহলের হকদারা পারে না। অথচ কোনো এক বিচিত্র কারণে দেওয়ান সাহেব বা আর কারো গায়ে আঁচ ফেলে না। গাছেরও প্রাণ আছে, এই মহল যেন খুদিত পাষাণসম প্রাণহীন! এত নিস্তব্ধতায় ঘুমে চটে যায়।
রাতের কোনো এক প্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে সে টের পায় সে ঘুমিয়েছিল। কিসের এক তীব্র গন্ধ নাকে আসে। কোনো ফুল বা সুগন্ধীর না, কোনো হার্বের গন্ধ। মঈন খেয়াল করে জিডিতে কিছুর উল্লেখ ছিল না। সন্দেহ তালিকায় কোন নাম নেই। শুধু এক বিশেষ গন্ধ। আর এই মুহূর্তে মঈনের যে গন্ধে ঘুম ভেঙেছে সেটা মেথির গন্ধ! এত কাছে যেন কেউ এক মাথা মেথি মেখে ঠিক তাঁর পাশে বসে শ্বাস ফেলছে। তাঁর গরম শ্বাস মঈনের মুখের ওপর পড়ে।
মঈন ধড়ফড় করে এক লাফে উঠে বসে। সাথে সাথে ঘ্রাণ শব্দ শ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়। “গন্ধ লেগে” থাকে না!
তাঁর মানে, সে কোন তালিকাভুক্ত?
জলের ধারে দাঁড়ালে শরীরের ভেতর কেমন টান আসে, দ্রবীভ‚ত হয়ে মিশে যেতে ইচ্ছা হয়। মানবদেহে তিনভাগ পানি বলে? মঈন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে খান সাহেবদের এক জলমহলের ধারে। এরা মাছের ঘের বললেও মঈন এসবের নাম দিয়েছে জলমহল। অন্দরমহল এই মহল সেই মহল বললে খানদানি ফ্লেবার আসে। এই মাছের ঘের চারপাশে ঘিরে রাখা। মাছ চোরের উপদ্রব ঠেকাতে এই বেড়া কতটা উপযোগী? মঈন সামান্য ধাক্কা দিয়ে পরখ করে।
– সরেন এইখান থেইকে!
হতভম্ব চোখ পেছনে ফিরিয়ে কণ্ঠের মালিককে দেখতে পায়। রুস্তম পেয়াদা। কণ্ঠে বজ্র থাকলেও চোখে আগুন নাই। বরং ভাবলেশহীন আবেগ বিবর্জিত চেহারা। মঈন প্রশ্ন করে,
– কি সমস্যা?
রুস্তম আগের মতো বিকারহীন কণ্ঠ,
– মাছ খারাপ। কুমির আসে।
– কুমির! মিঠা পানিতে? বাংলাদেশে মিঠা পানির শেষ কুমির ধলা পাহাড় কালা পাহাড় বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজারে ছিল!
– মধুমতি নাওতে কুমির পাওয়া গেছে সংবাদ পড়েন নাই?
– মধুমতি নদীর শাখা এটা? কুমির আসলে মাছ খেয়ে ফেলে না?
– এত দিকদারি কইরেন না তো! দেওয়ান সাহেব শুনলে নাখোশ হইবো। সইরে আসেন।
রুস্তম পেছন ফিরে হাটা দিল। এবং রুস্তমের প্রস্থানের সাথে সাথেই সেই গন্ধটা আবার নাকে এলো।
তবে গন্ধটা কি রুস্তমের চুল থেকে আসছে না পানির দিক থেকে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল না। যদিও বাতাসের চলন পানির দিক থেকে। তবে রুস্তমের একটা অভ্যাস লক্ষ্য করা গেল, সে থেকে থেকেই খুক খুক করে কাশে। প্রতিটি মানুষের কিছু লক্ষ্যযোগ্য বিষয় থাকে, হাঁটার আওয়াজ, গলা খাকারি, শ্বাসের শব্দ যা সে নিজে বেমালুম জানেই না।
আজ রাতে মঈন জেগে থাকতে চায়। তাই দুপুরের মোটামুটি সরব মহলেই সে ঘুমের কোটা পূর্ণ করে রেখেছে।
এখন মাঝরাত। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে সে ওঁৎ পেতে থাকে।
এই তো! আবার সেই গন্ধ! কিন্তু এবার তার খুব কাছে না, ঘরের বাইরে।
তাঁর নাক ও কানের ক্ষমতা ভালো। গন্ধ অনুসরণ করতে করতে শব্দের সন্ধান পেয়ে থমকে যায়।
কেউ কিছু একটা পানিতে ফেলেছে, ভারী কিছু। এবং মাছের সেই ঘেরের দিক থেকে শব্দ আসছে। কুমিরের সাথে কি শব্দের কোনো সম্পর্ক থাকবে? নচেৎ দিনে যে ঘেরের ধারে কেউ আসে না, রাতে কে আসবে বা নামবে?
ঝাঁপ দেয়া জিনিসটা কি দেখার জন্য সরাসরি টর্চের আলো ফেলে পানিতে শব্দের দিক অনুসরণ করে।
– কে?
রুস্তমের কণ্ঠ। সে ধার ঘেসেই দাঁড়ানো, যেখানটায় ঘেরের বেড়া খোলা। দুজনেই দুজনকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। তবে রুস্তমের নার্ভের জোর আছে! এই অবস্থাতেও সে খুব এলোমেলো না হয়ে উলটা মঈনকেই ফাঁপর দিল,
– আপনে!!! এত রাতে এইখানে কি? বললাম না এই পানিতে…
– তাহলে আপনিই বা কি করছেন? কি ফেললেন পানিতে?
আবারো টর্চ ফেলে মঈন। পানিতে বুদ বুদ উঠতে দেখা যাচ্ছে। প্রাণী কিছু?
– কি ফেলেছেন?
– মরা মাছ।
– মাছের ঘেরে! বিষ ছড়াবে না?
রুস্তম যেন গ্রানাইডের চোখে তাকিয়ে আছে।
-রুস্তম আপনি কি ফেলেছেন সত্য না বললে আমি এখন এই পানিতে ঝাঁপ দেব।
আচমকা রুস্তম মঈনকে পাকা জোলা তুলে ধরার চেষ্টা করে। মঈনের অল্প বয়স আর সাইজ দেখে সে বিভ্রান্ত হয়েছে। গরন হালকা পাতলা হলেও মঈন কিক বক্সিংয়ে দক্ষ।
ঝটকা মেরে সরিয়ে মঈন টর্চ ফেলে পানিতে নামার জন্য পা দিতেই হা করে আসে দাঁতালো মাছের ঝাঁক। পিরানহা!
পেছন থেকে রুস্তমের চিৎকার আর সেই সাথে ভারী কিছুর আঘাতে মঈন ঘাটেই ঘুরে পড়ে যায়।
জ্ঞান ফিরলে যে ঘর নজরে আসে সেটা মঈনের থাকার ঘর না।
যার পালঙ্ক দখল করে সে অনিচ্ছাকৃত ভাবে শুয়ে আছে সে পাশের আরাম কেদারায় বসে ছড়ি মাটিতে ঘষছেন।
দেওয়ান সাহেবের বয়স ষাটোর্ধ? না কাছাকাছি? ঠিক কত তা আন্দাজ করা যায় না। তবে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন, এটার কারণ জানা গেছে কোনো দুর্ঘটনা। আর দেয়ালে টাঙ্গানো ফ্রেমের মানুষকে তিনি কতটা ধারণ করে আছেন জানা না গেলেও তাঁর জীবনে নারীর আনাগোনা সম্ভবত থেমে নেই। কারণ সে পালঙ্কে লম্বা চুল আর মেয়েলি সুবাস পাচ্ছে। এবং তীব্র ভাবে মেথির গন্ধ।
– ব্যথা আছে?
খান সাহেব জিজ্ঞেস করার পরেই তার মাথার ব্যথাটা ফিরে এলো। ব্যথা আছে। কিন্তু তাঁকে আঘাত কেন করা হলো?
– কি উদ্দেশ্যে ঘেরের পাড়ে গেছিলেন?
মঈনের রাগে গা রি রি করছে। নিজের বাড়িতে মাস্তান রাখে, ঘেরের মধ্যে পিরানহা পালে, এদিকে প্রাণহানির আশঙ্কায় জিডি করে রাখে! এসব কি তামাশা!
– নুস্তম ঘেরে কাকে ফেলেছে?
উত্তর নাই।
– কতজনকে ফেলেছে এই ঘেরে আজ অবধি?
খান সাহেব ভ্রূ উঁচিয়ে ধনুকের বাঁকের মতো তাকালেন। তাকানোতে বিস্ময় ছিল; বিরক্তি ছিল, ভীতি ছিল না!
– রুস্তম কাউরে ফেলছে দেখছেন আপনি?
মঈন জবাব দিল না। অহেতুক প্রশ্নের জবাব দিতে ভালো লাগে না।
– আপনি কেন জিডি করেছেন? আপনার বংশধর তো নাই! কার প্রাণ কে নাশ করবে?
– বংশধর নাশ করে বইলেই তো নাই।
মঈনের হত বুদ্ধির মত লাগে। উঠে বসতে চেষ্টা করে পরে যায়। মাথার ব্যথাটা এখনো বেশ।
– কীভাবে নাশ করে বলেন তো?
খান সাহেব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মরা চোখ। ফ্যাসফ্যাসে শ্লেষা জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয়,
– সন্তান রাখে না পেটে। খালাস করে ফেলে।
মইনের জট ছাড়ার বদলে আরো পেঁচিয়ে যায়। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ে মঈন।
– যে রাখে না তাকেই কি পিরানহার পেটে দিতে ঘেরে ছুড়ে দিলেন?
খান সাহেব এখন বিস্মিতও না। তাঁর ঘোলাটে দৃষ্টি বহু দূরে। মঈনের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই।
ক্ষণকালের বিরতির পর আরো ক্ষীণ কণ্ঠে মুখ খুললেন,
– তাকে। তার আগে যারা ছিল…।
– আগে? কজন? কেউ আপনার বাচ্চা পেটে কেন রাখবে? আর কেনই বা তারা এখানে আসবে? ওরা কি আপনার স্ত্রী?
– না! আমার স্ত্রী একজনই ছিলেন।
খান সাহেব বেশ উত্তেজিত। মঈন আবেগ প্রশমিত হবার সুযোগ দেয়। থেমে আবার প্রশ্ন করে,
– তাহলে অন্যরা?
– অন্যদের নিয়ে আসি আমার বংশ ধারণের জন্য। রাখে না। তাই তাদেরও আমি রাখি না!
মঈন কষ্ট করে উঠে বসে। থানায় আগেই জানিয়ে রেখেছিল। এবার পকেটের মোবাইল আঙ্গুল টিপে এসএমএস পাঠাল অফিসার পাঠাতে। ইচ্ছে করেই মেসেজ দেরিতে পাঠানো, কারণ কিছু কথা খান সাহেবকে বলার আছে তাঁর, যা দ্বিতীয় কারো শোনার নয়। কান সজাগ রাখলোরুস্তমের কাশী শোনা যায় কিনা।
– খান সাহেব, আপনি অসুস্থ। আপনার চিকিৎসা হওয়া দরকার। আপনাকে আমি খুব ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব…
খান সাহেবের হুঙ্কার এই সময়ে কাক্সিক্ষতই ছিল! এই শ্রেণির মানুষেরা হুঙ্কার ছাড়া রাগ দেখাতে পারে না। এরা বাঘ সিংহ প্রজাতির!
– তুমি বলতে চাও আমি পাগল! কিসের ভিত্তিতে বলতে চাও?
– বলছি। কিন্তু অনুরোধ, আমার কথা শেষ হবার আগে কাউকে ডেকে বা আঘাত করে আমাকে থামাবেন না। আপনার সস্তান কেউ ধারণ করতে পারবে না খান সাহেব, আপনি জানেন। আপনি জানেন সেই সক্ষমতা আপনার নাই। আপনি নপুংসক।
খান সাহেব রাগে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে মুখে প্রায় ফেনা তুলে করে রুস্ত কে ডাকতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন ওয়াদা স্মরণ করায়।
– আমার স্ত্রী যে সন্তান জন্ম দিয়েছিল সেই কথা সকলে জানে অত্র এলাকায়!
– জী। তো সেই সন্তান কোথায়?
– এরাই মেরে ফেলেছে!
– কেউ মারেনি। আপনার স্ত্রী সন্তানসহ পালিয়ে গিয়েছিল। নাহলে আপনি তাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেন!
দেওয়ান সাহেব দুই হাত বজ্র মুঠি করে মঈনের কণ্ঠ রোধ করতে আসলেন। মঈন আটকে দিল। খান সাহেব কাঁপতে কাঁপতে মুখে লালা ঝরিয়ে উচ্চারণ করলেন,
– আমার স্ত্রীকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসাতাম!
– অবশ্যই বাসতেন। হয়তো এখনো বাসেন। কিন্তু তাঁর ঔরসজাত সন্তান আপনার ছিল না, কারণ সেই ক্ষমতাই আপনার ছিল না। আপনার স্ত্রীকে আপনি জোর করে আপনার কর্মচারীর সন্তান ধারণ করিয়েছেন। এবং সেই কর্মচারীকেও খুন করেছেন। আপনার স্ত্রীকে কঠিন নজরবন্দি রেখেছিলেন। তিনি প্রথম সুযোগেই ভয়ে এবং লজ্জায় সন্তানসহ পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দেওয়ান সাহেব সরু চোখে মঈনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর স্ত্রী মরে যায়নি, পালিয়ে গেছে সেটা এই এলাকায় কেউ জানে না! তিনি এক ভবঘুরে পাগলি এনে তার দগ্ধ মরা দেহ দেখিয়ে সবাইকে প্রমাণ দেখিয়েছেন স্ত্রী আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেছে, সন্তান হারানোর কষ্টে।
এই রহস্য এই ছেলে জানবে কীভাবে?
– দেওয়ান সাহেব। আপনার সেই স্ত্রী সেই সন্তানসহ বহু দূরে পালিয়ে বেঁচেছেন, সন্তানকেও বাঁচিয়েছেন। এবং আজকে সেই সন্তান আপনার স্ত্রীর অনুরোধেই আপনার এই রোগ সাড়াতে এভাবে ফেলুদা সেজে এই মহলে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে!
দেওয়ান সাহেব স্নায়ুক্ষয় রোগে আক্রান্তের মত ভেঙ্গে চুড়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন!
বহু স্থানে স্ত্রীর খোঁজ করেছেন। স্ত্রীর মত মেথির গন্ধ মাখা কোনো মেয়ের সাথে সামান্য মিল পেলে তাঁকে মহলে আনিয়েছেন। সন্তান ধারণের চেষ্টা করে গেছেন। বহু পড়া পানি, তাবিজ-কবজ করেছেন। শরীর ক্ষয়ে গেছে, তবুও যতবার ভাবেন তার স্ত্রী তাঁকে ফেলে চলে গেছেন তার অক্ষমতা আর কৃতকর্মের জন্য- তিনি এই অপমান, যন্ত্রণা ভুলতে আবারো এই একই নেশায় মত্ত হন।
আজ সব শেষ। খান সাহেব বরং বেশ শান্ত, স্থিত। যেন বেশ আয়োজন করেই অপেক্ষায় ছিলেন পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার। “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়…”
মঈনকে শুধু বললেন, ফাঁসির আগে তিনি তাঁর স্ত্রীকে একবার শুধু দেখতে চান। গারদের ভিতরে তাঁকে তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এই যে নাটকটা করলেন থানায় জিডি করে, তার প্রয়োজন ছিল, কারণ, শরীর ক্ষয়ে আসছে। ভেবেছিলেন গ্রেফতার হলে এত বড় অপরাধের ঘটনা হয়তো পত্রিকায় আসবে। তখন তিনি স্ত্রীর জন্য আকুতি কোনো রিপোর্টারের বরাতে লিখতেন পত্রিকা ওয়ালাদের কাছে, সে যদি বেঁচে থাকে! যদি খবর পায়! যদি আসে। মঈনকে পাওয়ায় বড় উপকার হয়ে গেল! এই মহল তো তাঁর অপেক্ষায়ই ছিল। নিলে নেবে, না নিলে ওয়াকফ করবে। শুধু তাঁর স্ত্রী যেন জানতে পান, তিনি মানুষটা ভিতরের অক্ষমতায় পশু হয়ে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ভালোবাস তো, তাঁর অক্ষমতাও সে ধারণ করতো। কিন্তু খান সাহেব তখন গাফেল ছিলেন। গোমরাহীদের মতো বংশধর খুঁজে গেছেন। কিন্তু তাঁর ভেতরে যে মানুষ, তার বুকের যে গেরস্থালি তাতে শুধু তাঁর সেই মানুষের গন্ধই সারা জীবন লেগে আছে।
সূএ:জাগো নিউজ