হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি

কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের সমাজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি। এ গরুর গাড়ি নিয়ে জনপ্রিয় অনেক ভাওয়াইয়া গানও রচিত হয়েছে। যেমনটা “ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে”। গাড়িয়াল না থাকায়, গাড়িয়াল ভাইয়ের অমৃত কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গানও হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে গরুরগাড়ি তৈরির কারিগররা।

 

এক সময় গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাহন ছিল গরুর গাড়ি। মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দু-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা তো দূরের কথা, গ্রামের ছেলেমেয়েরাও এখন গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নয়। তবে বর্তমানে এ গরুর গাড়ির দেখা মেলে কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারী গ্রামে। এসময় ওই গ্রামে তছলি মামুদ বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গরুর গাড়ি। চিরায়িত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে গরুর গাড়ির কথা।

 

একই ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের প্রবীণ গাড়িয়াল জরিয়াল উদ্দীন বলেন, মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। আগে আমাদের এলাকায় গরুর গাড়ির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই গরুর গাড়ি ছিল যা জীবিকার প্রধান উৎস ছিল।

গরুর গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক।

 

ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাবেদুল ইসলাম সানবীম বলেন, এক সময় কৃষি ফসল বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল গরুর গাড়ি। ধান কাটার সময় লাইন ধরে গরুর গাড়িতে করে ধান নেয়া হত কৃষকের উঠানে। গাড়িয়ালদের ভাওয়াইয়ার সুরে মুগ্ধ হত কৃষক-কৃষাণি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী যেত গরুর গাড়ি নিয়ে। সারিবদ্ধ গরুর গাড়ি দেখার জন্য রাস্তার দু’পাশে মানুষ ভিড় করতো।

 

নীলফামারী জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা কে এম আরিফুজ্জামান বলেন, নবান্ন বা নতুন বছরকে ঘিরে আয়োজন করা হত গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতার। হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করতো প্রতিযোগিতার দৃশ্য। এসবের কিছুই নেই এখন। গ্রামগঞ্জে দু’একজন বড় গৃহস্থ প্রাচীন ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে শখের বসে। কিন্তু বর্তমানে নীলফামারীর গ্রামীণ জনপথ থেকে গরুর গাড়ি হারিয়ে যাওয়ায় এসব অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা। আমাদের জীবন থেকে হারাচ্ছে এ রকম নানা ঐতিহ্য। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরু গাড়িকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চাঁদাবাজদের তালিকা তৈরি, দুদিনের মধ্যে অভিযান: ডিএমপি কমিশনার

» গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করে শেষ মুহূর্তে ‘শাটডাউন’ এড়ালো যুক্তরাষ্ট্র

» বাসে তল্লাশি চালিয়ে দেশীয় তৈরি পাইপ গানসহ দুই যাত্রী গ্রেপ্তার

» সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হাসান আরিফের জানাজা সম্পন্ন

» উত্তর ভারতের প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামানো হচ্ছে ‘পুষ্পা-২’

» ‘স্পিরিটস অব জুলাই’ কনসার্ট ঘিরে যান চলাচলে নির্দেশনা

» সাগরে নিম্নচাপ, দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি শুরু

» বেইলি ব্রিজ ভেঙে তুরাগ ন‌দে ট্রাক, বিকল্প পথে চলার অনুরোধ

» সড়ক ও পরিবহন খাতে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

» ক‍্যানবেরায় ১২ প্রবাসীকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অ‍্যাওয়ার্ড প্রদান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি

কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের সমাজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি। এ গরুর গাড়ি নিয়ে জনপ্রিয় অনেক ভাওয়াইয়া গানও রচিত হয়েছে। যেমনটা “ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে”। গাড়িয়াল না থাকায়, গাড়িয়াল ভাইয়ের অমৃত কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গানও হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে গরুরগাড়ি তৈরির কারিগররা।

 

এক সময় গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাহন ছিল গরুর গাড়ি। মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দু-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা তো দূরের কথা, গ্রামের ছেলেমেয়েরাও এখন গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নয়। তবে বর্তমানে এ গরুর গাড়ির দেখা মেলে কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারী গ্রামে। এসময় ওই গ্রামে তছলি মামুদ বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গরুর গাড়ি। চিরায়িত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে গরুর গাড়ির কথা।

 

একই ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের প্রবীণ গাড়িয়াল জরিয়াল উদ্দীন বলেন, মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। আগে আমাদের এলাকায় গরুর গাড়ির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই গরুর গাড়ি ছিল যা জীবিকার প্রধান উৎস ছিল।

গরুর গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক।

 

ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাবেদুল ইসলাম সানবীম বলেন, এক সময় কৃষি ফসল বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল গরুর গাড়ি। ধান কাটার সময় লাইন ধরে গরুর গাড়িতে করে ধান নেয়া হত কৃষকের উঠানে। গাড়িয়ালদের ভাওয়াইয়ার সুরে মুগ্ধ হত কৃষক-কৃষাণি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী যেত গরুর গাড়ি নিয়ে। সারিবদ্ধ গরুর গাড়ি দেখার জন্য রাস্তার দু’পাশে মানুষ ভিড় করতো।

 

নীলফামারী জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা কে এম আরিফুজ্জামান বলেন, নবান্ন বা নতুন বছরকে ঘিরে আয়োজন করা হত গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতার। হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করতো প্রতিযোগিতার দৃশ্য। এসবের কিছুই নেই এখন। গ্রামগঞ্জে দু’একজন বড় গৃহস্থ প্রাচীন ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে শখের বসে। কিন্তু বর্তমানে নীলফামারীর গ্রামীণ জনপথ থেকে গরুর গাড়ি হারিয়ে যাওয়ায় এসব অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা। আমাদের জীবন থেকে হারাচ্ছে এ রকম নানা ঐতিহ্য। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরু গাড়িকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com