এ দেশে শ্রীলঙ্কার অবস্থা হওয়ার আশঙ্কা নেই

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: শ্রীলঙ্কার দুর্দশা দেখে সারা বিশ্বের মানুষের মতো আমাদের দেশের লোকেরাও শঙ্কিত। কয়েক বছর আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল উন্নয়নের নজির। সেখানে শিক্ষার হার ১০০%, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থা ছিল অন্যান্য স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয়। সে দেশটিই যখন কয়েক বছরের ব্যবধানে আজ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে সেখানে শঙ্কা থাকাই স্বাভাবিক। যারা বলছে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা বাংলাদেশে হতে পারে তাদের এক বিরাট অংশ হচ্ছে সে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা দেখে হতাশায় ভুগছে, যারা যে কোনো উপায়ে এ সরকারের পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। তবে আবার কিছু মানুষ তাদের মন থেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন, কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে নয়, এদের মধ্যে সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদেরের নাম উল্লেখযোগ্য, কেননা তিনি কোনো রাজনৈতিক মতলবে প্রভাবিত হয়ে এমন কথা বলবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। সংসদেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অন্যরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার অবস্থা বাংলাদেশে হবে না এবং বাংলাদেশ ঋণ এবং প্রকল্পের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আমি একজন অর্থনীতিবিদ নই বটে, কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের আলোকে এটুকু বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা যুক্তি-বিবর্জিত নয়। তবে চীনের টাকার বস্তা থেকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। শ্রীলঙ্কার আজকের অবস্থার জন্য চীন যে বহুলাংশে দায়ী সে কথা বিশ্বব্যাপী সবাই বলছেন। ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটি আজ পৃথিবীর অভিধানে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে। এ ফাঁদ পেতে চীন প্রথমে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর দখলে নেয় ৯৯ বছরের জন্য, আর এখন মতলব আঁটছে গোটা শ্রীলঙ্কা দখলে নেওয়ার। অলৌকিক কিছু না ঘটলে শ্রীলঙ্কাকে দেশ বিক্রির পথেই এগোতে হবে। অতীতে শ্রীলঙ্কা উন্নয়নে চমক লাগালেও সে দেশটির অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সে দেশে বেড়াতে যাওয়া পর্যটক থেকে পাওয়া অর্থ, করোনা মহামারির সময় যে শিল্পে ধস নেমেছে, ছিল শ্রীলঙ্কার বিদেশি অর্থ উপার্জনের একটি প্রধান উৎস। আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প নেই বললেই চলে। এ শিল্প থেকে আমাদের আয় নগণ্য। এক সময় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শ্রীলঙ্কার বড় অবস্থান আজ আর নেই, কারণ এ শিল্পে আজ তুরস্ক, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, মিসর এবং এমনকি চীনও প্রতিদ্বন্দ্বী। মহামারিকালে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তেমন ধস নামেনি, যেটি শ্রীলঙ্কায় হয়েছে। চা রপ্তানিতেও আজ শ্রীলঙ্কার রয়েছে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী। দুর্ভাগ্যবশত শ্রীলঙ্কা তাদের সুদিনে রপ্তানি দ্রব্য বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। যেখানে গত ১২ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে যোগ হয়েছে, জাহাজ, বৈদ্যুতিক দ্রব্য, কাঁচা পাট এবং পাটজাত দ্রব্য, এমনকি ওষুধপত্র। তাছাড়াও এমন অনেক কিছু এখন রপ্তানি হচ্ছে যেমন ফুল, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, মাছের আঁশ, ছাই, পাটখড়ি, কার্বন, মাথার চুল ইত্যাদি যা অতীতে রপ্তানির চিন্তাই ছিল না। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার অন্যতম শীর্ষ সূত্র হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের পাঠানো টাকা, যা করোনা মহামারির সময়েও কমেনি। বাংলাদেশের কর্মীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বহু দেশে। তাছাড়া জাতিসংঘ মিশনে যাওয়া সামরিক এবং পুলিশ সদস্যরাও বেশ টাকা পাঠাচ্ছেন, যার কারণে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ দিন দিনই বেড়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বহু নাগরিক বিদেশে কর্মরত হলেও তাদের অধিকাংশই দেশে টাকা না পাঠিয়ে অবস্থানরত দেশেই টাকা জমাচ্ছে দেশে গৃহযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে শ্রমবাজার রক্ষা এবং বর্ধনের জন্য প্রচুর পদক্ষেপ নেওয়ায় সে বাজারে আমাদের অবস্থান পাকাপোক্ত রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী এবং পুলিশও আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখায় জাতিসংঘ মিশনের তালিকায় তারা প্রথম ক্রমিকে রয়েছেন। শ্রীলঙ্কা এভাবে বিদেশে শ্রমবাজার রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তামিল-সিংহলি গৃহযুদ্ধের কারণে তাদের পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হওয়ায় তারা জাতিসংঘের মিশনসমূহে স্থান পায়নি। এটা ঠিক যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা বড় হবে, তখন আর তারা দেশে এখনকার মতো টাকা পাঠাবে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই প্রভৃতি দেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নেই বলে সে সব দেশে থাকা শ্রমজীবীরা টাকা পাঠাতে থাকবে। তার পরও মানতে হবে যে, এই শ্রমবাজারকে কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা না ভেবে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, দেশে আরও অধিক রপ্তানি পণ্যের পথ উন্মুক্ত করতে হবে, আমদানি কমাতে হবে। শ্রীলঙ্কার আজকের পরিণতির অন্যতম কারণ শস্যহানি। সেখানেও ছিল চীনের কারসাজি। চীন শ্রীলঙ্কার কাছে এমন জৈব সার বিক্রি করেছিল যা সে দেশের জন্য অনুপযুক্ত। শ্রীলঙ্কা সে সার ফেরত দিয়ে, টাকা ফেরত চাইলে, চীন সার ফেরত নেয়নি ও টাকাও ফেরত দেয়নি। কারণ শ্রীলঙ্কা আগে থেকেই চীনের কবজাবন্দি হয়ে গেছে, যার ফলে চীনের নির্দেশ উপেক্ষা করার ক্ষমতা শ্রীলঙ্কার ছিল না। সে দিক থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। কারণ গত ১২ বছরে আমাদের কৃষি উৎপাদন শুধু দৃষ্টিনন্দনভাবে বেড়েই যায়নি, এতে এমন বিপ্লব ঘটানো হয়েছে যে, বহু অপরিচিত ফল-ফলারি আজ বাংলাদেশে উৎপন্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষিতে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কারণে আজ বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। শ্রীলঙ্কায় আর্থিক পতনের বড় কারণ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে দেশটি এমন সব মেগা প্রকল্পে হাত দিয়েছিল, যা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অপ্রয়োজনীয় এবং অলাভজনক, যেমন হাম্বানটোটা বন্দর, যা অবশেষে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য বর্গা দিতে শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে দৃশ্যত এমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। যে সব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এগুলো থেকে দেশের উন্নয়ন এবং আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নিয়ে যে সংশয় ছিল, সে ভয়কে ভুল প্রমাণিত করে এটি আজ দৃশ্যমান, যা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে। সৌভাগ্যবশত এই প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিতে হয়নি। সমুদ্র সম্পদ আহরণের জন্য যে সব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিশ্চয়ই আমাদের অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙা করে তুলবে।

 

গৃহযুদ্ধে জয়ের পর রাজাপক্ষ পরিবারের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে এই পরিবারের সদস্যরাই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী প্রভৃতি পদ দখল করে এমন এক সরকার গঠন করেছে যার সদস্যরা চরম অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে দেশ চালাতে তাদের ব্যর্থতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটেনি বা ঘটার সম্ভাবনাও নেই। তাই আমাদের চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে চীনের টাকার বস্তা থেকে চোখ সরাতে হবে।

 

চীন বিভিন্ন দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলার জন্য তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ করতে চাইছে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে অনেক দেশই এই প্রকল্প থেকে সরে গেছে, যার সর্বশেষ প্রমাণ নেপাল এবং মালয়েশিয়া। নেপাল সম্প্রতি এ প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে চীনের মন্ত্রীর মুখের ওপর অস্বীকৃতি জানিয়েছে। চীন বাংলাদেশকে এ প্রকল্পে আকৃষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত।

 

এ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের গভীর এবং ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দেখতে হবে এর ফলে আমাদের মঙ্গল হবে নাকি বিপদ হবে। তাছাড়া প্রকল্প গ্রহণের আগে ব্যাপক গবেষণা করে দেখতে হবে সেগুলো থেকে মুনাফা অর্জন করা যাবে নাকি সেগুলো ঋণের বোঝাকেই বাড়াবে? এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে বিশদভাবে চিন্তা করেই তা করা হবে। এই নীতি সব সময় অনুসৃত হলে আমরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারি। একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিশ্ব পরিস্থিতি যে কোনো সময় পূর্বাভাস না দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যেমনটি হয়েছে করোনা মহামারির কারণে এবং সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য। এসব অদৃশ্য, অচিন্তনীয়, পূর্বাভাসহীন পরিস্থিতির জন্য সব সময় তৈরি থাকতে পারার ওপর নির্ভর করে একটি সরকারের যোগ্যতা। আমাদের বর্তমান সরকার সে পরীক্ষায় নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন বিধায় এই সরকারকে আরও বহু বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। এমন কাউকে ক্ষমতায় আনা যাবে না যারা অদৃশ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকবে না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূূএ: বাংলাদেশ প্রতিদদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

এ দেশে শ্রীলঙ্কার অবস্থা হওয়ার আশঙ্কা নেই

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: শ্রীলঙ্কার দুর্দশা দেখে সারা বিশ্বের মানুষের মতো আমাদের দেশের লোকেরাও শঙ্কিত। কয়েক বছর আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল উন্নয়নের নজির। সেখানে শিক্ষার হার ১০০%, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থা ছিল অন্যান্য স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয়। সে দেশটিই যখন কয়েক বছরের ব্যবধানে আজ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে সেখানে শঙ্কা থাকাই স্বাভাবিক। যারা বলছে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা বাংলাদেশে হতে পারে তাদের এক বিরাট অংশ হচ্ছে সে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা দেখে হতাশায় ভুগছে, যারা যে কোনো উপায়ে এ সরকারের পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। তবে আবার কিছু মানুষ তাদের মন থেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন, কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে নয়, এদের মধ্যে সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদেরের নাম উল্লেখযোগ্য, কেননা তিনি কোনো রাজনৈতিক মতলবে প্রভাবিত হয়ে এমন কথা বলবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। সংসদেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অন্যরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার অবস্থা বাংলাদেশে হবে না এবং বাংলাদেশ ঋণ এবং প্রকল্পের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আমি একজন অর্থনীতিবিদ নই বটে, কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের আলোকে এটুকু বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা যুক্তি-বিবর্জিত নয়। তবে চীনের টাকার বস্তা থেকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। শ্রীলঙ্কার আজকের অবস্থার জন্য চীন যে বহুলাংশে দায়ী সে কথা বিশ্বব্যাপী সবাই বলছেন। ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটি আজ পৃথিবীর অভিধানে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে। এ ফাঁদ পেতে চীন প্রথমে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর দখলে নেয় ৯৯ বছরের জন্য, আর এখন মতলব আঁটছে গোটা শ্রীলঙ্কা দখলে নেওয়ার। অলৌকিক কিছু না ঘটলে শ্রীলঙ্কাকে দেশ বিক্রির পথেই এগোতে হবে। অতীতে শ্রীলঙ্কা উন্নয়নে চমক লাগালেও সে দেশটির অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সে দেশে বেড়াতে যাওয়া পর্যটক থেকে পাওয়া অর্থ, করোনা মহামারির সময় যে শিল্পে ধস নেমেছে, ছিল শ্রীলঙ্কার বিদেশি অর্থ উপার্জনের একটি প্রধান উৎস। আমাদের দেশে পর্যটন শিল্প নেই বললেই চলে। এ শিল্প থেকে আমাদের আয় নগণ্য। এক সময় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শ্রীলঙ্কার বড় অবস্থান আজ আর নেই, কারণ এ শিল্পে আজ তুরস্ক, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, মিসর এবং এমনকি চীনও প্রতিদ্বন্দ্বী। মহামারিকালে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তেমন ধস নামেনি, যেটি শ্রীলঙ্কায় হয়েছে। চা রপ্তানিতেও আজ শ্রীলঙ্কার রয়েছে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী। দুর্ভাগ্যবশত শ্রীলঙ্কা তাদের সুদিনে রপ্তানি দ্রব্য বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। যেখানে গত ১২ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে যোগ হয়েছে, জাহাজ, বৈদ্যুতিক দ্রব্য, কাঁচা পাট এবং পাটজাত দ্রব্য, এমনকি ওষুধপত্র। তাছাড়াও এমন অনেক কিছু এখন রপ্তানি হচ্ছে যেমন ফুল, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, মাছের আঁশ, ছাই, পাটখড়ি, কার্বন, মাথার চুল ইত্যাদি যা অতীতে রপ্তানির চিন্তাই ছিল না। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার অন্যতম শীর্ষ সূত্র হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের পাঠানো টাকা, যা করোনা মহামারির সময়েও কমেনি। বাংলাদেশের কর্মীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বহু দেশে। তাছাড়া জাতিসংঘ মিশনে যাওয়া সামরিক এবং পুলিশ সদস্যরাও বেশ টাকা পাঠাচ্ছেন, যার কারণে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ দিন দিনই বেড়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বহু নাগরিক বিদেশে কর্মরত হলেও তাদের অধিকাংশই দেশে টাকা না পাঠিয়ে অবস্থানরত দেশেই টাকা জমাচ্ছে দেশে গৃহযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে শ্রমবাজার রক্ষা এবং বর্ধনের জন্য প্রচুর পদক্ষেপ নেওয়ায় সে বাজারে আমাদের অবস্থান পাকাপোক্ত রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী এবং পুলিশও আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখায় জাতিসংঘ মিশনের তালিকায় তারা প্রথম ক্রমিকে রয়েছেন। শ্রীলঙ্কা এভাবে বিদেশে শ্রমবাজার রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তামিল-সিংহলি গৃহযুদ্ধের কারণে তাদের পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হওয়ায় তারা জাতিসংঘের মিশনসমূহে স্থান পায়নি। এটা ঠিক যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা বড় হবে, তখন আর তারা দেশে এখনকার মতো টাকা পাঠাবে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই প্রভৃতি দেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নেই বলে সে সব দেশে থাকা শ্রমজীবীরা টাকা পাঠাতে থাকবে। তার পরও মানতে হবে যে, এই শ্রমবাজারকে কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা না ভেবে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, দেশে আরও অধিক রপ্তানি পণ্যের পথ উন্মুক্ত করতে হবে, আমদানি কমাতে হবে। শ্রীলঙ্কার আজকের পরিণতির অন্যতম কারণ শস্যহানি। সেখানেও ছিল চীনের কারসাজি। চীন শ্রীলঙ্কার কাছে এমন জৈব সার বিক্রি করেছিল যা সে দেশের জন্য অনুপযুক্ত। শ্রীলঙ্কা সে সার ফেরত দিয়ে, টাকা ফেরত চাইলে, চীন সার ফেরত নেয়নি ও টাকাও ফেরত দেয়নি। কারণ শ্রীলঙ্কা আগে থেকেই চীনের কবজাবন্দি হয়ে গেছে, যার ফলে চীনের নির্দেশ উপেক্ষা করার ক্ষমতা শ্রীলঙ্কার ছিল না। সে দিক থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। কারণ গত ১২ বছরে আমাদের কৃষি উৎপাদন শুধু দৃষ্টিনন্দনভাবে বেড়েই যায়নি, এতে এমন বিপ্লব ঘটানো হয়েছে যে, বহু অপরিচিত ফল-ফলারি আজ বাংলাদেশে উৎপন্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষিতে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কারণে আজ বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। শ্রীলঙ্কায় আর্থিক পতনের বড় কারণ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে দেশটি এমন সব মেগা প্রকল্পে হাত দিয়েছিল, যা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অপ্রয়োজনীয় এবং অলাভজনক, যেমন হাম্বানটোটা বন্দর, যা অবশেষে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য বর্গা দিতে শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে দৃশ্যত এমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। যে সব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এগুলো থেকে দেশের উন্নয়ন এবং আয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নিয়ে যে সংশয় ছিল, সে ভয়কে ভুল প্রমাণিত করে এটি আজ দৃশ্যমান, যা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে। সৌভাগ্যবশত এই প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিতে হয়নি। সমুদ্র সম্পদ আহরণের জন্য যে সব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিশ্চয়ই আমাদের অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙা করে তুলবে।

 

গৃহযুদ্ধে জয়ের পর রাজাপক্ষ পরিবারের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে এই পরিবারের সদস্যরাই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী প্রভৃতি পদ দখল করে এমন এক সরকার গঠন করেছে যার সদস্যরা চরম অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে দেশ চালাতে তাদের ব্যর্থতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটেনি বা ঘটার সম্ভাবনাও নেই। তাই আমাদের চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে চীনের টাকার বস্তা থেকে চোখ সরাতে হবে।

 

চীন বিভিন্ন দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলার জন্য তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ করতে চাইছে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখে অনেক দেশই এই প্রকল্প থেকে সরে গেছে, যার সর্বশেষ প্রমাণ নেপাল এবং মালয়েশিয়া। নেপাল সম্প্রতি এ প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে চীনের মন্ত্রীর মুখের ওপর অস্বীকৃতি জানিয়েছে। চীন বাংলাদেশকে এ প্রকল্পে আকৃষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত।

 

এ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের গভীর এবং ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দেখতে হবে এর ফলে আমাদের মঙ্গল হবে নাকি বিপদ হবে। তাছাড়া প্রকল্প গ্রহণের আগে ব্যাপক গবেষণা করে দেখতে হবে সেগুলো থেকে মুনাফা অর্জন করা যাবে নাকি সেগুলো ঋণের বোঝাকেই বাড়াবে? এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে বিশদভাবে চিন্তা করেই তা করা হবে। এই নীতি সব সময় অনুসৃত হলে আমরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারি। একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিশ্ব পরিস্থিতি যে কোনো সময় পূর্বাভাস না দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যেমনটি হয়েছে করোনা মহামারির কারণে এবং সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য। এসব অদৃশ্য, অচিন্তনীয়, পূর্বাভাসহীন পরিস্থিতির জন্য সব সময় তৈরি থাকতে পারার ওপর নির্ভর করে একটি সরকারের যোগ্যতা। আমাদের বর্তমান সরকার সে পরীক্ষায় নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন বিধায় এই সরকারকে আরও বহু বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। এমন কাউকে ক্ষমতায় আনা যাবে না যারা অদৃশ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকবে না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূূএ: বাংলাদেশ প্রতিদদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com