কাঁকড়ার নামে পরিচিত হলেও মূলত বিছে ও মাকড়সার সঙ্গে এদের বেশি মিল। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক করা বিষয় হচ্ছে এদের রক্ত। অশ্বক্ষুরাকৃতির কাঁকড়ার প্রতি লিটার রক্ত বিক্রি হয় ১১ লাখ টাকায়। অন্যান্য প্রাণীর মতো এদের রক্ত লাল নয়, নীল।
লাল না হয়ে নীল হলো কেন? বিজ্ঞানীরা জানান, মেরুদণ্ডী প্রাণীরা সাধারণত হিমোগ্লোবিনে লোহার উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেন পরিবহণ করে থাকে। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। আর এই কাঁকড়ার নীল রক্তই বহুমূল্য।

ডাইনোসরের চেয়েও প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল এই লিমুলাস
এই রক্তের অসাধারণ ক্ষমতা বলে লিমিউলাস বা অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঁকড়ারা যে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই ১৯৭০ এর দশক থেকে বিজ্ঞানীরা কাঁকড়ার নীল রক্ত সংগ্রহ করে আসছেন। তারা এটি মূলত ব্যবহার করেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ধমনীর ভেতর সরাসরি ঢুকিয়ে দিতে হয়, এমন ওষুধ বিষ বা জীবাণুমুক্ত কিনা সেটা পরীক্ষার জন্য।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মানুষের রক্তে আয়রন বা লোহার উপস্থিতি রয়েছে। এ জন্য রক্ত লাল দেখায়। আর ‘নাল কাঁকড়ায়’ রয়েছে তামা। ফলে এদের রঙ নীল দেখায়। তবে নাল কাঁকড়ার নীল রক্ত নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ নেই। বিজ্ঞানীদের আগ্রহ হচ্ছে- কাঁকড়ার রক্তে তামা ছাড়াও আছে একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যেটি আসলে ব্যাকটেরিয়াকে আটকে ফেলতে পারে তার চারপাশে রক্ত জমাট বাঁধানোর মাধ্যমে।
এছাড়া কাঁকড়ার রক্ত দিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের প্রোটিন এজেন্ট বা জমাট বাঁধানোর রাসায়নিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য প্রতিবছর আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রায় পাঁচ লাখ নাল কাঁকড়া ধরা হয়।

বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে কাজে লাগানো হয় এই কাঁকড়ার রক্ত
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ‘দ্য নেচার কনজারভেন্সির’ গবেষক ড. বারবারা ব্রামার বলেন, ‘এখন ৩০টির বেশি কোম্পানি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে। এই কোম্পানিগুলোকে বহু ধরনের স্টেরাইলিটি টেস্ট চালাতে হয়। এজন্য কাঁকড়ার প্রয়োজন হয় ব্যাপক।
অশ্বক্ষুরের ন্যায় দেখতে উপবৃত্তাকার এই কাঁকড়াটি হল ‘হর্সসু ক্র্যাব’ বা ‘লিমুলাস’। কোথাও কোথাও এটি রাজ কাঁকড়া নামেও পরিচিত। নাল নামেও পরিচিত এই কাঁকড়া বিজ্ঞানীদের কাছে। তবে এটিকে কাঁকড়া বলা হলেও প্রজাতিগত দিক থেকে মাকড়সার সঙ্গে বেশি মিল রয়েছে এটির।
এরা প্রধানত অগভীর সমুদ্র ও নরম বালি বা কাদা সমৃদ্ধ সমুদ্রতলে বাস করে। কালেভদ্রে যৌনসঙ্গমের জন্য এদের ডাঙায় আসতে দেখা যায়। এদের এক জোড়া অক্ষিপুঞ্জের প্রতিটিতে এক হাজার চোখ রয়েছে। প্রজনন ঋতুতে এক একটি স্ত্রী অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঁকড়া উপকূলীয় অগভীর পানির নিচে বালুতে গর্ত তৈরি করে প্রায় এক লাখেরও বেশি ডিম পাড়ে। ডিমের অধিকাংশই পাখি ও অন্যান্য প্রাণী খেয়ে ফেলে। ফলে অল্পসংখ্যক ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

অশ্বক্ষুরাকৃতির কাঁকড়ার প্রতি লিটার রক্ত বিক্রি হয় ১১ লাখ টাকায়
চাষের কাজে সার হিসেবে এবং মাছ ধরার সময় টোপ হিসেবে এদের ব্যবহার আছে। সাম্প্রতিককালে জাপানে এদের সমুদ্রতটবর্তী বাসভূমি ধ্বংসের কারণে এবং উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে অত্যধিক চাষের কারণে এদের সংখ্যা কমে গেছে। থাইল্যান্ডের সমুদ্রোপকূলে বসবাসকারী প্রজাতিগুলোর ডিমের মধ্যে সম্ভবত টেট্রোডোটক্সিন-এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আজ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে বিবর্তিত হয়ে এতদিন প্রায় অবিকৃত চেহারায় থেকে যাওয়ার জন্য এদের জীবন্ত জীবাশ্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। এই কাঁকড়ার নীল রক্ত বহুমূল্যবান। এদের জীবন্ত জীবাশ্মও বলা হয়, কারণ ৪৪ কোটি ৫০ লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে এদের অস্তিত্ব ছিল। ডাইনোসরের চেয়েও প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল এই লিমুলাস। তাই এই জলজ প্রাণী বিজ্ঞানীদের কাছে আজও বিস্ময়। সূএ:ডেইলি বাংলাদেশ ডটকম