ইরাকে বাংলাদেশিদেরকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে ফরিদপুরের এক ইউপি সদস্যের ভয়ঙ্কর মানব পাচার চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই মানব পাচার চক্রটি ভিকটিমদের ইরাকে একটি বদ্ধ ঘরে টর্চার সেলে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে বিবস্ত্র করে বিদ্যুতের শক দেয়। রড দিয়ে পিটিয়ে করা হয় ভয়াবহ নির্যাতন। এ সময় পানির পিপাসায় পানি পানি বলে চিৎকার করলে ভিকটিমকে খাওয়ানো হয় তার নিজের প্রস্রাব। ইউপি সদস্য জসীম উদ্দিন ফকির এবং তার শ্যালক মাহবুবুর রহমান ইউপি সদস্যের আড়ালে ইরাকে গড়ে তুলেছেন ভয়ঙ্কর মানব পাচার চক্র। চক্রের এই অন্যতম সদস্য এবং তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার শেষে গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফরিদপুর এবং ঢাকার ফকিরাপুলে বসে কাজ করে চক্রটি। সমপ্রতি ইরাকে মানব পাচার, অপহরণ ও ভয়াবহ নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ে একজন নির্বাচিত ইউপি মেম্বার এবং তার শ্যালকের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে মহানগর গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ।
এ সময় ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার ৬ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জসীম উদ্দিন ফকির এবং তার শ্যালক মাহবুবুর রহমানের ইরাকে ভয়ঙ্কর মানব পাচার চক্রের সন্ধান পায় গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন ফকির ২০১৭ সাল থেকে পরবর্তী দেড় বছর ইরাকে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করে রপ্ত করেছে মানব পাচার এবং নির্যাতনের নানা কৌশল। ইরাকের বিমানবন্দর, হাসপাতাল, হোটেল, দোকান ও কনস্ট্রাকশন সাইটে চাকরির কথা বলে ভিজিটর হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়া, সেখান থেকে দুবাই এরপর ইরানে পাঠায়। সেখান থেকে পরবর্তীতে ইরাকে লোক পাঠানো হয় ভিজিটর ভিসায়। প্রতারণার মাধ্যমে তারা সারা দেশ থেকে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে ইরাকে লোক পাঠায়। মানব পাচারকারী চক্রটি মূলত তিন মাসের ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে দুবাই পাঠায়। সেখানে চক্রের সদস্য তাহেরসহ অন্যরা ভিজিটরদেরকে রিসিভ করে আলাদা ভাবে ১৫ থেকে ২০ দিনের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখে। পরে দুবাই থেকে ভিজিট ভিসায় পাঠানো হয় ইরানে। সেখান থেকে পোর্টের মাধ্যমে আকাশ পথে অথবা বাসে করে পাঠানো হয় ইরাকে। এ সময় ইরাকের ভিজিট ভিসা, টিকিট ও থাকা-খাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। পরবর্তীতে চক্রটি ইরাকের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদেরকে আটকে রেখে নির্যাতন এবং নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের সদস্যদেরকে দেখিয়ে বিকাশ ও হুন্ডির মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা হাতিয়ে নেয়।
মানব পাচারের শিকার এই ব্যক্তিরা ভিজিট ভিসায় ইরাকে যাওয়ায় ওয়ার্ক পারমিট এবং আকামা না থাকায় কোনো রেগুলার কাজ পায় না। ভাষা জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা না থাকায় ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে এ পর্যায়ে জিম্মি হয়ে পড়ে। মূলত ইরাকের বাগদাদ, বসরা, কিরকুক এবং আরবিল-এই চারটি শহরে শ্রমিকদেরকে ওয়ার্ক পারমিট বা আকামা দেয়া হয়। এই সব ভিকটিমদের পাসপোর্ট ও যে শহরে আকামা দেয়া হয় এই শহর ছাড়া অন্য শহরে তারা অবৈধ হয়ে পড়ে। এবং যে প্রতিষ্ঠানে ভিকটিমদের পাসপোর্ট জমা নেয় সেই প্রতিষ্ঠানে উক্ত শ্রমিক এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পালানো শ্রমিক, পাসপোর্ট হারানো শ্রমিক, কাজ না পাওয়া শ্রমিকরাই মূলত অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়কারী এই চক্রের মূল শিকার। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জসিম ফকিরের আপন ভাই জহিরুল ইসলাম ২০১২ সাল থেকে ইরাকে অবস্থান করে নিজস্ব স্বজন গোষ্ঠীকে নিয়ে তৈরি করেছে মানব পাচার, অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের একটি শক্তিশালী চক্র। জহিরুল ইসলাম এবং কিরকুকে অবস্থানরত শিহাব উদ্দিন, জিয়া, সুলতান আহমেদ স্থানীয় ইরাকি বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকারদের সহযোগিতায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অত্যাচার- নির্যাতন করে বাংলাদেশে অবস্থানরত চক্রের সহযোগীদের মাধ্যমে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। ইরাকে অবস্থানকারী হাবিব, আক্কাস, বাবলু মোল্লা, মমিন এবং মমিনের ভাই আকরাম এই মানব পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য।
সমপ্রতি চক্রটির অপহরণের শিকার হয়েছেন মাইনুদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। গোয়েন্দা হেফাজতে মঈনুদ্দিনের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে মানব পাচার চক্রের গ্রেপ্তারকৃত সদস্যরা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ভুক্তভোগী মাইনুদ্দিন ইরাকে যায়। পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতির কারণে বেকার হয়ে কাজ খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে চক্রের অন্যতম হোতা ইরাকে অবস্থানরত শিহাব উদ্দিন ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তাকে ইরাকের কিরকুকে নিয়ে যায়। কিরকুকে পৌঁছানোর পরে ভিকটিমকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি পরিত্যক্ত রুমে। যেখানে কোনো আলো- বাতাস এবং ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই। জেলখানার মতো বদ্ধ একটি কক্ষ। যেটাকে তারা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে। এই কক্ষে ভিকটিমের হাত-পা শিকল দিয়ে বেঁধে একটানা ১০ দিন আটকে রেখে জামা কাপড় খুলে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। এ সময় নির্যাতনের এক পর্যায়ে ভিকটিম পানির পিপাসা পেলে পানি পানি বলে চিৎকার করে। তখন ভিকটিমকে নিজের প্রস্রাব খাওয়ানো হয়। দেয়া হয় কারেন্টের শক। পাশাপাশি রড দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। পরবর্তীতে ভিকটিমের ইমো নম্বর থেকে ভিডিও কল করে নির্যাতনের স্থিরচিত্র ও ভিডিও বাংলাদেশে অবস্থানরত পরিবারকে দেখানো হয়। এবং মুক্তিপণ বাবদ পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। পরিবারের সদস্যরা প্রথমদিকে টাকা দিতে অস্বীকার করলে তারা নির্যাতনের মাত্রা এবং ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দেয়। পরে বাধ্য হয়ে মানব পাচারকারী চক্র এবং আসামিদের বিকাশ নম্বরে পর্যায়ক্রমে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাঠায় কুমিল্লার মাইন উদ্দিনের পরিবার। মাইন উদ্দিনের মতো এমন ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদনান, কিশোরগঞ্জের সুলতান এবং রুবেলসহ আরও অনেকেই। গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশে অবস্থানরত মানব পাচার এবং অপহরণকারী চক্রের সদস্য জসিম ফকির ও মাহাবুব হোসেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নত জীবনযাপন এবং আকর্ষণীয় বেতনের লোভ দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে ইরাকে পাঠায়। পরবর্তীতে তাদেরকে জিম্মি করে ইরাক থেকে ভিকটিমের বিকাশ নম্বর পরিবারের কাছে পাঠানোর কাজ করে। ঢাকায় অবস্থানরত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মাহবুব উক্ত বিকাশের টাকাগুলো উঠিয়ে তার দুলাভাই জসিম ফকিরের কাছে পাঠায়। যা পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংক ও ডাচ্- বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাগুলো হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করা হয়। এ ছাড়া এই মানব পাচারকারী চক্রটির ইরাকে রয়েছে জামিন বাণিজ্য। কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক ইরাকি পুলিশের কাছে ধরা পড়লে সেখানে অবস্থান করা সুলতান আলম, শিহাব উদ্দিন এবং শাহ আলম ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে জেল থেকে জামিন বাণিজ্য করে থাকে বলে চক্রের সদস্যরা গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। ইউপি সদস্য জসীম উদ্দিন ফকির এবং তার শ্যালক মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৭, ২০১৯ সালে মানব পাচার আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, জনপ্রতিনিধির আড়ালে চক্রের মূল হোতা ইউপি মেম্বার জসীম উদ্দিন ফকির এবং তার শ্যালক মাহবুবুর রহমান মূলত বাংলাদেশে এবং ইরাকে তার ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা মানব পাচার চক্রটি পরিচালনা করে। গ্রামের সহজ সরল এবং কম শিক্ষিত বেকার যুবকদের টার্গেট করে। এবং পরবর্তীতে উন্নত জীবন ও বেশি বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকে পাঠায়।
পরবর্তীতে ভিকটিমদেরকে সেখানে তাদের নিজস্ব টর্চার সেলে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। এবং কারেন্টের শক দেয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ভিকটিম পানি পানি বলে চিৎকার করলে তাদেরকে নিজেদের প্রস্রাব খেতে দেয়া হয়। পরবর্তীতে এসব নির্যাতনের স্থির চিত্র এবং ভিডিও পাঠিয়ে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দফায় দফায় বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয় এই মানব পাচার চক্রটি। বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে আরও সচেতন এবং এই ধরনের প্রতারক ও মানব পাচার চক্রের ফাঁদে পড়া থেকে সাবধান থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সূএ: মানবজমিন