গণতন্ত্রের অভিযাত্রায়

সংগৃহীত ছবি

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :গণতন্ত্র সম্পর্কে এত যে কথা বলা হয়, তাতে ধারণা করা মোটেই অসংগত নয় যে, গণতন্ত্র জিনিসটা কী- সে বিষয়ে সবাই একমত। সেটা অবশ্য ঠিক নয়। গণতন্ত্র বলতে নানা মত আছে। কেউ ভাবেন গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিত সরকার। অন্যপক্ষ বলেন, মোটেই না, গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। এ হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সংস্কৃতি। সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ যতই থাকুক, গণতন্ত্র যে পরিচিত শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, এ নিয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই।

সর্বোত্তম কেন তাও আমরা জানি। কারণটা হচ্ছে এই যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয়। কেবল মর্যাদা দেয় না, ব্যক্তির অধিকার, তার স্বার্থ, বিকাশ- এসবকে বিবেচনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। অন্য শাসনব্যবস্থায় এমনটা ঘটে না। সেখানে একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি জিনিস নানা নামে কার্যকর থাকে। কয়েকজন শুধু স্বাধীনতা পায়। অন্য সবার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। ক্ষমতা নাগরিকদের হাতে থাকে না, চলে যায় শাসকদের হাতে। ব্যক্তি ছোট ও কাবু হয়ে যায়। ওদিকে আবার ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্ক নিয়েও সমস্যা আছে। যেখানে রাষ্ট্র থাকে সেখানেই এই প্রশ্নটা থাকে। সমস্যাটা সমাজেও আছে এবং থাকে। আসলে সমাজ যেখানে, রাষ্ট্রও তো সেখানেই। আর সমাজ আছে সবখানেই। মানুষ অরণ্য, দ্বীপ বা পাহাড়চূড়া, যেখানেই থাক না কেন, সমাজের প্রয়োজনটা তার সঙ্গেই থাকে। সঙ্গ ছাড়ে না। সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে না; সম্পর্কটা মাছ ও পানির মতো না হলেও কাছাকাছি বটে।

ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্বটাও খুবই স্বাভাবিক। আর এখানেই গণতন্ত্রের বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। গণতন্ত্র সবার স্বার্থ দেখতে চায় এবং ব্যক্তির স্বার্থকে মেলাতে চায় সমষ্টির স্বার্থের সঙ্গে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা চায়, যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোনো কেন্দ্রে কুক্ষিগত থাকবে না, ছড়িয়ে থাকবে সমাজের সর্বত্র। এবং রাষ্ট্র শাসন করবেন জনপ্রতিনিধিরা। এখানেই নির্বাচনের ব্যাপারটা আসে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, অনেকে ধারণা করেন যে, যেখানে নির্বাচিত সরকার আছে, সেখানেই গণতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, তা তো আমরা আমাদের দেশে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই জেনেছি। এখানে নির্বাচন হয় এবং ছলেবলে-কৌশলে, এ-ওর সাহায্যে, জোর করে ক্ষমতা দখলও চলে। তবে জবরদখল স্থায়ী হয় না। নির্বাচন আসে এবং মনে করা হয় যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিণামে যা পাওয়া যায়, সেটাই সব সময় গণতন্ত্র নয়, অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়াচ্ছে নির্বাচিত স্বৈরাচার। আর সাধারণ অভিজ্ঞতা এটাই যে, স্বৈরাচার যদি নির্বাচিত হয়, অর্থাৎ নিজেকে বৈধ করে নেয়, তবে তা অবৈধ স্বৈরাচারের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে। কেননা বৈধ স্বৈরাচার নিজেকে স্বৈরশাসক মনে করে না। ভাবে সে জনগণের রায় নিয়ে এসেছে, তাই যা ইচ্ছা তা করতে পারবে। যতটা সম্ভব স্বেচ্ছাচারিতা চালাবে। পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে- জনগণ তাদের কাজ পছন্দ করেছে কি করেনি। বলাবাহুল্য, এরকম শাসনকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আবশ্যক। কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়, জবাবদিহি কার কাছে, স্বচ্ছতাই বা কতটা? আর ভোট? ভোটের তো কেনাবেচা চলে! আরও বড় সমস্যা যেটা, সেটা হলো নাগরিকদের সামনে আসলেই কোনো বিকল্প থাকে না। তারা বিদ্যমান প্রধান দুই দল থেকে একটিকে বেছে নেন। যাদের উভয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিন্ন মতাদর্শী। বর্তমানে যদিও প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। জনগণ কার হাতে অত্যাচারিত হবে, এর নাকি ওর! বিষয়টা অনেকটাই এরকম। ভোটের মধ্য দিয়ে প্রায়ই এর বাইরে কোনো কিছুর মীমাংসা ঘটে না। এমন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলার কোনো মানেই হয় না।

গণতন্ত্র চিনতে হয় কয়েকটি উপাদান দিয়ে। উপাদানগুলো আমাদের খুবই পরিচিত; কিন্তু বারবার স্মরণ করা আবশ্যক। এদের মধ্যে প্রথম যেটি, সেটি হলো অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তারপর আসে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং অবশ্যই দরকার হবে সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এসবই পন্থা। উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও বিকাশ নিশ্চিত করা। যথার্থ গণতন্ত্রের সঙ্গে তাই সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। বলা যায়, আসল পার্থক্যটা নামেরই, অন্য কিছুর নয়। গণতন্ত্রে পৌঁছাবার পথটা যে মসৃণ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন যে মসৃণ নয় তাও বোঝা যায়। মূল কারণ কায়েমি স্বার্থ। যারা ক্ষমতা পেয়ে গেছে, তারা সেটা জনগণের কাছে চলে যাক, এটা কখনই চায় না। চাইবার কথাও নয়। ক্ষমতা তাই শাসকশ্রেণির হাতেই থাকে। এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়, কিন্তু বৃত্তের বাইরে যায় না। কায়েমি স্বার্থের বিশ্বব্যাপ্ত একটি রূপ রয়েছে, তার নাম পুঁজিবাদ।

“সামনে থাকা চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে- চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। যার মাধ্যমে বিগত দেড় দশকের কঠিন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এবং এখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রে উত্তরণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশে”

পুঁজিবাদের তৎপরতার ভিতরে একটা বক্রাঘাত রয়েছে। ব্যক্তির জন্য স্বাতন্ত্র্যের বোধ তৈরিতে পুঁজিবাদের ভূমিকা আছে। ইহজাগতিকতার চেতনা, মানবতাবাদিতা, মানুষের ভিতর বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা এসব পুঁজিবাদের অবদান বৈকি। কিন্তু সেই পুঁজিবাদই আবার মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে তার নিজের শাসনে। যারা উৎপাদন করে তারা বঞ্চিত হয়। অথচ পুঁজি আসে শ্রমজীবী মানুষের তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য থেকেই।

গণতন্ত্রের কথা পুঁজিবাদ গলা ফাটিয়ে বলে। বলতেই থাকে; থামে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশে-ওদেশে গিয়ে সে হানা দেয়। মানুষ মারে। কিন্তু যার প্রতিষ্ঠা ঘটায়, তা হলো পুঁজির স্বেচ্ছাচার। পুঁজিবাদীরা ঋণ দেয়। তাদের আছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন সংস্থা। পুঁজিবাদীদের অধীনস্থ এনজিওগুলোও ঋণ দিয়ে থাকে। বিশ্ব পুঁজিবাদ রাষ্ট্রকে আটকায় ঋণের জালে, ক্ষুদ্র ঋণদাতারা গরিব মানুষকে বেঁধে ফেলে বিভিন্ন ধরনের দড়িতে। মূল পুঁজিটা আসে কোথা থেকে? আসে লুণ্ঠন ও জবরদখল থেকে। যে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে টাকা আসে, তাদেরই ঋণ দেওয়া হয়, নতুনভাবে শোষণের ইচ্ছায়। মাছের তেলে মাছ ভাজা হয়, ভক্ষণের স্বার্থে। এনজিওগুলোর আসল কাজ দারিদ্র্য-বিমোচন নয়। আসল কাজ হচ্ছে একদিকে সেবক ও ক্রেতা সৃষ্টি করা, অন্যদিকে মানুষকে পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত অবস্থায় রাখা।

আর আছে বাণিজ্য। মুনাফা লাভের যত বৈধ উপায় আছে, তার মধ্যে বাণিজ্যের অস্ত্র সবচেয়ে ধারালো। পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চালাচ্ছে; বলছে বাণিজ্য হবে উন্মুক্ত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে ধনী দেশের পণ্য গরিব দেশে বিক্রি করা। এর জন্য পুঁজিবাদীরা তাদের নিজেদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, বৃহৎ পরিমাণ উৎপাদনের সুযোগ দিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমায়, গরিব দেশের শ্রম ভাড়ায় খাটায় এবং বিজ্ঞাপনের বিশাল আয়োজন করে। পাশাপাশি গরিব দেশের পণ্য যাতে ধনী দেশে ঢুকতে না পারে, তার জন্য নানা রকম বিধি-বন্দোবস্ত ও অজুহাত খাড়া করে রাখে।

পুঁজিবাদীরা অবাধে জ্বালানি পোড়ায়। পরিবেশ নষ্ট করে। যে-সমুদ্র মানুষের বন্ধু হওয়ার কথা, তাকে শত্রুতে পরিণত করে। সমুদ্রের পানি উঁচু হয়, সেখান থেকে ঝড় আসে, বন্যার পানি সহজে নামে না, অন্যদিকে ভূমিতে দেখা দেয় পানির অভাব। আর সমাজ পরিণত হয় জঙ্গলে। যেখানে নিপীড়ন, সংঘর্ষ, ধর্ষণ চলতে থাকে। সব মিলিয়ে মানুষের বিপদ ঘটে। তার মুক্তি আসে না। প্রকৃত অর্থে উন্নতিও ঘটে না। তার বিপদ বাড়ে। প্রকট হয় বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতা। এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাই গণতন্ত্রের লক্ষ্য।

আর গণতন্ত্রের পথ তৈরি করার উপায় একটাই। সে হচ্ছে আন্দোলন। জনগণের আন্দোলন, মুক্তির লক্ষ্যে। সে-আন্দোলনকে একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হতে হবে এবং তার সামনে থাকা চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে- চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। যার মাধ্যমে বিগত দেড় দশকের কঠিন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এবং এখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রে উত্তরণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঘোড়াঘাটে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক্টরের মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’জন নিহত

» কাজলের এআই ভিডিও, বিপাকে নেটিজেনরা

» প্রথমবার কোকোর কবর জিয়ারত করলেন তারেক রহমান

» শুধু লোক বদলে দিলে দেশ বদলাবে না, সিস্টেম বদলাতে হবে : তথ্য উপদেষ্টা

» বিএনপিতে যোগ দিলেন গণ অধিকার পরিষদের রাশেদ খান

» কুমিল্লা-৩ আসনেও আসিফ মাহমুদের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ

» ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অস্ত্র উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে রাশিয়ার

» বছরের শুরুতে বন্ধ হচ্ছে অতিরিক্ত সিম ব্যবহার

» অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কারও পক্ষে নয় : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

» ঢাকা-১৭ আসনে ভোটার হচ্ছেন তারেক রহমান : ইসি সচিব

 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায়

সংগৃহীত ছবি

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :গণতন্ত্র সম্পর্কে এত যে কথা বলা হয়, তাতে ধারণা করা মোটেই অসংগত নয় যে, গণতন্ত্র জিনিসটা কী- সে বিষয়ে সবাই একমত। সেটা অবশ্য ঠিক নয়। গণতন্ত্র বলতে নানা মত আছে। কেউ ভাবেন গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিত সরকার। অন্যপক্ষ বলেন, মোটেই না, গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। এ হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সংস্কৃতি। সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ যতই থাকুক, গণতন্ত্র যে পরিচিত শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, এ নিয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই।

সর্বোত্তম কেন তাও আমরা জানি। কারণটা হচ্ছে এই যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয়। কেবল মর্যাদা দেয় না, ব্যক্তির অধিকার, তার স্বার্থ, বিকাশ- এসবকে বিবেচনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। অন্য শাসনব্যবস্থায় এমনটা ঘটে না। সেখানে একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি জিনিস নানা নামে কার্যকর থাকে। কয়েকজন শুধু স্বাধীনতা পায়। অন্য সবার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। ক্ষমতা নাগরিকদের হাতে থাকে না, চলে যায় শাসকদের হাতে। ব্যক্তি ছোট ও কাবু হয়ে যায়। ওদিকে আবার ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্ক নিয়েও সমস্যা আছে। যেখানে রাষ্ট্র থাকে সেখানেই এই প্রশ্নটা থাকে। সমস্যাটা সমাজেও আছে এবং থাকে। আসলে সমাজ যেখানে, রাষ্ট্রও তো সেখানেই। আর সমাজ আছে সবখানেই। মানুষ অরণ্য, দ্বীপ বা পাহাড়চূড়া, যেখানেই থাক না কেন, সমাজের প্রয়োজনটা তার সঙ্গেই থাকে। সঙ্গ ছাড়ে না। সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে না; সম্পর্কটা মাছ ও পানির মতো না হলেও কাছাকাছি বটে।

ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্বটাও খুবই স্বাভাবিক। আর এখানেই গণতন্ত্রের বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। গণতন্ত্র সবার স্বার্থ দেখতে চায় এবং ব্যক্তির স্বার্থকে মেলাতে চায় সমষ্টির স্বার্থের সঙ্গে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা চায়, যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোনো কেন্দ্রে কুক্ষিগত থাকবে না, ছড়িয়ে থাকবে সমাজের সর্বত্র। এবং রাষ্ট্র শাসন করবেন জনপ্রতিনিধিরা। এখানেই নির্বাচনের ব্যাপারটা আসে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, অনেকে ধারণা করেন যে, যেখানে নির্বাচিত সরকার আছে, সেখানেই গণতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, তা তো আমরা আমাদের দেশে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই জেনেছি। এখানে নির্বাচন হয় এবং ছলেবলে-কৌশলে, এ-ওর সাহায্যে, জোর করে ক্ষমতা দখলও চলে। তবে জবরদখল স্থায়ী হয় না। নির্বাচন আসে এবং মনে করা হয় যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিণামে যা পাওয়া যায়, সেটাই সব সময় গণতন্ত্র নয়, অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়াচ্ছে নির্বাচিত স্বৈরাচার। আর সাধারণ অভিজ্ঞতা এটাই যে, স্বৈরাচার যদি নির্বাচিত হয়, অর্থাৎ নিজেকে বৈধ করে নেয়, তবে তা অবৈধ স্বৈরাচারের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে। কেননা বৈধ স্বৈরাচার নিজেকে স্বৈরশাসক মনে করে না। ভাবে সে জনগণের রায় নিয়ে এসেছে, তাই যা ইচ্ছা তা করতে পারবে। যতটা সম্ভব স্বেচ্ছাচারিতা চালাবে। পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে- জনগণ তাদের কাজ পছন্দ করেছে কি করেনি। বলাবাহুল্য, এরকম শাসনকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আবশ্যক। কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়, জবাবদিহি কার কাছে, স্বচ্ছতাই বা কতটা? আর ভোট? ভোটের তো কেনাবেচা চলে! আরও বড় সমস্যা যেটা, সেটা হলো নাগরিকদের সামনে আসলেই কোনো বিকল্প থাকে না। তারা বিদ্যমান প্রধান দুই দল থেকে একটিকে বেছে নেন। যাদের উভয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিন্ন মতাদর্শী। বর্তমানে যদিও প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। জনগণ কার হাতে অত্যাচারিত হবে, এর নাকি ওর! বিষয়টা অনেকটাই এরকম। ভোটের মধ্য দিয়ে প্রায়ই এর বাইরে কোনো কিছুর মীমাংসা ঘটে না। এমন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলার কোনো মানেই হয় না।

গণতন্ত্র চিনতে হয় কয়েকটি উপাদান দিয়ে। উপাদানগুলো আমাদের খুবই পরিচিত; কিন্তু বারবার স্মরণ করা আবশ্যক। এদের মধ্যে প্রথম যেটি, সেটি হলো অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তারপর আসে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং অবশ্যই দরকার হবে সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এসবই পন্থা। উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও বিকাশ নিশ্চিত করা। যথার্থ গণতন্ত্রের সঙ্গে তাই সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। বলা যায়, আসল পার্থক্যটা নামেরই, অন্য কিছুর নয়। গণতন্ত্রে পৌঁছাবার পথটা যে মসৃণ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন যে মসৃণ নয় তাও বোঝা যায়। মূল কারণ কায়েমি স্বার্থ। যারা ক্ষমতা পেয়ে গেছে, তারা সেটা জনগণের কাছে চলে যাক, এটা কখনই চায় না। চাইবার কথাও নয়। ক্ষমতা তাই শাসকশ্রেণির হাতেই থাকে। এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়, কিন্তু বৃত্তের বাইরে যায় না। কায়েমি স্বার্থের বিশ্বব্যাপ্ত একটি রূপ রয়েছে, তার নাম পুঁজিবাদ।

“সামনে থাকা চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে- চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। যার মাধ্যমে বিগত দেড় দশকের কঠিন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এবং এখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রে উত্তরণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশে”

পুঁজিবাদের তৎপরতার ভিতরে একটা বক্রাঘাত রয়েছে। ব্যক্তির জন্য স্বাতন্ত্র্যের বোধ তৈরিতে পুঁজিবাদের ভূমিকা আছে। ইহজাগতিকতার চেতনা, মানবতাবাদিতা, মানুষের ভিতর বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা এসব পুঁজিবাদের অবদান বৈকি। কিন্তু সেই পুঁজিবাদই আবার মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে তার নিজের শাসনে। যারা উৎপাদন করে তারা বঞ্চিত হয়। অথচ পুঁজি আসে শ্রমজীবী মানুষের তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য থেকেই।

গণতন্ত্রের কথা পুঁজিবাদ গলা ফাটিয়ে বলে। বলতেই থাকে; থামে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশে-ওদেশে গিয়ে সে হানা দেয়। মানুষ মারে। কিন্তু যার প্রতিষ্ঠা ঘটায়, তা হলো পুঁজির স্বেচ্ছাচার। পুঁজিবাদীরা ঋণ দেয়। তাদের আছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন সংস্থা। পুঁজিবাদীদের অধীনস্থ এনজিওগুলোও ঋণ দিয়ে থাকে। বিশ্ব পুঁজিবাদ রাষ্ট্রকে আটকায় ঋণের জালে, ক্ষুদ্র ঋণদাতারা গরিব মানুষকে বেঁধে ফেলে বিভিন্ন ধরনের দড়িতে। মূল পুঁজিটা আসে কোথা থেকে? আসে লুণ্ঠন ও জবরদখল থেকে। যে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে টাকা আসে, তাদেরই ঋণ দেওয়া হয়, নতুনভাবে শোষণের ইচ্ছায়। মাছের তেলে মাছ ভাজা হয়, ভক্ষণের স্বার্থে। এনজিওগুলোর আসল কাজ দারিদ্র্য-বিমোচন নয়। আসল কাজ হচ্ছে একদিকে সেবক ও ক্রেতা সৃষ্টি করা, অন্যদিকে মানুষকে পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত অবস্থায় রাখা।

আর আছে বাণিজ্য। মুনাফা লাভের যত বৈধ উপায় আছে, তার মধ্যে বাণিজ্যের অস্ত্র সবচেয়ে ধারালো। পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চালাচ্ছে; বলছে বাণিজ্য হবে উন্মুক্ত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে ধনী দেশের পণ্য গরিব দেশে বিক্রি করা। এর জন্য পুঁজিবাদীরা তাদের নিজেদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, বৃহৎ পরিমাণ উৎপাদনের সুযোগ দিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমায়, গরিব দেশের শ্রম ভাড়ায় খাটায় এবং বিজ্ঞাপনের বিশাল আয়োজন করে। পাশাপাশি গরিব দেশের পণ্য যাতে ধনী দেশে ঢুকতে না পারে, তার জন্য নানা রকম বিধি-বন্দোবস্ত ও অজুহাত খাড়া করে রাখে।

পুঁজিবাদীরা অবাধে জ্বালানি পোড়ায়। পরিবেশ নষ্ট করে। যে-সমুদ্র মানুষের বন্ধু হওয়ার কথা, তাকে শত্রুতে পরিণত করে। সমুদ্রের পানি উঁচু হয়, সেখান থেকে ঝড় আসে, বন্যার পানি সহজে নামে না, অন্যদিকে ভূমিতে দেখা দেয় পানির অভাব। আর সমাজ পরিণত হয় জঙ্গলে। যেখানে নিপীড়ন, সংঘর্ষ, ধর্ষণ চলতে থাকে। সব মিলিয়ে মানুষের বিপদ ঘটে। তার মুক্তি আসে না। প্রকৃত অর্থে উন্নতিও ঘটে না। তার বিপদ বাড়ে। প্রকট হয় বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতা। এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাই গণতন্ত্রের লক্ষ্য।

আর গণতন্ত্রের পথ তৈরি করার উপায় একটাই। সে হচ্ছে আন্দোলন। জনগণের আন্দোলন, মুক্তির লক্ষ্যে। সে-আন্দোলনকে একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হতে হবে এবং তার সামনে থাকা চাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে- চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। যার মাধ্যমে বিগত দেড় দশকের কঠিন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এবং এখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রে উত্তরণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com