মাদকেও সেনাবাহিনীর যুগান্তকারী অ্যাকশনের অপেক্ষা

সংগৃহীত ছবি

 

মোস্তফা কামাল :জনস্বার্থে ও রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে বলে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার ঘোষণা ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের। জরুরি প্রয়োজনে সেনা ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জরুরি দরকারে নিকটস্থ সেনাবাহিনী ক্যাম্পে জানাতে। একটা নতুন স্বপ্ন, নতুন সময়ের পরিবর্তনের আশায় তা বেশ মন কেড়েছে মানুষের।

 

সেনা ক্যাম্পের টেলিফোন নম্বরের তালিকা অনেকেই পকেটে রাখছেন। আস্থা-ভরসার স্থল ভেবে কাউকে না জানিয়ে তাঁরা তথ্য জানিয়ে দিচ্ছেন ক্যাম্পে। দ্রুত অ্যাকশনে ফল মিলছে ম্যাজিকের মতো। আবার তথ্যদাতার পরিচয়ও গোপন থাকছে।

গত মাস কয়েকের কেসস্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, এসব তথ্যের বেশির ভাগই মাদকসংক্রান্ত। কাজও হচ্ছে সেনা সদস্যদের হাইভোল্টেজ অ্যাকশনে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম-কুমিল্লাসহ নানা জায়গায় অভিযান চলমান। গেল বুধবার রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় আচমকা এক অভিযানে নারীসহ সাত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।

 

সেটির নেপথ্যেও ছিল স্থানীয় একজনের মোবাইল বার্তা। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে সাতজনকে হাতেনাতে ধরাসহ বিপুল পরিমাণ গাঁজা এবং মাদক বিক্রির নগদ অর্থ জব্দ করা হয়।

বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র মাদকের কারবার চালিয়ে আসছিল। যাত্রী সেজে অবস্থান নিয়ে নারী ও কিশোরীদের মাধ্যমে গাঁজা সরবরাহ করত তারা। এদের কুকর্ম পুলিশ বা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জানার বাইরে ছিল না।

 

মিলেমিশে বোঝাপড়ায় চলত মাদকের কারবার। স্থানীয়রা বিভিন্ন জায়গায় জানাতে গিয়ে আপদের ওপর বিপদে পড়েছে। অবশেষে সেনাবাহিনীকে জানিয়ে কোনো আপদ-বিপদ নয়, বরং স্বস্তি মিলেছে। সেনাবাহিনীর দিক থেকে জানানো হয়েছে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদক নির্মূল এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের অভিযান সামনে আরো জোরদার করা হবে। স্থানীয়রা জানায়, মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে এলাকায় চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সেনাবাহিনীর অভিযান তাদের চমকে দেয়, টোকা দেয় ভরসার পারদে।

 

মাত্র দিন দুয়েক আগে সাবলীল মানুষ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বভাবসুলভে বলে ফেলেছেন, ‘মাদক ও দুর্নীতি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি।’ সঙ্গে আরো কিছু কথাও বলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় দাবি করা হয়, মাদকের বিস্তার কমে আসছে। এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি কিন্তু কোনো দিন এটা দাবি করিনি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালোর দিকে, কিন্তু মাদক কমিয়ে এনেছি তা কোনো দিন বলিনি।’ এ ব্যাপারে তাঁর একটি সদিচ্ছার কথাও জানান তিনি। সেনাবাহিনী থেকেও সেই আভাস মিলছে।

 

নির্বাচন, সংস্কার, বিচারসহ রাজনৈতিক-কূটনৈতিক নানা যন্ত্রণার মধ্যে দেশে ভেতরে-ভেতরে মাদকের কারবার বাড়ছে। চক্রবিশেষ এটিকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করতে শুরু করায় কোকেন চোরাচালান, বিশেষ করে আকাশপথে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা ও বড় বড় শহরে তালিকাভুক্ত বহু মাদক চোরাকারবারি এখনো সক্রিয়। তারা মাদক পরিবহনের কাজে ছোটখাটো অপরাধী, দিনমজুর ও রিকশাচালকদের নিয়োগ করছে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সাতক্ষীরা, পঞ্চগড় এবং দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল, গাঁজা এবং হেরোইন পাচার হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে দেশজুড়ে মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করার পর পুলিশ সদর দপ্তর সব জেলার পুলিশ সুপারদের মাদক পাচারকারীদের নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।

 

পাচারকারীদের আস্তানা ধ্বংস, নতুন এবং পুরনো পাচারকারীদের শনাক্ত এবং বিচারাধীন মাদক মামলার তদন্তের জন্য অভিযান জোরদার করতে বলা হয়েছে তাঁদের। শেষ পর্যন্ত কাজ কত দূর হবে, তা নিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। কারণ মাদক কখনোই নিজে নিজে কারো হাতে যায় না। জড় পদার্থ মাদককে মানুষ নামের জীবকুলের হাতে পৌঁছে দেওয়ার বহু প্রাণী রয়েছে পথে-ঘাটে। কারবারি-পুলিশসহ আরো কারো কারো মধুর সম্পর্ক মাদকের বিস্তার ঘটাচ্ছে। চাহিদা দৃষ্টে জোগান বাড়ছে। যে কারণে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ মাঠে মারা যাচ্ছে। স্থল-জল সীমান্তে যার যা করার করছে।  আকাশপথেও অনেকের হাত পড়েছে। আর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নামের প্রতিষ্ঠানটি আসলে কোন কিছিমের নিয়ন্ত্রণ করছে, তা-ও কম-বেশি সবার জানা। তারা দমন নয়, প্রকারান্তরে নিজেদের মতো মাদক নিয়ন্ত্রণই করে। সেখানে বিশাল লগ্নি, নিয়োগ-বিনিয়োগ, লোভনীয় পদ-পদায়নের বিষয়-আশয় রয়েছে।

 

এসবের আড়ালে প্রকারান্তরে চলছে মাদকের আরেক কারবার। মাদক নিরাময়ে দেশে সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত মাদকাসক্ত শনাক্তকরণের কথা বলে এক ধরনের চমক তৈরি করা হয়েছিল। অন্য কোনো সেক্টরে তো ডোপ টেস্টের আলোচনাই নেই।  পুলিশেও ‘ডোপ টেস্ট’ নিয়ে নন-ক্যাডার অফিসার ও সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক বাস্তবতায় মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে পুরো বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কেওয়াস, ব্যবসা-বিনিয়োগে খরাসহ অর্থনৈতিক দুর্দশা, কূটনৈতিক টানাপড়েনের আলোচনা-সমালোচনার ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে অনেকের অলক্ষ্যে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশের কোনো কোনো লোকালয়ে ঘরে ঘরে মাদকের কারবার। নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে মা-বাবা, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার মতো ঘটনা মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে এসে দিন কয়েক মাতামাতি পর্যন্তই সার। এবারের পরিপ্রক্ষিত একটু ভিন্ন। সেনাবাহিনী মাঠে আছে। তা-ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে। যৌথ বাহিনীর অংশীজন হয়ে তারা পেশাদারির সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের কয়েকটি অভিযান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। হত্যা মামলার আসামি, অবৈধ অস্ত্রধারী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, কিশোর গ্যাং সদস্য, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ পাকড়াও হচ্ছে নিয়মিত। মববাজও ধরা পড়ছে তাদের হাতে। পরিস্থিতি ও বাস্তবতার তাগিদে সেনা সদস্যদের মাদক দমনে বিশেষভাবে কাজে লাগানোর একটি মোক্ষম সময় এখন।

 

এ ব্যাপারে সরকারের কী নির্দেশনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে মানুষ তাদের লুফে নিয়েছে সর্বন্তকরণে। সেনা সদস্যদের গত কিছুদিনের মাদকবিরোধী অ্যাকশনে সেই নমুনা স্পষ্ট।  স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার যখন উপলব্ধি হয়েছে, মাদক দমন বা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসেনি, তখন একটি পদক্ষেপ অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। আর তালিকা তো তৈরি করাই আছে। নতুন-পুরনো তালিকার একটি ফর্দ বা সারসংক্ষেপ তাদের ধরিয়ে দিলে এ যাত্রায় মাদকবিরোধী অভিযানের একটি যুগান্তকারী ইতিহাস তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার শঙ্কা কম। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাদের সুবাদে কেবল আইন-শৃঙ্খলা আয়ত্তে থাকছে না, দানবীয় মব সন্ত্রাস দমনে কিছু পদক্ষেপে সেনাবাহিনীর প্রতি সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। মাদকের ভয়াল থাবার দিকে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপও পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। বিশ্বের কিছু কিছু দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশেও এখন একটি সুবর্ণ সময় সেনাবাহিনীকে এই গুরুদায়িত্ব পালনে স্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মাদকের ব্যাপকতায় চিন্তিত-অতিষ্ঠরা তো মুখিয়েই আছে। সেই অপেক্ষাই করছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন  ।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» পার্বত্য চট্টগ্রামের একশ স্কুলে এ বছরই ই-লার্নিং চালুর নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

» হোয়াটসঅ্যাপে নতুন ফিচার, স্ক্যান করে পাঠানো যাবে নথিপত্র

» সিডনিতে ‘জুলাই সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত

» ২০২৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনার জার্সি ফাঁস!

» মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কঠোর নির্দেশনা

» নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে : মোস্তফা ফিরোজ

» সীমান্ত দিয়ে আরও ৪৮ জন পুশইন করয় আটক

» শিবচরে গাড়িচাপায় অজ্ঞাতপরিচয় নারী নিহত

» নূরুলের মুখে রাতের ভোটের ভয়ংকর কাহিনি

» ‘ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’ কর্মসূচি বাতিল

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মাদকেও সেনাবাহিনীর যুগান্তকারী অ্যাকশনের অপেক্ষা

সংগৃহীত ছবি

 

মোস্তফা কামাল :জনস্বার্থে ও রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে বলে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার ঘোষণা ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের। জরুরি প্রয়োজনে সেনা ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জরুরি দরকারে নিকটস্থ সেনাবাহিনী ক্যাম্পে জানাতে। একটা নতুন স্বপ্ন, নতুন সময়ের পরিবর্তনের আশায় তা বেশ মন কেড়েছে মানুষের।

 

সেনা ক্যাম্পের টেলিফোন নম্বরের তালিকা অনেকেই পকেটে রাখছেন। আস্থা-ভরসার স্থল ভেবে কাউকে না জানিয়ে তাঁরা তথ্য জানিয়ে দিচ্ছেন ক্যাম্পে। দ্রুত অ্যাকশনে ফল মিলছে ম্যাজিকের মতো। আবার তথ্যদাতার পরিচয়ও গোপন থাকছে।

গত মাস কয়েকের কেসস্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, এসব তথ্যের বেশির ভাগই মাদকসংক্রান্ত। কাজও হচ্ছে সেনা সদস্যদের হাইভোল্টেজ অ্যাকশনে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম-কুমিল্লাসহ নানা জায়গায় অভিযান চলমান। গেল বুধবার রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় আচমকা এক অভিযানে নারীসহ সাত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।

 

সেটির নেপথ্যেও ছিল স্থানীয় একজনের মোবাইল বার্তা। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে সাতজনকে হাতেনাতে ধরাসহ বিপুল পরিমাণ গাঁজা এবং মাদক বিক্রির নগদ অর্থ জব্দ করা হয়।

বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র মাদকের কারবার চালিয়ে আসছিল। যাত্রী সেজে অবস্থান নিয়ে নারী ও কিশোরীদের মাধ্যমে গাঁজা সরবরাহ করত তারা। এদের কুকর্ম পুলিশ বা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জানার বাইরে ছিল না।

 

মিলেমিশে বোঝাপড়ায় চলত মাদকের কারবার। স্থানীয়রা বিভিন্ন জায়গায় জানাতে গিয়ে আপদের ওপর বিপদে পড়েছে। অবশেষে সেনাবাহিনীকে জানিয়ে কোনো আপদ-বিপদ নয়, বরং স্বস্তি মিলেছে। সেনাবাহিনীর দিক থেকে জানানো হয়েছে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদক নির্মূল এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের অভিযান সামনে আরো জোরদার করা হবে। স্থানীয়রা জানায়, মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে এলাকায় চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সেনাবাহিনীর অভিযান তাদের চমকে দেয়, টোকা দেয় ভরসার পারদে।

 

মাত্র দিন দুয়েক আগে সাবলীল মানুষ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বভাবসুলভে বলে ফেলেছেন, ‘মাদক ও দুর্নীতি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি।’ সঙ্গে আরো কিছু কথাও বলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় দাবি করা হয়, মাদকের বিস্তার কমে আসছে। এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি কিন্তু কোনো দিন এটা দাবি করিনি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালোর দিকে, কিন্তু মাদক কমিয়ে এনেছি তা কোনো দিন বলিনি।’ এ ব্যাপারে তাঁর একটি সদিচ্ছার কথাও জানান তিনি। সেনাবাহিনী থেকেও সেই আভাস মিলছে।

 

নির্বাচন, সংস্কার, বিচারসহ রাজনৈতিক-কূটনৈতিক নানা যন্ত্রণার মধ্যে দেশে ভেতরে-ভেতরে মাদকের কারবার বাড়ছে। চক্রবিশেষ এটিকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করতে শুরু করায় কোকেন চোরাচালান, বিশেষ করে আকাশপথে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা ও বড় বড় শহরে তালিকাভুক্ত বহু মাদক চোরাকারবারি এখনো সক্রিয়। তারা মাদক পরিবহনের কাজে ছোটখাটো অপরাধী, দিনমজুর ও রিকশাচালকদের নিয়োগ করছে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সাতক্ষীরা, পঞ্চগড় এবং দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল, গাঁজা এবং হেরোইন পাচার হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে দেশজুড়ে মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করার পর পুলিশ সদর দপ্তর সব জেলার পুলিশ সুপারদের মাদক পাচারকারীদের নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।

 

পাচারকারীদের আস্তানা ধ্বংস, নতুন এবং পুরনো পাচারকারীদের শনাক্ত এবং বিচারাধীন মাদক মামলার তদন্তের জন্য অভিযান জোরদার করতে বলা হয়েছে তাঁদের। শেষ পর্যন্ত কাজ কত দূর হবে, তা নিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। কারণ মাদক কখনোই নিজে নিজে কারো হাতে যায় না। জড় পদার্থ মাদককে মানুষ নামের জীবকুলের হাতে পৌঁছে দেওয়ার বহু প্রাণী রয়েছে পথে-ঘাটে। কারবারি-পুলিশসহ আরো কারো কারো মধুর সম্পর্ক মাদকের বিস্তার ঘটাচ্ছে। চাহিদা দৃষ্টে জোগান বাড়ছে। যে কারণে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ মাঠে মারা যাচ্ছে। স্থল-জল সীমান্তে যার যা করার করছে।  আকাশপথেও অনেকের হাত পড়েছে। আর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নামের প্রতিষ্ঠানটি আসলে কোন কিছিমের নিয়ন্ত্রণ করছে, তা-ও কম-বেশি সবার জানা। তারা দমন নয়, প্রকারান্তরে নিজেদের মতো মাদক নিয়ন্ত্রণই করে। সেখানে বিশাল লগ্নি, নিয়োগ-বিনিয়োগ, লোভনীয় পদ-পদায়নের বিষয়-আশয় রয়েছে।

 

এসবের আড়ালে প্রকারান্তরে চলছে মাদকের আরেক কারবার। মাদক নিরাময়ে দেশে সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত মাদকাসক্ত শনাক্তকরণের কথা বলে এক ধরনের চমক তৈরি করা হয়েছিল। অন্য কোনো সেক্টরে তো ডোপ টেস্টের আলোচনাই নেই।  পুলিশেও ‘ডোপ টেস্ট’ নিয়ে নন-ক্যাডার অফিসার ও সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক বাস্তবতায় মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে পুরো বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কেওয়াস, ব্যবসা-বিনিয়োগে খরাসহ অর্থনৈতিক দুর্দশা, কূটনৈতিক টানাপড়েনের আলোচনা-সমালোচনার ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে অনেকের অলক্ষ্যে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশের কোনো কোনো লোকালয়ে ঘরে ঘরে মাদকের কারবার। নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে মা-বাবা, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার মতো ঘটনা মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে এসে দিন কয়েক মাতামাতি পর্যন্তই সার। এবারের পরিপ্রক্ষিত একটু ভিন্ন। সেনাবাহিনী মাঠে আছে। তা-ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে। যৌথ বাহিনীর অংশীজন হয়ে তারা পেশাদারির সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের কয়েকটি অভিযান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। হত্যা মামলার আসামি, অবৈধ অস্ত্রধারী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, কিশোর গ্যাং সদস্য, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ পাকড়াও হচ্ছে নিয়মিত। মববাজও ধরা পড়ছে তাদের হাতে। পরিস্থিতি ও বাস্তবতার তাগিদে সেনা সদস্যদের মাদক দমনে বিশেষভাবে কাজে লাগানোর একটি মোক্ষম সময় এখন।

 

এ ব্যাপারে সরকারের কী নির্দেশনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে মানুষ তাদের লুফে নিয়েছে সর্বন্তকরণে। সেনা সদস্যদের গত কিছুদিনের মাদকবিরোধী অ্যাকশনে সেই নমুনা স্পষ্ট।  স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার যখন উপলব্ধি হয়েছে, মাদক দমন বা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসেনি, তখন একটি পদক্ষেপ অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। আর তালিকা তো তৈরি করাই আছে। নতুন-পুরনো তালিকার একটি ফর্দ বা সারসংক্ষেপ তাদের ধরিয়ে দিলে এ যাত্রায় মাদকবিরোধী অভিযানের একটি যুগান্তকারী ইতিহাস তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার শঙ্কা কম। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাদের সুবাদে কেবল আইন-শৃঙ্খলা আয়ত্তে থাকছে না, দানবীয় মব সন্ত্রাস দমনে কিছু পদক্ষেপে সেনাবাহিনীর প্রতি সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। মাদকের ভয়াল থাবার দিকে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপও পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। বিশ্বের কিছু কিছু দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশেও এখন একটি সুবর্ণ সময় সেনাবাহিনীকে এই গুরুদায়িত্ব পালনে স্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মাদকের ব্যাপকতায় চিন্তিত-অতিষ্ঠরা তো মুখিয়েই আছে। সেই অপেক্ষাই করছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন  ।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com