নিজেরাই যখন দৌড়ের ওপর থাকে তখন কে কাকে দেখে?

সংগৃহীত ছবি

 

মোস্তফা কামাল  :লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না, বাজারে জমা পানি মাজারেও চলে যায়-জাগতিক এ নিয়মে গেল আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় হতাহতের শিকার হয়েছেন অনেক গণমাধ্যমকর্মী। বাস্তবতার তোড়ে তখন কে ছাত্র, আর কে জনগণ বা মহাজন সেই পরিচয় সামনে থাকেনি। কে কাকে কোথায় হেনস্তা করেছে ঠিক-ঠিকানাও ছিল না। তার মধ্যেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবিয়েছে। তাড়নায় ফেলেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তখন সরকার, বিভিন্ন সংগঠন ও নিরাপত্তা বাহিনী দেয়নি। নিজেরাই যখন দৌড়ের ওপর থাকে তখন কে কাকে দেখে?

 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৫ আগস্টের পর নতুন প্রেক্ষাপটে আরেক ধরনের শিকার গণমাধ্যম এবং এ পেশায় যুক্তরা। নানা কারণে তখনকার বিশেষভাবে আলোচিত কিছু গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের কেউ কারাগারে, কেউ দেশান্তরি, কেউ বা গাঢাকায়। সাংবাদিক বলে কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে নন। কোনো দোষ থাকলে, প্রমাণ দৃষ্টে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াই উচিত। কিন্তু বিচারের আগেই বাজারি বিচার ঘটিয়ে বসার কিছু ঘটনা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। কষ্টের এ ধারাপাত চলেছে কিছুদিন।

একটু কমার পর সাম্প্রতিক সময়ে এতে আবার নতুন টোকা। এখানে-ওখানে ঢুঁ মেরে যাকে-তাকে ফ্যাসিস্টের দোসর বানানো, চাকরি থেকে খেদানোর ঢোলে বাড়ি; যা আগের আমলের কাউকে পছন্দ না হলেই জঙ্গি, বিএনপি, জামায়াত-শিবির, একাত্তরের চেতনাবিরোধী বানানোর নতুন সংস্করণ। গজবের এ আয়োজকরা কেউ ভিনদেশি নন। চাঁদের দেশ থেকেও নাজিল হননি। এ সময় এসে এমনটা মোটেই কাম্য ছিল না।

 

ধারণাও করা যায়নি মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির মাঝে এমন আজাব নামবে। দীর্ঘ সময় একটা ধকল সয়ে গণমাধ্যমগুলোতে স্থিতিশীলতা আনতে দিন-রাত বাড়তি শ্রমে আগোয়ান মালিক-কর্মচারীসহ গণমাধ্যমকর্মীদের গত মাস কয়েক কী দশায় জীবন কাটছে তা জানেন কেবল ভুক্তভোগীরাই। আর তাঁদের পরিবার ও স্বজনরা। বাইরের কারো পক্ষে তা উপলব্ধি করাও অসাধ্য।

 

এ রকম সময়ে এসে আবার গণমাধ্যমের ওপর মব-ভায়োলেন্স খোদার আরশ কাঁপানোর মতো যাতনার সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের কাছে। বিগত ১৫-১৬ বছর শাসনামলে গণমাধ্যমকে কী চাপে রাখা হয়েছিল, এর প্রথমত ভুক্তভোগীও সাংবাদিকরাই। দলান্ধতায় আসক্তদের কথা ভিন্ন। ওই অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও নানা ধরনের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। দীর্ঘদিনের বদচর্চা কাটিয়ে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চার মধ্যে নতুন আপদ কাম্য ছিল না। গণমাধ্যমকে উড়িয়ে দেওয়া, গুঁড়িয়ে দেওয়া, অপরাধী সাব্যস্ত করে তেড়ে আসা, ত্রাস তৈরির জন্য উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির কিছু লোক পাঠিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভাবনায়ও আসেনি। গণমাধ্যমের ওপর এই উৎপাত দেশকে গণতন্ত্রায়নের পথে আনতে চলমান নিরলস চেষ্টা ভুলের অংশও হয়ে থাকতে পারে। গণমাধ্যম মুক্ত হওয়ার অর্থ এখনো পরিষ্কার করতে না পারলে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ব্যাহত হবে, তা  বলা যায়।

 

স্বাধীনতা বা মুক্তি কোনো রকমের শর্ত দিয়ে হয় না। তার পরও গণমাধ্যমকে নিজ থেকেই কিছু শর্ত ও জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হয়। নিজেকে নিজের কাছে জবাব দিতে হয় সারাক্ষণ। অডিয়েন্সকে (পাঠক, দর্শক, শ্রোতা) আমলে রাখতে হয় সেকেন্ডে সেকেন্ডে। কারণ পাঠক, দর্শক, শ্রোতারা পুরোপুরি স্বাধীন। দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব বা তথ্যে হেরফেরের কারণে অপছন্দ হলে অন্য চ্যানেলে, পত্রিকা তথা গণমাধ্যমে চলে যেতে তাঁরা কাউকে জিজ্ঞাসার অপেক্ষা করবেন না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নেবেন। দলীয়পনার গণমাধ্যম যে ওই দলও পছন্দ করে না, একটু চোখ মেললে এর বেশ কিছু দৃষ্টান্ত সামনেই রয়েছে। প্রসঙ্গের প্রয়োজনে বলতে হয়, আওয়ামী লীগের লোকেরা তাদের দলীয় মুখপত্র দৈনিক বাংলার বাণী ভালোবাসলে পত্রিকাটি লাখ নয়, কয়েক কোটি চলত। বাস্তবে বাংলার বাণী ‘নাই’ হয়ে গেছে সেই কবেই। বিএনপির দৈনিক দিনকাল আছে। দলটির লোকেরা এর পাঠক-গ্রাহক হলে পত্রিকাটি চলতে পারে কয়েক কোটি। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামেরও প্রায় একই  অবস্থা। যে যে দলই করুক, প্রথমত তিনি মানুষ। তারপর দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ইত্যাদি। আর মানুষ হিসেবে তাঁদের প্রথম চাওয়া নিরেট তথ্য। আর তথ্যক্ষুধা মেটাতে এই দলীয় লোকদেরও ভরসা হচ্ছে পেশাদার, দলবাজিমুক্ত গণমাধ্যম।

 

গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকার কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। গণমাধ্যমের মালিকানা আছে, গণমাধ্যম পরিচালনাকারী সাংবাদিকরাও আছেন। কারো হুকুম ছাড়াও তাঁরা একটা জবাবদিহির মধ্যে থাকেন, থাকতে হয়। প্রয়োজনে তাঁদের আরো জবাবদিহি ও নীতিমালায় আনা যায়। সরকারসহ রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডারদের এখানে দায় আছে। দেশ-দুনিয়া কাঁপানো ৫ আগস্টের ছাত্র-জনশক্তিও স্টেকহোল্ডার। এসবের বাইরে ‘ফেউ’ গজানোর মতো যারা মাঠ চষছে, গণমাধ্যমেও ঢুঁ মারছে, এটাসেটা আরোপ করছে, কাকে রাখতে হবে, কাকে খেদাতে হবে-এসব দাওয়াও গেলাচ্ছে-এরা কারা? তাদের পেছনের শক্তিই বা কে ও কী? প্রশ্নটি গত কদিন ধরে ঘুরছে বিভিন্ন মহলে।

 

কয়েকটি ঘটনার তথ্য বলছে, গণমাধ্যম অফিসে ঢুকে পড়া আনকোরারা কার কাছে বা কাকে টার্গেট করে গেছে নিজেরাও জানে না। চেনেও না। এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে সমানে একঝলক গালমন্দ দিয়ে বেরিয়ে যায়। নমুনাই বলে দেয় এরা কারো না কারো প্রেরিত। আলামতদৃষ্টে যে যা বোঝার বুঝে নিচ্ছেন। গণমাধ্যমের অভ্যন্তরে তা ক্রমেই বদহজম হয়ে উঠছে। বমি শুরু হলে কার বমন কার ওপর পড়বে কে জানে? এক জায়গা থেকে তা আরেক জায়গায় গড়াবে। চক্কর দেবে বাজার থেকে মাজার, লোকালয় থেকে দেবালয়, পাতাল থেকে হাসপাতালসহ নানা মোকামে। গণমাধ্যমে মব যারা করছে, নিশ্চয়ই তারা এতিম-বেওয়ারিশ নয়, কেয়ার অব আছে কেউ না কেউ। এটি বাজে প্রবণতা। আর এ দেশে একবার কোনো বাজে ট্রেন্ড চালু হলে সেটা বাজার পায় দ্রুত। অন্যদিকে ভালো কিছুর দৃষ্টান্ত  ফলো করানো বড় কঠিন।

 

দীর্ঘদিন ধরেই মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষায় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো লড়াই করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে। এটি কম সুখবর নয়। এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদনে চলতি বছর বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর না থাকা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। পরিবর্তনের এই সূচনাকে ধরে আরো অনেক দূর যেতে হবে। কারণ গণমাধ্যমের কাছে এবং গণমাধ্যমকে নিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরো বেশি। কিন্তু সম্ভাব্য মবের শঙ্কায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠা সেল্ফ সেন্সরশিপকে আমন্ত্রণ করছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ কোনো স্বৈর বা ফ্যাসিস্ট সরকারের আরোপিত সেন্সরশিপের চেয়ে ক্ষতিকর। তা গণমাধ্যমের চেয়ে  সরকার,  দেশ, সমাজের জন্য আরো বেশি ক্ষতির। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সমস্যা, নানামুখী চাপ-তাপ এবং সেন্সরশিপ নিয়ে এমনিতেই অনেক কথা রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন। সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঐক্যের ডাকে রাজুতে নতুন কর্মসূচি

» ডা. জুবাইদা রহমানের আপিলের পরবর্তী শুনানি সোমবার

» আরেকটা এক-এগারো চাই না, আর চুপ থাকব না : রিফাত রশিদ

» প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াত আমির

» আসিফ, মাহফুজ, হাসনাত কিংবা হান্নান সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে: হান্নান মাসউদ

» আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাই না : গয়েশ্বর চন্দ্র

» ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে: খন্দকার মোশাররফ

» প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন নিয়ে যমুনায় ড. ইউনূসের সঙ্গে নাহিদের বৈঠক

» দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য, আগের বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ মাহফুজের

» ইসলামপুরে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ঢেউটিন বিতরণ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নিজেরাই যখন দৌড়ের ওপর থাকে তখন কে কাকে দেখে?

সংগৃহীত ছবি

 

মোস্তফা কামাল  :লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না, বাজারে জমা পানি মাজারেও চলে যায়-জাগতিক এ নিয়মে গেল আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় হতাহতের শিকার হয়েছেন অনেক গণমাধ্যমকর্মী। বাস্তবতার তোড়ে তখন কে ছাত্র, আর কে জনগণ বা মহাজন সেই পরিচয় সামনে থাকেনি। কে কাকে কোথায় হেনস্তা করেছে ঠিক-ঠিকানাও ছিল না। তার মধ্যেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবিয়েছে। তাড়নায় ফেলেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তখন সরকার, বিভিন্ন সংগঠন ও নিরাপত্তা বাহিনী দেয়নি। নিজেরাই যখন দৌড়ের ওপর থাকে তখন কে কাকে দেখে?

 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৫ আগস্টের পর নতুন প্রেক্ষাপটে আরেক ধরনের শিকার গণমাধ্যম এবং এ পেশায় যুক্তরা। নানা কারণে তখনকার বিশেষভাবে আলোচিত কিছু গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের কেউ কারাগারে, কেউ দেশান্তরি, কেউ বা গাঢাকায়। সাংবাদিক বলে কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে নন। কোনো দোষ থাকলে, প্রমাণ দৃষ্টে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াই উচিত। কিন্তু বিচারের আগেই বাজারি বিচার ঘটিয়ে বসার কিছু ঘটনা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। কষ্টের এ ধারাপাত চলেছে কিছুদিন।

একটু কমার পর সাম্প্রতিক সময়ে এতে আবার নতুন টোকা। এখানে-ওখানে ঢুঁ মেরে যাকে-তাকে ফ্যাসিস্টের দোসর বানানো, চাকরি থেকে খেদানোর ঢোলে বাড়ি; যা আগের আমলের কাউকে পছন্দ না হলেই জঙ্গি, বিএনপি, জামায়াত-শিবির, একাত্তরের চেতনাবিরোধী বানানোর নতুন সংস্করণ। গজবের এ আয়োজকরা কেউ ভিনদেশি নন। চাঁদের দেশ থেকেও নাজিল হননি। এ সময় এসে এমনটা মোটেই কাম্য ছিল না।

 

ধারণাও করা যায়নি মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির মাঝে এমন আজাব নামবে। দীর্ঘ সময় একটা ধকল সয়ে গণমাধ্যমগুলোতে স্থিতিশীলতা আনতে দিন-রাত বাড়তি শ্রমে আগোয়ান মালিক-কর্মচারীসহ গণমাধ্যমকর্মীদের গত মাস কয়েক কী দশায় জীবন কাটছে তা জানেন কেবল ভুক্তভোগীরাই। আর তাঁদের পরিবার ও স্বজনরা। বাইরের কারো পক্ষে তা উপলব্ধি করাও অসাধ্য।

 

এ রকম সময়ে এসে আবার গণমাধ্যমের ওপর মব-ভায়োলেন্স খোদার আরশ কাঁপানোর মতো যাতনার সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের কাছে। বিগত ১৫-১৬ বছর শাসনামলে গণমাধ্যমকে কী চাপে রাখা হয়েছিল, এর প্রথমত ভুক্তভোগীও সাংবাদিকরাই। দলান্ধতায় আসক্তদের কথা ভিন্ন। ওই অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও নানা ধরনের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। দীর্ঘদিনের বদচর্চা কাটিয়ে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চার মধ্যে নতুন আপদ কাম্য ছিল না। গণমাধ্যমকে উড়িয়ে দেওয়া, গুঁড়িয়ে দেওয়া, অপরাধী সাব্যস্ত করে তেড়ে আসা, ত্রাস তৈরির জন্য উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির কিছু লোক পাঠিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভাবনায়ও আসেনি। গণমাধ্যমের ওপর এই উৎপাত দেশকে গণতন্ত্রায়নের পথে আনতে চলমান নিরলস চেষ্টা ভুলের অংশও হয়ে থাকতে পারে। গণমাধ্যম মুক্ত হওয়ার অর্থ এখনো পরিষ্কার করতে না পারলে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ব্যাহত হবে, তা  বলা যায়।

 

স্বাধীনতা বা মুক্তি কোনো রকমের শর্ত দিয়ে হয় না। তার পরও গণমাধ্যমকে নিজ থেকেই কিছু শর্ত ও জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হয়। নিজেকে নিজের কাছে জবাব দিতে হয় সারাক্ষণ। অডিয়েন্সকে (পাঠক, দর্শক, শ্রোতা) আমলে রাখতে হয় সেকেন্ডে সেকেন্ডে। কারণ পাঠক, দর্শক, শ্রোতারা পুরোপুরি স্বাধীন। দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব বা তথ্যে হেরফেরের কারণে অপছন্দ হলে অন্য চ্যানেলে, পত্রিকা তথা গণমাধ্যমে চলে যেতে তাঁরা কাউকে জিজ্ঞাসার অপেক্ষা করবেন না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নেবেন। দলীয়পনার গণমাধ্যম যে ওই দলও পছন্দ করে না, একটু চোখ মেললে এর বেশ কিছু দৃষ্টান্ত সামনেই রয়েছে। প্রসঙ্গের প্রয়োজনে বলতে হয়, আওয়ামী লীগের লোকেরা তাদের দলীয় মুখপত্র দৈনিক বাংলার বাণী ভালোবাসলে পত্রিকাটি লাখ নয়, কয়েক কোটি চলত। বাস্তবে বাংলার বাণী ‘নাই’ হয়ে গেছে সেই কবেই। বিএনপির দৈনিক দিনকাল আছে। দলটির লোকেরা এর পাঠক-গ্রাহক হলে পত্রিকাটি চলতে পারে কয়েক কোটি। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামেরও প্রায় একই  অবস্থা। যে যে দলই করুক, প্রথমত তিনি মানুষ। তারপর দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ইত্যাদি। আর মানুষ হিসেবে তাঁদের প্রথম চাওয়া নিরেট তথ্য। আর তথ্যক্ষুধা মেটাতে এই দলীয় লোকদেরও ভরসা হচ্ছে পেশাদার, দলবাজিমুক্ত গণমাধ্যম।

 

গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকার কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। গণমাধ্যমের মালিকানা আছে, গণমাধ্যম পরিচালনাকারী সাংবাদিকরাও আছেন। কারো হুকুম ছাড়াও তাঁরা একটা জবাবদিহির মধ্যে থাকেন, থাকতে হয়। প্রয়োজনে তাঁদের আরো জবাবদিহি ও নীতিমালায় আনা যায়। সরকারসহ রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডারদের এখানে দায় আছে। দেশ-দুনিয়া কাঁপানো ৫ আগস্টের ছাত্র-জনশক্তিও স্টেকহোল্ডার। এসবের বাইরে ‘ফেউ’ গজানোর মতো যারা মাঠ চষছে, গণমাধ্যমেও ঢুঁ মারছে, এটাসেটা আরোপ করছে, কাকে রাখতে হবে, কাকে খেদাতে হবে-এসব দাওয়াও গেলাচ্ছে-এরা কারা? তাদের পেছনের শক্তিই বা কে ও কী? প্রশ্নটি গত কদিন ধরে ঘুরছে বিভিন্ন মহলে।

 

কয়েকটি ঘটনার তথ্য বলছে, গণমাধ্যম অফিসে ঢুকে পড়া আনকোরারা কার কাছে বা কাকে টার্গেট করে গেছে নিজেরাও জানে না। চেনেও না। এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে সমানে একঝলক গালমন্দ দিয়ে বেরিয়ে যায়। নমুনাই বলে দেয় এরা কারো না কারো প্রেরিত। আলামতদৃষ্টে যে যা বোঝার বুঝে নিচ্ছেন। গণমাধ্যমের অভ্যন্তরে তা ক্রমেই বদহজম হয়ে উঠছে। বমি শুরু হলে কার বমন কার ওপর পড়বে কে জানে? এক জায়গা থেকে তা আরেক জায়গায় গড়াবে। চক্কর দেবে বাজার থেকে মাজার, লোকালয় থেকে দেবালয়, পাতাল থেকে হাসপাতালসহ নানা মোকামে। গণমাধ্যমে মব যারা করছে, নিশ্চয়ই তারা এতিম-বেওয়ারিশ নয়, কেয়ার অব আছে কেউ না কেউ। এটি বাজে প্রবণতা। আর এ দেশে একবার কোনো বাজে ট্রেন্ড চালু হলে সেটা বাজার পায় দ্রুত। অন্যদিকে ভালো কিছুর দৃষ্টান্ত  ফলো করানো বড় কঠিন।

 

দীর্ঘদিন ধরেই মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষায় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো লড়াই করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে। এটি কম সুখবর নয়। এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদনে চলতি বছর বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর না থাকা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। পরিবর্তনের এই সূচনাকে ধরে আরো অনেক দূর যেতে হবে। কারণ গণমাধ্যমের কাছে এবং গণমাধ্যমকে নিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরো বেশি। কিন্তু সম্ভাব্য মবের শঙ্কায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠা সেল্ফ সেন্সরশিপকে আমন্ত্রণ করছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ কোনো স্বৈর বা ফ্যাসিস্ট সরকারের আরোপিত সেন্সরশিপের চেয়ে ক্ষতিকর। তা গণমাধ্যমের চেয়ে  সরকার,  দেশ, সমাজের জন্য আরো বেশি ক্ষতির। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সমস্যা, নানামুখী চাপ-তাপ এবং সেন্সরশিপ নিয়ে এমনিতেই অনেক কথা রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন। সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com