সংগৃহীত ছবি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :অন্য অনেক কিছুর মতোই ইতিহাসও কৌতুকপ্রিয়। কারও কারও ধারণা ইতিহাসের কৌতুকপ্রবণতা বুঝি একটু বেশিই। ভুক্তভোগীরা তো তেমনটা মনে করতে একেবারে বাধ্য। ওপরের ইতিহাসটা সর্বদাই জয় ও পরাজয়ে আকীর্ণ। বড় বড় ঘটনা সেসব। কিন্তু তাদের আড়ালে আরও এক ইতিহাস থাকে, অনেক সময় পরিহাসের, কখনো কখনো হয়তোবা নির্মল কৌতুকের। অভিজ্ঞ একজন পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে বলছিলেন একদিন। তিনি শুনেছেন, সেই মহাবদমাশ রবার্ট ক্লাইভ পালানোর ২০টা উপায় ঠিক করে রেখেছিল। ভরসা ছিল শুধু একটা। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা। কৌতুক এখানেই যে ২০টার কোনোটাই প্রয়োজন হয়নি, সবেধন নীলমণি একটাতেই কাজ হয়ে গেছে। নবাব সিরাজদ্দৌলা প্রথমে পরাজিত, পরে পলাতক এবং শেষ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন।
বিভেদ সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলেই জিতেছে, নইলে কোথায় যেত পালিয়ে, পালিয়েও বাঁচত কিনা সন্দেহ। আমাদের জন্যও ঐক্য যে কত প্রয়োজন, সেটা কে না অবগত। ঐক্যের চেষ্টা হয়। নানা ক্ষেত্রেই হয়। তবু ঐক্য আসে না। মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টার কথাই ধরি না কেন। কম কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বারবার একই উদ্যোগ যে নেওয়া হয়, তাই তো প্রমাণ করে বিভাজন কত গভীর, ঐক্য কতটা অসম্ভব। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঐক্য ছিল। কেননা তখন শত্রু ছিল একটাই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যেই যুদ্ধ থেমে গেল, অমনি যোদ্ধারা একে অন্যের শত্রু হয়ে দাঁড়াল। ঐক্য গেল খান খান হয়ে। পরস্পর পরস্পরকে ঘায়েল করতে উদ্যত হলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস তো এদিক থেকে অন্য কিছু নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের ইতিহাস ভিন্ন।
কে কতটা মুক্তিযোদ্ধা সে প্রশ্ন উঠেছে। এর মীমাংসা অসম্ভব। কিন্তু এটা তো সত্য যে অন্য সব ভেদাভেদের মধ্যেও কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর কে তার বিপক্ষে-এ প্রশ্নটা অতীত, ইতিহাসের নয়, চলমান বর্তমানেরও। কেননা এ বিবেচনাটা সমাপ্ত একটা যুদ্ধের নয়, একটা জনগোষ্ঠীর মুক্তির। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কে, কে তার বিপক্ষে। ঐক্যের স্বার্থেই এই পার্থক্যটা নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি।
এই প্রশ্নটা আরও একবার উঠেছিল। বায়ান্নর রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের সময়। সেই সময়েও কেউ কেউ ছিল উর্দুর পক্ষে এবং বাংলার বিপক্ষে। অর্থাৎ বন্ধনের পক্ষে, মুক্তির বিপরীতে। সেই সংকটের মীমাংসা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন, এমনকি মৌলবাদীদের মধ্যেও এমন লোক পাওয়া যাবে না-যিনি বলবেন, বাংলা ফেলে উর্দুর চর্চা করা আবশ্যক। কিন্তু একসময় তেমন মানুষ ছিল বৈকি। একজন তরুণ গবেষক বাঙালি মুসলমানের ভাষা শেখার ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে গিয়ে বেশ বিভ্রান্ত হয়েছেন বলে আমাকে বললেন কদিন আগে। দেখেন, গম্ভীর গম্ভীর সব রচনাতে এ কথা বলা হচ্ছে যে সব বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা নয়। কেউ কেউ মুসলমান হয়েছে ধর্মান্তরিত হয়ে, তাদের ভাষা বাংলা বটে। কিন্তু খাস মুসলমান যারা, যারা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, তাদের ভাষা ছিল আরবি-ফার্সি-উর্দু। পাকিস্তান আমলে নয় শুধু, তার আগেও এসব কথা বলা হতো, জানি আমরা। কিন্তু এখন আর এসব কথা গুরুত্ব পাবে না।
ওই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফলে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এখনো যে লোক নেই তা তো নয়। রয়েছে এবং থাকাটাও স্বাভাবিক বটে। মীরজাফররা আছে। নতুন পোশাকে।
একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধের সূত্রপাত একাত্তরেই নয়, বায়ান্নতেই। বায়ান্ন ছিল একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী-সামন্তবাদবিরোধী অভ্যুত্থান। তারই সূত্র ধরে নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতা পরম্পরায় একাত্তরের অভ্যুদয়। ভ্রƒণ থেকে শিশুর জন্মের মতোই অনিবার্য। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। এত বেশি দূরত্ব যে অসম্ভব মনে হবে তাদের একত্র হওয়া। একটা বিদেশি, অন্যটি স্বদেশি। একটা নবীন, অন্যটি প্রাচীন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারা আবার মিত্রও। এর সোনায় ওর সোহাগা। সাম্রাজ্যবাদই সোনা, সামন্তবাদ সোহাগা। সাম্রাজ্যবাদেরই ছত্রছায়ায় সামন্তবাদ রক্ষিত থাকে। আজও যে বাংলাদেশে সামন্তবাদী সাংস্কৃতিক কুসংস্কার ও অদৃষ্টবাদের এত পোয়াবারো; সেটা সাম্রাজ্যবাদেরই তৎপরতার একটি প্রমাণ বটে। সাম্রাজ্যবাদ চায় না আমরা মুক্ত হই; সে চায় একদিকে পুঁজিবাদের প্রতি মোহ, অন্যদিকে সামন্তবাদের বেষ্টনে মানসিক অন্ধকারে আমরা নিমজ্জিত থাকি। তাই মোহ ও অন্ধকার উভয়ের সৃষ্টিতেই বিস্তর উৎসাহ দেখায়।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ একসঙ্গে বিরোধিতা করেছে। সামন্তবাদ বলেছে ধর্মের কথা, অথচ কোনো একটা মুসলিম রাষ্ট্রও বাংলার মাটিতে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। উল্টো মদত জুগিয়েছে। ওদিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর সব কটি হয় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, নয় তো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার-তাই নাক গলানো উচিত হবে না বলে অনড় সাত্ত্বিক ভাব ধারণ করেছে। সৌভাগ্যক্রমে বিদেশি দুটি রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকে বিরামহীন সমর্থন দিয়েছিল, নইলে ঘটনার গতি কেমন হতো কে জানে। একাত্তরে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যেমনভাবে এক হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তাতে হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ আয়তনে দৈত্য ও বামন হলেও কেমন ইয়ার তারা একে অপরের।
আমাদের জন্য যুদ্ধটা ছিল বাঁচা কিংবা মরার। এ দুয়ের মাঝখানে কোনো জায়গা ছিল না খোলা। এই যুদ্ধে যে মিত্র নয় সেই ছিল শত্রু এবং শত্রু ছিল চতুর্দিকে। তবু আমরা যে জয়ী হয়েছি তার প্রধান কারণ ঐক্য। নইলে পলাশীর যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটত না ঠিকই, কেননা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে কিছু নেই। এক নদীতে যেমন দুবার গোসল করা যায় না, ইতিহাসকেও তেমনি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা কোনোটাই থাকে না। পুনরাবৃত্তি ঘটত না, তবে পরাজয় ঘটত অবশ্যই। পাকিস্তানিরাই জয়ী হতো। ক্লাইভ যেমন মীরজাফর খুঁজেছিল, পাকিস্তানিরাও তেমনি মীরজাফরদের সন্ধান পেয়েছিল বৈকি। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেও এমন লোকের গন্ধ পেয়েছিল যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে যুদ্ধরত বাঙালিদের সঙ্গে এবং আপস করে ফেলবে পাকিস্তানিদের সঙ্গে। যোগাযোগও করেছে। কিন্তু ফল হয়নি। কেননা যোদ্ধারা মানত না।
যোদ্ধাদের জন্য পাকিস্তান মরে গেছে ২৫ মার্চ রাতেই। তারপরে তার লাশের সৎকারটা শুধু বাকি ছিল। যুদ্ধের সময় পারেনি ঠিকই, কিন্তু পরে ওই দুই শত্রু ফিরে এসেছে। আজ যে বাংলাদেশে এত দারিদ্র্য এমন বিশৃঙ্খলা তার মৌল কারণও দৈত্য ও ভৃত্যের যুগল তৎপরতা। এদের হাত থেকে মুক্তির লড়াই চলছে এবং চলবে। এতে কে কোন পক্ষে, সে প্রশ্ন যে কেবল থাকছেই তা নয়, সে অত্যন্ত জরুরিও বটে।
ইতিহাসের কৌতুক এখানেও যে যুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যারা ছিল, যারা আলবদর, রাজাকার, তাদের রাষ্ট্রের এক নম্বর দুশমন মনে করা হয়নি। দুশমন মনে করা হয়েছে বামপন্থিদের, যারা চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ থামতে দেবেন না, এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং বাংলার মাটিতে সামন্তবাদের উচ্ছেদ ঘটাবেন, পরাজয় ঘটাবেন সাম্রাজ্যবাদের। এ ব্যাপারে শাসকশ্রেণির মধ্যে ব্যবধান পরিমাণগতই শুধু, গুণগত নয়। মুক্তির বিরুদ্ধ পক্ষকে প্রশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণি কোনো সীমা মানেনি।
জাতি হিসেবে আমাদের একটা বড় লজ্জা এই যে যুদ্ধাপরাধীদের আমরা নির্মূল করতে পারিনি। পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যকে আমরা চলে যেতে দিয়েছি। তাদের দোসরদের দিয়েছি পুনর্বাসিত হতে। এটা ঘটতে পেরেছে সেই পুরোনো কারণেই। সে হলো বিভেদ। মুক্তির পক্ষে যারা তারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধাপরাধীরাও দিব্যি পার পেয়ে যায়। বড় অপরাধে যেখানে শাস্তি নেই, সেখানে ছোট ছোট অপরাধের শাস্তি হয় বৈকি, নিয়ম সেটাই। কিন্তু তাতে ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে না, বাড়ছেও না, দেখতে পাচ্ছি। নানা পথ-পন্থা-প্রক্রিয়ায়, ইতিহাস আবারও কৌতুক করছে আমাদের সঙ্গে। নতুন করে। আমরা পছন্দ করব না হয়তো, কিন্তু ইতিহাস তো কৌতুক পছন্দ করে।
♦ লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন







