কলমে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী: রাগ-জেদ, মান-অভিমান, ভুল বোঝা যে কী ভয়ানক তা আজ খুব বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছে তৃণা। দত্ত বাবুর ছোটো মেয়ে তৃণা দত্ত। তৃণাকে ডানা কাটা পরী বললেও বোধহয় খুব কম বলা হয়।সে যেমন রূপসী তেমনি মেধাবীও।কিন্তু কোনো অহংকার তার নেই। এককথায় তৃণা রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। কিন্তু তৃণার দোষ একটাই– তার রাগ-জেদ আর মান-অভিমানটা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি।আর এই দোষই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল।
কোয়েড স্কুলে পড়ার সূত্রে নীলের সঙ্গে সেই ছোটো থেকেই তার বন্ধুত্ব।কলেজে গিয়ে সেই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তরিত হলো।কিন্তু তাদের সম্পর্কের পরিণতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াল নীলের পরিবার।নীলের ঠাকুরদা গোঁড়াব্রাহ্মণ।তিনবেলা আহ্নিক না করে জলস্পর্শ করেন না।বাড়িতে দুর্গাপুজো আছে।তিনি নীলের তৃণাকে বিয়ে করার প্রস্তাবের কথা শুনেই রেগে আগুন হয়ে চিৎকার করে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন -“আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে কখনও সম্ভব না।একটা ব্রাহ্মণের সঙ্গে দত্ত মানে বেনের মেয়ের বিয়ে আমি মানব না ।আমি কোনো বেনের মেয়েকে নাতবৌ করে আনব না।” ঠাকুরদার কথার উপর কারো কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। তবে শুধু ঠাকুরদা নয় পরিবারের অন্য সদস্য মানে নীলের ঠাকুমা,মা,বাবা কেউই এই বিয়ের পক্ষে ছিল না।
এদিকে মেয়ের বিয়ের বয়স হওয়ায় তৃণার বাড়ি থেকে সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়েছে।একটা খুব ভালো ছেলের সম্বন্ধ আসায় তৃণার পরিবার সেখানেই তার বিয়ে দেওয়ার মনস্থ করে।কিন্তু তৃণা কিছুতেই রাজি হয় না।পরিবারের সকলে রাজি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তৃণা চুপ করে থাকে।ছেলের বাড়ি বিয়ের জন্য ক্রমশ চাপ দিতে থাকে।ফলে তৃণার উপরও তার পরিবার চাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যেদিন বিকেলে মন্দিরের মাঠে দাঁড়িয়ে নীল বিয়ের বিষয়ে তৃণাকে পরিবারের মতামত জানায় সেদিন একটু কথাকাটাকাটির পর তৃণা “তাহলে তুমি পরিবারের পছন্দ মতো ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করো”-বলে রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।তারপর থেকে নীলও তৃণার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আর তৃণার ধাতে তো সেটা কখনও ছিল না। তবুও রাগের মধ্যেই দু-তিনবার মোবাইল এ হোয়াটস অ্যাপ চেক করে দেখে নীল কোনো মেসেজ করেছে কিনা।কিন্তু তা দেখতে না পেয়ে তার রাগ আরও বহুগুণিত হয়।সেদিনের পর আজ তৃণাই প্রথম নীল কে ফোন করল।দু-তিনবার রিং হয়ে গেলেও কেউ ধরল না।অবশেষে চতুর্থ বারে নীল ফোন ধরল। কাশতে কাশতে নীল “হ্যালো”বলতেই আগ্নেয়গিরি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে ফেটে পরল–তৃণা রাগাত স্বরে বলল “আজ বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় মন্দিরের মাঠে পুকুর পাড়ে একবার দেখা করো।” নীল কিছু একটা বলছিল কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যায় সেটা ঠিক বুঝতে পারল না তৃণা। তৃণা আরও চড়া সুরে বলল “আজ বিকাল সাড়ে পাঁচটায় পুকুর পাড়ে দেখা করবে”–বলেই ফোনটা কেটে দিল।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই তৃণা মন্দিরের মাঠে পুকুর পাড়ে যেখানে তারা দেখা করে বসে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে পাঁচটা বাজতে তখনও দু-তিন মিনিট বাকি। নীল এখনও আসেনি।এতদিনের সম্পর্কে এরকম প্রথম ঘটল যখন তৃণা আগে পৌঁছেছে,নীল পৌঁছায় নি।এতদিন নীল সময়ের আগেই এসে পৌঁছে তৃণার জন্য অপেক্ষা করত।নীল খুব পাংচুয়াল কিন্তু আজ কী হলো? হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তৃণা দেখে সন্ধ্যা ছ’টা–কিন্তু নীল কোথায়?রাগে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে তৃণার।পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে নীল কে ফোন করল কিন্তু মোবাইল সুইজ অফ।দু-তিন মিনিট অন্তর ফোন করে গেল কিন্তু প্রত্যেক বারই একই।এদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে।মাঠ ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে তৃণার মাথায় রাগ ততো চড়ছে। আর একটু দেখি– করতে করতে পৌঁনে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করল তৃণা।কিন্তু এখনও নীলের ফোন বন্ধ বলছে ।রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নিজের মোবাইলটা পুকুরের জলে ছুড়ে ফেলে এক নিঃশ্বাসে স্কুটিতে চেপে বসে।তারপর ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে বাবাকে জানায় তাদের পছন্দের ছেলেকেই সে বিয়ে করতে রাজি আছে। আর আগামী সাতদিনের মধ্যে তার বিয়ের সব ব্যবস্থা করতে।কথা মতো সাতদিনের ভিতরেই তৃণার বিয়ে হয়ে গেল।তৃণা বরের পাশে বসে হুস করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল।
আজ তৃণার অষ্টমঙ্গলা।বরের পাশে বসে সে আজ বাবার বাড়ি আসছে।তৃণাদের বাড়ি আসার আগে বড়ো বাজারে গাড়িটি দাঁড়ায় মিষ্টি নেওয়ার জন্য।হঠাৎ তৃণার চোখ যায় মিষ্টির দোকানের পাশে মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের দিকে।এ কী দেখছে তৃণা!–তার ছেলেবেলার বন্ধু প্রেমিক— নীল!কী দশা হয়েছে!–জিমকরা সুঠাম দেখের অধিকারী নীল বাতা হয়ে গেছে–একমুখ দাঁড়ি–একমাথা উশকো-খুশকো চুল।আর ওর পরনে সাদা মার্কিন–গায়েও একটা মার্কিন জড়ানো–কোমরে ঝুলছে কম্বলের আসন–কিন্তু কেন? কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা তৃণা। দোকান থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো মিষ্টির প্যাকেট হাতে গাড়িতে ওঠে তৃণার বর।গাড়িতে তৃণার মুখ চোখের অবস্থা দেখে ও জিজ্ঞাসা করল “কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করছে? ” তৃণা- “কিছু না” বলে মুখটা অন্য দিকে করল। একটু আগে যে তৃণা সারা রাস্তা বকবক করছিল হাসাহাসি করে গল্প করতে করতে আসছিল সে হঠাৎ কেমন থম মেরে গেছে দেখে তার স্বামী আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না।
বাজার থেকে গাড়িতে ঘন্টা খানেক সময় লাগে তৃণাদের বাড়ি পৌঁছাতে।এই ঘন্টা খানেকের পথে তৃণা হিসাব মিলানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারেনা।গাড়ি ঘরের দরজায় আসতেই বাড়ির সবাই ছুটে আসে মেয়ে জামাইকে আদর করে ঘরে নিয়ে যেতে কিন্তু তৃণা পরিবারের কারো কথার কোনো জবাব না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে একাই সোজা বাড়ির ভিতরে চলে যায়।অষ্টমঙ্গলা উপলক্ষ্যে দুপুরে অল্প সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী,কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটা ছোটো-খাটো খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই উপলক্ষ্যেই নীলের প্রতিবেশী তাদের বান্ধবী স্বপ্নাকে আসতে দেখেই চিলের মতো ছোঁ মেরে টানতে টানতে দোতলায় একটা ফাঁকা ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে বাজারের ঘটনাটা বলে, তৃণা। স্বপ্না জানায় নীলের গোটা পরিবার করোনায় শেষ হয়ে গেছে। এই কয়েকদিনে সে একে একে তার ঠাকুরদা,ঠাকুমা,বাবাকে হারিয়েছে।ওর মা এখনও হাসপাতালে ভর্তি–তার অবস্থাও ভালো না।নীলেরই প্রথম করোনা হয়–ওর অবস্থাও ভালো ছিল না–একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিল—ওঠা বসার ক্ষমতা ছিল না–গলা থেকে আওয়াজ বেরচ্ছিল না–ওর বাঁচার কথা ছিল না কিন্তু বরাত জোরে বেঁচে ফিরেছে।স্বপ্নার কথা গুলো শুনে তৃণার সব হিসাব একে একে মিলে যায়–তার দু- চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল–দু-চোখে অন্ধকার দেখে সে–মনে হয় গোটা পৃথিবী যেন বনবন করে ঘুরছে–ওর চারপাশ কেমন যেন খালি খালি মনে হয়–পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে –ধপ করে খাটের উপর বসে পরে তৃণা।