গত ৫৩ বছরে আমরা দেখেছি ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার সাধন এবং পরিবর্তনের উদ্যোগ। তবে এগুলোতে কতটুকু বৃহত্তর জনস্বার্থের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে আর কতটুকু সমষ্টি এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে-এটি নিয়ে আলোচনা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অতীত পেছনে চলে যায় সত্যি, তবে এটিকে তো বাদ দেওয়া যায় না। অস্বীকার করা যায় না। কেননা অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমান সময়ের যে পাথেয়। আর ক্রীড়াঙ্গনের একটি চোখ তো সব সময় পেছনে থাকে!
মানুষ পরিবর্তন চাইছে। চাইছে ঐক্যবদ্ধ বৈষম্যহীন ন্যায়নীতির সমতার ক্রীড়াঙ্গন দেখতে, স্বাধীনতার পর যে ক্রীড়াঙ্গনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। মানুষ জেগে উঠেছে। তরুণরা তাদের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ক্রীড়াঙ্গনে পুরনো ছবি দেখা থেকে পরিত্রাণ চাইছে। চাইছে ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের মাধ্যমে সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে। তারা শুধু মুখে নয়, বাস্তবতায় দেখতে চাইছে এই ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়োজনীয় ইতিবাচক উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবর্তন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্রীড়াঙ্গনকে বুঝতে পারা। ক্রীড়াঙ্গনের চাহিদা ও সংস্কৃতি বোঝা। ওপরে উল্লেখ করেছি ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে অন্য কোনো সেক্টরের তুলনা করা যাবে না। ক্রীড়াঙ্গনের যাঁরা চালিকাশক্তি, সেই সংগঠকরা তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগ এবং খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসার জন্য নিজেকে সংযুক্ত করেন। ৫৩ বছরের ক্রীড়া ইতিহাসে অনেক নিবেদিত সংগঠক, যাঁদের প্রজ্ঞা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো, তাঁদের অনেকেই পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে ‘মিসফিট’ ভেবে ক্রীড়াঙ্গন থেকে ধীরে ধীরে সরে গেছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্রীড়াচর্চা। পুনর্বাসিত যাঁদের করা হয়েছে, তাঁরা অনেকেই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেম, কমিটমেন্ট ও দূরদর্শিতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো মুশকিল। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা এবং সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি টিম হয়ে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। একত্ববাদিতা ক্রীড়াঙ্গনের কয়েকটি খেলাকে কিভাবে পিছিয়ে রেখেছে, বিতর্কিত করেছে, ক্রীড়াঙ্গনের মূল চেতনাকে ধ্বংস করেছে, তার অভিজ্ঞতা সবার আছে। ক্রীড়াঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টিকে পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। নিজেরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর একনায়কতন্ত্র ছিল তাঁদের পছন্দ। টিমে নির্বাচিত বিভিন্ন পদের সংগঠকরা অনুপ্রাণিত হয়ে ফুটবল ও ক্রিকেটে বিভিন্ন দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন। তাঁদের দেওয়া হয়নি। এতে খেলার চর্চা সাফার করেছে। খেলার ভালোর জন্য, খেলাকে গতিশীল করার জন্য পেশাদারি মানসিকতার বিকল্প নেই। খেলার বৃহত্তর স্বার্থে সবাই একমত হলে যেকোনো ইতিবাচক উদ্যোগ সফল হতে বাধ্য।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের পর সর্বক্ষেত্রে অর্থবহ পরিবর্তনের রব উঠেছে। এর আগেই কিন্তু ২০২৩-২৪ ফুটবল মৌসুমে প্রথমবারের মতো লীগ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ফুটবল সংগঠক মো. ইমরুল হাসান সবার ঐকমত্যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেখানে পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে দেশে পেশাদার প্রিমিয়ার লীগ শুরু হলেও এই উদ্যোগগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি। ভাবা হয়েছে খেলা তো মাঠে আছে।
বছরের পর বছর পেশাদার ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে অপেশাদার মোড়কে মুড়িয়ে। মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে লীগ কমিটি প্রথম শুরু করেছে সপ্তাহে দুই দিন (শুক্র ও শনিবার) লীগ ম্যাচ। আর মঙ্গলবার ফেডারেশন কাপের খেলা। আন্তর্জাতিক ফুটবল দুনিয়ায় এভাবেই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে খেলা পরিচালনা সচেতন মহলের প্রশংসা পেয়েছে। নির্ধারিত দিনে লীগ শুরু করা এবং শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শৃঙ্খলা ছাড়া উপায় নেই। এতে আন্তর্জাতিক ‘ফুটবল উইন্ডো’ প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবগুলো প্রয়োজন সাপেক্ষে সহজেই কাজে লাগাতে পারছে। এটি দেশের পেশাদার ফুটবল ক্লাবগুলোর জন্য স্বস্তি!
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি ম্যাচের পর একজন সাবেক ফুটবল লিজেন্ডের হাত দিয়ে ‘ম্যাচসেরা’ খেলোয়াড়কে পুরস্কৃত করা। এটি একটি নতুন উদ্যোগ। ফুটবলে আগে ছিল না। একসময় যেসব তারকা মাঠ আলোকিত করেছেন, ফুটবলপিপাসু মানুষকে অসংখ্য আনন্দঘন প্রহর উপহার দিয়েছেন-মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার পর দেশের ফুটবল সংস্কৃতি অনুযায়ী তাঁদের কথা কেউ মনে রাখে না। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের বেশির ভাগ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পেশাদার লীগ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁদের মধ্যে একজনকে প্রতি ম্যাচে মাঠে এনে সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের অসাধারণ অবদানের সামান্যতম ঋণ পরিশোধ করতে; পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ফুটবলার এবং ফুটবল দর্শকদের সঙ্গে তাঁদের মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে। প্রতি ম্যাচে সাবেক তারকা খেলোয়াড়ের মাঠে উপস্থিতি আলাদা একটি আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ফুটবল চত্বরে।
ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ কোনো খেলায়ই পরিবর্তনের নামে হঠকারিতার সুযোগ নেই। ক্রীড়াঙ্গন যেন অনিশ্চয়তায় না ভোগে- এটিই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার সুযোগ নেই। ক্রীড়া সংগঠন বাতিল করা খুব সহজ, কিন্তু পরে এটি নতুন করে সৃষ্টি করা কঠিন। দেশে খেলার চর্চাটা কিভাবে তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে চলে, এটি বুঝতে হবে। কোন কোন খেলা চলছে আর কোন কোনটির চত্বরে নীরবতা বিরাজ করছে, এটি বুঝতে হবে। ক্রীড়াঙ্গন সর্বস্তরে পরিচালিত হতে হবে ক্রীড়া সংগঠকদের দ্বারা। আমরা বারবার বলেছি, ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের উচিত প্রায়োরিটি সেট করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে চলমান খেলাধুলা বাধাগ্রস্ত না হয়। ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার সাধন তো অন্তর্বর্তী সরকারের এই স্বল্প সময়ে করা সম্ভব নয়। এই কাজ করবে পরে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে সেই সরকার। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বলা হয়েছে, তারা নির্বাচিত হলে ক্রীড়াঙ্গন দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখবে। অপেক্ষায় থাকব আশাভঙ্গ না হওয়ার জন্য।
ভিন্ন প্রসঙ্গ
কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবলে কিংবদন্তি এবং জনপ্রিয় খেলোয়াড়। খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। দেশের ফুটবলে কাজী সালাউদ্দিন একটি ‘ব্র্যান্ড’। প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড়, যিনি হংকং প্রফেশনাল লীগে খেলেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সক্রিয় সদস্য। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফুটবলার। খেলোয়াড়, অধিনায়ক, কোচ ও সংগঠক। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে চারটি টার্মে (১৬ বছর) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পঞ্চম টার্মে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একান্ত ব্যক্তিগত কারণে আর নির্বাচনের লড়াইয়ে নামতে চাননি। বর্তমানে তিনি সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। খেলোয়াড় সালাউদ্দিন যেভাবে দেশের ফুটবলে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, সেটি অন্য কোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের যেমন কিছু সফলতা আছে, আছে অনেক ব্যর্থতাও। তবে ইতিহাসের জন্য কাজী সালাউদ্দিনকে মূল্যায়ন করার সময় এখনো হয়নি। দোষে-গুণে মানুষ। ব্যক্তি সালাউদ্দিন এর ঊর্ধ্বে নন। তাঁর দোষ যেমন ছিল আবার গুণও ছিল। অনেকেই সালাউদ্দিনের বিরোধিতা করেছেন, তাঁকে হিংসা করেছেন, তাঁর সঙ্গে থেকেও বিরুদ্ধাচরণ করতে দ্বিধা করেননি। আবার কেউ কেউ তাঁকে পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন তাঁর কারিশমার জন্য। আন্তর্জাতিক ফুটবল চত্বরে সংগঠকদের মধ্যে সালাউদ্দিনের বিশেষ পরিচিতি ছিল।
স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ের স্পোর্টস পারসোনালিটি অধ্যায়ে এত দিন কৃতী ফুটবলার হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন সম্পর্কে লেখা ছিল। এখন এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে ফুটবলপ্রেমিক মানুষমাত্রই অবাক হয়েছেন। খেলোয়াড় সালাউদ্দিন তো তাঁর সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়। তাঁকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে কি নীতিহীনতার নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আছে? যদি থাকে, তাহলে কি সেটি তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে? সালাউদ্দিন আইনের ঊর্ধ্বে নন, যদি তিনি অন্যায় বা অপরাধ করে থাকেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনার সুযোগ আছে। কিছু ব্যক্তিমানুষের বিদ্বেষ বা হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী সালাউদ্দিনকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে কেন? সুস্থ জীবনবোধের জয় হোক।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক, সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন