নারী হয়ে জন্মালেও এক সময় পুরুষ হয়ে যায় যে প্রাণী

ছবি সংগৃহীত

 

পৃথিবীর প্রতিটি পরতেই লুকিয়ে আছে হাজারো রহস্য। যার বেশিরভাগই এখনো সমাধান করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে সমুদ্র নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। বিজ্ঞানী বা গবেষকরা তো বটেই সাধারণ মানুষও মাঝে মাঝে সমুদ্রের নানান রহস্যের সম্মুখীন হয়েছেন।

 

তেমনই এক রহস্যের সাক্ষী হয়েছিলেন হিরোইউকি আরাকাওয়া নামের জাপানের একজন পুরোহিত। সেই সঙ্গে তিনি একজন প্রশিক্ষিত ডুবুরি। তিনি জাপানের তাতেয়ামা উপসাগরে একটি ডুবন্ত উপসানালয় বা মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ৩০ বছরের বেশি সময় তিনি প্রতিদিন পানির নিচে গিয়ে সেই মন্দিরে ঘণ্টা বাজাতেন।

এর মধ্যেই তার সঙ্গে একটি মাছের পরিচয় হয়। সেই মাছটি প্রথম প্রথম খুব স্বাভাবিক আর দশটা মাছের মতোই ছিল। হিরোইউকি যখন মন্দিরে যেতেন মাছটি তার সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা করতে আসত। বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের। হিরোইউকি মাছটির নাম দেন ইয়োরিকো। নাম ধরে ডাকলেই হাজির হয়ে যেত সে।

 

এসব অবশ্য ৩০ বছর আগের ঘটনা। তবে সময় যতই এগোতে যাতে ইয়োরিকো নামের মাছটি বড় হতে থাকে। একসময় তার মাথা ফুলে উঠে একেবারে বিকট আকার ধারণ করে। আগের চেহারার সঙ্গে কোনো মিলই ছিল না তার। এমনই প্রথমে নারী মাছ হলেও পরে সে পুরুষ হয়ে ওঠে।

এই অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হন হিরোইউকি। তবে এদি মাছ প্রথম নজরে আসে বিবিসি আর্থের একটি ডকুমেন্টরি তৈরির সময়। জাপানের সাডো দ্বীপের কাছে পানিতে চিত্রগ্রহণের সময় বিবিসি আর্থ ক্রুদের ক্যামেরায় রূপান্তরটি ধরা পড়লে প্রজাতিটি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৭ সালে, এটি ব্লু প্ল্যানেট ২পর্ব ওয়ান ওশানে দেখানো হয়েছিল।

 

যে মাছটির কথা এতক্ষণ বলছিলাম তার আসল নাম হচ্ছে এশিয়ান শিপসহেড র্যাস। প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মাছটি। জাপানে কোবুদাই নামেও পরিচিত। এরা মূলত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের স্থানীয়, কোরিয়ান উপদ্বীপ, চীন, জাপান এবং ওগাসাওয়ারা দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে পাথুরে প্রাচীর অঞ্চলে বাস করে।

jagonews24

প্রজাতিটির পুরুষদের শারিরীক গড়ন নারী মাছের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। না, না অন্য কোনো প্রাণীর মতো নয় দেখতে, অন্যান্য প্রজাতির মাছের বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে প্রায় ১৫ আনাই বিদ্যমান। এর মোট দৈর্ঘ্য ১০০ সেমি (৩৯ ইঞ্চি) হতে পারে। এই প্রজাতির রেকর্ড করা সর্বাধিক ওজন হলো ১৪.৭ কেজি (৩২ পাউন্ড)।

 

জাপানে এই মাছের চাহিদা অনেক। মাছের স্বাদ অনেকটা ঝিনুকের মতো। তবে এই প্রজাতির মাছের ফোলানো মাথা আর লম্বা চোয়াল এক এলিয়েনের রূপ দিয়েছে এদের। এদের দাঁত দেখতেও বেশ ভয়ংকর। একেবারে সাজানো গোজানো পরিপাটি ছোট ছোট দাঁত নয়। আকারে বড় এবং বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই এদের দাঁত গজায়। যা দেখে রীতিমতো গা ছমছম করবে আপনার। এমনকি বাঙালি হয়ে এই মাছ খাওয়ার রুচি নাও হতে পারে।

 

কোরালযুক্ত সামুদ্রিক অঞ্চলেই এদের বসবাস। কবুডাই পৃথিবীর আদিম মাছেদের মধ্যে অন্যতম। এই প্রজাতির নারী মাছেরা পুরুষ মাছের তুলনায় আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। শারিরীক গড়নও অন্যান্য সাধারণ মাছের মতোই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, প্রতিটি পুরুষ মাছের উত্থান ঘটে নারী মাছের থেকেই। তবে বিস্ময়কর পরিবর্তনটি কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করে পার করছে দিনের পর দিন।

গ্রীষ্মের তাপমাত্রা চরমে পৌছালে, কাবুডাই প্রজননে মেতে ওঠে। প্রতিটি পুরুষ মাছ একটি নির্দিষ্ট এলাকা দখল করে রাখে। দখলকৃত প্রতিটি নারী মাছই তার অনুগত। পুরুষ মাছটি তার হেরেমের সব নারী মাছের সঙ্গেই মিলনের সুযোগ পায়। এই অঞ্চলে অন্য কোনো পুরুষ মাছের ঢোকার অনুমতি নেই।

 

তবে কোনো নারী মাছের বয়স ১০ পেরোলেই সে মিলনে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ এই সময় তার শরীরের নাটকীয় এক পরিবর্তন শুরু হয়। দেহে নারী হরমোনগুলো নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে পুরুষ হরমোন সঞ্চালন হতে শুরু করে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তার মাথা এবং থুতনি ফুলে ওঠে। নারী মাছটি পরিণত হয় এক দাপুটে পুরুষে।

 

এই পরিবর্তন কবুডাই রাজ্যে এক মল্লযুদ্ধের সূচনা করে। নতুন পুরুষ বয়স্ক পুরুষ মাছটির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কারণ একটি অঞ্চলে একটি পুরুষই রাজত্ব করতে পারে। মাথা যত বড় প্রতিপক্ষ ভয় দেখানো তত সহজ। সম্মুখযুদ্ধে জয় পরাজয়ের মধ্যে দিয়েই রাজ্যের অধিপতি নির্ধারিত হয়। সব অধিকার ছেড়ে পরাজিত পুরুষ মাছটি প্রস্থান করে।

এখানেই শেষ নয়। কোনো পুরুষেরই ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত নয়। কারণ প্রতিজন নারীর অভ্যন্তরেই একেকটি দাপুটে পুরুষের বাস। সময়ের পরিক্রমায় যার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং কাবুডাই রাজ্যে আসে নতুন অধিপতি। এভাবেই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। সূত্র: বিবিসি আর্থ, ওয়াইল্ডলাইফ জাপান

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» জাকসু নির্বাচন: ছাত্রদলের ৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা

» ঝটিকা মিছিল আয়োজনকারী আওয়ামী লীগ নেত্রী গ্রেফতার

» শাড়িতে মুগ্ধতা ছড়ালেন জয়া

» আ.লীগ ও জাতীয় পার্টিকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে: সারজিস আলম

» জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলায় গণঅধিকার জড়িত নয়: রাশেদ খাঁন

» সন্ত্রাস-চাঁদাবাজের দলই পিআর মানছে না: জামায়াতের নূরুল ইসলাম

» দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে: আনিসুল

» ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান না চাইলে ভালো রাজনীতি করতে বললেন সালাহউদ্দিন

» নুরাল পাগলার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা নিন্দনীয়: আখতার হোসেন

» কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে ফিরছেন তারেক রহমান: ডা. জাহিদ হোসেন

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নারী হয়ে জন্মালেও এক সময় পুরুষ হয়ে যায় যে প্রাণী

ছবি সংগৃহীত

 

পৃথিবীর প্রতিটি পরতেই লুকিয়ে আছে হাজারো রহস্য। যার বেশিরভাগই এখনো সমাধান করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে সমুদ্র নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। বিজ্ঞানী বা গবেষকরা তো বটেই সাধারণ মানুষও মাঝে মাঝে সমুদ্রের নানান রহস্যের সম্মুখীন হয়েছেন।

 

তেমনই এক রহস্যের সাক্ষী হয়েছিলেন হিরোইউকি আরাকাওয়া নামের জাপানের একজন পুরোহিত। সেই সঙ্গে তিনি একজন প্রশিক্ষিত ডুবুরি। তিনি জাপানের তাতেয়ামা উপসাগরে একটি ডুবন্ত উপসানালয় বা মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ৩০ বছরের বেশি সময় তিনি প্রতিদিন পানির নিচে গিয়ে সেই মন্দিরে ঘণ্টা বাজাতেন।

এর মধ্যেই তার সঙ্গে একটি মাছের পরিচয় হয়। সেই মাছটি প্রথম প্রথম খুব স্বাভাবিক আর দশটা মাছের মতোই ছিল। হিরোইউকি যখন মন্দিরে যেতেন মাছটি তার সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা করতে আসত। বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের। হিরোইউকি মাছটির নাম দেন ইয়োরিকো। নাম ধরে ডাকলেই হাজির হয়ে যেত সে।

 

এসব অবশ্য ৩০ বছর আগের ঘটনা। তবে সময় যতই এগোতে যাতে ইয়োরিকো নামের মাছটি বড় হতে থাকে। একসময় তার মাথা ফুলে উঠে একেবারে বিকট আকার ধারণ করে। আগের চেহারার সঙ্গে কোনো মিলই ছিল না তার। এমনই প্রথমে নারী মাছ হলেও পরে সে পুরুষ হয়ে ওঠে।

এই অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হন হিরোইউকি। তবে এদি মাছ প্রথম নজরে আসে বিবিসি আর্থের একটি ডকুমেন্টরি তৈরির সময়। জাপানের সাডো দ্বীপের কাছে পানিতে চিত্রগ্রহণের সময় বিবিসি আর্থ ক্রুদের ক্যামেরায় রূপান্তরটি ধরা পড়লে প্রজাতিটি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৭ সালে, এটি ব্লু প্ল্যানেট ২পর্ব ওয়ান ওশানে দেখানো হয়েছিল।

 

যে মাছটির কথা এতক্ষণ বলছিলাম তার আসল নাম হচ্ছে এশিয়ান শিপসহেড র্যাস। প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে মাছটি। জাপানে কোবুদাই নামেও পরিচিত। এরা মূলত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের স্থানীয়, কোরিয়ান উপদ্বীপ, চীন, জাপান এবং ওগাসাওয়ারা দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে পাথুরে প্রাচীর অঞ্চলে বাস করে।

jagonews24

প্রজাতিটির পুরুষদের শারিরীক গড়ন নারী মাছের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। না, না অন্য কোনো প্রাণীর মতো নয় দেখতে, অন্যান্য প্রজাতির মাছের বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে প্রায় ১৫ আনাই বিদ্যমান। এর মোট দৈর্ঘ্য ১০০ সেমি (৩৯ ইঞ্চি) হতে পারে। এই প্রজাতির রেকর্ড করা সর্বাধিক ওজন হলো ১৪.৭ কেজি (৩২ পাউন্ড)।

 

জাপানে এই মাছের চাহিদা অনেক। মাছের স্বাদ অনেকটা ঝিনুকের মতো। তবে এই প্রজাতির মাছের ফোলানো মাথা আর লম্বা চোয়াল এক এলিয়েনের রূপ দিয়েছে এদের। এদের দাঁত দেখতেও বেশ ভয়ংকর। একেবারে সাজানো গোজানো পরিপাটি ছোট ছোট দাঁত নয়। আকারে বড় এবং বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই এদের দাঁত গজায়। যা দেখে রীতিমতো গা ছমছম করবে আপনার। এমনকি বাঙালি হয়ে এই মাছ খাওয়ার রুচি নাও হতে পারে।

 

কোরালযুক্ত সামুদ্রিক অঞ্চলেই এদের বসবাস। কবুডাই পৃথিবীর আদিম মাছেদের মধ্যে অন্যতম। এই প্রজাতির নারী মাছেরা পুরুষ মাছের তুলনায় আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। শারিরীক গড়নও অন্যান্য সাধারণ মাছের মতোই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, প্রতিটি পুরুষ মাছের উত্থান ঘটে নারী মাছের থেকেই। তবে বিস্ময়কর পরিবর্তনটি কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করে পার করছে দিনের পর দিন।

গ্রীষ্মের তাপমাত্রা চরমে পৌছালে, কাবুডাই প্রজননে মেতে ওঠে। প্রতিটি পুরুষ মাছ একটি নির্দিষ্ট এলাকা দখল করে রাখে। দখলকৃত প্রতিটি নারী মাছই তার অনুগত। পুরুষ মাছটি তার হেরেমের সব নারী মাছের সঙ্গেই মিলনের সুযোগ পায়। এই অঞ্চলে অন্য কোনো পুরুষ মাছের ঢোকার অনুমতি নেই।

 

তবে কোনো নারী মাছের বয়স ১০ পেরোলেই সে মিলনে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ এই সময় তার শরীরের নাটকীয় এক পরিবর্তন শুরু হয়। দেহে নারী হরমোনগুলো নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে পুরুষ হরমোন সঞ্চালন হতে শুরু করে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তার মাথা এবং থুতনি ফুলে ওঠে। নারী মাছটি পরিণত হয় এক দাপুটে পুরুষে।

 

এই পরিবর্তন কবুডাই রাজ্যে এক মল্লযুদ্ধের সূচনা করে। নতুন পুরুষ বয়স্ক পুরুষ মাছটির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কারণ একটি অঞ্চলে একটি পুরুষই রাজত্ব করতে পারে। মাথা যত বড় প্রতিপক্ষ ভয় দেখানো তত সহজ। সম্মুখযুদ্ধে জয় পরাজয়ের মধ্যে দিয়েই রাজ্যের অধিপতি নির্ধারিত হয়। সব অধিকার ছেড়ে পরাজিত পুরুষ মাছটি প্রস্থান করে।

এখানেই শেষ নয়। কোনো পুরুষেরই ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত নয়। কারণ প্রতিজন নারীর অভ্যন্তরেই একেকটি দাপুটে পুরুষের বাস। সময়ের পরিক্রমায় যার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং কাবুডাই রাজ্যে আসে নতুন অধিপতি। এভাবেই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। সূত্র: বিবিসি আর্থ, ওয়াইল্ডলাইফ জাপান

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com