বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক: গত ১৪ জুলাই বঙ্গবন্ধুকন্যা তথা প্রধানমন্ত্রী একটি অতীব মূল্যবান প্রশ্ন রেখেছেন। প্রশ্নটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধররা কোটার সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারদের নাতি-পুতিরা পাবে? জননেত্রী শেখ হাসিনার এই অমোঘ বাক্য একদিকে যেমন অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়, অন্যদিকে তেমনি বহু প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় যুদ্ধে নেমে পড়লেও বেশ কিছু বাঙালি ছিল যারা পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় মেনে নিতে পারেননি। এদের অনেকে নিষ্ক্রিয় থাকলেও অনেকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, হত্যা করেছে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে, শত সহস্র নারীকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে যাতে পাকিস্তানি পিশাচরা তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে পারে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করার পর কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমসহ অনেকে পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছিলেন, অনেকে দেশের ভিতরেই আত্মগোপনে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দালাল আইন প্রবর্তন করে এদের মধ্য থেকে কয়েক সহস্রকে গ্রেফতার করে বিচারে দিয়েছিলেন। প্রতিটি জেলায় এদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু নেহায়েত মানবিক কারণে এদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষভাবে অপরাধে জড়িত ছিল এমন ১১ হাজারকে আটক রেখে বাকিদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তবে মুক্তি পাওয়ারাও বসে থাকেননি। দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকেন দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার জন্য। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনি জিয়া-মোশতাকের অপনেতৃত্বে এদের ষড়যন্ত্র সফল হয়। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, নেমে যান তাদের মূল পরিকল্পনায়, অর্থাৎ দেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার জন্য। প্রথম প্রহরেই তারা পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর নির্দেশে, তার কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তানিকরণের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। খুনি জিয়াকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির লোকেরা জিয়ার নেতৃত্বে একত্রিত হন। এদের সঙ্গে ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ দলের নরপিশাচ। আরও ছিল যাদু মিঞাসহ সে সব চীনপন্থি যারা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। খুনি জিয়া কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করে এবং অন্যান্য চিহ্নিত রাজাকারকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে দেশে রাজাকারের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিভিন্ন অজুহাতে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর দালাল আইন রহিত করে ১১ হাজার বন্দি রাজাকারকে মুক্ত করেন, যার মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পিতাও ছিলেন। শুরু হয় রাজাকারদের রাজত্ব। খুনি জিয়ার সহায়তায় এরা প্রত্যেকেই হয়ে পড়েন কোটি কোটি টাকার মালিক। আজ যারা তথাকথিত কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন, তাদের একাংশই যে ’৭১-এ পরাজিত রাজাকারদের বংশধর, তা তাদের কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার। অত্যন্ত নির্লজ্জের মতো তারা বলার সাহস পাচ্ছে ‘তুই কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। তাদের নেতৃত্বে দেখা যাচ্ছে চিহ্নিত জামায়াত-শিবিরের লোক। নেতৃত্বে এবং উসকানিদাতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিএনপি এবং সমমনা অন্যান্য চুনাপুঁটি দলের এমন নেতাদের, যারা প্রমাণিতভাবে রাজাকারদের বংশধর। প্রতিদিন দুই বেলা এদের বিরিয়ানি খাওয়াতে, যাতায়াত ভাড়া দিতে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। সে টাকারইবা উৎস কী? এটা অজানা নয় বিলেতে বসে থাকা খুনি তারেক জিয়াসহ অন্যান্যরা এসব টাকার জোগানদাতা।
এরা মেধা মেধা বলে চিৎকার করছে। অথচ এদের মধ্যে যে মেধার ন্যূনতম উপাদান নেই সে কথাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এরা সবাই এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। এ সময়ে তাদের ভালোভাবেই জানা উচিত যে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের অংশ নয়, বিচারপতিরা সরকারি কর্মকর্তা নন। এটা জানা উচিত যে বিষয়টি যতদিন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন, ততদিন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কোনো ক্ষমতা নেই কিছু করার। তাদের অন্তত এই মৌলিক কথাটি জানা উচিত যে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ, যথা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং আইন প্রণয়ন বিভাগ একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যা ফরাসি দার্শনিক মন্টোস্কোর ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করা। এরা বলছে সুপ্রিম কোর্ট মানে না, কোর্টে যাবে না ইত্যাদি। এরা প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গ করে, রাস্তা ব্লক করে প্রমাণ করছে আইন-কানুন এবং মানুষের অধিকারের প্রতি তাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। তাদের সরকারি পদে বসার সুযোগ করে দিলে তারা একইভাবে বেআইনি কাজ করতে থাকবেন, মানুষের অধিকার টুঁটি চেপে হত্যা করবেন। আইন এবং সাংবিধানিক শাসনের প্রতি তাদের কোনো রকম আনুগত্য থাকবে না। তারা পাকিস্তানিকরণের বাসনা চরিতার্থ করার কাজে লিপ্ত হবেন। তাই এদের চিহ্নিত করে রাখতে হবে যাতে এরা কখনো সরকারি কোনো চাকরিতে প্রবেশ করতে না পারে।
আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উচিত হবে এদের পারিবারিক পরিচয় নিশ্চিত করা। তাহলে হয়তো দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু দালাল আইনে যাদের গ্রেফতার করেছিলেন, এদের অনেকেই তাদের বংশধর। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় শুধু মির্জা ফখরুল, রিজভী, আমীর খসরু (যার গোটা পরিবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী) কে দেখছি না, দেখছি যাদু মিঞার মেয়েদেরও। যা প্রমাণ করে এদের তথাকথিত আন্দোলন শুধু কোটার ব্যাপারেই সীমিত নয়। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে অবৈধ পন্থায় সরকারের পতন ঘটানো, যে চেষ্টা তারা বহু বছর ধরে করে যাচ্ছে, যে কথা মাহমুদুল হক মান্না, নূর, সাকিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন। অতীতে পাকিস্তানপন্থিদের সহায়তায়, তাদের শাসন আমলে কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমের ছেলে সামরিক বাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উঠতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় না এলে সে রাজাকার পুত্র পূর্ণাঙ্গ জেনারেল হয়ে পড়তেন। এখনো এদের অভিলাষ রাজাকারদের বংশধরদের সরকারি পদে বসিয়ে তাদের কূট উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এসব রাজাকারের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি। তারা রাজপথে নেমে এসে রাজাকার সন্তানদের প্রতিহত করতে চাইলে এরা তুলার মতো উড়ে যাবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা আইন ভঙ্গ করবেন না বলেই রাজাকার সন্তানদের প্রতিহত করতে রাস্তায় নামছেন না। তথাকথিত আন্দোলনকারীরা রাস্তা ব্লক করে জনজীবনে দুর্ভোগের সৃষ্টি করছে। আইন-কানুন এবং জনমানুষের অধিকারের প্রতি যাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই তারা সরকারি পদে গেলে কী করবেন, তা আন্দাজ করতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। সেদিন টেলিভিশনে এক তরুণীর কথা শুনে পরিষ্কার হয়ে গেল তাদের আসল উদ্দেশ্য কী। বাঘিনী বলে পরিচয় দেওয়া সেই তরুণী বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রমাণ করলেন তাদের উদ্দেশ্য সরকারের পতন ঘটানো। কিন্তু তথাকথিত বাঘিনীদের সে গুড়েবালি। দেশের সিংহভাগ মানুষ এই সরকারের পক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে, যারা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। রাজাকারদের বংশধর নয়, এমন কিছু ছেলেমেয়েও রাজাকারদের বংশধরদের সঙ্গে মিলেছে কারণ তাদের বোঝানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধারা ভালো নয়। তাই আমাদের দায়িত্ব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এদের জানিয়ে দেওয়া ১৯৭১ সালে রাজাকাররা কী নৃশংসভাবে দেশের ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, ৫ লাখের অধিক নারীকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে। যারা নিজেদের রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে, তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, রবীন্দ্রনাথের বাংলায়, নজরুলের বাংলায়, লালনের বাংলায় রাজাকারদের আস্তানা গাড়তে দেওয়া যাবে না, যেমন দেওয়া যায়নি ১৯৭১-এ।
ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে সাধুবাদ জানাতে হয় কারণ তারা কঠোর হস্তে সে সব তথাকথিত আন্দোলনকারীদের দমন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যারা আইন ভঙ্গ করে রাস্তা অবরোধ করছে। প্রতিটি মানুষের জানমাল রক্ষা করা তাদের মৌলিক দায়িত্ব, আর সে দায়িত্ব পালনেই তারা ব্রতী হয়েছেন।
অবৈধ এবং আইন ভঙ্গ করে আন্দোলনের মাধ্যমে মাননীয় আপিল বিভাগকে প্রভাবিত করার যে অপচেষ্টা এসব ব্যক্তি করছেন, তা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। এরা সফল হলে আইনের শাসন, সংবিধানের শাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এসব মেধাশূন্য, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী স্বঘোষিত রাজাকাররা অবশ্যই সফল হবেন না। যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে কথা বলেন, এ দেশে কখনো তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ’৭১-এর হাতিয়ার আবার গর্জে উঠবে।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন