সংগৃহীত ছবি
মোস্তফা কামাল : রাত পোহালেই ফিরবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রায় দেড়যুগ বিরতিতে এই নেতার দেশে ফেরা নিয়ে উজ্জীবিত দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। তাঁদের প্রত্যাশা, তিনি দেশে ফিরে দলকে আরো শক্তিশালী করে, সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবেন। এ ভাবনা একেবারেই দলীয় গণ্ডির ভাবনা। কিন্তু জনপ্রত্যাশা অন্যখানে। যেমনটি দেশের এক চরম ক্রান্তিকালে দলটি গঠন করেছিলেন তাঁর বাবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তা করতে গিয়ে তিনি ভিন্নমত খোঁজেননি। খুনখারাবি, লুট, রাহাজানি, লুটপাট স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন বহুদলীয় দলীয় চিন্তায়।
পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির পূর্বাপর বছর কয়েক ধরে চলতে থাকা অরাজকতায় এলোমেলো বিক্ষিপ্ত দেশকে টেনে তুলেছিলেন জিয়াউর রহমান। অবিশ্বাস্য ওই কাজ কারো কাছে ছিল ম্যাজিক, কারো কাছে প্রকৃতির আশীর্বাদ, কারো কাছে ওপরওয়ালার খাস রহমত। দেশকে দেশাত্ববোধের জায়গায় ফিরিয়ে আনার সেই রেশ দেখিয়েছেন তারেক রহমানের মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও। টানা ৯ বছরের স্বৈরশাসন অবসানের পর একানব্বইতে জনগণ আবারও দেশকে খাদের কিনার থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব দেয় বেগম খালেদা জিয়াকে। তিনি জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।
গত প্রায় দুই যুগ অরাজকতা-অগণতান্ত্রিক চর্চায় ক্ষতবিক্ষত দেশ আবারও অন্ধকারে খাবি খাচ্ছে খুন-মবসহ নানা অরাজকতায়। রাজনৈতিক উত্তেজনার পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা চরমে। জননিরাপত্তা হুমকিতে। ব্যবসা-বিনিয়োগে এক নারকীয় বন্ধ্যত্ব। দেশ কোন অন্ধকারে বাঁক নিচ্ছে, কঠিন প্রশ্ন। এখান থেকে লাগাম টানার ঐতিহাসিক দায়িত্ব তারেক রহমানের। দলীয় লোকদের কাছে অপেক্ষা ক্ষমতার। কিন্তু দেশান্ধ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা ক্ষমতায় সীমিত নয়। তাদের কাছে তারেক রহমান অন্য উচ্চতায়। সেই প্রত্যাশার পারদে দেশকে তৃতীয়বারের মতো টেনে তোলার কাজটির স্মারক হওয়ার অভিযাত্রায় তারেক রহমান। দেশে ফেরার আগে তার মেয়ে জাইমা রহমানের আবেগঘন স্ট্যাটাসেও মিলেছে এ প্রত্যাশার ছাপ।
তারেক রহমানের সুদূর লন্ডনে থেকে দেশ পরিচালনা, গত বছর দেড়েকের বিভিন্ন পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত ও পরিমিত কথাবার্তায় জনমানুষের মধ্যে তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ উঠছে। বিভিন্ন জায়গায় মব, সহিংসতা নিয়ে তাঁর বক্তব্যগুলো রাজনীতির বাইরের প্রায় সব শ্রেণি-পেশাকেও আগ্রহী করে তুলেছে। যেখানে সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তাঁর বাবা জিয়াউর রহমানের কিছু পদক্ষেপের ছায়া মিলছে। ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরে নতুন এক স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার রেকর্ড গড়েছিলেন জিয়াউর রহমান। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন সেক্টর নিয়ে তিনি টানা কয়েক দিন ধরে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন, যেগুলোর মাঝে তাঁর পিতার পরিকল্পনার ছায়া দেখছেন অনেকে।
দীর্ঘ নির্বাসন থেকে তাঁর ঘরে ফেরা দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের কাছে রাজনৈতিক প্রাপ্তি। এর সঙ্গে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির কিছু তফাত রয়েছে। তাঁদের চাওয়া কেবল দেশকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়া নয়, আরো কিছু। আর সেই ‘আরো কিছুটা’ হচ্ছে একটি সুস্থ-সুন্দর নিরাপদ বাংলাদেশ। মব-সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটমুক্ত গতিময়-কর্মমুখর বাংলাদেশ। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া। আর এই প্রতীক বয়ে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কাণ্ডারি তারেক রহমান। সময়, প্রকৃতি, বাস্তবতা তাঁকে এ দায়িত্ব শিরোধার্য করেছে। তাই রাজনীতির বাইরের অনেকেরও বিশ্বাস, তারেক রহমানের হাত দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের খুঁটি যেমন মজবুত হবে, রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্যের লাগামেও টান পড়বে। গতিময়তা পাবে ব্যবসা-বিনিয়োগসহ দেশের অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন।
কদিন আগে তারেক রহমান বলেছেন, তাঁর দলটির মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হওয়ার কথা। আরেকটি বার্তায় বলেছেন, যেকোনো মূল্যে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর নিয়ত পরিষ্কার বলেও জানান দিয়েছেন। আর অর্থনীতির চাকা ঘোরানোসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা তো জানিয়েছেনই। বিচারের আগে বিচার করে ফেলার একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি বাংলাদেশে বহু দিন থেকেই চলমান-বহমান। সমপ্রতি আরো ধাবমান। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মব সন্ত্রাস, হত্যা, রাহাজানি, আগুনকাণ্ড যে যাকে যেভাবে পারছে ঘায়েল করছে। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ ও ইন্টারনেটের প্রসার মিডিয়া ট্রায়াল প্রবণতাকে আরো বিধ্বংসী করেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপতথ্য, ভুলতথ্যসহ নানা অনুষঙ্গ। বিভিন্ন ব্যক্তির সমান্তরালে তা চলছে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের ওপরও। এ ব্যথার প্রকাশও ঘটিয়েছেন তারেক রহমান, যা দেশের বিজনেস কমিউনিটিকে ভরসা জাগিয়েছে। লুকানো বা রাখ-ঢাকের বিষয় নয় যে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছে নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য এবং সম্ভাবনা নস্যাৎ করার অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্র বেশ দৃশ্যমান। এ দশা থেকে বাবা-মায়ের অনুসরণে দেশকে আবারও লাইনে তোলার দায়িত্ব পড়তে যাচ্ছে তারেক রহমানের ঘাড়ে।
তিনি কথা দিয়েছেন, পছন্দ না হলে তাঁকে ভোট না দিক, তাঁর দল যদি ক্ষমতায় না-ও যায়, তবু ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এমন ওয়াদা-অঙ্গীকার তাঁর ব্যক্তিত্বকে দলের ওপর ভিন্ন হাইটে নিয়ে গেছে। তারেক রহমানকে কোনো হাইপে-হাইটে আবেগতাড়িত হওয়ার একরত্তি সুযোগও রাখেনি চব্বিশে ইতিহাসের নতুন এ বাঁকবদল। অনিবার্য নতুন এ বন্দোবস্ত ও বাস্তবতাকে কেবল রাজনৈতিক নয়, নিতে হবে আর্থ-সামাজিক পর্যায়েও। তা করতে হবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং বাবা-মায়ের দেশ টেনে তোলার ঐতিহ্য ধারণ করে।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। দেশে ফিরতে মানা, কথা বলতে মানা, কথা প্রচারেও আদালতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিনি এগিয়েছেন হাত-পা বাঁধা সাঁতারুর মতো করে। তাঁর দৃঢ়তার সামনে নির্যাতকদেরই পরাস্ত হতে হয়েছে নিদারুণভাবে। তারেক রহমানের নাছোড়বান্দা ভূমিকায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রই তৈরি করেনি, বিপ্লব-পরবর্তী স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটও রচনা করেছে।
বিগত সরকারের অবিরাম অপপ্রচার, প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীর নিয়মিত গালমন্দ, ভেংচি, খিঁচুনির জবাবে না গিয়ে তারেক রহমান এগিয়েছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তাঁর কাজ তিনি করেই গেছেন অবিরাম। তাঁর নেতৃত্ব খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তোলার শক্তিও দেখিয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে তা একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। পাশাপাশি দেশের রাজনীতি ও বিপ্লবকে করে তুলেছে আরো প্রাসঙ্গিক। তুমুল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিভাবে অটল-অবিচল থেকে ক্রমেই উচ্চতায় ওঠা যায়, সে ক্ষেত্রে পাঠপঠনের মতো উদাহরণ হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান। বৈরী পরিবেশেও তিনি সবাইকে শান্ত থাকার বার্তা দিচ্ছেন। এখন তাঁরো তাঁদের আস্থা-ভরসার মর্যাদা দেওয়ার অভিষেক।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
সূূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন








