ফাইল ছবি
জিল্লুর রহমান : ১. কেন লিখি, কেন বলি
এই প্রশ্নটা আমি নিজেকেই বারবার করি-কেন লিখি, কেন বলি? এত কথা বলারই বা কী দরকার? লেখার দায়টা আলাদা। লেখা থেকে যায়। লেখা মানুষকে একা পায়, কোনো শব্দের চাপে নয়, কোনো চিৎকারের ভিড়ে নয়।
এই সময়টা এমন, যেখানে কথা বলার লোকের অভাব নেই। টেলিভিশন খুললেই আলোচনা, মোবাইল খুললেই মতামত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই কিছু না কিছু বলছে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সবাইকে বক্তা বানিয়েছে, কিন্তু শ্রোতা বানাতে পারেনি। ফলে শব্দের ঘনত্ব বেড়েছে, অর্থের গভীরতা কমেছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সবখানেই এই তাড়াহুড়া, এই অতিশব্দ। অদ্ভুতভাবে মনে হয়, আমরা ক্রমেই কম শুনছি, কম ভাবছি।
তবু লিখতে হয়। কারণ না লিখলে, না বললে, এই সময়ের অসংলগ্নতা একসময় স্বাভাবিক হয়ে যায়। কারণ কথা না বললে, অন্য কেউ আমাদের হয়ে কথা বলে দেয়। এই কলাম তাই নতুন করে কথা বলার চেষ্টা। বক্তৃতা নয়, বিশ্লেষণ নয়, কথা। যে কথার মধ্যে প্রশ্ন থাকে, দ্বিধা থাকে, কখনো ব্যক্তিগত স্মৃতিও থাকে। লিখি কারণ সব কথা মাইক্রোফোনে বলা যায় না। লিখি কারণ লেখা থামে না, পাঠকের সঙ্গে একা একা কথা বলে। লিখি কারণ চুপ থাকাও এই সময় একধরনের অবস্থান।
এই কলাম তাই কোনো একক মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়। কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের মুখপত্র নয়। এটা প্রশ্ন তোলার জায়গা। চারদিক থেকে দেখা, চতুর্মাত্রিকভাবে। এখানে চারটি ভিন্ন প্রসঙ্গ থাকবে, রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবন, আন্তর্জাতিক অস্থিরতা, ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তা। রাজনীতি, সমাজ, ব্যক্তি, স্মৃতি, সব একসঙ্গে। কারণ মানুষের জীবনও এমনই। রাষ্ট্র আলাদা নয়, রাজনীতি আলাদা নয়, ব্যক্তিগত যন্ত্রণাও আলাদা নয়।
রাষ্ট্র যখন সিদ্ধান্ত নেয়, তার অভিঘাত পড়ে ব্যক্তির জীবনে। বিশ্ব যখন অস্থির হয়, তার ছায়া পড়ে আমাদের ঘুমের মধ্যেও। চতুর্মাত্রা তাই চার দিক থেকে তাকানোর চেষ্টা। একটি সময়কে, একটি ক্লান্তিকে, একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমপ্রশ্নকে-চারটি কোণ থেকে দেখা। লেখার প্রয়োজন এখানেই। এই সময়কে একটু থামিয়ে দেখার জন্য।
২. নির্বাচন, রাজনীতি এবং মানুষের ক্লান্তি
নির্বাচন সামনে। এ কথাটা সবাই জানে। এই বাক্যটা এখন প্রায় যান্ত্রিক শোনায়। কিন্তু চোখে মুখে সেই উত্তেজনা নেই, যে উত্তেজনা একসময় নির্বাচন মানেই ছিল। আলোচনায় তাপ নেই। বরং আছে একধরনের ক্লান্তি। যেন মানুষ ভাবছে, আবার কি সেই একই গল্প? রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে সভা, সমাবেশ, আসন হিসাব, জোটের অঙ্ক। সংবাদে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নির্বাচনি খবর। তবু সাধারণ মানুষের জীবনে নির্বাচনের প্রভাবটা খুব সীমিত।
কারণ মানুষের প্রশ্ন বদলে গেছে। ভোট কবে হবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ভোটের পর কী হবে?
নির্বাচনের আগে রাজনীতি যতটা সরব, মানুষের দৈনন্দিন জীবন ততটাই নীরব। বাজারে জিনিসের দাম কমছে না। চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ রয়েই যাচ্ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা-এই প্রশ্নগুলোর উত্তর রাজনীতির ভাষায় পাওয়া যায় না।
রাজনীতি এখানে অনেক সময় একধরনের আলাদা জগৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বক্তৃতা আছে, স্লোগান আছে, কিন্তু মানুষের রান্নাঘরের কথা খুব কমই ঢোকে। এই দূরত্ব থেকেই জন্ম নেয় ক্লান্তি। এই ক্লান্তিই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ ক্লান্ত মানুষ সহজে চরম ভাষার শিকার হয়, সহজে আশ্বাসে বিশ্বাস করে।
মানুষ রাজনীতি এড়িয়ে চলে, কারণ রাজনীতি তার কাছে নিজের কথা বলে মনে হয় না। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলেন, মানুষ রাজনীতি বোঝে না। কিন্তু মানুষ খুব ভালোভাবেই বোঝে, কারা তার কথা বলছে না। নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়। এটা মানুষের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নতুন করে গড়ার সুযোগ। সেই সুযোগটা যদি আবার হারিয়ে যায়, তাহলে ক্লান্তিটা আরও গভীর হবে।
এই প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার খবর শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গভীর প্রতীক। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংঘাত, অবিশ্বাস, প্রতিহিংসার রাজনীতির মধ্যে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আজ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাঁর অসুস্থতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের শরীর, মানুষের সীমাবদ্ধতার বাইরে নয়।
অন্যদিকে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের আলোচনা রাজনীতিকে আবার উত্তপ্ত করছে। কেউ এটাকে নতুন আশার শুরু ভাবছে, কেউ ভাবছে পুরোনো সংঘাতের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রশ্নটা খুব সোজা, এতে আমার জীবনে কী বদলাবে? এই প্রশ্নের উত্তর না থাকলে, নির্বাচন মানুষের উৎসব হয় না, বোঝা হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক ক্লান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি ভয়, নিরাপত্তাহীনতা। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। প্রকাশ্য হামলা, সহিংসতা, দখলদারি-এসব এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আক্রমণ নয়, এটা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ওপর প্রশ্ন। মানুষ যখন দেখে, দিনের আলোয়, প্রকাশ্যে হামলা হয়, আর তার পরিণতি অস্পষ্ট, তখন সে রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র শুধু আইন বানানোর জায়গা নয়, রাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি দুর্বল হলে, মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে চায়। তখন সমাজে গড়ে ওঠে প্রতিশোধের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার ভয়ংকর চক্র। আইনশৃঙ্খলা শুধু পুলিশ বা প্রশাসনের বিষয় নয়, এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। যে রাষ্ট্র তার নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে রাষ্ট্র তার নৈতিক কর্তৃত্ব হারাতে শুরু করে। এই অনিশ্চয়তা রাজনীতির ওপর মানুষের অনাস্থা আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩. আন্তর্জাতিক অস্থিরতা এবং ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তা
বিশ্বটা এই মুহূর্তে অস্থির। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয়নি, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত থামেনি। বড় শক্তিগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে। এসব খবর আমরা দেখি টেলিভিশনে, পড়ি কাগজে। মনে হয় এগুলো তো অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু বাস্তবে এই দূরত্ব খুব আপেক্ষিক।
ডলারের দর বাড়ে, আমাদের আমদানি ব্যয় বাড়ে। জ্বালানির বাজার অস্থির হয়, বিদ্যুতের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে। বিশ্ব রাজনীতি কঠিন হলে, ছোট দেশের সিদ্ধান্ত আরও সংকুচিত হয়। এই বৈশ্বিক অস্থিরতার ভিতরেই ব্যক্তি নিজের জীবনটা সামলানোর চেষ্টা করে। চাকরি থাকবে তো? ব্যবসা টিকবে তো? সন্তানদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?
রাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলে, তখন মানুষ ভাবে, এই চাপের বোঝা কী শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়েই পড়বে? এই জায়গাটাতেই রাষ্ট্র আর ব্যক্তির সম্পর্কটা সবচেয়ে স্পর্শকাতর।
কারণ বৈশ্বিক সিদ্ধান্তের দায় ব্যক্তি বহন করে, কিন্তু সিদ্ধান্তে তার অংশগ্রহণ সীমিত। আন্তর্জাতিক অস্থিরতা তাই শুধু কূটনীতির বিষয় নয়। এটা ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তার গল্পও।
৪. স্মৃতি, মৃত্যু, সময় এবং রাষ্ট্র
রাজনীতি, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, সবকিছুর মাঝেই জীবন থেমে যায় হঠাৎ। মৃত্যু আসে। স্মৃতি ফিরে আসে। বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা আমাদের শুধু একজন নেত্রীর কথা মনে করিয়ে দেয় না, আমাদের মনে করিয়ে দেয় সময়ের সীমা। রাষ্ট্র অনেক সময় নিজেকে অমর ভাবে। ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠান, আইন, সবকিছু যেন চিরস্থায়ী। কিন্তু মানুষ চিরস্থায়ী নয়। রাজনীতিও নয়। একজন মানুষ অসুস্থ হলে, মৃত্যু হলে-রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্রটা বেরিয়ে আসে। সে সহানুভূতিশীল কি না, ন্যায়বিচারী কি না, মানবিক কি না।
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আন্তর্জাতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা শুধু বৈশ্বিক নয়, ব্যক্তিগতও। মানুষ জানে না, আগামী বছর তার জীবন কোথায় যাবে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, মানুষকে অন্তত এই আশ্বাস দেওয়া যে সে একা নয়। তার জীবনের মূল্য আছে। চতুর্মাত্রার এই প্রথম লেখাটা তাই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নয়। এটা প্রশ্ন রেখে যাওয়ার জন্য। কারণ প্রশ্ন না থাকলে রাষ্ট্রও একদিন নিঃশব্দ হয়ে যায়।
কয়েক দিন আগে একজন পরিচিত মানুষ মারা গেল। খুব বড় কোনো নাম নয়। কিন্তু তার মৃত্যু আমাকে থামিয়ে দিল। রাষ্ট্র চলে নিয়মে। নীতি চলে সময়সূচি মেনে। কিন্তু মৃত্যু আসে হঠাৎ। এই হঠাৎ থেমে যাওয়াটাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের সব হিসাবের বাইরে একজন মানুষের জীবন কতটা নাজুক।
আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি, প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করি। কিন্তু ব্যক্তির স্মৃতি, ক্ষতি, শোক, এসব প্রায়ই রাষ্ট্রের ভাষায় জায়গা পায় না। যখন কোনো মৃত্যু রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, তখন আমরা কথা বলি। কিন্তু নীরব মৃত্যুগুলো, সেগুলো শুধু পরিবারের ভিতরেই রয়ে যায়। একটা রাষ্ট্র আসলে কী দিয়ে মাপা হয়? শুধু অবকাঠামো দিয়ে? শুধু সংখ্যায়? নাকি সে তার মানুষের সময়কে, স্মৃতিকে, জীবনের অনিশ্চয়তাকে কতটা মর্যাদা দেয়, সেটা দিয়েও?
চতুর্মাত্রার এই শেষ অংশটা ইচ্ছা করেই ব্যক্তিগত। কারণ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রও মানুষের গল্প দিয়েই গঠিত। যদি সেই গল্পগুলো হারিয়ে যায়, তাহলে বড় বড় সিদ্ধান্তের ভিতরেও একটা শূন্যতা থেকে যায়।
শেষ কথা
এই কলাম নিয়মিত হবে। প্রতিবার চারটি আলাদা দিক থেকে দেখবে সময়কে।
কারণ সময় নিজেই একমাত্রিক নয়। আমরা কথা বলব, কারণ নীরবতা এখন আর নিরপেক্ষ নয়।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ
সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন








