সংগৃহীত ছবি
মোস্তফা কামাল : নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য করতে ইসিকে যাবতীয় সহযোগিতার অঙ্গীকার ও প্রস্তুতির কথা জানিয়ে রেখেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এ-ও বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো পথ অনুযায়ী দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের কল্যাণে, কাজ করে যাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বিভিন্ন মহল থেকে যখন আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জিং বলা হচ্ছে, তখন সেনাপ্রধানের পরিষ্কার কথা- সেনাবাহিনী যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। এরকম সময়ে জেনেবুঝেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
সেই সঙ্গে প্রশংসা করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা, অগ্রগতি, জাতি গঠন এবং সংকটকালে জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের। বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মহামারির মতো সংকটে সশস্ত্র বাহিনীর অব্যাহত প্রচেষ্টা দেশের জনগণের কল্যাণে তাঁদের প্রস্তুতি ও অটল নিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বৈশ্বিক শান্তিতে বাহিনীটির অবদানের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। ন্যাশনাল ডিফেন্স গ্র্যাজুয়েশন কোর্স অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার এসব কথা ও আহ্বানের মধ্য দিয়ে বার্তা পরিষ্কার। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহও স্পষ্ট। এ ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা কত জরুরি, তা-ও বোধগম্য।
চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত প্রত্যাশিত। তা চ্যালেঞ্জিংও। সংগত কারণেই এ নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ-সংশয়। নির্বাচন হবে তো? হলেও সুষ্ঠু হবে তো? অন্তর্বর্তী সরকার পারবে তো- এ ধরনের বহু প্রশ্ন। আকাক্সক্ষা বেশি থাকলে প্রশ্ন-সংশয় বেশি থাকাও স্বাভাবিক। টানা ৯ বছর স্বৈরশাসন অবসানের পর একানব্বইয়ের নির্বাচনেও এ ধরনের একটি আকাক্সক্ষার সঙ্গে প্রশ্নও দেখা দিয়েছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার জনমানুষের সেই প্রত্যাশা মেটাতে পেরেছিল।
সেনা সহায়তায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিতের মাধ্যমে। সেবারের সঙ্গে এবারের বেশ তফাত। একানব্বই-এ তিন জোটের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে ঐক্য ছিল, তা এবার অনুপস্থিত। সে সময় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাত যেমন ছিল না, তেমনি নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলে নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাও বিরল ছিল। অন্যদিকে বর্তমানে প্রশাসন, পুলিশসহ সরকারি সব দপ্তরকে দলীয়করণের যে অভিযোগ উঠছে সেবার তা ছিল না। এবার সেখানে মারাত্মক বিপত্তি। দৃশ্যমান আরও নানা কারণে এবারের নির্বাচন একানব্বইয়ের নির্বাচনের মতো সরল সমীকরণের বদলে নানা জটিল হিসাবনিকাশে ভরা। সংগত কারণেই এবার তাই বিশেষ ভরসাস্থলে সশস্ত্র বাহিনী।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ব্যবস্থাকে মাটি দিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দলীয় সন্ত্রাসীদের চেয়েও আমলাদের দিয়ে নির্বাচনি অঘটন বেশি ঘটিয়েছে। দিনের ভোট রাতে, বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে এমপি বানিয়ে ফেলা, ডামি-আমি, ভোটার সংখ্যার চেয়ে অধিক ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনি যত তামাশার বড় মাধ্যম তারাই ছিলেন। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রশাসন কিংবা পুলিশের মধ্যে যারা অতীতে নির্বাচনে কারচুপি ও অসদুপায় অবলম্বন করে নির্দিষ্ট প্রার্থী বা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের কাউকেই বিগত এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। ফলে অসৎ সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে এবারের জাতীয় নির্বাচন যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। এ কারণেই কাক্সিক্ষত নির্বাচনের পথে কেটেও কাটছে না সংশয়।
নানান যদি, তবে, কিন্তুর ফেরে পাকছে খটকা। এ অবস্থার মাঝে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে দশ কথার এক কথা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসের। তাই পুনর্ব্যক্ত করলেন ডিফেন্স কলেজের অনুষ্ঠানে। ঘুরিয়েপেঁচিয়ে নয়; একেবারে স্পষ্ট করে, সোজাসিধা ভাষায় সুষ্ঠু নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক সহায়তা চাইলেন তিনি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, এ আশাবাদের কথা পরিষ্কার করে জানানো স্বচ্ছতার পাশাপাশি একধরনের উদারতাও। প্রধান উপদেষ্টার ঐকান্তিক আশা- সামনের নির্বাচনটির মাধ্যমে নতুন পথে যাত্রা করবে বাংলাদেশ। তা বাস্তবতার সঙ্গে মেলবন্ধনও।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, চলমান দেশ পুনর্গঠন ও সংস্কার কার্যক্রমেও সশস্ত্র বাহিনী আগের মতোই মানুষের পাশে থেকে আস্থার প্রতিদান দিচ্ছে। ফ্যাসিস্ট আমলে সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বজায় রাখা ও উন্নয়নকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সব বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচন পর্যন্ত নয়, নির্বাচনের পরও সশস্ত্র বাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকছে। তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে আরও আগেই। জন-আকাক্সক্ষার তাগিদ, বাস্তবতা ও সক্ষমতা বুঝেই সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব সমপদমর্যাদার কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (কোস্টগার্ড ও বিজিবিতে প্রেষণে নিয়োজিত সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ২০২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তাবোধ করেই এমন সিদ্ধান্ত।
সোয়া এক বছর আগে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত প্রতিরোধ-ঐক্য। জনতার কাতারে এসে তারা ত্বরান্বিত করেছিল জনগণের চূড়ান্ত বিজয়। একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক দেশ গড়তে কাঁধে কাঁধ বুকে বুক মিলিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী-ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় ঐক্য। সশস্ত্র বাহিনী ও ছাত্র-জনতার মধ্যকার মৈত্রীর এই দৃঢ় বন্ধনই সার্থক উপসংহারে পৌঁছে দিয়েছিল চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানকে। আন্দোলনকারীদের বুকে গুলি না চালানোর জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক সামরিক বাহিনীর ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্তই ঘুরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা আরও বেড়েছে। তা নির্বাচন প্রশ্নেও। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। দীর্ঘদিন আইনের প্যাঁচে সশস্ত্র বাহিনীকে ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। এবার নির্বাচন কমিশন নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা’র সংজ্ঞায় ‘সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীকে যুক্ত করেছে। এটি দেশের সাধারণ মানুষেরও চাওয়া। তাদের বিশ্বাস সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষেই একটি রক্তপাতমুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। প্রধান উপদেষ্টাও নির্বাচনকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর করতে সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষ ভূমিকা কামনা করেছেন।
গত দেড় যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ভয়, দখলদারত্ব, সন্ত্রাস এবং ব্যাপক অনিয়মের স্মৃতি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচনি পরিবেশ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, মানুষ নির্বাচনকে আর উৎসব মনে করত না; বরং অনেকেই নির্বাচনের দিন ঘর থেকে বের হতে ভয় পেত। কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি, বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা- এসব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল। চব্বিশ সেখানে ছেদ ফেলেছে।
অনিয়ম আর ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের পর, মানুষ একধরনের মুক্তি অনুভব করেছে। সেই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবর্তন এসেছে, আর সেই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের মনে ফিরে এসেছে সেই পুরোনো নির্বাচনি উৎসবের স্মৃতি, সেই প্রত্যাশা। মানুষ আবার আশা করতে চাইছে, নির্বাচন যেন তাদের ভোটে, তাদের অংশগ্রহণে হয়। কিন্তু বছরের পর বছর নির্বাচনকে ঘিরে যে অনিয়ম-সহিংসতা চলেছে, তা রাতারাতি দূর হয়ে যাবে?
প্রতিপক্ষ দমনে সন্ত্রাসীদের ব্যবহারসহ নানা পুরোনো কান্ডকীর্তি তো সামনে ঘটছে। তাই সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রশ্নে সশস্ত্র বাহিনীর আবশ্যকতার কথা উচ্চারণ হচ্ছে ঘুরেফিরে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বরাবরই সংকটময় মুহূর্তে ভরসার জায়গা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে জাতীয় জরুরি মুহূর্ত- এমন সব ক্ষেত্রে মানুষ তাদের অপেক্ষাই করে। নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও। তাদের বিশ্বাস- সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে কেন্দ্র দখল বা জোরজবরদস্তি থাকবে না।
সেনাবাহিনীর দ্রুত প্রতিক্রিয়া, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত উপযোগী। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরাপদ নির্বাচন আয়োজনে তাই সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা অত্যাবশ্যক। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও সহিংসতা প্রতিরোধ সম্ভব। নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর কাছে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা চাওয়ার ফের এখানেই।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। সূএ : বংলাদেশ প্রতিদিন







