সংগৃহীত ছবি
মোস্তফা কামাল :শুধু নির্বাচন পর্যন্ত নয়, নির্বাচনের পরও সশস্ত্র বাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকছে- এই মেসেজ পরিষ্কার। তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। জন-আকাঙ্ক্ষার তাগিদ, বাস্তবতা ও সক্ষমতা বুঝেই সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব সমপদমর্যাদার কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (কোস্ট গার্ড ও বিজিবিতে প্রেষণে নিয়োজিত সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ২০২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, উত্বমুখর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেই এমন সিদ্ধান্ত।
দেশে উদ্ভূত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর পর থেকে এই মেয়াদ দুই মাস করে বাড়িয়ে আসছিল সরকার। এবার বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা একসঙ্গে বাড়ানো হলো সাড়ে তিন মাসের মতো। এতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই সম্ভব হবে না, তা বুঝতে পেরে মহলবিশেষের ঘুম হারাম। তাই তাদের মিশন এখন জাতির এই সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত, উত্তেজিত করে একটা গোলমেলে অবস্থা তৈরি করা।
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষা করার মাঝেই এখন আর সেনাবাহিনীর আবশ্যকতা নির্ধারিত নয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখছে, রাখতে হচ্ছে। তা কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনেও। সেই ধারাবাহিকতায় সেনা সদর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনীও আশা করছে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরো ভালো হবে। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক হবে, সেনাবাহিনী সেনানিবাসে ফিরে যাবে। কথা একদম পরিষ্কার। নির্বাচনী সহায়তায় তাদের প্রস্তুতিও ব্যাপক। কিছু মহলের উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার, গুজব, বিভ্রান্তিতে যে সেনাবাহিনী বিচলিত নয়, সেই বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই তাঁর বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ও দৃঢ়তা অটুট রাখার তালিম দিচ্ছেন। গেল সপ্তাহে খুলনার জাহানাবাদ সেনানিবাসে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) অধিনায়ক সম্মেলনে আহবান জানিয়েছেন, একবিংশ শতাব্দীর জটিল ও পরিবর্তনশীল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বদা প্রস্তুত থাকার। আর্মি সার্ভিস কোরের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, গবেষণা, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও করেছেন। ছুটির দিন শুক্রবার গেছেন জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজের সাবেক ক্যাডেটদের তিন দিনের পুনর্মিলনীতে। বলেছেন, দেশের ৫০ শতাংশই নারী, তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়নের চিন্তা করলে তা ভুল হবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা নারী নেতৃত্ব চাচ্ছি, নারী ক্ষমতায়নও চাচ্ছি।’
সেনাপ্রধান ও তাঁর বাহিনীর এ দৃঢ়তায় গুজববাজদের সুবিধা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষও গ্রাহ্য করছে না মহলবিশেষ ও সোশ্যাল মিডিয়ার হাওয়াই খবর। সরকারও গুজব দিয়ে গুজব মোকাবেলার পথে না গিয়ে সত্য দিয়ে পরিস্থিতি উত্রাতে চায়। আর সেনাবাহিনী থেকে বলা হয়েছে, মিথ্যাকে বিতাড়িত করতে সত্যই যথেষ্ট। সত্যের মাধ্যমে এবং কাজের মাধ্যমে সেটার প্রমাণ করতে চায় সেনাবাহিনী। তাদের এ দৃঢ়তা মানুষকে আশাবাদী করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এরই মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকে নির্বাচনকেন্দ্রিক নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য সাধুবাদও জানিয়েছেন তিনি। স্মরণ করেছেন গত ১৫-১৬ মাসে সেনাসহ সব বাহিনীর সদস্যদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পরিশ্রমের কথা। গোটা দেশ এখন নির্বাচনমুখী। রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটারসহ দেশে-প্রবাসে সবাই নির্বাচনমুখী। সেনাবাহিনী জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থানের পর থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। সেই তাগিদ এবং চেষ্টায় তারা আরো বলীয়ান। কিন্তু খেয়াল করার বিষয়, সেখানে দুষ্ট চোখের চাহনি আঁচ করা যাচ্ছে। নির্বাচন বিঘ্নিত করতে সশস্ত্র বাহিনীকে চটাতে, মন ভাঙতে সর্বোপরি মনোবল দুর্বল করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। চক্রটি চায় দেশে-বিদেশে সেনাবাহিনীর ইমেজ-সুনাম ও বিশ্ব মর্যাদায় আঁচড় বসানো। সেনাবাহিনী যত চেষ্টা-সাধনায় এ ইমেজকে আরো শাণিত করছে, কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি চেষ্টা হচ্ছে ইমেজে ঘা লাগানোর। নির্বাচনী ট্রেন ট্র্যাকে উঠে পড়ায় মহলটি একটু মনোকষ্টে ভুগছে। পর পর তিনটি তামাশাপূর্ণ নির্বাচনের পর জনগণ মূলত মুখিয়ে আছে সেনাবাহিনীর দিকে। সেখানে একটি আস্থা-ভরসা তাদের।
বাংলাদেশের মতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ জাতীয় নানা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর ওপর ভরসা করার দৃষ্টান্ত বিশ্বে কম দেশেই আছে। আবার সেনাবাহিনী নিয়ে অবান্তর কথা, আজেবাজে ন্যারেটিভ তৈরির প্রবণতাও বিশ্বে বিরল। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর এই রোগটি সেরে যেতে পারত। কিন্তু মাঝেমধ্যেই রোগ চাগাড় দেওয়ার লক্ষণ ভর করছে। ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি মহল তো লেগেই আছে এই দুষ্টু কাজে। চব্বিশের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার অনন্য দৃষ্টান্তের প্রশংসা এ চক্রের চরম অসহ্য। নির্বাচন সামনে রেখে যেকোনো ছুঁতায় এর একটা প্রতিশোধ তাদের প্রত্যাশিত। নির্বাচনের মুখ্য দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও তা কেবল তাদের একার নয়। এখানে প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ অংশীজন অনেক। ইসি অনেকটা রেফারির মতো। আর আম্পায়ারিংয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে মানুষ আগে চেনে পুলিশকে। তারপর সেনা, র্যাব, বিজিবি, আনসার। বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশ এখনো ট্রমার মধ্যে রয়েছে। গেল সরকার নানা ক্রিয়াকর্মে পুলিশকে জনতার প্রতিপক্ষ করে দিয়ে গেছে। টানা গত তিনটি নির্বাচনে পুলিশকে দলীয় বাহিনীর মতো কাজ করানো হয়েছে। এতে পুলিশের ইমেজ-গ্রহণযোগ্যতা ঠেকেছে তলানিতে।
ঘৃণার ওই জায়গা থেকে পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর বিপরীতে সেনাবাহিনী চলে এসেছে আরো ভরসা ও আস্থার জায়গায়। গেল সরকার নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকেই তাদের খারিজ করে দিয়েছিল। এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভোট দেওয়া ভুলে যাওয়া মানুষের বিশ্বাস, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুফল আসবে। এই বিশ্বাস থেকেই ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বাদ দেয়। এবার সেখানে আশাবাদের খবর। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে- এ আশা ও নিশ্চয়তা গণতন্ত্রকামী যে কারোর জন্যই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। সশস্ত্র বাহিনীরও সেই আশা ও অপেক্ষা।
নির্বাচন, ভোট, ভোটারের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সরকারেরও গভীর মনোযোগ এদিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রয়োজন ও আবশ্যকতা দৃষ্টেই আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে সরকারের এমন প্রস্তুতি। সেই সঙ্গে জন-আকাঙ্ক্ষার বিষয়ও রয়েছে। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অভিপ্রায় সেই আশাবাদে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর ’৭৩ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনগুলোর নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, দখলবাজির পর ’৯১ সালে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা নিয়েও এমন ভাবনা ও সংশয় ছিল। উৎকণ্ঠা ছিল তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফেরও। তবে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নজির তৈরি হয় ’৯১ সালে। ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা উহ্যই থেকেছে। কিছুদিন আগে, ওই সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন খান কিঞ্চিত মুখ খুলেছেন ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা নিয়ে। বলেছেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একদিন তাঁকে বলেছিলেন, তাঁকে একটি চমৎকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা সেনাশাসন দিয়ে নয়, সেনাবাহিনীর অধীনে বা তত্ত্বাবধানে নয়, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও নয়। নূরউদ্দিন খান যা বোঝার বুঝে নেন। পুলিশ থেকে শুরু করে আনসার পর্যন্ত সবার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে মিলিয়ে দিয়ে তিনি এমন একটা ম্যাজিক্যাল ব্যবস্থা করেন, যা ওই নির্বাচনটিকে ঐতিহাসিক মানদণ্ডে নিয়ে যায়।
এরপর ’৯৬, ২০০১ এমনকি ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেই ধারার কিছু ছোঁয়া ছিল। ২০১৪ থেকে বরবাদ হতে হতে ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে এসে নির্বাচন তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়। এর পরিণতিতে দেশে অনিবার্য নতুন প্রেক্ষাপট। দেশের নির্বাচন ছারখার করা ফ্যাসিস্টকুলের পতন, পলায়ন। এখন অন্তর্বর্তী সরকার একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন আয়োজনের সন্ধিক্ষণে। কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেবে অন্তর্বর্তী সরকার- এই অপেক্ষায় নির্বাচনমুখী দল ও ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী মানুষ। তাদের এ আগ্রহ ও প্রত্যাশা পূরণে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার কোনো বিকল্প নেই। আসন্ন নির্বাচনের সময়ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়েই তাদের মাঠে থাকার বার্তাটি জনমানুষের মাঝে আশার পারদ জাগিয়ে তুলেছে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন







