’৭৫-এর হাতিয়ার কি কেবলই স্লোগান?

সৈয়দ বোরহান কবীর:আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির বিকাশ। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর থেকেই রাজপথের আন্দোলন ছিল রাজনীতির প্রধান ধারা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এ রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেই বাঙালির জাগরণ ঘটে। ’৭০-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের গণরায়। এ আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত ছিল। ছিল সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ। এ আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতি ও চিন্তার মানকেও বিকশিত করেছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক কালজয়ী সেøাগান তৈরি হয়েছে। এসব স্লোগানের ঐতিহাসিক মূল্য অমূল্য। ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘রক্তসূর্য উঠেছে/বীর বাঙালি জেগেছে’। স্লোগানগুলোর রাজনৈতিক মর্মার্থ গভীর। সাহিত্যমূল্য অনেক উচ্চ। এসব স্লোগান বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক গন্তব্য ও আকাক্সক্ষার প্রকাশ। স্বাধীনতার পর জাসদের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির চরিত্রের সঙ্গে সেøাগানও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’, ‘অমুকের দুই গালে জুতা মার তালে তালে’ কিংবা ‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও দালালদের আস্তানা’ ইত্যাদি নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক স্লোগান রাজনীতির মাঠ দখল করে। এর বিপরীতে ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ/এসো দেশ গড়ি’ জাতীয় স্লোগান পানসে হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে মিছিল শুরু হতো ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। জাসদ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ দিয়ে মিছিল শুরু করা চালু করে। এ ধারায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালির জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। ইতিহাসে নির্মমতম বর্বরতার শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্লোগানের বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। একদিকে অমর সৃজনশীল স্লোগান উচ্চারিত হয়, অন্যদিকে তীব্র সাম্প্রদায়িক ও উসকানিমূলক স্লোগান রাজনীতির মাঠে জায়গা করে নেয়। ‘এক মুজিব লোকান্তরে /লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ কিংবা ‘মুজিব হত্যার পরিণাম/বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। এর মতো সেøাগানগুলো রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর বিপরীতে ‘রুশ-ভারতের দালালরা/হুঁশিয়ার সাবধান’। কিংবা ‘সিকিম নয় ভুটান নয়/এই আমাদের বাংলাদেশ’-এর মতো স্লোগানগুলো উচ্চারিত হতে থাকে। ’৭৫-এর পর সেøাগান থেকে নিষিদ্ধ হয় ‘জয় বাংলা’, আমদানি করা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এভাবেই রাজনীতিতে দুই মেরুর মতো দুটি বিপরীতমুখী ধারা সমান্তরাল চলছে। একটি ধারার রাজনীতি বাংলাদেশকে হৃদয়ে লালন করে। অন্য ধারার রাজনীতি হলো বাংলাদেশকে অস্বীকার করে, উগ্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে। আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফেরত নেওয়া।

এ দুই ধারার রাজনৈতিক স্লোগানও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রতিফলিত করে। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/মুজিব আছে দেশ জুড়িয়া’ এমন কাব্যিক স্লোগানের বিপরীতে ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান’-এর মতো ভয়ংকর স্লোগানও রাজনীতির মাঠে শোনা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্লোগান শুনে আঁতকে উঠেছি। বিস্মিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’। আমার বিবেচনায় এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, কুৎসিত বীভৎস রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রকাশ। এ স্লোগানটি যারা দিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় এ রকম চিন্তা আছে নিশ্চয়ই। এ স্লোগানের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে। আজ (শনিবার) বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করবে ক্ষমতাসীন দলটি। সামনে আরও কিছু কর্মসূচি পালন করবে। এর বিপরীতে বিএনপিও হয়তো পাল্টা কর্মসূচি দেবে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হবে। রাজনীতিকে সহিংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা আরও জোরালো হবে। কিন্তু আমি হতবাক, বিস্মিত। এ রকম একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক স্লোগানের পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই! তাঁরা তাঁদের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের তিরস্কার করেননি। এ ধরনের স্লোগান যে কোনো রাজনৈতিক কর্মীর ভাষা হতে পারে না, তা বলেননি। ছাত্রদলও এ রকম আপত্তিকর সেøাগান প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। বরং বিএনপি নেতাদের অন্দরমহলে এ স্লোগান নিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ ও আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর এনেছে। কোনো কোনো নেতা এ দুর্বৃত্তদের বাহবাও দিয়েছেন বলে শুনেছি। এর অর্থ হলো ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সেøাগান দিয়েছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিএনপির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের একটি প্রকাশ। একটি পরিবারে বাবা-মা যে ভাষায় কথা বলেন, তার প্রতিফলন ঘটে সন্তানদের মধ্যে। ঠিক তেমনি একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সিনিয়র নেতারা যে চিন্তা-চেতনা ধারণ করেন, ছাত্র এবং যুব সংগঠনগুলো মাঠে তারই বাস্তবায়ন করে।

 

‘৭৫-এর হাতিয়ার’ তাই কোনো বিচ্ছিন্ন, অতি উৎসাহীর আচমকা সেøাগান নয়। এটি বিএনপির একটি রাজনৈতিক দর্শন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এটি নজিরবিহীন, বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অন্যতম একটি জঘন্যতম ঘটনা। বিশ্বের সুস্থ চিন্তার কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি এ ঘটনা সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইতিহাসের এ নিকৃষ্টতম ঘটনাকে সমর্থন করাই হলো বিএনপির অন্যতম নীতি। জাতির পিতা হত্যাকান্ডের পর খুনি মোশতাক এ হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। জিয়া সে অধ্যাদেশ কেবল বহালই রাখেননি; খুনিদের বিদেশে কূটনৈতিক চাকরি দিয়েছেন। এসব খুনিকে জিয়া ‘সূর্যসন্তানে’র খেতাব দিয়েছিলেন। ’৯১ সালে বিএনপি বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসে। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের অনুরোধ করা হয়েছিল। বেগম জিয়া সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বেগম জিয়ার সরকার খুনিদের চাকরিচ্যুত করেনি। পদোন্নতি দিয়েছে। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এর পরই জাতির পিতা হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। প্রচলিত আইনে বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নিম্ন আদালতে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ের দিন বিএনপি দেশব্যাপী হরতাল পালন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হন আইনমন্ত্রী। বিচারপতির শূন্যতা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় বেগম জিয়ার সরকার। শুধু তাই নয়, আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে যারা কূটনৈতিক চাকরি করত, তাদের চাকরি চলে গিয়েছিল হত্যা মামলার জন্য। কিন্তু বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে তাদের আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এ ঘটনাগুলোর উল্লেখ করলাম এজন্য যে, ’৭৫-এর ঘৃণ্য হত্যাকান্ডকে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক প্রবণতা বিএনপির মধ্যে প্রোথিত। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। তবে শুধু জিয়া নন, গোটা বিএনপিই ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। এজন্যই বিএনপি খুনিদের দুধভাতে রেখেছিল। বিচার হতে দেয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেনি। রায়ের দিন হরতাল ডেকেছে। ক’বছর আগেও শোকাবহ এই দিন বেগম জিয়া কেক কেটে পৈশাচিক উৎসব করেছেন। 

বিএনপি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টকে শুধু সমর্থন করে না, আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতেও চায়। অতীতেও বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন কথাবার্তায় আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর হীন অভিপ্রায় উচ্চারিত হয়েছিল। বিএনপি অবশ্য শুধু কথায় নয়, কাজেও ’৭৫ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট। ওই দিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সেদিন সৃষ্টিকর্তার কৃপায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার ছাত্রদলের করিৎকর্মা নওজোয়ানরা অবশ্য ১৫ আগস্ট ঘটানোর সেøাগান তোলেনি। তারা বলেছে ’৭৫-এর হাতিয়ারের কথা। ১৫ আগস্ট এবং ’৭৫-এর হাতিয়ার- কথা দুটির পার্থক্য অনেক। ১৫ আগস্ট ছিল একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। আর ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো ১৫ আগস্ট ঘটানোর উপকরণ। ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো সেসব উপকরণ বা অস্ত্র-কৌশল যা দিয়ে বাঙালি জাতিকে অভিভাবকহীন করা হয়েছিল। কী ছিল এ উপকরণে? আমার বিবেচনায় ’৭৫-এর হাতিয়ার ছিল মোটা দাগে পাঁচটি। প্রথম উপকরণ ছিল পাকিস্তানে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি এজেন্ট বা চরদের নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। এরা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর এক অবাস্তব নীলনকশার এরা ছিল বাস্তবায়নকারী। এরা হত্যাকান্ড ঘটায়। ’৭৫-এর দ্বিতীয় হাতিয়ার ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। জাতির পিতা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবতার নেতা। বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আলোড়িত হয়েছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেয়েছিল। এজন্য তারা পাকিস্তানপন্থিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডে আন্তর্জাতিক মদদ ছিল। এ হত্যাকান্ডে তারাই সমর্থন দিয়েছিল যারা এখন মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। ’৭৫-এর তৃতীয় হাতিয়ার ছিল পাকিস্তানপন্থি প্রশাসন। গুটিকয় মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সব ছিল পাকিস্তানিদের পদলেহী আমলা। এরাই বঙ্গবন্ধু সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য প্রশাসনের ভিতর থেকে কাজ করেছিল। চতুর্থ হাতিয়ার ছিল দলের বিশ্বাসঘাতকরা। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ আগস্ট ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছিল। এরা দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এরা চাটুকারিতা আর তোষামোদ করে জাতির পিতাকে ঘিরে রেখেছিল। আর শেষ হাতিয়ার বা উপকরণ ছিল কাপুরুষ নেতৃত্ব এবং বিভ্রান্ত কর্মীরা। এ কাপুরুষ অক্ষম নেতৃত্ব অস্ত্রের ভয়ে সুড়সুড় করে বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কিংবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মতো দু-এক জন বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর প্রতিবাদ ছিল সশস্ত্র। আর সিরাজুল হকের প্রতিবাদ ছিল কণ্ঠ। এ পাঁচ সূত্র একবিন্দুতে মিলিত হয়ে মরণঘাতী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। যে হাতিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করে। ’৭৫-এর হাতিয়ার কেবল একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া কিছু বুলেট নয়। এটি বাঙালির অস্তিত্ব অর্জনকে তছনছ করে দেওয়ার এক মারণাস্ত্র।

 

’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে বাংলাদেশকে ধ্বংসের এক বিস্ফোরক। তাহলে ছাত্রদলের সেøাগানের মাধ্যমে বিএনপি কি বাংলাদেশ ধ্বংসের বার্তা দিল? বিএনপি কি তাহলে বাংলাদেশের সব অর্জন ল-ভ- করে দেওয়ার মারণাস্ত্র বানাচ্ছে? পাঁচ উপকরণকে একবিন্দুতে মেলাতে চাইছে? এটা যে বিএনপি চাইছে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিএনপির ষড়যন্ত্রের কিছু কিছু আলামত এখন দৃশ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় জোর করেই বাংলাদেশের সব বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। পিটার হাস নতুন রাষ্ট্রদূত হয়ে এ দেশে আসার পর যেন দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। আজ গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠান তো কাল ডিক্যাবের সঙ্গে মতবিনিময়। সব জায়গায় তিনি রীতিমতো শাসাচ্ছেন বাংলাদেশকে। এ অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গুলিতে মারা যাচ্ছে নিরীহ নাগরিক। কদিন আগে টেক্সাসে স্কুলে হামলা হলো। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ওকলাহোমায় মেডিকেল সেন্টারে হামলা। কোনো দেশ বলে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকের জীবন হুমকির মুখে। যে দেশে নাগরিকদের জীবন এত অনিশ্চিত তারাই কি না বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আহাজারি করে।

 

প্রশাসনে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রেতাত্মারা। এরা বিভিন্ন কাজকর্মে সরকারকে বিব্রত করছে। এদের কারণে জিনিসপত্রের দাম অযাচিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রশাসনের ভিতরে বসে এরা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রশাসনে ছদ্মবেশী মতলববাজ হঠাৎ আওয়ামী লীগ বনে যাওয়া আমলারা এখন যেন একেকটা গ্রেনেড। আওয়ামী লীগেও এখন সুযোগসন্ধানী এবং হঠাৎ বনে যাওয়া নেতাদের দাপট। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতরা কোণঠাসা সর্বত্র। তৃণমূলে বিভক্তি এবং হতাশা। এর মধ্যে কিছু কিছু উঠতি পাতিনেতা এমন সব কর্মকান্ড করছেন যাতে সরকার এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। মন্ত্রিসভা যেন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, টেকনোক্র্যাটের সমাহার। সব কথা শেখ হাসিনাই বলছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যগুলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কতটা উদ্দীপ্ত করে জানি না। সাধারণ মানুষ তাঁর কথায় চমকিত হয় না। এত পোড় খাওয়া, যুদ্ধ করা নেতাকে কেন কাগজ দেখে দেখে কথা বলতে হবে? আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশ কম করছেন না। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলগুলো মন্ত্রীদের সভা-সমাবেশ-সেমিনারে মুখরিত থাকে। এর মধ্যে ড. হাছান মাহমুদ, শ ম রেজাউল করিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, এনামুল হক শামীম আর খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ছাড়া আর কজন মন্ত্রী রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন? মন্ত্রীরা এখন বড় আমলায় পরিণত হয়েছেন। তাঁরা যেন একটি মূল্যবান চাকরি পেয়েছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে বিতর্কিত হতে চান না।

 

এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে দেশ আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকে বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এ দাবি তুলতেই পারে। এ দাবি নিয়ে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করছে। এতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু যেভাবে এখন দলটি তাদের ছাত্র এবং যুব সংগঠনকে মারমুখী করে তুলেছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ শঙ্কা আরও বাড়ে যখন ’৭৫-এর হাতিয়ার সেøাগান ওঠে। আর এ সেøাগান উপেক্ষা করা যায় না যখন চারপাশে ষড়যন্ত্রের খেলা আলো-আঁধারিতে উন্মোচিত হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে কি তাহলে বিএনপির একটি লাশ প্রয়োজন? একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতির পূর্বাভাস পেয়েই কি কোনো কোনো পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে? এজন্যই কি সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় মাতম উঠেছে? এ কারণেই কি ভরা মৌসুমে চালের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে? সবকিছুই কি ’৭৫-এর জংধরা হাতিয়ার সচল করার সম্মিলিত প্রয়াস? ’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেতাদের ড্রয়িংরুমের গোপন কথা জেনে ফেলা ছাত্রদল অতি উৎসাহী হয়ে সেøাগানের আকারে তা প্রকাশ করেছে। ছাত্রদলের মিছিলে এ স্লোগান আরেকবার প্রমাণ করল, বিএনপি আসলে ’৭৫-এর মতো ঘটনা ঘটিয়ে এ সরকারকে হটাতে চায়। জনগণ, নির্বাচন কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, ষড়যন্ত্রই বিএনপির প্রধান অস্ত্র। এটাই তাদের ’৭৫-এর হাতিয়ার। এখন প্রশ্ন হলো, ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’- এ স্লোগানের মর্মবাণী কি আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে? যদি করে থাকে তাহলে সরকারের ভিতরে-বাইরে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে। আর মর্মবাণী উপলব্ধি না করলে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]      সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো : যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা

» জাতি ক্রান্তি লগ্নে, ভালো নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই: ইসি সানাউল্লাহ

» ৫০ হাজার ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা গ্রেফতার

» ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা

» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা জরুরি : তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

’৭৫-এর হাতিয়ার কি কেবলই স্লোগান?

সৈয়দ বোরহান কবীর:আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির বিকাশ। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর থেকেই রাজপথের আন্দোলন ছিল রাজনীতির প্রধান ধারা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এ রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেই বাঙালির জাগরণ ঘটে। ’৭০-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের গণরায়। এ আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত ছিল। ছিল সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ। এ আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতি ও চিন্তার মানকেও বিকশিত করেছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক কালজয়ী সেøাগান তৈরি হয়েছে। এসব স্লোগানের ঐতিহাসিক মূল্য অমূল্য। ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘রক্তসূর্য উঠেছে/বীর বাঙালি জেগেছে’। স্লোগানগুলোর রাজনৈতিক মর্মার্থ গভীর। সাহিত্যমূল্য অনেক উচ্চ। এসব স্লোগান বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক গন্তব্য ও আকাক্সক্ষার প্রকাশ। স্বাধীনতার পর জাসদের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির চরিত্রের সঙ্গে সেøাগানও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’, ‘অমুকের দুই গালে জুতা মার তালে তালে’ কিংবা ‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও দালালদের আস্তানা’ ইত্যাদি নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক স্লোগান রাজনীতির মাঠ দখল করে। এর বিপরীতে ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ/এসো দেশ গড়ি’ জাতীয় স্লোগান পানসে হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে মিছিল শুরু হতো ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। জাসদ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ দিয়ে মিছিল শুরু করা চালু করে। এ ধারায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালির জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। ইতিহাসে নির্মমতম বর্বরতার শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্লোগানের বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। একদিকে অমর সৃজনশীল স্লোগান উচ্চারিত হয়, অন্যদিকে তীব্র সাম্প্রদায়িক ও উসকানিমূলক স্লোগান রাজনীতির মাঠে জায়গা করে নেয়। ‘এক মুজিব লোকান্তরে /লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ কিংবা ‘মুজিব হত্যার পরিণাম/বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। এর মতো সেøাগানগুলো রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর বিপরীতে ‘রুশ-ভারতের দালালরা/হুঁশিয়ার সাবধান’। কিংবা ‘সিকিম নয় ভুটান নয়/এই আমাদের বাংলাদেশ’-এর মতো স্লোগানগুলো উচ্চারিত হতে থাকে। ’৭৫-এর পর সেøাগান থেকে নিষিদ্ধ হয় ‘জয় বাংলা’, আমদানি করা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এভাবেই রাজনীতিতে দুই মেরুর মতো দুটি বিপরীতমুখী ধারা সমান্তরাল চলছে। একটি ধারার রাজনীতি বাংলাদেশকে হৃদয়ে লালন করে। অন্য ধারার রাজনীতি হলো বাংলাদেশকে অস্বীকার করে, উগ্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে। আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফেরত নেওয়া।

এ দুই ধারার রাজনৈতিক স্লোগানও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রতিফলিত করে। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/মুজিব আছে দেশ জুড়িয়া’ এমন কাব্যিক স্লোগানের বিপরীতে ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান’-এর মতো ভয়ংকর স্লোগানও রাজনীতির মাঠে শোনা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্লোগান শুনে আঁতকে উঠেছি। বিস্মিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’। আমার বিবেচনায় এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, কুৎসিত বীভৎস রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রকাশ। এ স্লোগানটি যারা দিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় এ রকম চিন্তা আছে নিশ্চয়ই। এ স্লোগানের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে। আজ (শনিবার) বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করবে ক্ষমতাসীন দলটি। সামনে আরও কিছু কর্মসূচি পালন করবে। এর বিপরীতে বিএনপিও হয়তো পাল্টা কর্মসূচি দেবে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হবে। রাজনীতিকে সহিংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা আরও জোরালো হবে। কিন্তু আমি হতবাক, বিস্মিত। এ রকম একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক স্লোগানের পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই! তাঁরা তাঁদের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের তিরস্কার করেননি। এ ধরনের স্লোগান যে কোনো রাজনৈতিক কর্মীর ভাষা হতে পারে না, তা বলেননি। ছাত্রদলও এ রকম আপত্তিকর সেøাগান প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। বরং বিএনপি নেতাদের অন্দরমহলে এ স্লোগান নিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ ও আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর এনেছে। কোনো কোনো নেতা এ দুর্বৃত্তদের বাহবাও দিয়েছেন বলে শুনেছি। এর অর্থ হলো ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সেøাগান দিয়েছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিএনপির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের একটি প্রকাশ। একটি পরিবারে বাবা-মা যে ভাষায় কথা বলেন, তার প্রতিফলন ঘটে সন্তানদের মধ্যে। ঠিক তেমনি একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সিনিয়র নেতারা যে চিন্তা-চেতনা ধারণ করেন, ছাত্র এবং যুব সংগঠনগুলো মাঠে তারই বাস্তবায়ন করে।

 

‘৭৫-এর হাতিয়ার’ তাই কোনো বিচ্ছিন্ন, অতি উৎসাহীর আচমকা সেøাগান নয়। এটি বিএনপির একটি রাজনৈতিক দর্শন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এটি নজিরবিহীন, বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অন্যতম একটি জঘন্যতম ঘটনা। বিশ্বের সুস্থ চিন্তার কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি এ ঘটনা সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইতিহাসের এ নিকৃষ্টতম ঘটনাকে সমর্থন করাই হলো বিএনপির অন্যতম নীতি। জাতির পিতা হত্যাকান্ডের পর খুনি মোশতাক এ হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। জিয়া সে অধ্যাদেশ কেবল বহালই রাখেননি; খুনিদের বিদেশে কূটনৈতিক চাকরি দিয়েছেন। এসব খুনিকে জিয়া ‘সূর্যসন্তানে’র খেতাব দিয়েছিলেন। ’৯১ সালে বিএনপি বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসে। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের অনুরোধ করা হয়েছিল। বেগম জিয়া সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বেগম জিয়ার সরকার খুনিদের চাকরিচ্যুত করেনি। পদোন্নতি দিয়েছে। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এর পরই জাতির পিতা হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। প্রচলিত আইনে বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নিম্ন আদালতে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ের দিন বিএনপি দেশব্যাপী হরতাল পালন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হন আইনমন্ত্রী। বিচারপতির শূন্যতা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় বেগম জিয়ার সরকার। শুধু তাই নয়, আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে যারা কূটনৈতিক চাকরি করত, তাদের চাকরি চলে গিয়েছিল হত্যা মামলার জন্য। কিন্তু বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে তাদের আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এ ঘটনাগুলোর উল্লেখ করলাম এজন্য যে, ’৭৫-এর ঘৃণ্য হত্যাকান্ডকে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক প্রবণতা বিএনপির মধ্যে প্রোথিত। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। তবে শুধু জিয়া নন, গোটা বিএনপিই ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। এজন্যই বিএনপি খুনিদের দুধভাতে রেখেছিল। বিচার হতে দেয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেনি। রায়ের দিন হরতাল ডেকেছে। ক’বছর আগেও শোকাবহ এই দিন বেগম জিয়া কেক কেটে পৈশাচিক উৎসব করেছেন। 

বিএনপি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টকে শুধু সমর্থন করে না, আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতেও চায়। অতীতেও বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন কথাবার্তায় আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর হীন অভিপ্রায় উচ্চারিত হয়েছিল। বিএনপি অবশ্য শুধু কথায় নয়, কাজেও ’৭৫ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট। ওই দিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সেদিন সৃষ্টিকর্তার কৃপায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার ছাত্রদলের করিৎকর্মা নওজোয়ানরা অবশ্য ১৫ আগস্ট ঘটানোর সেøাগান তোলেনি। তারা বলেছে ’৭৫-এর হাতিয়ারের কথা। ১৫ আগস্ট এবং ’৭৫-এর হাতিয়ার- কথা দুটির পার্থক্য অনেক। ১৫ আগস্ট ছিল একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। আর ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো ১৫ আগস্ট ঘটানোর উপকরণ। ’৭৫-এর হাতিয়ার হলো সেসব উপকরণ বা অস্ত্র-কৌশল যা দিয়ে বাঙালি জাতিকে অভিভাবকহীন করা হয়েছিল। কী ছিল এ উপকরণে? আমার বিবেচনায় ’৭৫-এর হাতিয়ার ছিল মোটা দাগে পাঁচটি। প্রথম উপকরণ ছিল পাকিস্তানে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি এজেন্ট বা চরদের নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। এরা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর এক অবাস্তব নীলনকশার এরা ছিল বাস্তবায়নকারী। এরা হত্যাকান্ড ঘটায়। ’৭৫-এর দ্বিতীয় হাতিয়ার ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। জাতির পিতা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবতার নেতা। বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আলোড়িত হয়েছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেয়েছিল। এজন্য তারা পাকিস্তানপন্থিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডে আন্তর্জাতিক মদদ ছিল। এ হত্যাকান্ডে তারাই সমর্থন দিয়েছিল যারা এখন মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। ’৭৫-এর তৃতীয় হাতিয়ার ছিল পাকিস্তানপন্থি প্রশাসন। গুটিকয় মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সব ছিল পাকিস্তানিদের পদলেহী আমলা। এরাই বঙ্গবন্ধু সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য প্রশাসনের ভিতর থেকে কাজ করেছিল। চতুর্থ হাতিয়ার ছিল দলের বিশ্বাসঘাতকরা। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ আগস্ট ষড়যন্ত্রের অংশ হয়েছিল। এরা দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এরা চাটুকারিতা আর তোষামোদ করে জাতির পিতাকে ঘিরে রেখেছিল। আর শেষ হাতিয়ার বা উপকরণ ছিল কাপুরুষ নেতৃত্ব এবং বিভ্রান্ত কর্মীরা। এ কাপুরুষ অক্ষম নেতৃত্ব অস্ত্রের ভয়ে সুড়সুড় করে বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কিংবা প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মতো দু-এক জন বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর প্রতিবাদ ছিল সশস্ত্র। আর সিরাজুল হকের প্রতিবাদ ছিল কণ্ঠ। এ পাঁচ সূত্র একবিন্দুতে মিলিত হয়ে মরণঘাতী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। যে হাতিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করে। ’৭৫-এর হাতিয়ার কেবল একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া কিছু বুলেট নয়। এটি বাঙালির অস্তিত্ব অর্জনকে তছনছ করে দেওয়ার এক মারণাস্ত্র।

 

’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে বাংলাদেশকে ধ্বংসের এক বিস্ফোরক। তাহলে ছাত্রদলের সেøাগানের মাধ্যমে বিএনপি কি বাংলাদেশ ধ্বংসের বার্তা দিল? বিএনপি কি তাহলে বাংলাদেশের সব অর্জন ল-ভ- করে দেওয়ার মারণাস্ত্র বানাচ্ছে? পাঁচ উপকরণকে একবিন্দুতে মেলাতে চাইছে? এটা যে বিএনপি চাইছে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিএনপির ষড়যন্ত্রের কিছু কিছু আলামত এখন দৃশ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় জোর করেই বাংলাদেশের সব বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। পিটার হাস নতুন রাষ্ট্রদূত হয়ে এ দেশে আসার পর যেন দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। আজ গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠান তো কাল ডিক্যাবের সঙ্গে মতবিনিময়। সব জায়গায় তিনি রীতিমতো শাসাচ্ছেন বাংলাদেশকে। এ অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গুলিতে মারা যাচ্ছে নিরীহ নাগরিক। কদিন আগে টেক্সাসে স্কুলে হামলা হলো। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ওকলাহোমায় মেডিকেল সেন্টারে হামলা। কোনো দেশ বলে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকের জীবন হুমকির মুখে। যে দেশে নাগরিকদের জীবন এত অনিশ্চিত তারাই কি না বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আহাজারি করে।

 

প্রশাসনে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রেতাত্মারা। এরা বিভিন্ন কাজকর্মে সরকারকে বিব্রত করছে। এদের কারণে জিনিসপত্রের দাম অযাচিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রশাসনের ভিতরে বসে এরা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রশাসনে ছদ্মবেশী মতলববাজ হঠাৎ আওয়ামী লীগ বনে যাওয়া আমলারা এখন যেন একেকটা গ্রেনেড। আওয়ামী লীগেও এখন সুযোগসন্ধানী এবং হঠাৎ বনে যাওয়া নেতাদের দাপট। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতরা কোণঠাসা সর্বত্র। তৃণমূলে বিভক্তি এবং হতাশা। এর মধ্যে কিছু কিছু উঠতি পাতিনেতা এমন সব কর্মকান্ড করছেন যাতে সরকার এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। মন্ত্রিসভা যেন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, টেকনোক্র্যাটের সমাহার। সব কথা শেখ হাসিনাই বলছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যগুলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কতটা উদ্দীপ্ত করে জানি না। সাধারণ মানুষ তাঁর কথায় চমকিত হয় না। এত পোড় খাওয়া, যুদ্ধ করা নেতাকে কেন কাগজ দেখে দেখে কথা বলতে হবে? আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশ কম করছেন না। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলগুলো মন্ত্রীদের সভা-সমাবেশ-সেমিনারে মুখরিত থাকে। এর মধ্যে ড. হাছান মাহমুদ, শ ম রেজাউল করিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, এনামুল হক শামীম আর খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ছাড়া আর কজন মন্ত্রী রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন? মন্ত্রীরা এখন বড় আমলায় পরিণত হয়েছেন। তাঁরা যেন একটি মূল্যবান চাকরি পেয়েছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে বিতর্কিত হতে চান না।

 

এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে দেশ আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকে বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এ দাবি তুলতেই পারে। এ দাবি নিয়ে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করছে। এতেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু যেভাবে এখন দলটি তাদের ছাত্র এবং যুব সংগঠনকে মারমুখী করে তুলেছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ শঙ্কা আরও বাড়ে যখন ’৭৫-এর হাতিয়ার সেøাগান ওঠে। আর এ সেøাগান উপেক্ষা করা যায় না যখন চারপাশে ষড়যন্ত্রের খেলা আলো-আঁধারিতে উন্মোচিত হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে কি তাহলে বিএনপির একটি লাশ প্রয়োজন? একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতির পূর্বাভাস পেয়েই কি কোনো কোনো পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে? এজন্যই কি সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় মাতম উঠেছে? এ কারণেই কি ভরা মৌসুমে চালের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে? সবকিছুই কি ’৭৫-এর জংধরা হাতিয়ার সচল করার সম্মিলিত প্রয়াস? ’৭৫-এর হাতিয়ার আসলে ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেতাদের ড্রয়িংরুমের গোপন কথা জেনে ফেলা ছাত্রদল অতি উৎসাহী হয়ে সেøাগানের আকারে তা প্রকাশ করেছে। ছাত্রদলের মিছিলে এ স্লোগান আরেকবার প্রমাণ করল, বিএনপি আসলে ’৭৫-এর মতো ঘটনা ঘটিয়ে এ সরকারকে হটাতে চায়। জনগণ, নির্বাচন কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, ষড়যন্ত্রই বিএনপির প্রধান অস্ত্র। এটাই তাদের ’৭৫-এর হাতিয়ার। এখন প্রশ্ন হলো, ‘৭৫-এর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’- এ স্লোগানের মর্মবাণী কি আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে? যদি করে থাকে তাহলে সরকারের ভিতরে-বাইরে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে। আর মর্মবাণী উপলব্ধি না করলে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]      সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com