সংগৃহীত ছবি
অনলাইন ডেস্ক : ৫০ বছর পরেও দর্শকদের মনিকোঠায় সমান উজ্জ্বল সিনেমাটি, যার সংলাপ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, যার চরিত্রগুলো আজও জীবন্ত। হ্যাঁ, কালজয়ী সৃষ্টি ‘শোলে’ সিনেমার ঘটনা এমনই। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে আইকনিক চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত রমেশ সিপ্পির এই মহাকাব্যিক সৃষ্টিটি আবারও বড় পর্দায় ফিরছে, তবে এবার এক অনন্য রূপে – সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারকৃত এবং অসম্পাদিত সংস্করণে, যা দর্শকদের সামনে উন্মোচন করবে এক ভিন্ন ‘শোলে’কে।
ইতালির বোলোনিয়া শহরে শুরু হয়েছে ইল চিনেমা রিত্রোভাটো ফেস্টিভ্যাল। এই উৎসবের মাধ্যমেই বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সাক্ষী হতে চলেছেন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। এখানে প্রদর্শিত হবে ‘শোলে’র সেই সংস্করণ, যেখানে ফিরে আসছে মূল সমাপ্তি দৃশ্য – যা ১৯৭৫ সালের মূল মুক্তির সময় সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেই সাথে থাকছে কিছু দুর্লভ, আগে কখনও না দেখা বাদ পড়া দৃশ্যও। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ আউটডোর স্ক্রিন, পিয়াজা মাজিওরে-তে এই প্রদর্শনী ‘শোলে’ প্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নপূরণের মতো।
সালিম-জাভেদ জুটির অনবদ্য চিত্রনাট্য আর অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, জয়া ভাদুড়ী, সঞ্জীব কুমার, এবং বিশেষত আমজাদ খান গব্বর সিং চরিত্রে – এই তারকাবহুল অভিনেতামণ্ডলী ‘শোলে’কে দিয়েছে এক অমরত্ব। এটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘শোলে’র সংলাপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে – বিয়ের অনুষ্ঠানে, রাজনৈতিক বক্তৃতায়, এমনকি বিজ্ঞাপনেও এর প্রভাব দেখা যায়। ধর্মেন্দ্র, যিনি ছবিতে বীরুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সম্প্রতি বলেছেন, “শোলে হচ্ছে বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য।” আর অমিতাভ বচ্চন, জয়-এর চরিত্রে যিনি প্রাণ দিয়েছেন, তার কাছে ছবিটি ছিল এক “অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা”।
২০৪ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি রামগড় নামের এক কাল্পনিক গ্রামের গল্প বলে। গ্রামের প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা ঠাকুর বলদেব সিং তার পরিবারের হত্যার প্রতিশোধ নিতে দুই ছোট অপরাধী, জয় এবং বিরুকে ভাড়া করেন। তাদের লক্ষ্য একটাই – ভারতের সবচেয়ে কুখ্যাত ডাকাত গব্বর সিংকে পরাস্ত করা। এই গল্প কেবল একটি প্রতিশোধের গল্প নয়, এটি ন্যায় ও অন্যায়ের এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। গব্বর সিংয়ের নির্মমতা এবং তার আইকনিক সংলাপ আজও ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে।
জানলে অবাক হবেন, ‘শোলে’র শুরুটা এতটা মসৃণ ছিল না। প্রাথমিক সমালোচনা ছিল কঠোর, বক্স অফিসেও ভালো ফল করছিল না। এমনকি একটি ম্যাগাজিন এটিকে ‘মৃত আগুনের আগুন’ বলেও অভিহিত করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে, মৌখিক প্রচারে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। দর্শকরা এর দৃশ্যের মহত্ব ও শব্দের কারুকার্য বুঝতে পারেন। চলচ্চিত্র লেখিকা অনুপমা চোপড়া যেমন লিখেছেন, তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই দর্শকরা সংলাপগুলো জোরে বলতে শুরু করেছিলেন – এর মানে ছিল তারা বারবার ছবিটি দেখছিলেন।
‘শোলে’ শুধু ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব ছিল গভীর। ২০১৫ সালে এটি পাকিস্তানে মুক্তি পায় এবং ৪০ বছরের পুরনো হওয়া সত্ত্বেও, এটি শাহরুখ খানের ২০০২ সালের হিট ছবি ‘দেবদাস’-কেও বক্স অফিসে পেছনে ফেলে দেয়। এই তথ্যই প্রমাণ করে ‘শোলে’র আবেদন কতটা চিরন্তন। মুম্বাইয়ের মিনার্ভা থিয়েটারে এটি টানা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়েছিল – এমন সাফল্য ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে বিরল। চলচ্চিত্র পরিবেশক শ্যাম শ্রফ অনুপমা চোপড়াকে বলেছিলেন, যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্পর্কে বলা হতো, ঠিক সেভাবেই শোলে নিয়েও বলা যায় – এর সূর্য কখনো অস্ত যায় না।
‘শোলে’র এই নতুন সংস্করণটি তৈরি করা সহজ ছিল না। মূল ৭০ মিমি প্রিন্টগুলো সংরক্ষিত ছিল না, আর ক্যামেরার নেগেটিভগুলো ছিল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে, রমেশ সিপ্পির ছেলে শেহজাদ সিপ্পি এবং ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টায় মুম্বাইয়ের একটি গুদাম থেকে মূল ৩৫ মিমি ক্যামেরা নেগেটিভ ও সাউন্ড নেগেটিভ উদ্ধার হয়। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সহযোগিতায়, যুক্তরাজ্যের সংরক্ষিত রিলগুলোও সংগ্রহ করা হয়। এরপর বোলোনিয়ার লি’মাজিনে রিত্রোভাতা -তে এক দীর্ঘ তিন বছরের কঠোর পরিশ্রমে সিনেমাটিকে পুনরুদ্ধার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ছবির শুটিংয়ে ব্যবহৃত মূল ক্যামেরাও আবিষ্কৃত হয়েছে, যা এই পুনরুদ্ধারকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
অর্ধশতাব্দী পরেও কেন ‘শোলে’ দর্শকদের মনে দাগ কাটে? অমিতাভ বচ্চনের উত্তরটি সহজ, কিন্তু গভীর ‘সত্যের জয় আর… সবচেয়ে বড় কথা, তিন ঘণ্টার মধ্যেই ন্যায়বিচার! আপনি আর আমি যা একটা জীবদ্দশায়ও নাও পেতে পারি।’ এই চলচ্চিত্রে সত্য ও ন্যায়ের এক দ্রুত বিজয় দেখানো হয়েছে, যা দর্শকদের এক গভীর তৃপ্তি এনে দেয়।
‘শোলে’ শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা, একটি আবেগ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছে। এই নতুন সংস্করণটি ‘শোলে’র মহিমাকে আরও একবার বড় পর্দায় ফিরিয়ে আনছে।