নূরে আলম সিদ্দিকী : ৯৬ বছর বয়সে গ্রেট ব্রিটেনের মহারানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ পরলোকগমন করেছেন। সমস্ত গ্রেট ব্রিটেন শোকে মুহ্যমান। বাংলার বর্ষার মতো অবিশ্রান্ত ধারায় গ্রেট ব্রিটেনের অজস্র অগণিত উদ্বেলিত চিত্তের মানুষ অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেখানে ১০ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মনে হয়েছে যেন এ শোক অনন্তকাল ধরে গ্রেট ব্রিটেনের মর্মাহত জনতার হৃদয়জুড়ে কালো মেঘের মতো অবস্থান করবে। শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, সমস্ত পৃথিবীর মানুষেরই অনুভূতির রং বদলায়। এ গ্রেট ব্রিটেনেই প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর ব্রিটেনজুড়ে কান্নার অবিশ্রান্ত ধারা প্রবাহিত হতে দেখেছি।
আজকে যিনি গ্রেট ব্রিটেনের অভিষিক্ত রানি ক্যামিলা এবং রাজা চার্লস, সেদিন ব্রিটেনের উচ্ছ্বসিত বেদনাহত মানুষগুলো ঘৃণার ডালি সাজিয়ে দিয়েছিলেন এদের বিরুদ্ধে। প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য রানি এলিজাবেথকেও প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছিল গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ। সমস্ত বেদনাহত জনতা রাজতন্ত্রের বিপক্ষে একটা নেতিবাচক মনোভাব সামগ্রিকভাবে উন্মোচিত করেছিল। তারা সেদিন প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে একাত্ম আছে, শুধু এই একটা ঘোষণাই করেনি, তার সঙ্গে সঙ্গে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও প্রচ- উষ্মা প্রকাশ করেছিল।
দুর্ঘটনাকবলিত ডায়ানার মৃত্যুকালীন লন্ডনে থাকার সুবাদে সেদিন বিস্ফোরিত লন্ডনকে আমি স্বচক্ষে অবলোকন করেছি। দেশবাসীর দুই চোখে সেদিন যে ঘৃণা, যে বিদ্বেষ, যে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন আমি দেখেছি তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর শোকদগ্ধ ব্রিটেনবাসীর এসব বেদনাহত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মননের কোনো চিত্তধারা ভাবনার মধ্যে আসে না। আমি ভাবতাম বাঙালিরাই বোধহয় আবেগপ্রবণ। গ্রেট ব্রিটেনের অধিবাসীরা আবেগে উচ্ছ্বসিত হয় না। তাদের অনুভূতিগুলো হয়তো যুক্তির শিকলে বাঁধা। ব্রিটিশদের আমরা পুরোটাই শাসক হিসেবে দেখেছি। শাসনের রক্তচক্ষুর অন্তরালে একটা কোমলকুসুম অনুভূতিপ্রবণ প্রাণ যে তাদের থাকতে পারে, সেটা কখনই ভাবিনি। আমরা শুধুই তাদের শাসকের পোশাকেই দেখেছি। দেখিনি তাদের হৃদয়ের ফল্গুধারা। তারাও যে বিরহে কাঁদে, মিলনে হাসে, তাদের হৃদয়েও যে একটি সূক্ষ্ম কুসুমকুঁড়ি রয়েছে, সেটা ক্লাইভ আর ওয়ারেন হেস্টিংসের জাতি, চার্চিলের স্বগোত্রীয়দের মধ্যে অবস্থান করে, এটাও আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সেই মনন সেই অনুভূতি সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যেদিন আমি প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুসংবাদ গ্রেট ব্রিটেনের উদ্বেলিত জনতাকে অবহিত হতে দেখেছিলাম, সেদিন সত্যিই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম। বিমুগ্ধ চিত্তে বিমোহিত হৃদয়ে গ্রেট ব্রিটেনের অধিবাসীদের দিকে এ লন্ডন শহরেই বসে ভেবেছিলাম, এরাও তো আমাদের মতো একটি সুকোমল হৃদয়ের অধিকারী। এরা শুধু শাসন ও শোষণ করতেই জানে না, আপনজনের বিরহবেদনায় কুঁকড়ে কেঁদে উঠতেও জানে। তারা শুধু পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী নয়, তাদের চিত্তেও একটি স্নিগ্ধ কোমল কুসুমকুঁড়ি অবস্থান করে।
সেদিন প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুতে বিশ্ববাসী গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি অনুচ্চারিত প্রতিবাদে শরিক হয়েছিল। এই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুসংবাদে গোটা গ্রেট ব্রিটেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ধীর পায়ে এগিয়ে চলা মানুষের পুষ্পাঞ্জলি পাহাড়ের মতো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বাকিংহাম প্যালেসের সিংহদ্বারে গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে ওঠে। সেদিন যে মানুষটিকে তারা ঘৃণা করেছিল, যে রাজতন্ত্রকে তারা ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল সেই রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার রাজা চার্লসের প্রতিও আনুগত্য দেখিয়েছে তারা নিঃশর্তে, অকপটে, পুলকিত চিত্তে। কোথায় গেল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেই ক্ষোভ? কোথায় গেল চার্লসের বিরুদ্ধে সেই উত্তেজনা?
তখনকার সদ্য শপথ গ্রহণ করা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ডায়ানার মৃত্যুকালীন একটা বিবৃতিতে বলেছিলেন, জনগণের হৃদয়ের রানি অকালপ্রয়াত হয়েছেন একটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। যখনই এ কথাটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে প্রকাশিত হলো, তখনই রুদ্ররোষে ফেটে পড়ল সমগ্র ব্রিটেন। শুধু ব্রিটেনই বা বলব কেন, তামাম দুনিয়া প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কেবল সোচ্চারই হয়নি, তাদের হৃদয়ের ঘৃণাই শুধু প্রকাশ করেনি, বরং জানান দিতে চেয়েছিল তারা বাকিংহাম প্রাসাদ এবং প্রাসাদের অন্তঃপুরে সংঘটিত ষড়যন্ত্রের কতখানি বিরুদ্ধে। কতটুকু উচ্চকিত প্রাণ, কতটুকু প্রতিবাদী তারা। সেদিন প্যারিসের একটি টানেলে দুর্ঘটনাকবলিত প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু রাজতন্ত্রের ও বাকিংহাম প্রাসাদের অনিবার্য বিলুপ্তির দিকে ইঙ্গিত করেছিল। বিশ্ববাসী ধরেই নিয়েছিল, এই বোধহয় গ্রেট ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের অবসান হলো, পরিসমাপ্তি ঘটল। বাকিংহাম প্যালেসের সিংহদ্বার রাজতন্ত্রের জন্য বোধহয় বন্ধই হয়ে যাবে। শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ অতিক্রান্তের পর আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখলাম, সেই গ্রেট ব্রিটেনের অধিবাসীদের চোখে-মুখে রাজতন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রতীক ৭১ বছর দোর্দ- শাসন পরিচালনার অধিকর্ত্রী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণের পর বিদগ্ধ যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা আপ্লুত হৃদয়ে সর্বস্তরের আবালবৃদ্ধবনিতা কী নির্মল, কী অমলিন, কী শুচিশুভ্র শ্রদ্ধার অর্ঘ্য প্রদান করল।
প্যারিসে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে প্রিন্সেস ডায়ানার অকালমৃত্যুর পর বাকিংহাম প্যালেসের ভিত্তি যখন টলটলায়মান হয়ে উঠেছিল, গ্রেট ব্রিটেনবাসী প্রাসাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, রাজপথের অগণিত শোকার্ত মানুষের অগ্নিদগ্ধ প্রতিবাদ প্রতিভাত হয়েছিল, সেই মানুষগুলোরই হৃদয় নিংড়ানো শুচিশুভ্র পূতপবিত্র অম্লান ও জ্যোতির্ময় শ্রদ্ধায় উদ্ভাসিত হলেন রানি এলিজাবেথ, মহাপ্রয়াণের পর। তাঁর শবমিছিল যখন শকটে বহন করা হচ্ছিল, তখন যুক্তরাজ্যের চৌকশ বাহিনীগুলোর চমৎকার ও হৃদয়স্পর্শী অভিবাদন শুধু চোখে পড়েনি, টিভির পর্দায় বিমুগ্ধ চিত্তে সর্বস্তরের শোকাহত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার উদগ্র প্রদর্শনগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সত্যিই অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মহাপ্রয়াণের পর অন্তিম বিদায়ের আনুষ্ঠানিক শোকযাত্রা ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে রাজ পরিবারের সদস্যরা, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনসহ বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান পদব্রজে অংশ নিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ একটি বিরল ঘটনা।
ডায়ানার মৃত্যুকালে অবশ্য সমগ্র পৃথিবী শোকে মুহ্যমান হলেও জৌলুশপূর্ণ সরকারি আয়োজনে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের এত বিশাল সমাহার ও উপস্থিতি হয়নি। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শোক শোভাযাত্রায় সমগ্র পৃথিবীই যেন অংশ নিয়েছিল। শোক শোভাযাত্রার দীপ্ত পদচারণে বেদনাবহুল চিত্তে যারা অংশ নিয়েছিল সবারই পরনে ছিল হয় গহিন কালো স্যুট অথবা নানাবিধ কৃষ্ণকালো পোশাক। মানুষের মিছিল দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন এক অনন্তকালের শোক শোভাযাত্রা। এর যেন আদি আছে, অন্ত নেই। ডায়ানার অকালমৃত্যুতে বিস্ফোরিত গ্রেট ব্রিটেনের মানুষদের শোকাহত হৃদয়কে যারা অবলোকন করেছেন অথবা অনুভব করেছেন, তারা ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেট ব্রিটেনের রাজপথে জনতার বাঁধভাঙা স্রোত দেখে বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত হবেন বইকি। এখানে বারবার নিজের মনে একটি প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, কে যেন হৃদয়ের সিংহদ্বারে কড়া নেড়ে প্রশ্ন করতে থাকে, মৃত্যুসংবাদ প্রাপ্তির পর শোকাহত গ্রেট ব্রিটেনের সেই অযুত-নিযুত মানুষগুলোই যুক্তরাজ্যের রানির মৃত্যুতে চাপা ক্রন্দন নিয়ে রাজপথ পাড়ি দিল কী অবিশ্রান্ত পদক্ষেপে।
সেই ১৯৯৭ সালের গ্রেট ব্রিটেনের কিশোর-যুবকরা আজকে কেউ প্রৌঢ়, কেউ বৃদ্ধ, কেউ হয়তো পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু ব্রিটিশের রাজনৈতিক আবহ মৃদুমন্থর গতিতে আজও তো প্রবহমান। সেই একই রাজ্যের দুই রানি, ভেবেছিলাম একজনের আসন মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় প্রতিস্থাপিত সিংহাসনে, আরেকজনের সিংহাসন বাকিংহাম প্যালেসে। কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মহাপ্রয়াণের পর টেলিভিশনের পর্দায় অনিমেষ আঁখি মেলে যা অবলোকন করলাম, তা-ও তো একটি কালজয়ী দৃশ্য। শতাব্দীর ইতিহাসে এ ঘটনা নিতান্তই বিরল। ভাবতেও পারিনি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সমগ্র বিশ্বের মানুষের এতখানি হৃদয়জুড়ে রয়েছেন। ব্রিটেনের জনগণের অন্তরের অন্তস্তলে তাঁর আসন এতটা সুদৃঢ়, তা কল্পনারও বাইরে ছিল। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রমাণ করে গেলেন, ঐতিহ্যে বিশ্বাসী গ্রেট ব্রিটেনের মানুষের হৃদয়ে রাজতন্ত্র স্থায়ী আসন পেতে আছে। এটা উপড়ে ফেলা দূরে থাক, হেলানোও দুষ্কর। অনেকটা অসম্ভব বললেও চলে। ডায়ানার পরিত্যক্ত স্বামী প্রিন্স চার্লস সেদিন গ্রেট ব্রিটেনের সব অধিবাসীর কাছে একটা ভয়ংকর ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। চার্লসের স্ত্রী রানি ক্যামিলা সেদিন মানুষের কাছে একটা অশুভ প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলেন। সেই রাজা ও রানির প্রতি গ্রেট ব্রিটেনবাসী যে শ্রদ্ধার পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করল, তা দেখে শুধু আমি কেন, সমগ্র বিশ্বের অগণিত উদ্বেলিত চিত্ত হয়তো বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। হয়তো আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেছে, একি দৃশ্য দেখলাম আজ গ্রেট ব্রিটেনের প্রশস্ত রাজপথে! পথে পথে মানুষের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, রাজা-রানির প্রতি তাদের শ্রদ্ধাপ্লুত চাউনি ডায়ানার মৃত্যুতে ঘৃণিত এ দম্পতির বিরুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেনের সব রোষের যবনিকা ঘটল।
আমি জানি না ডায়ানার আত্মার কী অনুভূতি হবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর। যে দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রিন্সেস ডায়ানাকে বাকিংহাম প্যালেস ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, যে এলিজাবেথ সেদিনের চার্লসকে আশকারা দিয়েছিলেন, এর সঙ্গেও আজকের অভিষিক্ত রানির নাম জড়িত। ক্যামিলার সঙ্গে চার্লসের প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হলে রানি এলিজাবেথ আড়চোখে সেটা দেখলেও না দেখার ভান করেছিলেন, অনেকটা প্রশ্রয় দেওয়ার মতো। অভিমানী ডায়ানা স্বামীর এ পরকীয়া সম্পর্ক সহ্য করতে পারেননি। তাঁর অব্যক্ত হৃদয়ের অনুভূতি তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে। একপর্যায়ে দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে তিলে তিলে দগ্ধীভূত প্রিন্সেস ডায়ানা চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে বাধ্য হন। সমগ্র ব্রিটেনবাসী এবং সারা বিশ্বের তপ্ত-তাজা-প্রাণ ডায়ানার শুচিশুভ্র মনের এ তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণকে, এ অগ্নিদগ্ধ পদক্ষেপকে বিমুগ্ধচিত্তে সাধুবাদ জানিয়েছিল। তারা মনেপ্রাণে কামনা করেছিল ডায়ানার সেই বিদ্রোহী সত্তার বহিঃপ্রকাশ কালজয়ী হোক। প্রিন্সেস ডায়ানা শুধু চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি মিসরীয় বংশো™ূ¢ত দোদি আল ফায়েদ নামে এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আর সেটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ক্ষুব্ধ মনে প্রতিশোধের প্রতিহিংসায় মেতে ওঠেন। প্যারিসের একটি টানেলে যে লোকটি ট্রাকের মাধ্যমে ডায়ানা এবং তাঁর স্বামীর গাড়িটি পেছন থেকে আঘাত করে ওই দুর্ঘটনাটির জন্ম দেন, সেই ট্রাক ড্রাইভার অকপটে স্বীকার করেছিলেন তিনি মহারানি কর্তৃক নির্দেশিত। পরে ওই ড্রাইভারের কতটুকু শাস্তি হয়েছিল, নাকি অপ্রতিরোধ্য রাজশক্তির আকাশছোঁয়া প্রভাবে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন তা ফলাওভাবে সংবাদমাধ্যমে আর আসেনি। আমরাও ঘটনার যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজকে নতুন করে বিষয়টির অবতারণা করছি এ কারণে, সেদিন ডায়ানার সপক্ষে বিস্ফোরিত জনগণ আজকে রানি এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোকাহত। এ জনগণ একই গ্রেট ব্রিটেনের অধিবাসী, হয়তো একই প্রজন্মেরও মানুষ। আবেগ-উচ্ছ্বাস, অনুভূতি, হৃদয়ের আকুতি সবকিছুই হয়তো এক। শুধু ঘটনাটি একটি অন্যটির বিপরীত। এটা আমাদের মতো আবেগপ্রবণ বাঙালির কাছে একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। এ ঘটনায় আমরা যেমন আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়েছি, তেমনিভাবে একটি সত্যে উপনীত হয়েছি- মানুষের মন, সে মানুষ সাদা, কালো, বাদামি যে রঙেরই হোক না কেন, তার গতিবিধি, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ অনেকটাই শাশ্বত, অকৃত্রিম ও অবারিত। মানুষের হৃদয়ের ফল্গুধারা দেশকালের কোনো সীমানা মানে না।
বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়, দূর আকাশে শরতের মেঘের মতো বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের আকাশ নিত্যনতুন আবর্তে পরিবর্তিত হয়। এটি আমাদের বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট বিশ্বজনমত। কিন্তু আজকের গ্রেট ব্রিটেনের চিত্র আর সেদিনের ডায়ানার মৃত্যুর পরের চিত্র মিলিয়ে দেখলে আমাদের মতোই একই চিত্র কি প্রতিভাত হয় না?
বাংলাদেশে আমরাও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোকাহত। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দেশেও তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই বাস্তব। কারণ বাংলাদেশ কেবল কমনওয়েলথভুক্ত দেশই নয়, এখানে নানাভাবে গ্রেট ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ প্রভাব অনুভূত হয়। প্রায় সাড়ে সাত যুগ আগে আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছি, ফিরিঙ্গিদের রাজতন্ত্রের শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছি। তবু আমাদের মননের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজের কোনায় কোনায় তাদের প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে বিস্তার লাভ করে আছে। তাই ডায়ানার মৃত্যুতে সেদিন আমরা যেমন ব্রিটেনবাসীর মতোই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম, তেমনই সবকিছু বিস্মৃত হয়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতেও আমরা শোকাহত হয়েছি। কী অদ্ভুত মনের এ গতিবিধি! এ যেন কোনো নিয়মের শৃঙ্খল মানে না। তবু ব্যক্তিগতভাবে আমি ডায়ানার বিক্ষুব্ধ মননের সঙ্গে আজও একাত্ম হয়ে আছি। দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোকাহত হৃদয়গুলোর প্রতি কোনো কটাক্ষ না হেনেও বিনম্র চিত্তে হৃদয় ও পুরনো অনুভূতির আবির মাখিয়ে ডায়ানার সেদিনের সেই উচ্চকিত মননের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি। এ কথা সত্যি, ‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা’। ডায়ানার মৃত্যু তাঁদের প্রেমকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে, জীবনকে মহিমান্বিত করেছে। পাশাপাশি সেদিন রানিকে দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে দগ্ধীভূত করেছে, তবু সেই রানি আজ সমগ্র ইংরেজ জাতির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ফল্গুধারায় সিক্ত হলেন- একে অস্বীকার করব কীভাবে?
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন