ডা. মাফরুহা আক্তার: সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও গত ১৭ এপ্রিল বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস পালিত হল। বিশ্ব হিমোফিলিয়া ফেডারেশন ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর এ তারিখে বিশেষ দিবসটি পালন করে আসছে। এর উদ্দেশ্য হলো এই হিমোফিলিয়া ও সেই সঙ্গে রক্তক্ষরণজনিত অন্যান্য যে বিরল রক্তরোগ আছে সে সম্পর্কে সচেতনতা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা করা এবং সেই সঙ্গে সমাজে সুবিধাবঞ্চিতদের এ বিষয়ে সহায়তা করা। বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান যা হিমোফিলিয়া রোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ সোসাইটি অব হেমাটোলজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ দিবসে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা আয়োজিত হয়। এছাড়াও ফেসবুকভিত্তিক পেজ হেমাটোকেয়ার থেকেও ‘হিমোফিলিয়া ও প্র্যাকটিকাল ইস্যু’ শীর্ষক একটি সচেতনতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও দিবসটি পালিত হয়েছে বাংলাদেশে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : সবার জন্য অধিগম্যতা, সবার জন্য চিকিৎসা। সবার অংশীদারিত্বে, স্বাস্থ্যনীতিতে সম্পৃক্ত করে এর অগ্রগতি সাধন।
এখনো সারা বিশ্বে ৭৫% হিমোফিলিয়া রোগী শনাক্তের বাইরে আছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সবার জন্য শনাক্তকরণ সুবিধা সুনিশ্চিত করা জরুরি। সব হিমোফিলিয়া রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণ তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার।
কেস এক : ছয় বছরের একটি ছেলের সুন্নত-ই-খতনা করার পর কিছুতেই রক্তপাত কমছে না। তাকে গ্রাম থেকে জেলা সদর হাসপাতালে আনার পর কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হলো। তারপরও রক্তপাত হয়েই যাচ্ছে। পরবর্তীতে ঢাকায় রেফার করা হলো এবং হেমাটোলজিস্ট বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর পর হিমোফিলিয়া ধরা পড়ল।
কেস দুই : হিমোফিলিয়া আক্রান্ত একটি ছেলে মাঝে মাঝে ফ্যাক্টর এইট ইনজেকশন নেয়। তার হাঁটু দুটোই অর্ধেক ক্ষমতাসম্পন্ন। এবার আবারও হাঁটু ফুলেছে। তবে চিন্তার বিষয় হলো তার ক্ষেত্রে আর ফ্যাক্টর কাজ করছে না। চিকিৎসক জানিয়েছেন তার এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। এখন যে চিকিৎসা লাগবে তা বেশ ব্যয়বহুল যা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়।
হিমোফিলিয়া কী?
হিমোফিলিয়া রক্তের একটি বিশেষ জন্মগত বা জিনগত রোগ যেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। আমাদের শরীরে কোথাও কেটে গেলে সাধারণত কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিকভাবে রক্তজমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগীর রক্তক্ষরণ দীর্ঘসময় চলতে থাকে। কারণ রক্ত জমাট বাঁধার জন্য যে বিশেষ প্রোটিন FVIII ও FIX প্রয়োজন হয় তার ঘাটতি থাকে। এ দুইটি ফ্যাক্টরের জিন মানুষের এক্স ক্রোমোজমে থাকে।
জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের রানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন হিমোফিলিয়া জিনের বাহক। তার পুত্র সন্তান লিওপোল্ডের ছিল হিমোফিলিয়া রোগ। আর রাজকন্যা অ্যালিস ও বেয়াত্রিস এরা ছিলেন বাহক। এটি রক্তক্ষরণ রোগ যা পরবর্তীতে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। লিওপোল্ডের মা তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন এবং তাকে খুব সুরক্ষিত রাখতেন। তারপরও খেলতে গিয়ে মাথায় সামান্য আঘাতে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ছেলেটি মারা গিয়েছিল। এরপর রানীর উত্তরসূরিদের বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে ইউরোপ ও রাশিয়ার রাজপরিবারেও এই জিন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে ওই একই ব্রিটিশ রাজপরিবারের স্টিফেন ক্রিসমাস একই ধরনের হিমোফিলিয়া-বি রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর নাম অনুযায়ী হিমোফিলিয়া বি কে ক্রিসমাস ডিজিজ বলা হয়। মোদ্দা কথা ওই সময়ে হিমোফিলিয়াকে রয়েল ডিজিজ বলা হতো। এখন বিশ্বের সবদেশেই এই রোগ দেখা যায়।
কাদের হয়? কেন হয়?
সাধারণত ছেলেরা আক্রান্ত হয়, আর মেয়েরা এই হিমোফিলিয়া জিনের বাহক হয়। কারণ বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় X-linked disease যা শুধু এক্সক্রোমোজমের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। ছেলেদের একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজম থাকে যা মায়ের কাছ থেকে আসে। তাই মা যদি তার এক্স ক্রোমোজমে এই ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করে তবে তার পুত্র সন্তানরা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। মেয়ে সন্তানরা বাহক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জিনেটিক ত্রুটির কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রোটিন বা ফ্যাক্টর (FVIII or FIX) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম থাকে। তাই রোগীর বেশি ও দীর্ঘ রক্তক্ষরণ হয়।
পারিবারিক ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, আক্রান্তের নিজের ভাই, খালাতো ভাই, মামা, নানা এদের ইতিহাস জানা জরুরি। তবে ২৫% ক্ষেত্রে কোনো পারিবারিক ইতিহাস নাও থাকতে পারে, অর্থাৎ নতুন মিউটেশন থেকেও হতে পারে।
হিমোফিলিয়ার ধরন ও লক্ষণ
সাধারণত দুই ধরনের হয়। যেমন
হিমোফিলিয়া A : FVIII এর ঘাটতি
হিমোফিলিয়া B : FIX এর ঘাটতি
রোগের তীব্রতা ও ফ্যাক্টরের মাত্রা অনুযায়ী এদের তিনভাগে ভাগ করা হয়। যেমন :
* মৃদু: ফ্যাক্টর মাত্রা >৫-৪০%। এদের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে কোথাও কেটে গেলে বা আঘাত পেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
* মাঝারি: ফ্যাক্টর মাত্রা ১-৫%। মাঝে মাঝে মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট ও অন্যান্য টিস্যু তে রক্তক্ষরণ হয়।
* মারাত্মক: ফ্যাক্টর মাত্রা < ১%। এখানে কোনো রকম আঘাত ছাড়াই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। জন্মের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এ ছাড়াও মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট বিশেষত হাঁটু, কুনুই, পায়ের গোড়ালি এসব স্থানে ফুলে যেতে পারে ও ব্যথা হয়। জয়েন্ট ফুলে গিয়ে গরম হয়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। ত্বকের নিচে আঘাত বা bruise, মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ এসবও হতে পারে। মারাত্মক ক্ষেত্রে শিশু অবস্থাতেই লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এ ছাড়াও দাঁত পড়া, সুন্নাত-ই-খতনা, যেকোনো সার্জারি বা আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্ত পড়তে পারে।
হিমোফিলিয়াতে মূল সমস্যা হলো হাড়জোড়া বা জয়েন্ট ফুলে যাওয়া যাকে বলা হয় hemarthrosis/arthropathy। একই জয়েন্ট বার বার ফুলে গিয়ে টার্গেট জয়েন্টে পরিণত হয়। ফলে তার কার্যকারিতা কমে যায়। এতে রোগীর হাঁটা ও চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। এক সময় জয়েন্টের কাজ সম্পূর্ণ ব্যাহত হতে পারে।
শনাক্তকরণ
যথাযথ ইতিহাস ও লক্ষণ জানার পর রক্তের স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে APTT নামক পরীক্ষার ফল বেশি। এর পরে নির্দিষ্ট ফ্যাক্টর পরীক্ষা (Factor VIII or IX Assay) করে হিমোফিলিয়া রোগ নির্ধারণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়। যদিও এই শনাক্তকরণ সুবিধা দেশের মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আছে যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
চিকিৎসা
* ফ্যাক্টর ইঞ্জেকশন (FVIII or FIX concentrate replacement)
* প্লাজমা পরিসঞ্চালন (Fresh frozen Plasma or cryoprecipitate)* রক্ত পরিসঞ্চালন ক্ষেত্র বিশেষে।
* ইনহিবিটর বা এন্টিবডি শনাক্তকরণ ও জটিলতার চিকিৎসা
বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা
* আক্রান্ত স্থানকে বিশ্রাম দেওয়া ও সম্ভব হলে উঁচু করে রাখা।
* রক্তক্ষরণের স্থানকে চেপে ধরে রাখা।
* দ্রুত বরফ বা ঠাণ্ডা পানি দেওয়া।
* ব্যথা হলে প্যারাসিটামল খাওয়া।
* হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাবধানতা : যা রোগীদের মেনে চলতে হবে
* যেকোনো ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করা।
* শিশুকে সুরক্ষিত রাখা।
* মাংসপেশিতে ইনজেকশন না দেওয়া।
* ছেলে শিশুদের সার্জারির আগে পারিবারিক ইতিহাস নেওয়া
* চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথার ওষুধ না খাওয়া।
* বাড়িতে সবসময় বরফ রাখা।
শেষ কথা
বাংলাদেশে আনুমানিক ২০ হাজারের বেশি হিমোফিলিয়া রোগী থাকার কথা। কিন্তু মাত্র আনুমানিক ২৬০০ রোগী নিবন্ধিত হয়েছে। বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি রোগী শনাক্তকরণসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা হাসপাতাল আছে সেখানে হিমোফিলিয়া সম্বন্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা। এ ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো হতে পারে হিমোফিলিয়া প্রাথমিক চিকিৎসার কেন্দ্র।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি সচেতনতা, শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ । সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন