ছবি সংগৃহীত
ডেস্ক রিপোর্ট : কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বিস্তীর্ণ হাওড় ধ্বংস করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি প্রমোদ সড়ক। সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের পরিবারের ইচ্ছা পূরণে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য বেষ্টিত হাওড়ের বুকে তৈরি করা হয়েছে এই সড়কটি, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে “হামিদ পরিবারের প্রমোদ সড়ক” নামে পরিচিত। কেউ কেউ এটিকে “অলওয়েদার সড়ক” নামেও ডাকেন।
এই সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে, প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই এই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই সড়কে প্রতিদিন ২৬,০০০ যানবাহন চলাচল করবে এবং টোল আদায়ের পরিমাণ পদ্মা সেতুর চেয়েও বেশি হবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সড়কটি চালু হওয়ার চার বছর পরও সেখানে অল্প কিছু মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা ছাড়া তেমন কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি।
পরিবেশবিদরা এই সড়ক নির্মাণকে দেশের অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, হাওড় দেশের হৃদপিণ্ডের মতো। একটি পরিবারের ইচ্ছা পূরণে বিগত সরকার হাওড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে। সড়ক নির্মাণের ফলে হাওড়ের জীববৈচিত্র্য, মৎস্য সম্পদ ও জলজ উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, সড়কটি নির্মাণের পর থেকে প্রতিবছর তিন জেলা অকাল বন্যার কবলে পড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও কমে গেছে।
সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই সড়ক নির্মাণে দুটি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, হাওড়ের জীববৈচিত্র্য ও কৃষির ক্ষতি হয়েছে আরও কয়েক গুণ বেশি। সড়ক নির্মাণের ফলে হাওড়ের মাটির শ্রেণীতে পরিবর্তন এসেছে এবং ধানের উৎপাদনও কমেছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার সাংবিধানিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এই সড়ক নির্মাণের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে চারটি চিঠি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, হামিদের চাপে এই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
এই সড়ক নির্মাণের ফলে হাওড়ের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, “কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই বাঁধের মতো করে এ সড়ক নির্মাণ করায় হাওড়ের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হাওড়ের বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হতে পারে।
এদিকে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের পরিবারের সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিতর্কিত প্রকল্প হলো কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে নির্মিত “প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট”। এই রিসোর্টটি নির্মাণে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে বলে জানা গেছে। রিসোর্টটিতে ২০টি দোতলা কটেজ, ৪০টি সীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুইট, রেস্টুরেন্ট, পার্টি সেন্টার, শিশুদের গেম জোন ও ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, এই রিসোর্ট নির্মাণের জন্য জমি জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে।
হাওড় অঞ্চলের পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর এই সড়ক ও রিসোর্ট নির্মাণের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, হাওড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে এই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা দেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তারা এই প্রকল্পগুলির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্পগুলির বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাউজুল কোভিদ খান বলেছেন, “বিগত সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে এই প্রকল্পগুলি নিয়েছে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।”
সূএ: বার্তাবাজার