সুলেখা আক্তার শান্তা :
আব্বা রিটায়ার করেছেন অনেকদিন। জীবন এভাবে সাজিয়েছেন বৈষয়িক বিষয় নিয়ে তাঁকে বড় একটা ভাবতে হয় না। শরীর স্বাস্থ্য ভালো, হাসিখুশি মানুষ। সৌখিন কিন্তু বাতিকগ্রস্ত। হঠাৎ এক বাতিক তাঁকে পেয়ে বসে। তাতে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আব্বার ছিল খাওয়া দাওয়ার শখ। রসনা তৃপ্তির কত যে কাহিনী তাঁর কাছে শুনেছি। তার মুখে পুরনো দিনের কথা শুনে মনে হয় সে আমলে জন্মালে জন্ম সার্থক হত। পুরনো দিনের খাওয়া-দাওয়ার কথা তিনি ভুলতে পারেন না।
বাবার হঠাৎ সাধ জাগে মাটির হাঁড়িতে মাংস রান্না করবেন। তাও আবার কাঠের চুলায়। যে কথা সেই কাজ। শুরু হলো মহা আয়োজন। বাগড়া দিলেন মা, এসব অনাসৃষ্টি চলবে না। বাবার যুক্তিতে অনেক বিঘ্ন খন্ডন হলো কিন্তু মাটির হাড়ি নিয়ে বাধলো যুক্তির বিভ্রাট। মা বললেন, মাটির হাঁড়ি কোন ভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। মাটির হাঁড়িতে দুই কেজি মাংস তোলা হলে হাঁড়ি ভেঙে যেতে পারে। বাবার যুক্তি, ভাত হোক, মাংস হোক সে আমল মাটির হাঁড়িতেই সব রান্না হতো। রান্না করতে গিয়ে হাঁড়ি ভেঙে পড়া চালু থাকলে তাদের তো না খেয়ে থাকতে হতো। মায়ের যুক্তি, সে আমলে নির্ভরযোগ্য মাটির হাঁড়ি তৈরি হতো এখন সেটা পাওয়া যাবে না। তাঁর আপত্তির আরেকটি কারণ ছিল। তখন দুই কেজি মাংসের দাম ছিল হয়তো আট টাকা। এখন এক কেজির দাম আটশত টাকা। এতগুলো টাকার জিনিস দিয়ে তো আর ছেলে খেলা করা যায় না।
বাবা অদম্য। পাল পাড়ায় গিয়ে খুঁজে মজবুত মাটির হাড়ি কিনে আনলেন। এবার লাকড়ির চুলা। গবেষণা শুরু হলো তার কি ব্যবস্থা করা যায়। ফ্ল্যাট বাড়ি, নিচে একটু ফাঁকা জায়গা আছে কয়েকটা ফুলের টপ দিয়ে ঘেরা। সেখানে করা যায়। মা বললেন, বেশ হবে। সিরাজ সাহেবের দুই কেজি মাংস রান্না হচ্ছে দেখে লোকে হাততালি দেবে। কথাটা ঠিকই, দুই মণ মাংস রান্না হলে সেটা দর্শনীয় কিছু হত। দুই কেজি মাংস সো পুওর। বাদ সে পরিকল্পনা। রান্নাঘরের চুলের পাশে কিছু করা যায় কিনা ভাবা হলো। হবে না, মা স্ট্রেট কাট বাতিল করে দিলেন সেই প্রস্তাব।
অন্য উপায় ভাবা শুরু হলো। ভাইয়া বলল একটা উপায় আছে। আব্বা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, বলতো কী উপায় করা যায়। বারান্দায় একটা টেম্পোরারি ব্যবস্থা করা যায়। আব্বা উদ্বিগ্ন, কী করে? ভাইয়া বিস্তারিত বলে। দুই বস্তা বালুর উপর ইট বিছিয়ে রান্না করলে ফ্লোর এর কোন ক্ষতি হবে না। আর শুকনো লাকড়ি দিয়ে রান্না করলে ধোঁয়া হবার সম্ভাবনা কম। আব্বা বললেন, সামান্য জায়গা একটু কালি ঝুলে পড়লে প্লাস্টিক পেইন্ট করিয়ে নেওয়া যাবে। লেগে পড়া হলো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। ভাইয়া বের হলো ইট বালু আর শুকনো লাকড়ি আনতে। একজন লেবার দিয়ে নিয়ে আসা হলো সব বারান্দায়। সব আয়োজন সম্পন্ন। গলদঘর্ম সবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা। এমন সময় মা এসে বললেন, খেতে এসো সবাই মাংস রান্না হয়ে গেছে। প্রেসার কুকারে পনের মিনিটে রান্না হয়ে গেল। তোমাদের অপেক্ষায় থাকলে আজ আর খাওয়া হত না।
Facebook Comments Box