সড়ক আর নৌপথের নৈরাজ্য: চালকের মন

গাজী মিজানুর রহমান: অনেকেই প্রাইভেট কারে, উবারের ভাড়া করা গাড়িতে, সিএনজি-তে, কিংবা পাবলিক বাসে চড়ে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করেন। এইসব গাড়ির আরোহীরা একটু মনোযোগ দিলে বুঝতে পারবেন, আপনি যে যানবাহনে উঠে চলাচল করছেন, তার চালক কিন্তু নিজেকে কখনোই ছোট ভাবে না, তারা নিজেদেরকে এক-একজন রাজা-উজির ভাবে। যদি প্রতিপক্ষের গাড়িটা সাইজে ছোট, হালকা-পাতলা, কিংবা কম দামের হয়, তখন তো কথাই নেই; অপর গাড়ির চালকের প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আসে। রিক্সায় চড়লে দেখবেন, রিক্সাওয়ালা প্রাইভেট কারকে বলছে, প্লাস্টিক! সে জানে রিক্সার চাকার মাঝখানে একটা বল্টু খানিকটা মুখ বের করে থাকে। এটা যদি কোনো কারের শরীরে এসে লাগে, তাহলে শরীরটায় গর্ত হয়ে যাবে। তাই রিক্সাকে কার চলকদের সমীহ করে চলতে হয়।

ঢাকার পাবলিক বাসের কাছে একমাত্র ট্রাক, লরি আর পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন ধর্তব্যের মধ্যে আসেই না। বাস দেখে অন্য যানবাহন সসম্মানে রাস্তা ছেড়ে দূর দিয়ে চালায়, কারণ জানে ওদের শরীরে কোনো মায়া নেই। নিজের শরীরের উপরেও দরদ কম, ছেঁড়ে ছিড়ুক, কাটে কাটুক, তিন-চার বছর পরে একবার রঙ করিয়ে নিলে হবে।

তবুও এসব বাসকে এই রাজধানী মহানগরের পথচারীরা খুব একটা ভয় পায় না। সড়ক পার হতে গিয়ে পথচারী ভাবে, রাস্তা-পারাপারের যেহেতু কোনো চিহ্ন নেই কোথাও, তাই সব যায়গায় সে পার হতে পারে।

হাত একটা উঠিয়ে দিলেই গাড়িকে বুঝতে হবে, পথচারী সড়ক পার হতে চায়। পথিকের প্রয়োজন আগে, কারণ সে পায়ে হাঁটছে। তাকে দেখে গাড়ি-ঘোড়া দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তা এমন দাঁড়াতে গেলে এক কিলো যেতে এ মহানগরে এক ঘন্টা লেগে যাবে। তাই গাড়ির চালকেরা সিগনালে এসে মওকা খোঁজে ট্রাফিক হাত উঠানোর আগেই যাতে পার হওয়া যায়। তা নাহলে ঠায় বসে থাকতে হবে। নানা ধরণের যানবাহন এসে ক্রসিং পয়েন্টে রাস্তা ক্রস করবে, ইউটার্ন নেবে, এমনকি উল্টো দিক চালিয়ে আসবে।

ঢাকার গাড়ির আরোহীরা খেয়াল করলে দেখবেন, আপনি যে গাড়িতে উঠেছেন তার চালক এমন ভাব দেখায় যে, সে একাই আইন মানে, আর কেউ মানে না। অথচ দেখবেন, সে নিজেও আইন ভাঙে। অতএব কে কখন আইন ভাঙে তার নিশ্চয়তা নেই। নিশ্চয়তা না থাকায় যে দুর্বল, তাকে চৌদ্দ হাত দূর দিয়ে চলতে হয়। কিন্তু কোনো কোনো চালক আছে ওই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার কথা না ভেবে প্রতিপক্ষ চালক আইন মানবে এমন ভেবে গাড়ি চালিয়ে যায়। তখন অতিরিক্ত সাবধানতা গ্রহণ না করার ফলে নিজে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

ঘটনা একটা ঘটে গেলে তারা মালিককে বা আরোহীকে বুঝায়, দেখেন আমি তো ঠিক জায়গায় ছিলাম, ওই গাড়ির চালক অন্যায়ভাবে আমাকে এসে ধাক্কা দিল। তখন চীৎকার, চেচামেচি, জনসমাগম হবে। তাতে কে হারবে, কে জিতবে তা আইন দেখে নির্ধারিত হবে না; তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত জনতা যার পক্ষে বেশি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ অফিসার যার পক্ষে, ক্ষতিপূরণ পাওয়া তার পক্ষে যাবে।

মানুষের আচার-ব্যবহার ডাঙ্গায় এক, আর নদীতে আরেক, তা তো হতে পারে না! শীতলক্ষা নদী আবার ঢাকার একেবারে কাছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখলে যে কারো হৃদয় ব্যথিত না হয়ে পারবে না। কেমন করে ২০ মার্চ দুপুরে কয়লাঘাট এলাকায় রূপসী-৯ নামের একটা বিশালাকৃতির মালবাহী কার্গো জাহাজ ছোট সাইজের এম এল আফসার উদ্দিন লঞ্চটিকে চেপেঠেসে ডুবিয়ে দিলো! ডুবিয়ে দিয়ে একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ডুবন্তপ্রায় যাত্রীদের উদ্ধার করা দূরে থাকুক, শেষ পরিণতিটাও দাঁড়িয়ে দেখলো না!

এখানে কয়েকটা প্রশ্ন জাগে– ডুবে যাওয়া লঞ্চের চালক কি ভেবেছিল যে ঘাতক জাহাজের মাস্টার কড়াকড়ি আইন মেনে তার জাহাজ চালাবে, তাই লঞ্চের নিজের একটু সমীহ করে দূরে সরে যাওয়ার দরকার নেই? অন্যদিকে ঘাতক জাহাজের চালক কি ভেবেছিল, এত ছোট জলযান, তোর এত সাহস কাছে আসিস, চল্লিশ হাত দূরে থাকতে পারিস না! কিন্তু দুই চালকের কেউই ভাবলো না, লঞ্চে আছে মানুষ, যাদের মূল্যবান প্রাণ দশবিশটি জাহাজের মূল্য দিয়ে পূরণ করা যাবে না? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিতেই পারে। সড়কে আর নদীতে বছর-বছর যেভাবে প্রাণহানি হচ্ছে তা কোনো দেশের যুদ্ধের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। এ যুদ্ধে পরাজয় হচ্ছে মানুষের, আর জয়ী হচ্ছে যন্ত্রদানব কিংবা মানুষের দুর্বিনীত অবহেলা।

(গাজী মিজানুর রহমান– লেখক এবং সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট)       সূএ: মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সড়ক আর নৌপথের নৈরাজ্য: চালকের মন

গাজী মিজানুর রহমান: অনেকেই প্রাইভেট কারে, উবারের ভাড়া করা গাড়িতে, সিএনজি-তে, কিংবা পাবলিক বাসে চড়ে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করেন। এইসব গাড়ির আরোহীরা একটু মনোযোগ দিলে বুঝতে পারবেন, আপনি যে যানবাহনে উঠে চলাচল করছেন, তার চালক কিন্তু নিজেকে কখনোই ছোট ভাবে না, তারা নিজেদেরকে এক-একজন রাজা-উজির ভাবে। যদি প্রতিপক্ষের গাড়িটা সাইজে ছোট, হালকা-পাতলা, কিংবা কম দামের হয়, তখন তো কথাই নেই; অপর গাড়ির চালকের প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আসে। রিক্সায় চড়লে দেখবেন, রিক্সাওয়ালা প্রাইভেট কারকে বলছে, প্লাস্টিক! সে জানে রিক্সার চাকার মাঝখানে একটা বল্টু খানিকটা মুখ বের করে থাকে। এটা যদি কোনো কারের শরীরে এসে লাগে, তাহলে শরীরটায় গর্ত হয়ে যাবে। তাই রিক্সাকে কার চলকদের সমীহ করে চলতে হয়।

ঢাকার পাবলিক বাসের কাছে একমাত্র ট্রাক, লরি আর পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন ধর্তব্যের মধ্যে আসেই না। বাস দেখে অন্য যানবাহন সসম্মানে রাস্তা ছেড়ে দূর দিয়ে চালায়, কারণ জানে ওদের শরীরে কোনো মায়া নেই। নিজের শরীরের উপরেও দরদ কম, ছেঁড়ে ছিড়ুক, কাটে কাটুক, তিন-চার বছর পরে একবার রঙ করিয়ে নিলে হবে।

তবুও এসব বাসকে এই রাজধানী মহানগরের পথচারীরা খুব একটা ভয় পায় না। সড়ক পার হতে গিয়ে পথচারী ভাবে, রাস্তা-পারাপারের যেহেতু কোনো চিহ্ন নেই কোথাও, তাই সব যায়গায় সে পার হতে পারে।

হাত একটা উঠিয়ে দিলেই গাড়িকে বুঝতে হবে, পথচারী সড়ক পার হতে চায়। পথিকের প্রয়োজন আগে, কারণ সে পায়ে হাঁটছে। তাকে দেখে গাড়ি-ঘোড়া দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তা এমন দাঁড়াতে গেলে এক কিলো যেতে এ মহানগরে এক ঘন্টা লেগে যাবে। তাই গাড়ির চালকেরা সিগনালে এসে মওকা খোঁজে ট্রাফিক হাত উঠানোর আগেই যাতে পার হওয়া যায়। তা নাহলে ঠায় বসে থাকতে হবে। নানা ধরণের যানবাহন এসে ক্রসিং পয়েন্টে রাস্তা ক্রস করবে, ইউটার্ন নেবে, এমনকি উল্টো দিক চালিয়ে আসবে।

ঢাকার গাড়ির আরোহীরা খেয়াল করলে দেখবেন, আপনি যে গাড়িতে উঠেছেন তার চালক এমন ভাব দেখায় যে, সে একাই আইন মানে, আর কেউ মানে না। অথচ দেখবেন, সে নিজেও আইন ভাঙে। অতএব কে কখন আইন ভাঙে তার নিশ্চয়তা নেই। নিশ্চয়তা না থাকায় যে দুর্বল, তাকে চৌদ্দ হাত দূর দিয়ে চলতে হয়। কিন্তু কোনো কোনো চালক আছে ওই নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার কথা না ভেবে প্রতিপক্ষ চালক আইন মানবে এমন ভেবে গাড়ি চালিয়ে যায়। তখন অতিরিক্ত সাবধানতা গ্রহণ না করার ফলে নিজে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

ঘটনা একটা ঘটে গেলে তারা মালিককে বা আরোহীকে বুঝায়, দেখেন আমি তো ঠিক জায়গায় ছিলাম, ওই গাড়ির চালক অন্যায়ভাবে আমাকে এসে ধাক্কা দিল। তখন চীৎকার, চেচামেচি, জনসমাগম হবে। তাতে কে হারবে, কে জিতবে তা আইন দেখে নির্ধারিত হবে না; তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত জনতা যার পক্ষে বেশি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ অফিসার যার পক্ষে, ক্ষতিপূরণ পাওয়া তার পক্ষে যাবে।

মানুষের আচার-ব্যবহার ডাঙ্গায় এক, আর নদীতে আরেক, তা তো হতে পারে না! শীতলক্ষা নদী আবার ঢাকার একেবারে কাছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখলে যে কারো হৃদয় ব্যথিত না হয়ে পারবে না। কেমন করে ২০ মার্চ দুপুরে কয়লাঘাট এলাকায় রূপসী-৯ নামের একটা বিশালাকৃতির মালবাহী কার্গো জাহাজ ছোট সাইজের এম এল আফসার উদ্দিন লঞ্চটিকে চেপেঠেসে ডুবিয়ে দিলো! ডুবিয়ে দিয়ে একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ডুবন্তপ্রায় যাত্রীদের উদ্ধার করা দূরে থাকুক, শেষ পরিণতিটাও দাঁড়িয়ে দেখলো না!

এখানে কয়েকটা প্রশ্ন জাগে– ডুবে যাওয়া লঞ্চের চালক কি ভেবেছিল যে ঘাতক জাহাজের মাস্টার কড়াকড়ি আইন মেনে তার জাহাজ চালাবে, তাই লঞ্চের নিজের একটু সমীহ করে দূরে সরে যাওয়ার দরকার নেই? অন্যদিকে ঘাতক জাহাজের চালক কি ভেবেছিল, এত ছোট জলযান, তোর এত সাহস কাছে আসিস, চল্লিশ হাত দূরে থাকতে পারিস না! কিন্তু দুই চালকের কেউই ভাবলো না, লঞ্চে আছে মানুষ, যাদের মূল্যবান প্রাণ দশবিশটি জাহাজের মূল্য দিয়ে পূরণ করা যাবে না? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিতেই পারে। সড়কে আর নদীতে বছর-বছর যেভাবে প্রাণহানি হচ্ছে তা কোনো দেশের যুদ্ধের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। এ যুদ্ধে পরাজয় হচ্ছে মানুষের, আর জয়ী হচ্ছে যন্ত্রদানব কিংবা মানুষের দুর্বিনীত অবহেলা।

(গাজী মিজানুর রহমান– লেখক এবং সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট)       সূএ: মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com