হজ্ব, খনি, যুবরাজ, মরুভূমি এই শব্দগুলো শুনলেই আমরা ধারণা করতে পারি যে সৌদি আরবের কথা বলা হচ্ছে। প্রচলিত আছে সৌদিতে ধুলোয় সোনা আর বাতাসে খনিজ তেলের গন্ধ ছড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যের এই ধনী দেশটি জল ছাড়া কমবেশি সকল প্রাচুর্যে ভরপুর। এদেশে যেমন মাটি খুঁড়লেই জল বের হয় তেমনি সৌদি আরবে মাটি খুঁড়লে বের হয় তেল, গ্যাস, সোনা। আমাদের দেশে সোনার মূল্য যেমন অত্যধিক তেমনি সৌদিতে পানির মূল্য অসম্ভব রকমের বেশি। ভারতের প্রায় ১ দশমিক ৮ কোটির জনবহুল শহর দিল্লিতে একদিন পানি না থাকলে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে আসে। সেখানে ৩০ কোটি মানুষের দেশ সৌদি আরবকে প্রতিটি দিন পোহাতে হয় পানিকেন্দ্রিক ভোগান্তিতে।
পানি এ দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সময়ে। তাইতো ২০১১ সালে তৎকালীন সৌদি শাসক মোহাম্মদ ঘানী স্বীকার করেছিলেন যে সৌদি আরবে সোনার চেয়েও পানি যোগান অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু কথা হলো, সৌদিতে তো মাটির নিচে পানি নেই আবার তাদের দেশে বছরে একদিন থেকে দু’দিন বৃষ্টিপাত হয় আবার যে বৃষ্টি হয় তা ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রবল ঝড়ের বাতাসে মিলিয়ে যায়, তাহলে সৌদিতে জল আসে কোথায় থেকে!
ধারণা করা হয়, সৌদি আরবে প্রাকৃতিক পানির যে উৎস আছে তা আজ থেকে ১১ বছরের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। মরুভূমির দেশ সৌদি আরবের একমাত্র পানির উৎস হলো আরব সাগর। যার পুরোটাই নোনা জল এছাড়া এদেশে কোনো নদী, ঝর্ণা, খাল বা জলাভূমির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তার উপর সৌদি আরব প্রাকৃতিকভাবে একটি বৃষ্টিশুন্য দেশ। প্রতিবেশী দেশ জর্ডান এবং সিরিয়াতে বৃষ্টি হলে সৌদিতে ভৌমজলের স্তর একটু হলেও বাড়ে। অতীতে পানি ব্যবহারের জন্য আরববাসী কুয়ো ব্যবহার করতো। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভৌমজল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণে কুয়োর গভীরতা বাড়ালেও পানির স্তর অব্দি আর পৌঁছানো যায় না। তাহলে কোথা থেকে কীভাবে আসে এই পানি! চলুন তাহলে তারই উত্তর জানিয়ে দেই আপনাদের!
প্রকৃতপক্ষে সৌদি আরব কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের প্রতিদিনের পানি সংগ্রহ করে। তাহলে কি সেই প্রযুক্তি যেগুলো তাদের জলের চাহিদা মেটাচ্ছে!
এক্যুইফার
পানি নিয়ে বহু সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পরে সৌদি আরব সরকার এমন কিছু পরিকল্পনা হাতে নেয় যাতে পুরো দেশের মানুষ জলের সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পায়। এই ব্যাপারে সৌদি সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিলো এক্যুইফারের প্রযুক্তি। ভৌমজলের অভাবে যেমন পানির চাহিদা বাড়ে তেমনি কৃষিক্ষেত্রেও পানির অভাব চূড়ান্ত হয়ে উঠে। সেই কারণেই বিজ্ঞানীরা যে অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেন সেটিই হল এক্যুইফার। এই প্রক্রিয়ায় ভূ-পৃষ্ঠের উপরে অনেক বড় জলাশয়ের মতো গর্ত করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশিত করা হয়।
তবে এটি বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। কিছুক্ষেত্রে ঝুকিপূর্ণ এই কারণে যে, এক্যুইফারের তলানি যদি সমুদ্রের নোনাজলের সন্ধান পায় তাহলে সেটি একদম অব্যবহার্য হয়ে পড়বে। সেই হিসেবে সৌদি সরকার এক্যুইফারের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে অনেকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সৌদিতে পানি এবং কৃষি সংক্রান্ত বিষয় তদারকি করে পানি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। ১৯৭০ সালে এই এক্যুইফারের উপরে সরকার গবেষণা শুরু করে। অতঃপর সারা দেশের জন্য প্রায় এক হাজারটি এক্যুইফার তৈরি করা হয়। পাশাপাশি এই প্রযুক্তির সাথে অন্যান্য প্রযুক্তি নিয়েও গবেষণা শুরু হয়।
নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়া
সৌদি আরবের পানির সমস্যার প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে এই প্রক্রিয়াটি। আগেই জানলাম সৌদিতে পুকুর, হৃদ, কিংবা নদী নেই আর বছরে যে দু’বার বৃষ্টিপাত হয় তাও সেটি কোনো কাজে লাগে না। অপরদিকে, আরব সাগরের নোনাজল যেমন পানীয় জলের জন্য বিষস্বরূপ তেমনি কৃষিকাজের জন্যও অনুপযুক্ত। আরব সাগর থাকার পরেও সেটি কোনোভাবে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার এক অসাধারণ প্রক্রিয়া বের করেছে সৌদি সরকার যেটির নাম নীর্লবণীকরণ। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষারীয় নোনাজল থেকে ক্ষার নিষ্কাশন করে তাকে পানযোগ্য করে তোলা হয়। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সৌদি আরব হলো নীর্লবণীকরণ পানির সবচেয়ে বড় উৎস।
স্যালাইন ওয়াটার কনভার্সন কর্পোরেশন(এসডব্লিউসিসি) নীর্লবণীকরণের ২৭ টি স্টেশনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসডব্লিউসিসি এর সহায়তায় প্রতিদিন প্রায় ৩ মিলিয়ন কিউবিক মিটার নোনা জল পানি হিসেবে রুপান্তরিত হয়। এই কারণেই সৌদি আরবে শিল্প, ব্যবসায় পানির যোগান দেয়া সম্ভব হয়। এছাড়াও এদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় কাজে আরব সাগরের নোনা জলের প্রয়োজন হয়। আই ডি এ (ইন্টারন্যাশনাল ডিস্যালিনেশন এসোসিয়েশন) এর মতে, ৩০ কোটির সৌদিতে একমাত্র এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জলের যোগান দেয়া সম্ভব। যদিও এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল তবুও এই দেশের মানুষদের নীর্লবণীকরন পাওয়ার প্ল্যান্টের উপর নির্ভর করতে হয়।
আর এই প্রক্রিয়ায় যে কার্বন নিঃসরণ হয় তা জ্বালানি প্রস্তুতকরণে ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানীরা যদিও দাবি করে এতে পানির চাহিদা মিটলেও জলীয় বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে জলে বসবাসকারী অসংখ্য ছোট, বড় প্রাণীর মৃত্যুর মাধ্যমে। তবে এসব ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি তা হলো আর্থিক ব্যয়। সমুদ্রের নোনা জলকে মিষ্টি জলে রুপান্তর করা অসম্ভব ব্যয়সাপেক্ষ।
প্রতি একর ফুট নোনা জলকে মিষ্টি জলে রুপান্তর করতে খরচ হয় হাজার ডলার বা প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশী টাকা। যেখানে সাধারন পানি পরিশুদ্ধ করতে খরচ হয় মাত্র ১৬ হাজার টাকা। আর্থিক ব্যাপারটি মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছে, কীভাবে এই নীর্লবণীকরণ প্রক্রিয়ার খরচ কমিয়ে সাধ্যের মধ্যে রাখা যায়। এই যুগান্তকারী প্রক্রিয়ায় উদ্ভুত পানির ৭০ শতাংশই ব্যয় করে সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার যেখানে উত্তর আফ্রিকা মাত্র ৬ শতাংশ জল ব্যবহার করে থাকে।
পানির জন্য সৌদি আরব কত খরচ করে
অবাক করার মতো হলেও সত্যি, সৌদি আরব খনিজ তেলের ব্যবসা করে যতটা আয় করে তার একটা বিরাট অংশ তাদের খরচ করতে হয় নোনা জলকে মিষ্টি জলে পরিণত করতে। সৌদি সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর তাদের পানির খরচ ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই হিসেবে আগামী ১০ বছরে তাদের পানির জন্য খরচ হবে ১৩৩ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব তার জিডিপির ২ শতাংশ জলের পরিপ্রেক্ষিতে খরচ করে। সেই হিসেবে ২০৫০ সালের মধ্যে মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জিডিপির কমপক্ষে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ জলের চাহিদায় খরচ করতে হবে।
সূএ:ডেইলি বাংলাদেশ ডটকম