ছবি সংগৃহীত
মোফাজ্জল করিম :এবার প্রকাশ্য দিবালোকে প্রহূত হলেন এক নারী চিকিৎসক। ঘটনাটি ঘটেছে এক জেলা শহরে। কুষ্টিয়ায়। যে শহরের সঙ্গে আমার নাড়ির বন্ধন না থাকলেও অন্তরের টান আছে। স্বাধীনতার পরে পরেই যখন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছিল, তখন ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র দুই দিনের নোটিশে আমাকে সচিবালয়ের নিরাপদ কর্মস্থল থেকে ছুটে যেতে হয়েছিল (বৃহত্তর) কুষ্টিয়ায় জেলা প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে।
এর আগে ষাটের দশকের শেষ ভাগে আমার চাকরিজীবনের শুরুতে বছর দেড়েক কেটেছিল পাশের পাবনা জেলায় শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনার হিসেবে। আর পাশের আরেক জেলা বগুড়া তো ছিল আমার কৈশোরের লীলাভূমি। ১৯৫০-৫৪ সালে বগুড়া জিলা স্কুল, খেলার মাঠ আর ঈদগাহ লেনে আমাদের বাসা—সবই যেন মনে হয় বিধাতা সৃষ্টি করেছিলেন আমাকে, কেবলই আমাকে, পেলে-পুষে, আনন্দ-হিল্লোলের ভেতর বড় করে তোলার জন্য।
আর তার আগে কুসুম ফোটার কালের ঘুম ঘুম মৌলভীবাজার শহরই বা কম ছিল কিসে। কিন্তু কুষ্টিয়া? সে ছিল এক অজ্ঞাতকুলশীল জনপদের নাম। তবে কোনো বদনাম ছিল না এই ক্ষুদ্র অথচ লালনসমৃদ্ধ জেলাটির। ’৭৪ সালে কুষ্টিয়ায় গিয়ে আমার মনে হলো, মাইনাস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, কুষ্টিয়া আসলে একটি চমৎকার জেলা, তার মানুষজন সোজা-সরল, আউল-বাউল—সবাই যেন গুরু লালনের শিষ্য।
তা সত্তরের দশকের উৎপাত এখন আর নেই। কুষ্টিয়া অনেক আগেই ফিরে পেয়েছে তার শান্ত সমাহিত রূপ। কিন্তু সেই কুষ্টিয়া যদি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় নারী চিকিৎসক নির্যাতনের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য, তখন কেমন লাগে বলুন তো? সুকবি, গীতিকার প্রয়াত অধ্যাপক, আমার বিশিষ্ট বন্ধু আবু জাফর না হয় চলে গেছেন অনন্তলোকে, কিন্তু লালনসম্রাজ্ঞী কুষ্টিয়ার মেয়ে ফরিদা পারভীন তো আছেন। তাহলে কি ফরিদাকে তাঁর দলবল নিয়ে কুষ্টিয়ায় যেতে হবে গানে গানে এটা বলার জন্য : হে আমার পড়শীরা, সত্তরের দশকের সন্ত্রাসী মন্টু, তার ভাই নান্টু প্রমুখ তোমাদের আদর্শ হতে পারে না, তোমাদের আমাদের সকলের আদর্শ বাবা লালন শাহ।
বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞেস করো বাউল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর আনোয়ারুল করীমকে। তিনি তো কুষ্টিয়ার মানুষ। আর এই লেখক এককালে কুষ্টিয়ার একজন সামান্য সেবক হিসেবে এটুকু বলতে পারে নারী নির্যাতন, নারী চিকিৎসককে প্রহার ইত্যাদি কুষ্টিয়া নামটির সঙ্গে যায় না। এ ধরনের ন্যক্কারজনক একটি ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবেই তো কুষ্টিয়াবাসীদের, বিশেষ করে ওই জেলার সুধীজনদের ফুঁসে ওঠার কথা ছিল, মিটিং-মিছিল করে দুষ্কৃতকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করা উচিত ছিল। কিন্তু কই, কোনো প্রতিক্রিয়াই তো দেখা গেল না কোথাও, ভাবটা যেন, এটা তো হতেই পারে, এ আর এমন কি ঘটনা। আর প্রতিক্রিয়া যদি জানাতেই হয়, তাহলে চিকিৎসকসমাজ জানাক না, ব্যবস্থা নিক স্থানীয় প্রশাসন।
যে জাতীয় দৈনিকের কুষ্টিয়ার নিজস্ব প্রতিবেদক সংবাদটি পরিবেশন করেছেন তাঁর মারফত জানা গেল, শারমিন সুলতানা নামের এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ‘প্রতারণার অভিযোগে’ একদল নারী টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে বেধড়ক মারধর করেন। ওই নারী চিকিৎসকের স্বামী ডা. মাসুদ রানাও নাকি স্ত্রীকে উদ্ধার করতে গিয়ে মার খেয়েছেন। তারপর তাঁরা থানা পুলিশ ইত্যাদি করেছেন। থানার ওসি নাকি আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। স্থানীয় চিকিৎসকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি’ জানিয়েছেন। অন্যথায় তাঁরা ‘বৃহত্তর ও কঠোর’ কর্মসূচি দেবেন বলেও হুঁশিয়ার করেছেন।
এরপর কী ঘটেছে আমরা জানি না। হয়তো থানা পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা শুধু আশা করব, বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা নিশ্চয়ই দেখতে চাই না চিকিৎসকরা তাঁদের ঘোষিত কর্মসূচি দিয়ে হাসপাতালগুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করুন।
যে অভিযোগে ডা. শারমিন সুলতানাকে মারধর করা হলো, তা কিন্তু অভিনব। সচরাচর দেখা যায়, তথাকথিত ভুল চিকিৎসাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু, কর্তব্যে অবহেলা, রোগী বা তার সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট কারো দুর্ব্যবহার ইত্যাদি কারণে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও কখনো কখনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। কুষ্টিয়ার আলোচ্য ঘটনায় ডা. শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি চেম্বারে আগত রোগীদের বিদেশে পাঠাবেন, চাকরি দেবেন ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আদায় করতেন।
এসব কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বা থানা পুলিশ কারো কাছে কোনো অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। সে যা-ই হোক, এসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা তদন্ত করলেই জানা যাবে। আমাদের কথা হলো এসব কারণে বা এর চেয়ে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও অভিযুক্ত চিকিৎসককে, তিনি নারী হোন বা পুরুষ—নির্যাতন বা প্রহারের শিকার হতে হবে কেন? এবং এটা আজ হঠাৎ যে ঘটল তা নয়, প্রায়ই ডাক্তার, নার্স বা হাসপাতালের অন্য কোনো স্টাফকে নানা অজুহাতে বহিরাগতদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়। এটা কী ধরনের কালচার? এ কেমন অসভ্য দেশে বাস করছি আমরা? একজন ডাক্তার কি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর রোগীকে মেরে ফেলবেন? রোগীর মৃত্যু হলে তো তাঁরই ক্ষতি। তাঁকে লোকে বলবে মূর্খ, অদক্ষ। রোগী বেশি মারা গেলে তো তাঁর চেম্বারে নতুন রোগী আসা বন্ধ হয়ে যাবে। লালবাতি জ্বলবে তাঁর প্র্যাকটিসে।
আমাদের শতকরা ৯০ জন মুসলমান অধিবাসীর বাংলাদেশে আমাদের ঈমান-আকিদা কি আমরা ভুলে গেছি? আমরা কি জন্মের পর থেকে বিশ্বাস করে আসছি না হায়াত, মউত, রিজিক—এই তিনটাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হাতে। তিনি গরিব-ভিখারির সদ্যোভূমিষ্ঠ সন্তানকে সারা জীবন দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যেও এক শ বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, আবার একটি হাঁচি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ডজন ডাক্তার-কবিরাজ ছুটে আসেন যে রাজপুত্রের জন্য, তাকে হয়তো শৈশব-কৈশোরেই তুলে নিতে পারেন এই সসাগরা ধরিত্রী থেকে। তাহলে বেচারা চিকিৎসক যে তাঁর অধীত সব বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন রোগীর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত, তাঁকে কেন শূলে চড়াতে হবে ‘মানুষ মরণশীল’ জানার পরও? উন্নত বিশ্বে পাবলিকের এহেন অদ্ভুত আচরণ কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাহলে কি আমরা আফ্রিকার জঙ্গলের সভ্যতাবর্জিত মানুষের সগোত্র? যদি তা-ই হয়, তাহলে সেই মর্মে ঘোষণা দিয়ে দিন, দেখবেন দুনিয়ার মানুষ আমাদের জন্মের মতো আড়ি দিয়ে দেবে।
ডাক্তার বা শিক্ষক নিগ্রহ-নির্যাতনের ঘটনাকে কর্তৃপক্ষ আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং যেখানে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেখানে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর যাঁরা ডাক্তার বা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ডাক্তার-শিক্ষকরা আমাদের-আপনাদেরই সন্তান। কেউ আপনার ছেলে বা মেয়ে, কেউ ভাতিজা, ভাগিনা বা কেউ ভাতিজি, ভাগিনি। আজ হয়তো আপনার আপনজন কেউ এই পেশায় নেই, কাল যে আসবে না কে জানে। তাকে যদি কেউ ডাক্তার শারমিন সুলতানার মতো…। যাক, আর বললাম না। আল্লাহপাক আপনাকে, আমাকে, আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ।।
সূএ: বাংলাাদেশ প্রতিদিন