সৈয়দ বোরহান কবীর : ১৬ জুলাই, ২০০৭। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির সব শোক যেন বৃষ্টি হয়ে নেমেছে। প্রবল বর্ষণের মধ্যেই ভোর ৬টায় সুধা সদনে প্রবেশ করে যৌথ বাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার দেখিয়ে সুধা সদন থেকে বের করে আনেন। এর আগে সুধা সদনের চারদিকে ছিল রীতিমতো যেন যুদ্ধাবস্থা। ২ সহস্রাধিক পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য বাহিনী ঘিরে রেখেছিল সুধা সদন। পুলিশ, র্যাবসহ যৌথ বাহিনীর প্রায় ৩০ জন সদস্য সুধা সদনে প্রবেশ করেন। শেখ হাসিনা এ সময় ছিলেন অবিচল, ভয়হীন। সকালেই তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে জানতে চান কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে? দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে? যৌথ বাহিনীর অফিসাররা জানান, ১৩ জুন গুলশান থানায় ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী তাঁর বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা এতটুকু বিচলিত না হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে আইনি বিষয়ে কথা বলেন। শেখ হাসিনা গ্রেফতারের সময় কথা বলেছিলেন তৎকালীন আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গেও। নির্ভীক, সাহসী শেখ হাসিনা তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য আনা গাড়িতে ওঠেন। এরপর সুশীল নিয়ন্ত্রিত অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর। সে লড়াইয়ে জয়ী হয়েই শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার শেখ হাসিনার কারণেই শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়।
বিএনপির দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাটের প্রেক্ষাপটে এক-এগারোর সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপর প্রথম দিন থেকেই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তারেক জিয়া একের পর এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেন। নির্বাচনের পরপরই সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর তান্ডব শুরু হয়। তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয়। ১ অক্টোবর ২০০১ থেকে ১০ অক্টোবর ২০০১ বাংলাদেশে ছিল এক বীভৎসতার নারকীয় উৎসব। এরপর হাওয়া ভবন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেই দলীয়করণ করা হয়। বিএনপির সাবেক নেতা বিচারপতি কে এম হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হন, এজন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচন কমিশনকে এক তামাশার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। সেনাবাহিনীকে নিজেদের পক্ষে রাখতে সাতজনকে ডিঙিয়ে মইন উ আহমেদকে করা হয় সেনাপ্রধান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য। বিএনপি যেন চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকে সেজন্য সব আয়োজনই করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে সময় জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। একসময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থান রাজপথকে সহিংস করে তোলে। জনগণের জীবন এক ঘোর অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে নিপতিত হয়। এ সময়ই সুযোগ নেয় সুশীলসমাজ, আন্তর্জাতিক মহল ও গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অনড় অবস্থান। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার উদগ্র মানসিকতার মধ্যেই সুশীলরা দেশের ক্ষমতা দখলের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে। বিএনপির একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার কারণে দেশজুড়ে তখন এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ড. ইয়াজউদ্দিনের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ দেশবাসী। এ রকম এক পরিস্থিতিতে সেনাসমর্থিত সরকারকে স্বাগত জানায় দেশবাসী। মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু শিগগিরই এক-এগারো সরকারের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হতে থাকে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নয় বরং বিরাজনীতিকরণ বাস্তবায়নই ছিল ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই শুরু করে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান। রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিবাজ এটা প্রমাণই যেন এক-এগারো সরকারের মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি শুরু হয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও অভিযান। এসব অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের চরিত্রহনন, তাদের ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়। কয়েকজন সুশীল শুধু সাধু আর বাদবাকি সবাই চোর, দুর্নীতিবাজ- এটি প্রমাণই যেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের প্রধান কাজে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এক-এগারো হঠাৎ করে এক বাস্তবতা ছিল না। এটি ছিল সুশীলসমাজের একটি অংশের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার এক নিখুঁত বাস্তবায়ন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোও। এক-এগারোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থাভাজন এই ব্যক্তিকে সামনে রেখেই নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ড. ইউনূস যেন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হন, এজন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু সুশীলরা দ্রুতই বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক লড়াইয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনোভাবেই তাঁরা পারবে না। বরং শেষ পর্যন্ত এ দেশের জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপরই আস্থা রাখে। এক-এগারো সরকার তাই রাজনীতিহীন এক দেশে কর্তৃত্ব করতে চেয়েছিল। আর সে কারণেই নির্বাচন নয়, তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানেই ছিল তাদের সব মনোযোগ। এক-এগারোর পরিকল্পনায় কিছু লোভী রাজনীতিবিদও যুক্ত হয়েছিলেন। হালুয়া-রুটির আশায় তাঁরাও সুশীলদের পদলেহন শুরু করেন। সুশীলদের ‘রাজনৈতিক সংস্কার’ ফরমুলা আসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভ্রষ্ট, ভীরু রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেই। এ রাজনৈতিক সংস্কার ফরমুলায় দুই নেত্রীকে ‘মাইনাস’ করার প্রস্তাব রাখা হয়। দুটি প্রভাবশালী বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ‘মাইনাস ফরমুলার’ আবিষ্কারক। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন একজন। শেখ হাসিনা। এক-এগারোর আসল উদ্দেশ্য তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন। এ কারণে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ স্মরণ করিয়ে দেন। ২০০৭ সালের ২৩ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্রুত নির্বাচন আয়োজন এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা শুনতে হয় তাঁকে। বেশ কজন হেভিওয়েট নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। কারা সেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরোধিতা করেছিলেন। কারা দলে গণতন্ত্রায়ণের ফতোয়া দিয়ে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সবাই চেনে। নতুন করে নাম উচ্চারণ করে তাঁদের লজ্জা দিতে চাই না। স্রোতের বিপরীতে লড়াই করেই শেখ হাসিনা আজকের জায়গায় এসেছেন। তাই দ্রুত নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাড়াবাড়ির সমালোচনা তিনি অব্যাহত রাখেন। সুশীলরা বুঝতে পারেন দীর্ঘ মেয়াদে তাঁদের ক্ষমতায় থাকার একমাত্র বাধা শেখ হাসিনা। সুশীলদের প্রভু আন্তর্জাতিক মুরুব্বিরাও বুঝতে পারে, শেখ হাসিনাকে সরাতে না পারলে কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে না। এ কারণেই শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। পুত্র ও কন্যাকে দেখতে ১৫ মার্চ, ২০০৭ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তাঁর বিদেশযাত্রার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গীতা পাসি ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জানিয়েছিলেন এক মাসের মধ্যে তিনি দেশে ফিরবেন। ২৩ এপ্রিল তাঁর দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এটি ছিল একজন নাগরিকের মানবাধিকারের ওপর সবচেয়ে ঘৃণ্য হস্তক্ষেপ। কোনো বিচারেই একজন নাগরিককে তাঁর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না। ২০০৭-এর ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এক বিস্ময়কর প্রেসনোট জারি করে। ওই প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, ‘তাঁর দেশে ফিরে আসা দেশের আইনশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, জননিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’ কিন্তু শেখ হাসিনা সব সময়ই সাহসী। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই তিনি টিকে আছেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২৩ এপ্রিল ঢাকায় ফেরার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। ১৯ এপ্রিল লন্ডনে আসেন তিনি। এরপর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরতে চাইলে হিথরো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁকে বোর্ডিং পাস দেননি। এটি ছিল সুশীল সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনায় গোটা দেশের জনমত আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে চলে যায়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নতুন মেরুকরণ ঘটে। তীব্র সমালোচনার মুখে ২৬ এপ্রিল পিছু হটতে বাধ্য হয় মইন উ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দীনের সরকার। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় পান বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিমানবন্দরে লাখো মানুষের উপস্থিতি শেখ হাসিনাকে দেয় নতুন শক্তি, সাহস। কিন্তু সুশীলরা তখনো মাইনাস ফরমুলায় অটল। তাঁদের টার্গেট হয়ে যান শুধু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তাঁরা বুঝতে পারেন, শেখ হাসিনা থাকলে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্যই নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাঁরা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হতে থাকে। বোঝাই যাচ্ছিল শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এজন্য তিনি তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় বার্তাগুলো দিতে থাকেন। ঢালাও গ্রেফতার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রহননের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করতে থাকেন অব্যাহতভাবে। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ২০০৭-এর এই দিনে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি ছিলেন গণতন্ত্র আর মুক্তির প্রতীক। তাঁকে গ্রেফতার করে আসলে গণতন্ত্রকেই বন্দি করেছিল অনির্বাচিত সরকার।
এক-এগারোয় প্রবল চার প্রতিপক্ষের সঙ্গে একাই লড়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল এ দেশের সুশীলসমাজের একটি অংশ। যাঁদের ক্ষমতায় বসার খায়েশ যেন প্রায় চিরস্থায়ী এক রোগ। এঁরা সব সময় অনির্বাচিত শাসন চান। গণতন্ত্রে এঁদের প্রবল অরুচি। দেশে সব অবৈধ, অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনে এঁরা ‘উপদেষ্টা’ হয়ে ভাড়া খেটেছেন। এক-এগারোয় এই সুশীলরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাঁরা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে হটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ১৬ জুলাই তাঁরা চূড়ান্ত আঘাত হানেন। শুধু এক-এগারোয় নয়, শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভ্রষ্ট সুশীল ও ভ- জ্ঞানপাপীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এখনো করছেন।
এক-এগারোয় শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রতিপক্ষ ছিল আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহল। যারা বাংলাদেশকে একটি অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। বাংলাদেশ ওই সব দেশের কথায় উঠবে-বসবে। তাদের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। এ প্রভাবশালী মহল তাদের পোষা সুশীলদের দিয়ে একটি চিরস্থায়ী শাসনব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন জাতির পিতা। লড়াইটা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর কন্যা। বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর করার লড়াইটা আসলে পশ্চিমা প্রভুত্বের বিরুদ্ধেই লড়াই।
২০০৭-এ শেখ হাসিনার তৃতীয় প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁর দলের কিছু বিভ্রান্ত নেতা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গোটা তৃণমূল, মাঠের কর্মীরা ছিলেন দলের সভানেত্রীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু লোভে পড়ে বা পথভ্রষ্ট হয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁরা আসলে রাজনীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার চতুর্থ প্রতিপক্ষ ছিল প্রভাবশালী গণমাধ্যম। যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে লিপ্ত ছিল। এ প্রভাবশালী গণমাধ্যমই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এরা চিন্তার দিক থেকেই বিরাজনীতিকরণকে লালন করে।
আজ ১৫ বছর পর আমরা যদি ফিরে দেখি তাহলে প্রশ্নটা উঠতেই পারে। ১৬ জুলাইর লড়াইটা কি শেষ হয়েছে? আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তার পরও কি ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়েছে? শেখ হাসিনা কি নিরাপদ? ঝুঁকিমুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তরে আজকের চারপাশ একটু খতিয়ে দেখা জরুরি। এক-এগারোর সময় যে চার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখনো চলছে। এক-এগারোর সুশীলরা আগের চেয়ে সক্রিয়। প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা মাতম তুলছে। গণতন্ত্র নিয়ে তাঁদের আর্তনাদ দেখলে ভিরমি খেতে হয়। সুশাসন, মানবাধিকার, নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এসব ইস্যু নিয়ে সুশীলরা বিনিদ্র রজনি কাটাচ্ছেন। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধ করাই সুশীলদের এখন একমাত্র কাজ।
এক-এগারোয় সক্রিয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় কোনো রাখঢাক নেই। যত ভাবে পারে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। অথচ নিজেদের দেশের কী হাল তা যদি দেখত। প্রধানমন্ত্রীও মার্কিন নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এক-এগারোর মতোই সরব-সক্রিয়।
এ কথা ঠিক, এক-এগারো আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা দিয়েছে। এক-এগারোয় বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই তাঁকে দলে এবং দেশে অবিসংবাদিত নেতা বানিয়েছে। তৃণমূলে শেখ হাসিনাই শেষ কথা। তার পরও দলে যে নব্য মোশতাক নেই তা কী করে বলব। আপাত-নিষ্ক্রিয় কিন্তু যে কোনো সময় ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগের নব্য মোশতাকরা।
এক-এগারোর চেয়েও সক্রিয় এখন মাইনাস ফরমুলার প্রবক্তা গণমাধ্যমগুলো। কথায় কথায় বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানানো। কিছু লোডশেডিংয়ে আহাজারি করা। অর্থনীতি নিয়ে ভয়ংকর পূর্বাভাস দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এক নতুন মিশন এখন দৃশ্যমান।
সবচেয়ে বড় কথা, শেখ হাসিনা ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর কিছু নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, প্রয়াত সাহারা খাতুনের মতো কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনার পাশে। এখন কি দাঁড়ানোর মতো মানুষ পাওয়া যাবে? এক-এগারো আসলে এক প্রতীক। ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে অনির্বাচিত সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল। এক-এগারোর শক্তি সে সময়ই পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হয়নি। এখন এক-এগারোর শক্তি নতুন করে সক্রিয় হচ্ছে। ষড়যন্ত্র চলছে এখনো।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
[email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন