বিষ্ণু সরকার:
অত্রির জীবনটা পাল্টে গেল। হঠাৎ করেই।
যতদূর মনে পড়ে অত্রিকে প্রথম দেখেছিলাম কলেজস্ট্রিটে। একটা ছোট্ট বইয়ের দোকানে। সেদিন কি একটা কাজে আমি কলেজস্ট্রিটে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই ওর সঙ্গে দেখা।
অত্রির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যে খুব গভীর তা নয়। হয়তো আর পাঁচটা বন্ধুদের মতই। কিন্তু তবুও অত্রির মুখটা আমার ভীষণ চেনা ছিল। আসলে অত্রির মুখটা খুবই কমন। যে কেউ দেখলেই বলবে, ‘আরে তোকে আগে কোথায় যেন দেখেছি বলতো ?’ অথচ কিছুতেই মনে পড়বে না অত্রিকে আগে কোথায় দেখেছি।
অত্রিই ডাক দিয়েছিল। ‘আরে, পলাশদা না, কেমন আছো ?’
আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘এই তো ভালো। তুই কেমন আছিস, অত্রি?’
প্রায় জোর করেই সেদিন অত্রি আমাকে কফিহাউসে নিয়ে গিয়েছিল।কফি-স্ন্যাক্স খেতে খেতে আমার সঙ্গে প্রবল আড্ডায় ডুবে যাচ্ছিল।
অথচ কে বলবে এটা আমাদের প্রথম আলাপ।সেদিন যারা আমাদের দুজনকে কফিহাউসের টেবিলে বসে কফি-স্ন্যাক্স খেতে দেখেছিল, আমি নিশ্চিত তারা প্রত্যেকেই ভেবেছিল আমরা নিশ্চই খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড।
অবশ্য অত্রির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অল্প দিনেই গাঢ় হল। কিভাবে হয়ে গেল ঠিক বলতে পারব না। তবে মনে হত অত্রির মধ্যে এক জাদু আছে। যে জাদুগুণে সে আমাকে ওর দিকে টেনেছিল।
অত্রির আরও কিছু ক্ষমতা ছিল। মানুষকে মুগধ করার ক্ষমতা। আসলে অত্রি এরকমই। ওর মুখটা সুখ-দুঃখে সবসময় হাসিমাখা। আর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল।ওর চোখে চোখ পড়লেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠতো। কি এক রহস্যময় ওর চোখ। যেন মরা মানুষকেও জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে !
অত্রিকে দেখে সেদিন আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম।কত পাল্টে গেছে অত্রি ! কত পরিণত। কত স্মার্ট। অনর্গল বকে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে নিজেই টেবিল চাপড়াচ্ছে। আবার কখনও কখনও তুড়ি মেরে খিলখিল করে হেসে উঠছে। কফিহাউসের ঝোলানো পাখাগুলোয় ধাক্কা খেয়ে সে হাসি যেন চারদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে।
তারপর যতবার অত্রির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও ততবারই আমাকে কোনও না কোনও নতুন জায়গায় নিয়ে গেছে। অল্পদিনেই আমরা একসঙ্গে ঘুরে ফেলেছি চিড়িয়াখানা, ভিক্টরিয়া, রবীন্দ্রসদন, গঙ্গার পাড়।
রবীন্দ্রসদনে প্রায়দিনই অত্রিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতাম। একসঙ্গে পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখতাম। আলো-ছায়ায় কিভাবে রঙিন জীবন ফুটে উঠত আমাদের চোখের সামনে। সে-সব দেখতে দেখতেই অত্রি আমার হাত চেপে ধরত। কাঁধে মাথা রাখত।ওর নরম শরীর থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসত আমার নাকে।আমি পুরোটা সময় জুড়ে সেই গন্ধ উপভোগ করতাম।
মনে হত এই অত্রিকে আমি বহুদিন ধরে চিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই। মনে হত বালিগঞ্জে এক বিয়ে বাড়িতে আমি এই অত্রিকে দেখেছিলাম। ছোট্ট মিষ্টি একটা মেয়ে। সবে মুখে কথা ফুটেছে।বড়রা সবাই ওর গাল টিপছে আর নাম জিজ্ঞাসা করছে। মেয়েটা হাসিমুখে সবাইকে নিজের নাম বলছে। মনে হত মেয়েটি খুব চঞ্চল ছিল। বিয়ে বাড়ির এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছিল।যেন গোটা বিয়ে বাড়িটাকেই ব্যস্ততায় ভরিয়ে দিচ্ছিল।হৈ-হুল্লোড়-হাসিতে ভরিয়ে তুলছিল গোটা আসর।
মনে হত সেই অত্রি, বিয়ে বাড়ির ভিড়ের মধ্যে থেকে ওর চেয়ে বয়সে সামান্য বড় একটা ছেলে বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিল। ভিড় ঠেলে তার কাছে গিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘কি নাম গো তোমার ?’
লাজুক ছেলেটি উত্তর দিয়েছিল, ‘পলাশ’।
মেয়েটি ফের জানতে চেয়েছিল, ‘তোমার বাড়ি কোথায় ?’
ছেলেটি উত্তর দিয়েছিল, ‘হৃদয়পুর’।
মেয়েটি মিষ্টি হাসি দিয়ে ছেলেটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমার বন্ধু হবে পলাশ ?’
ছেলেটি হাত বাড়িয়েছিল।
তারপর মেয়েটি বলেছিল, ‘চলো, তাহলে একসঙ্গে খেলা করি।’
সেদিন বিয়ে বাড়ি জুড়ে প্রবল বৃষ্টি নেমেছিল।বৃষ্টির জলে ভিজে গিয়েছিল চারপাশের সমস্ত গাছপালা, আকাশ-বাতাস।দূরে শোনা যাচ্ছিল ব্যাঙের ডাক।
তারপর বহুদিন অত্রির সঙ্গে দেখা নেই।পলাশ খুঁজেছিল অত্রিকে, কিন্তু পায়নি। পাবে কিভাবে।মেয়েটা তো নাম-ঠিকানা কিছুই জানায়নি।
একদিন দমদম স্টেশনে একটা মেয়েকে দেখে চমকে গিয়েছিল পলাশ। ঠিক যেন অত্রির মত দু-চোখ। মেয়েটা লেডিস কামরায় উঠেছিল। আর ভিড় ঠেলে পলাশ জেনারেলে। বিরাটিতে নেমে গিয়েছিল মেয়েটা।চলে যেতে যেতে বারবার ঘুরে দেখছিল পলাশকে।পলাশও জানলা দিয়ে চোখ রেখেছিল, ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগ পর্যন্ত।
পলাশের একবার মনে হয়েছিল ট্রেন থেকে নেমে যাই। ছুটে যাই ওর কাছে। আবার মনে হয়েছে, ধুর বোকা।আমি তো অত্রিকে খুঁজছি।অত্রিকেই চাইছি। অন্য কাউকে তো নয় !
আর একদিন বিকেলে উল্টোডাঙা মোড়ে বাসে উঠে চমকে গিয়েছিল পলাশ। ওর ঠিক উল্টোদিকের লেডিস সিটে বসে আছে অত্রি। কানে হেডফোন গোজা। চোখ ঢাকা কালো চশমায়।অত্রির বয়স কত কমে গেছে ! বাস ছুটছে ভিআইপি দিয়ে। জানলার খোলা হাওয়ায় অত্রির মাথার চুল উড়ছে।
দু-বার ডাকব ডাকব করেও ডাকতে পারেনি পলাশ। শুধু অত্রিকে লক্ষ্য করে গেছে। যদি একবার ওর দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু অত্রি একমনে শুধু গান শুনছে।চারপাশে কোন নজর নেই।
বাঙুর ঢোকার আগেই উঠে দাঁড়ায় অত্রি। এগিয়ে যায় দরজার দিকে। বাস থেমে গেলে অত্রির পিছু নেয় পলাশ। অত্রি গড়গড় করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বাঙুর এভিনিউর দিকে। কিছুটা দৌড়েই ওর নাগাল পায় পলাশ। পিছন দিয়ে ডাক দেয়, ‘অত্রি। এই অত্রি।’
মেয়েটা থমকে দাঁড়ায়। পিছন দিকে ফেরে। তারপর পলাশের দিকে অবাক হয়ে তাকায়।
-‘কিরে, সেই থেকে তোকে ডাকছি। আর তুই গডগড করে হেঁটেই যাচ্ছিস ?’
মেয়েটা ফের অবাক হয়। কিছুটা হাতবাকও। -‘সরি, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন ?’
-‘হ্যাঁ, তোকেই তো বলছি।তোকে বলব না তো আর কাকে বলব !’ পলাশের চোখে-মুখে হাসি।
-‘কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না !’
-‘মানে কি, তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি পলাশ…।’
মেয়েটা এবার বিরক্ত হয়। বলে ওঠে, ‘দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার অফিসের তাড়া আছে।চলি।’
অত্রি চলে যায়। পলাশ রাস্তার উপর বোকার মত একা দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, অত্রি ওকে চিনতে পারল না কেন ?
এরও বেশ কিছুদিন পরে রবীন্দ্রসদনে অত্রির সঙ্গে দেখা। যথারীতি অত্রির চোখে-মুখে সেই একইরকম উচ্ছ্বাস।আমাকে দেখে প্রায় জোর করেই টেনে নেয় একপাশে। তারপর কানের কাছে ওর মুখ এনে বলে-‘দারুণ একটা খবর আছে। একদম মন ভালো করা খবর ।’
আমি চমকে উঠি। আমার মনখারাপের খবর কিভাবে পেল অত্রি ?
-‘বুঝেছি।বিশ্বাস হচ্ছে না তো আমায় ? ঠিক আছে, চলো আগে বসি কোথাও।’
আমি বাধ্য ছেলের মত অত্রির পাশে গিয়ে বসি। অবাক হই। এই অত্রিকে যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। কে বলবে এই অত্রি প্রতিদিন লোকাল ট্রেনের ভিড় ঠেলে বাবুদের বাড়ি কাজে যায়। কিংবা বিকেল হলেই সেজেগুজে তৈরি হয় আরও একটা অন্ধকার রাতের জন্য।
-‘এই। কি হল ? কি ভাবছ ?’
অত্রির ডাকে আমার হুস ফেরে। দেখি অত্রি হাতে দু-কাপ চা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
আশ্চর্য ! অত্রি কিভাবে বুঝল ওকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে আমার মাথাটা ধরে আসছিল।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যেন মাথাটা ছাড়ল।
অত্রি এবার আমার বা-হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘মা-বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। ওরা তোমাকে দেখতে চায়। কাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে তোমাকে ডেকেছে। ওদেরকে প্রপোজালটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে।’
অত্রির কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল-এই তো সেই অত্রি, যাকে আমি কিছুতেই হারাতে চাইছিলাম না। সূএ:দা নিউজ এক্সপ্রেস ডটকম