ডা. শুভ প্রসাদ দাস: ফেসবুকে আগে সমসাময়িক অনেক ব্যাপার নিয়ে লেখালেখি করতাম। ইদানীং লেখা হয় না। সব ব্যাপারে বিবৃতি দিতেই হবে এমন কেউ আমি নই। তবে মাঝে মাঝে নিজের অবস্থান নিয়ে খুব চিন্তা করি। একটু নিজের অবস্থান ভালো করবো, একটু অপারেশন শিখবো বলে ঢাকায় থাকা। চারপাশের সমাজ বারবার আঙুল তুলে এটাও দেখায় তোমার বড় ডিগ্রি অর্জন করা উচিত।
আমার একজন গুরু লক্ষণ স্যার একদিন দিল্লির মিরাটে সন্ধ্যায় কনফারেন্স শেষে গল্প করতে করতে বলেছিলেন- তুমি আগে নিজেকে নিয়ে বসো এবং নিজেকে তিনটা প্রশ্ন করো-
১. তোমার জীবনে চাওয়া কতটুকু?
২. সেই চাওয়া অর্জন করতে তোমাকে যে কষ্ট করতে হবে তার জন্য তুমি প্রস্তুত তো?
৩. সেই চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে তুমি তোমার জীবন অসহনীয় করে ফেলছো না তো?
এই তিনটা প্রশ্নের উত্তর নিজেকে নিজে দিয়ে তুমি তোমার জীবন সাজাও। আমি বসেছিলাম। কিন্তু হিসেব মেলে না।
আমার স্বপ্ন একাডেমিশিয়ান হওয়া। পড়াশোনা করা। আমার হাসপাতালে আমি যেই পদে আছি সেটার চেয়েও পড়াশোনা রিলেটেড পদে থাকতে পারলে ভালো লাগত। যেখানে আমি পড়তে পারতাম। কিন্তু হিসেব মেলে না।
আমার চাওয়া ছিল বাবা মাকে নিয়ে একসাথে থাকা। কিন্তু তারা তাদের আজীবনের সঞ্চয় দিয়ে নিজের হাতে করা বাসা থেকে নড়বেন না। এদিকে আমারও আরও কিছুদিন শেখা দরকার। তাই হিসেবে মেলে না।
আমার খুব চাওয়া আমার একটা বড় লাইব্রেরি থাকবে। যেখানে ওয়াল ভরা বই থাকবে। আমি দিনে দুই এক ঘণ্টা সেখানে পড়ব। কিছু শিক্ষনীয় ভিডিও বানাবো, ঘোরাঘুরির ব্লগ করব। একটা ভালো গাড়ি কেনা বা নতুন জমি কেনার শখ আমার নেই। আবার নতুন করে আবার রেসিডেন্ট/ট্রেইনি হতে ভীষণ ভয় করে আমার।
জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি আমি বাজার করার সময় পাই না। বাচ্চার স্কুলে কি পড়ছে না পড়ছে দেখার সময় পাই না। মাসে একটা বেলাও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারি না তাই বন্ধুরাও হারিয়ে গেছে।
এই তো মহসীন সাহেব একা একা থেকে আত্মহত্যা করে মরে গেলেন। আমরাই তো ব্যস্ততায় আমাদের সন্তানদের সময় দিতে পারি না। ওদের নিরাপদ জীবনের জন্য বিদেশ পাঠিয়ে নিজেরা একা থাকি। সুস্থ পারিবারিক পরিবেশের চেয়ে কার সন্তান কত বড় হল, কত ব্যস্ত হলো সেটাই আমাদের গর্বের বিষয়।
অনেকে হয়ত মহসীন সাহেবের মতো সুইসাইড করে মরে যাচ্ছেন না, তবে মনে মনে ঠিকই মরে যাচ্ছেন। তার জন্য সমাজের সাথে সাথে তাদের দায়ও কম না। তারাই নিজেরা সন্তানের সাথে একবেলা বসে ভাত না খেয়ে নিজের সম্পত্তি মেইন্টেইন করেছেন। অন্যের সন্তান কত বড় হলো এই হা হুতাশ করে নিজের সন্তানকে আরও ব্যস্ত করে ফেলেছেন। পাঠিয়ে দিয়েছেন বিদেশে। নিজের ইগো ঝেড়ে না ফেলে একসাথে থাকার ব্যাপারে বারবার নিজের কথাই রেখেছেন।
আমরা সবাই কেন যেন কাউকে বুঝি না। এমনকি নিজের সন্তান বাবা-মাকে বুঝে না, বাবা মা সন্তানকে বুঝে না। এই বোঝাপড়ার ব্যাপারটা ছোটবেলা হতেই তৈরি করতে হয় কি না এটা নিয়েও হয়ত বেশি ভাবি না।
এই সমাজ এরকম একাকী মহসীন সাহেব আরও অনেক তৈরি করছে। আপনার সন্তানের দোষ শুধু না দিয়ে তার সাথে এমন সম্পর্ক তৈরি করুন যাতে আপনার কষ্টের কথা তাকে বুঝাতে পারেন। তার অভিমানের কথা আপনাকে বলতে পারে।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) সূএ:ঢাকাটাইমস