ছবি সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক : সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর লুটের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘দায়িত্ব’ নিলেও দায় নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সবাই কিন্তু জানি। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পরিস্থিতিটা কেমন ছিল, সেটাও সবাই অবগত। পাথর কিন্তু আমরা মন্ত্রণালয়ের বিষয় না। আমি পরিবেশ দেখি বলে পাথরের দায়িত্বটাও নিয়েছি। কিন্তু দায়টা নিতে পারছি না। শুধু দায়িত্ব নিয়েছি।
শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ঢাকার জলাধার পুনরুদ্ধার: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক নগর সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। এ সংলাপের আয়োজন করে ‘নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম’।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সাদা পাথর ইস্যুতে আমি নিজে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে যিনি উপদেষ্টা আছেন, তিনিও তাৎক্ষণিক আমার সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন। পাথর মহালগুলো ইজারার লিস্ট থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
উপদেষ্টাদের পাথর মহাল দেখতে স্পটে যাওয়ার বিষয়টি ব্যতিক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার প্রজন্ম বা পরের প্রজন্মের প্রত্যেকের জাফলংয়ের সঙ্গে একটা স্মৃতি আছে। তো চোখের সামনে তো এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে; কয়েকজন পাথর ব্যবসায়ীর জন্য; এটা তো মেনে নিতে পারি না। সেজন্য আমরা স্পটে গেলাম দুজন উপদেষ্টা। আপনারা কোনোদিন কোনো উপদেষ্টা বা মন্ত্রীকে পাথর দেখতে স্পটে যেতে দেখেছেন বলে মনে হয় না। তারপরও আমরা গেছি।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা ওখান থেকে চলে আসার পর বেশ শক্ত অভিযান শুরু হলো। পাথর কারখানায়; যেখানে পাথর ভাঙা হয়, সেখানে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। সর্বদলীয় ঐক্যের কথা বলেছিলাম আমি। সেটাও আপনারা জানেন। আপনারা সর্বদলীয় ঐক্য খুঁজে তো বেরও করেছেন…। সেজন্য বলি রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি। প্রশাসন তৎপর থাকলেও রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া কাজ এগিয়ে নেওয়া যায় না।
সাদা পাথর উত্তোলন বহু বছর ধরে চলছে উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুধু সাদা পাথর তো নয়, সিলেটের এমন ছয়টি পাথর মহাল থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন কিন্তু চলেছে; বছরের পর বছর লুট হয়েছে। আমিই প্রথম মামলা করেছিলাম ২০০৯ সালে। লুটপাট শুরু হওয়াটা কিন্তু ২০২৫ সালের হঠাৎ কোনো ঘটনা না। এটা কিন্তু এতদিন যাবত চলে এসেছে। কিছু কিছু পত্রিকা লিখেছে। তবে এটিকে খুব গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেনি। এটিই বাস্তবতা।
তিনি আরও বলেন, মামলা-মোকদ্দমা করে এটি বন্ধ করতে পারলাম ২০২০ সালে। সরকার একপর্যায়ে এটা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। এরপরও বিভিন্ন ধরনের চাপ ছিল এটা খুলে দেওয়ার জন্য। এখন আসলো ৫ আগস্ট; ৫ আগস্টের কাঁধে বন্দুক রেখে বলা হলো- ৫ আগস্টের পরই এতসব কিছু হচ্ছে।
পাঁচ বছর ইজারা দিয়ে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হচ্ছে ভোলাগঞ্জে ২৩২ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে, কোনো পত্রিকায় বলা হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকার পাথর। অথচ নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সিলেটের পাথর মহালগুলো ইজারা দিয়ে পাঁচ বছরে (২০১৪-১৯) সরকার ৪০ কোটি টাকা পেয়েছিল। অথচ বলা হচ্ছে, ৫-৮ আগস্টের মধ্যে নাকি সব পাথর লুটপাট করে নিয়েছে। সেগুলোর দাম বলা হচ্ছে ৫০০ কোটি, ৩০০ কোটি, কেউ কেউ বলছে এক হাজার কোটি। ৫ বছরে আপনি রাজস্ব পেলেন ৪০ কোটির মতো। ধরলাম বছরে পেয়েছেন ১০ কোটি টাকা করে। আর তিনদিনে লুটপাট করে নিলো এক হাজার কোটি টাকার পাথর! এতে দেখা যায়, পাথরের প্রকৃত রাজস্ব মূল্য যেটা, সেটা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে লুটেরা গোষ্ঠী তো আমরাই সৃষ্টি করেছি।
সিলেটে চাহিদার ৬ শতাংশ পাথর পাওয়া যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিলেটে একটা সময় একজন ডিসি ছিলেন। তিনি পাথর লুটের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, দেশের মোট পাথরের চাহিদার মাত্র ৬ শতাংশ আসে সিলেট থেকে। বাকি ৯৪ শতাংশ যখন আমরা আমদানি করি। তাহলে এটুকু কেন আমদানি করে রক্ষা করতে পারলাম না? কেন আমি এখানে ট্যুরিজম করতে পারলাম না?
সব অপরাধের বিষয়ে জনগণকে সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সাদা পাথরে আমরা সফল হলাম, যখন জনগণ এটার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কথা বলা শুরু করলো। জনগণের কাছে আমার একটা আবেদন যে, সেটা রাজনৈতিক সরকার বলেন বা আমাদের মতো অন্তর্বর্তী সরকার; জনসমর্থন পেলে সবার পক্ষে কাজ করাটা সুবিধাজনক। যেভাবে সাদা পাথর নিয়ে কথা বলেছেন, সেভাবে যেন বাঁকখালী নদীর দখল নিয়েও কথা বলেন।
বাঁকখালী নদীর উচ্ছেদ অভিযান আবারও শুরু করা হবে জানিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত করতে গেলাম। হঠাৎ আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। পাঁচদিনের অভিযান তিনদিনে শেষ করতে হলো। সেখানে কারও ১০ তলা ভবন ভাঙা পড়বে, কারও চারতলা ভবন ভাঙা হবে বলে মাঠপর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলো। দেখবেন, যখন আমরা উচ্ছেদ বন্ধ করলাম, তখন কারা খুশি হলো? খোঁজটা নেবেন। তার মানে এই নয় যে, বাঁকখালী নদীর উচ্ছেদ থেমে গেছে। আমরা উচ্ছেদ করবো, আবারও অভিযান শুরু হবে।
নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি মতিন আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক দেশ রূপান্তরের সম্পাদক কামাল উদ্দিন সবুজ, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিবেশ ও নগরায়ণ সম্পাদক স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. মু. মুসলেহ উদ্দীন হাসান।অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল্লাহ, ইউএনডিপির প্রোজেক্ট ম্যানেজার ইয়ুগেশ প্রাধানাং, নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সাবেক সভাপতি অমিতোষ পাল, সংগঠনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ হেলিমুল আলম প্রমুখ।