ছবি সংগৃহীত
ডেস্ক রিপোর্ট :বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, সাংবাদিকদের সত্য উদ্ঘাটন, অনুসন্ধান ও প্রকাশে নির্ভীক হতে হবে। অর্ধ সত্য নয়, সত্য ও অসত্যের মিশ্রণও নয়, তাদের প্রকাশ করতে হবে অখণ্ড ও পূর্ণ সত্য।
সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের চাকরির ঝুঁকি, জীবনের ঝুঁকিসহ নানা ঝুঁকি নিতে হয়। সাংবাদিকরা এই ঝুঁকি না নিলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? অসহায় আত্মসমর্পণ সাংবাদিকদের মানায় না। বিগত সরকা রের সময় আমাদের সাংবাদিকদের বিরাট অংশকে আমরা অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখেছি সেলফ সেন্সরশিপের মাধ্যমে। মনে রাখবেন সত্য প্রকাশে বাধা ও বিপদের সম্মুখীন হলেও সমাজের সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
আজ রবিবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিলে তিনি এসব বলেন।
কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বাচ্চুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাব হোসেন, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আল মামুন সাগর, জামায়াত সেক্রেটারি সুজা উদ্দিন জোয়ার্দার, ইসলামি আন্দোলনের আহমদ আলী, বিএফইউজের দফতর সম্পাদক আবু বকর, পিপি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও এড. সাতিল মাহমুদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শামীউল হাসান অপু।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, জীবনে কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যার সঙ্গে আপোস করা চলবে না। তাহলে সাংবাদিকতা হবে না। সত্যের তরে দৈত্যের সাথে লড়াই করাই সাংবাদিকতা। সত্য প্রকাশই হতে হবে গণমাধ্যমের একমাত্র অঙ্গীকার।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে সবচেয়ে জীবন্তু ও আধুনিক পেশা। বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা, সাংবাদিকতা কখনই মূর্খজনের পেশা নয়, পেশা হিসেবেই সাংবাদিকতা বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের পেশা। যে মানুষ অতীতকে ধারণ করে বর্তমানের সঙ্গে তা মিলিয়ে ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে না পারেন, ভাষায়-ব্যাখ্যায়-উপস্থাপনায় যিনি মেধার ছোঁয়া না বুলাতে পারেন, তিনি আর যাই হোন সাংবাদিক হতে পারেন না। কিছু মৌলিক কাঠামোই সাংবাদিকতাকে আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
সাংবাদিকতাকে দাঁড়াতে হয় এই মৌলিক ভিত্তির উপর। একটি সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতাটি যদি নিশ্চিত না থাকে, সমাজটি যদি চিন্তা ও বিবেকের জন্য খোলা প্রান্তর অবারিত করতে না পারে, সেই সমাজে স্বাধীন বা মুক্ত সাংবাদিকতা বিকশিত হতে পারে না। সাহসী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংবাদিকতার ভিতও দৃঢ় হয় না।
তিনি বলেন, আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলি কিন্তু নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার কথা বলি না।আজকাল প্রায়শই সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার বিষয়টি উচ্চারিত হয় জোরেসোরে। সংবাদ মাধ্যমের প্রথাগত দায়িত্বটি মানুষকে তথ্য জানানো, সেই তথ্য জানানোর মধ্য দিয়েই মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা, তথ্য এবং আলোচনার মাধ্যমে বিনোদন দেয়া এবং সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে উদ্দীপ্ত করে তোলা।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে আপনারা জানেন। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে, সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের এক দল সম্পাদক গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। মানিক মিয়া স্মৃতিচারণ করছেন, সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের বন্ধু সাংবাদিক মি. সুলেরী বলছেন: মানিক মিয়া তোমরা পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রে এখন সাংবাদিকতার
চাইতে রাজনীতিটাই বেশি করছো। মানিক মিয়া হেসে জবাব দিয়েছিলেন: সুলেরী, পূর্ববঙ্গে এখনকার যা পরিস্থিতি, যে জন আকাঙ্ক্ষা আমরা তার সাথে মিলিয়েই সাংবাদিকতা করছি। সেই জনআকাঙ্ক্ষার
অনেক দূরে পশ্চিমে বসে তোমরা যা করতে পার আমরা তা পরি না। সাংবাদিকতা যেহেতু জনমানুষের আশ্রয়েই বেঁচে থাকে কাজেই পেশাদারিত্ব বজায় রেখেই নতুন দায়িত্বও মাথায় নিতে হয়।
দায়িত্বশীলতা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার সাথে এমনভাবে ঘনিষ্ঠ যে, সেজন্য পৃথক কোন সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। কারণ সাংবাদিকতা পেশাটিই দায়িত্বশীল পেশা। প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকতা কখনও
‘অ-দায়িত্বশীল’ হতে পারে না। যারা দায়িত্বহীনভাবে সাংবাদিকতা পেশাকে ব্যবহার করেন, তারা আর যাই হোক ‘সাংবাদিক’ নন।
আরেকটি বিষয়ে না বললেই নয়, গণমাধ্যম বা সাংবাদিক কার প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, কার কাছে জবাবদিহি করবে? এই নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সরকার চায় জবাবদিহিতা থাকুক তার কাছে, মালিক চায় তার কাছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংবাদ মাধ্যমের দায়বদ্ধতা সমাজের প্রতি। সমাজের পাঠক বা দর্শকই তো তার ভোক্তা। তারাই মূল্যায়ন করবেন। ভালো লাগলে গ্রহণ করবেন, না হলে প্রত্যাখ্যান করবেন। সেই গণমাধ্যমই টিকে থাকবে, যেটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে যদি সংবাদমাধ্যমটি নৈতিকতার দিক থেকে পরিশীলিত হয়, পেশাদারিত্বের দিক থেকে পরিশীলিত হয়, সত্য প্রকাশে সাহসী- আপসহীন হয়। আবার রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতির গণমাধ্যমের দায়বোধ থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে, কোন স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর বিদ্বেষ ছড়ানো সমার্থক নয়। কোন তথ্য যাচাই না করে তার ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ঘোষণা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নয়। সমাজে ন্যায্যতার পক্ষে গণমাধ্যমকে থাকতে হবে। তবে সমাজকে শিক্ষিত করে তোলাও গণমাধ্যমের দায়িত্ব। শিক্ষিত সমাজই বুঝবে গণমাধ্যমের কাছে কতটা প্রত্যাশা করা সঙ্গত। তাই বলা হয়, শিক্ষিত সমাজে সাংবাদিকরা বেশি নিরাপদ।
মনে রাখবেন, সততা ছাড়া কোন গণমাধ্যম বহু মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে না। বৈশ্বিকভাবেই এখন সংবাদ মাধ্যমের বড় সংকট ‘ফেক নিউজ’। ফেক নিউজ বা অসত্য সংবাদ প্রকাশের প্রবণতা আমেরিকা থেকে শুরু হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল ‘পেইড নিউজ’ দিয়ে। ভারতে নির্বাচনের সময় বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে মিডিয়া কিনে ফেলা হতো। বাংলাদেশে এটি ভয়াবহভাবে দেখা দেয় বিগত সরকারের সময়।
পেশাদারি সাংবাদিকতার জন্য বড় সংকট এটি। প্রশ্ন হলো- সাংবাদিকতা কি টিকে থাকতে পারবে, নাকি ফেক নিউজের স্রোতে ডুবে যাবে। যখন পেইড নিউজ বিতর্কের শুরু হয়, তখন বলা হয়েছিল পেইড রিপোর্টার, পেইড বার্তা সম্পাদক এবং পেইড সম্পাদক সংবাদ মাধ্যমকে ডোবাচ্ছে। কিন্তু যখন খোদ মালিক ‘পেইড’ হলেন তখন আবার ঘুরে দাঁড়ালেন প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকরাই। এই সংকট মোকাবিলায় একমাত্র সমাধান, পেশাদারি সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার মৌলিক শর্তগুলোই সাংবাদিকতাকে রক্ষা করেত পারে। মাত্র কিছুদিন আগে রয়টার্স ফাউন্ডেশন তাদের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তার শিরোনাম দিয়েছে : বায়াস, বুলশিট, লাই। এই জরিপটি চালানো হয়েছিল ইউরোপ ও অমেরিকাজুড়ে। গণমাধ্যম ভোক্তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যমকে কতটা বিশ্বাস করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোক্তা জবাব দিয়েছিলেন, তারা এখন আর সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না। তারা মনে করেন, কারণ যাই হোক সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন হয় কারো পক্ষে লিখে (বায়াস), অথবা তারা আবোল তাবোল কথা লিখে (বুলশিট) অথবা মিথ্যা (লাই) লিখে। এর কিছুদিন পর জানতে চাওয়া হয় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের প্রতি ভোক্তাদের আস্থা কতটুকু? এবারের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বেশির ভাগেরই জবাব, সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা হয় বেকুব (স্টুপিড) না হয় অন্ধ অথবা এরা ঘুষ খায়। ভয়াবহ চিত্র! বাংলাদেশে জরিপ চালানো হলে চিত্র এর চাইতে ভালো হবে মনে হয় না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ একটাই তা হলো ভালো সাংবাদিকতা। কি বিষয়বস্তুতে, কি উপস্থাপনায় ভালো হওয়াই একমাত্র পথ। এ কথায় আস্থা রাখতেই হবে যে, ভালো সাংবাদিকতাই সাংবাদিকতার রক্ষাকবচ।