সময় থাকিতে হও সাবধান

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : মহামান্য হাই কোর্টে আইন পেশারত তিন আইনজীবীর প্রশংসা করেই এ লেখাটি শুরু করছি। এই তিনজনের শুধু একজনকেই চিনি যিনি ব্যারিস্টার আনিক আর হক, যে ১৯৭১ সালে আমার বিলেত প্রবাসী একজন সহমুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাইপো। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিএনপিতে যোগদান করার কারণে তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও ’৭১-এ তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।  অন্য দুজন সম্ভবত নতুন প্রজন্মের আইনজ্ঞ হওয়ায় আমার চেনার কথা নয়, যাদের একজনের নাম পূর্ণিমা জাহান এবং অন্যজন মো. শাহিনুজ্জামান। এদের প্রশংসা করার কারণ তারা একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন করে মহামান্য হাই কোর্ট থেকে এই মর্মে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ পেতে সক্ষম হয়েছেন যে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে নড়াইলের প্রধান বিচারিক হাকিমের নেতৃত্বে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা আবার প্রমাণ করলেন সুপ্রিম কোর্টের হাত অনেক লম্বা।

 

অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির লোকেরা অপদস্থ করার পর, যা ছিল মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলায় জুতার মালা পরানোর শামিল, চারটি প্রশাসনিক পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। একটি ছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষে অন্যটি পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে, তৃতীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শেষটি ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। এর মধ্যে প্রথম দুটি কমিটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা অভিযোগের তীর তাদেরই দিকে এবং তাই প্রথম থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি। তা না হওয়ায় এই মহান দায়িত্বটি মহামান্য হাই কোর্টকেই পালন করতে হলো উল্লিখিত তিনজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক আইনজীবীর প্রার্থনা মতে।

অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে ঘৃণিতভাবে অপদস্থ করা যে কোনো বিক্ষিপ্ত, স্থানীয় ঘটনা নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালের কয়েকটি একই ধরনের অপপ্রয়াস থেকে পরিষ্কার এটি ধর্মান্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ’৭১ এবং ২০১৩ সালের ৫ মে পরাজিত অপশক্তির দীর্ঘ, ঐক্যবদ্ধ এবং সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল যে কথা অধ্যাপক মুনতাসির মামুন অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে অপমান করার পরই বহুলভাবে প্রশংসিত, জ্ঞানগর্ভ এবং গবেষণাভিত্তিক একটি প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন, যে কথা পরবর্তীতে অধ্যাপক মান্নান, সাংবাদিক স্বদেশ রায় এবং আমি নিজেও প্রবন্ধের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়েছি। এর পরপরই আরও যে দুটি হিংসাত্মক ঘটনা ধর্মান্ধরা ঘটাল, তা বলা প্রয়োজন। প্রথমটি ছিল প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক দৃঢ় ব্যক্তি শিক্ষাবিদ রতন সিদ্দিকি এবং তার স্ত্রীকে উত্তরার কতিপয় মাদরাসা শিক্ষক-ছাত্রের আক্রমণ যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেদিন র‌্যাব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে হয়তো সেই ধর্মান্ধ অনুসরদের হাতেই তাদের জীবনের যবনিকাপাত ঘটত। এ জন্য র‌্যাব প্রশংসার দাবিদার যে বিষয়টি মার্কিন কর্তৃপক্ষের নজরে নেওয়া উচিত। এখানে উল্লেখযোগ্য, রতন সিদ্দিকি সাহেব শুধু একজন মুক্তমনা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায়ই নিবেদিত নন, আপসহীন আদর্শবাদ হচ্ছে তার গোটা পরিবারের ঐতিহ্য। তার অনুজ অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকি একজন বিরল প্রজ্ঞাসম্পন্ন আইনজ্ঞ। তার আদর্শবাদ এতই অনড় যে, প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের জীবদ্দশাই তাকে এই পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হলে তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, যেহেতু তার সন্তানগণ অধ্যয়নরত তাই সীমিত বেতনের পদ গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েও তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন, এমনটি বলা হলে অ্যাডভোকেট সিদ্দিকির জবাব ছিল- অ্যাটর্নি জেনারেল হলে তিনি ব্যক্তিগত মামলা করবেন না। আরও উল্লেখ্য যে, সিদ্দিকি ভ্রাতৃদ্বয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মুখ্য কৌঁসুলি, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক সাহেবের আপন ফুপাতো ভাই, অর্থাৎ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাহেবের চাচা, যে কথা তারা কখনো প্রচার করেন না বলে খুব কম লোকই তা জানেন। এ ধরনের এক আদর্শিক দম্পতিকে আক্রমণের উদ্দেশ্য একই সূত্রে গাঁথা, একই ষড়যন্ত্রের অংশ যা হলো দেশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে উচ্ছেদ করে তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। 

গত দুই বছরে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সবগুলো অঘটনই করা হয়েছে সংঘবদ্ধ, উঁচু পর্যায়ের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। ঘটনার এলাকাগুলো ভিন্ন হলেও তাদের ষড়যন্ত্র অভিন্ন এবং একত্রীভূত যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সবগুলো ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ মর্মে গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে, এসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করেছে। এর পর মুহূর্তের মধ্যে শত শত ধর্মান্ধের জমায়েত থেকে পরিষ্কার যে, এলাকা ভিন্ন হলেও তাদের যোগাযোগ সার্বক্ষণিক এবং অবিচ্ছিন্ন, তারা আগে থেকে জেনেশুনে তৈরি থাকে হিন্দু নাগরিক, তাদের মন্দির এবং বাসস্থান আক্রমণের জন্য। সবকটি জায়গায়ই বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ প্রমাণিত। কক্সবাজারের রামুর ঘটনা, নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির, বাড়িঘর ধ্বংস, দুর্গাপূজার সময়ে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি একইভাবে করা হয়েছে মিথ্যা কথা প্রচার করে যে কোনো অমুসলিম তার ফেসবুকে ইসলামবিরোধী কথা ব্যক্ত করেছে, অথবা কোনো হিন্দু দুর্গা দেবীর পায়ে কোরআন রেখে দিয়ে ইসলাম অবমাননা করেছে। অথচ এ সবকটি ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে যে, কিছু ধর্মান্ধ মুসলমানই এগুলো ঘটিয়েছে সম্প্রীতি নস্যাৎ করার জন্য। নাসিরনগরের চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা জেলে মনোরঞ্জন যে ফেসবুক চালাতে অক্ষম এ কথা সেদিন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার সাহেবই লিখেছিলেন, যিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছেন। আমাদের সরেজমিন তদন্তেও তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ভোলায় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সময় স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, এক হিন্দুর ফেসবুক হ্যাক করে এক মুসলমানই এটি প্রচার করেছিল। কুমিল্লায় দুর্গার মূর্তিতে যে ইকবাল নামক এক মুসলমান কোরআন রেখেছিল, সেটি নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত, যে কথা সে ধর্মান্ধ ইকবালও স্বীকার করেছে। সুনামগঞ্জের ঝুমন দাসকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছিল তা সত্যিই হতভম্ব করার মতো। কেননা সে স্বীকৃত মিথ্যাচারী এবং ধর্ষণ মামলার আসামি মামুনুল হকের সম্পর্কে কিছু সত্য কথা প্রকাশ করায় অভিযোগ ওঠে সে নাকি ধর্মবিরোধী কথা বলেছে। একজন ধর্ষণ মামলার আসামির বিরুদ্ধে কিছু বলা যদি ধর্ম বিরোধিতা হয় তাহলে সবকিছুই ওলট-পালট করে দেখতে হবে সর্বশেষ আবিষ্কৃত জেমস ওয়েব নামক দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে। সুনামগঞ্জের জেলা জজের বদৌলতে ঝুমনকে এক বছর কারাবাস করতে হয়েছে, যে কারণে সুনামগঞ্জের সেই জেলা এবং দায়রা জজের নাম সব সময়ই ঘৃণাভরে উচ্চারিত হবে, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদানোর জন্য। পরবর্তীকালে মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশে প্রমাণিত হলো যে, সেই জেলা জজের আদেশটি ছিল অবৈধ। মুন্সীগঞ্জের অধ্যাপক হৃদয় মন্ডলকে গ্রেফতার করা হলো অথচ তিনি এমন কিছুই বলেননি যা ধর্ম অবমাননার সংজ্ঞাভুক্ত। এটা সবাই জানে যে কিছু ছাত্র তাদের কর্তাদের প্ররোচনায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। অধ্যাপক মন্ডলকে গ্রেফতার করা হলো অথচ যারা সেখানে বহুবিদ অপরাধ করল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। তাজরিয়ান শিকদার নামক যে তথাকথিত বিজ্ঞান শিক্ষক দৃশ্যত বহিরাগতদের আইন ভঙ্গ করতে লেলিয়ে দিয়েছিল, আলাউদ্দিন নামক যে তথাকথিত প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে একটি বেআইনি এজাহার করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি। মুন্সীগঞ্জ সফরকালে পুলিশ সুপার এসব বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল সে নিজেও ধর্মান্ধ গোত্রের লোক, কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য মৃণাল বাবু বললেন সেই এসপি ছাত্রলীগ করা মানুষ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল ছাত্রলীগের মানুষটি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজ করলেন? অল্প সময়ের ব্যবধানে ধর্মান্ধরা নড়াইলে দুটি ঘৃণ্য ঘটনা ঘটিয়ে প্রমাণ করল তারা কত সংঘবদ্ধ, সংগঠিত, তাদের অর্থের থলে কত বিশাল এবং তাদের প্রভুরা কত করিৎকর্মা। মুহূর্তের ডাকেই শত শত ধর্মান্ধ একত্রিত, অনেক বহিরাগতসহ। কোনো ইসলাম ধর্মীয় নেতাও বললেন না যে তারা যা করছে তা অন্যায়, অপরাধ এবং ধর্মবিরোধী, যে কথা কয়েক সপ্তাহ আগে পশ্চিমবাংলার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেম বলেছিলেন। যে গুটিকয়েককে গ্রেফতার করা হয়েছে, আক্রমণকারীদের তুলনায় তাদের সংখ্যা নগণ্য। সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে অধ্যক্ষ বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হলো? কীভাবেই বা পরবর্তী ঘটনায় শত শত হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বা কী করছিলেন? এটি অজানা নয় যে, গত কয়েক বছর বহু জামায়াত-বিএনপির লোক আওয়ামী লীগের খোলা দরজা নীতির সুযোগে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এদের সংখ্যা তো সত্যিকার আওয়ামী লীগারদের চেয়ে বেশি নয়। নরসিংদী স্টেশনে এক মহিলাকে মারধর করার ঘটনা প্রমাণ করল জামায়াত-হেফাজতিরা প্রচুর মহিলাকে তাদের দলভুক্ত করেছে।

 

যে কনস্টেবল ড. লতা সমাদ্দারকে হেস্তনেস্ত করল, নির্লজ্জ মিথ্যা কথা বলল, তাকে এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করা হয়নি। সবকিছু বাদ দিলেও যে পুলিশ সদস্য বাইকের পেছনে রাখা বাজারের ব্যাগকে স্ত্রী বলে মিথ্যা বক্তব্য দিতে পারে তাকে পুলিশের চাকরিতে বহাল রাখলে সে যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আরও অনেক জঘন্য অন্যায় করতে পারে, সেটা কি কেউ উপলব্ধি করল না? ধর্মান্ধদের সংখ্যা বেশি নয়। নির্বাচনে এরা ৪% বেশি ভোট পায় না। এরা ’৭১ এবং পরে ২০১৩-এর ৫ মে চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। তারপরও মনে হচ্ছে কেউ কেউ তাদের ভয়ে অকারণে ভীত। ২০১৩-এর ৫ মে তারা দৌড়ে পালিয়েছিল, কিন্তু তারপরও তাদের বহু দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে ছিলেন সে সময়ের মন্ত্রী নাহিদ সাহেব, যার কারণে বহু কোমলমতি ছাত্রছাত্রী সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছে। পরাজিতদের দাবি মানার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।

 

এসব অঘটন যেমন দেশের মানুষ দেখছেন, তেমনি দেখছেন বিদেশিরাও। সাম্প্রতিক বিলেত সফরকালে পূর্বপরিচিত বহু সংসদ সদস্য, লর্ড, অধিকারকর্মী, মূলধারার সাংবাদিক, ব্যারিস্টারদের কাছ থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান এবং হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাসের বিষয়ে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে (আমার জীবনের বড় অংশ বিলেতে কেটেছে বলে পরিচিতজন অনেক)। একদিকে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা অন্যদিকে সত্য প্রকাশ করা এই দুয়ের দ্বন্দ্বে পড়ে অবশেষে সতর্ক জবাব দিয়ে দেশের ভাবমূর্তির পক্ষেই কথা বলেছি। বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে সম্প্রীতি রক্ষায়, ধর্ম ব্যবসায়ীদের পরাজিত করতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। কিন্তু এভাবে শাক দিয়ে কদিন মাছ ঢাকা যাবে।

 

কিছু লোক মনে করছেন নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ধর্মান্ধদের হাতে রাখা প্রয়োজন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, তারা এ সত্যটি অনুধাবন করতে ভুল করছেন যে, এই ধর্মান্ধদের মূল উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে তালেবানি-পাকিস্তানি শাসন প্রতিষ্ঠা, যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেশকে হিন্দুশূন্য করার জন্য প্রলয় তান্ডবে মেতে উঠেছে। সুতরাং তারা আওয়ামী নেতৃত্বের সরকারের পক্ষে থাকবে এটা ভাবা যুক্তির কোনো মাপকাঠিতেই পড়ে না। এসব ধর্মান্ধ মামাবাড়ি আবদারের মতো দাবি তুলেছে মুমিনুল হকসহ সব ধর্মান্ধ আসামিকে মুক্তি দেওয়ার। মুমিনুল হককে মুক্তি দিলে অন্য সব ধর্ষণ মামলার আসামিদেরও মুক্তি না দিলে তা হবে সংবিধান লঙ্ঘন। কেননা সংবিধান বলছে আইনের চোখে সবাই সমান। গত কয়েক বছরে প্রমাণিত হয়েছে বহু ধর্মান্ধ জামায়াত-হেফাজতি পুলিশে, প্রশাসনে এবং এমনকি নিম্ন আদালতেও ঘাঁপটি মেরে আছে। এদের রাহু গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অতীতে যারা তান্ডব সৃষ্টি করেছে তাদের গ্রেফতার করা হলে সম্ভবত নড়াইলের ঘটনা ঘটত না। যে কথাটি বারবার বলতে হচ্ছে তা হলো, আমরা যদি এখনই এই সংখ্যালঘিষ্ঠ, বারবার পরাজিত ধর্মান্ধ অপশক্তিকে না রুখি, তা হলে ভবিষ্যতে এটা আরও কঠিন হবে। যে জন্য জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি লালনের একটি লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন-‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ লেখাটি শুরু করেছিলাম তিনজন মানবতাবাদী বিজ্ঞ আইনজীবীর প্রশংসা করে।  এভাবে যদি সমাজের বিবেকবান বহু মানুষ এগিয়ে আসেন তাহলে ধর্মান্ধ অপশক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। আসুন আমরা এ ব্যাপারে একত্রিত এবং সোচ্চার হয়ে এসব অসুরকে প্রতিরোধ করি সময় থাকা অবস্থায়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডিবির মশিউর সাময়িক বরখাস্ত

» মোটরসাইকেলে চালকসহ দুইজনের বেশি বহন না করার নির্দেশ

» ইসলামী শাসনব্যবস্থা ছাড়া বৈষম্য দূর হবে না : মামুনুল হক

» নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে বিদেশি অংশীজনরা অপেক্ষা করছে : খসরু

» বিস্ফোরক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান

» তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

» রাশিয়ার নতুন ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চলবে: পুতিন

» গুজব প্রতিরোধে সহায়তা চায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

» পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত

» এআই নিয়ে কাজ করবে গ্রামীণফোন ও এরিকসন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সময় থাকিতে হও সাবধান

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : মহামান্য হাই কোর্টে আইন পেশারত তিন আইনজীবীর প্রশংসা করেই এ লেখাটি শুরু করছি। এই তিনজনের শুধু একজনকেই চিনি যিনি ব্যারিস্টার আনিক আর হক, যে ১৯৭১ সালে আমার বিলেত প্রবাসী একজন সহমুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাইপো। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিএনপিতে যোগদান করার কারণে তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও ’৭১-এ তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।  অন্য দুজন সম্ভবত নতুন প্রজন্মের আইনজ্ঞ হওয়ায় আমার চেনার কথা নয়, যাদের একজনের নাম পূর্ণিমা জাহান এবং অন্যজন মো. শাহিনুজ্জামান। এদের প্রশংসা করার কারণ তারা একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন করে মহামান্য হাই কোর্ট থেকে এই মর্মে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ পেতে সক্ষম হয়েছেন যে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে নড়াইলের প্রধান বিচারিক হাকিমের নেতৃত্বে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা আবার প্রমাণ করলেন সুপ্রিম কোর্টের হাত অনেক লম্বা।

 

অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির লোকেরা অপদস্থ করার পর, যা ছিল মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলায় জুতার মালা পরানোর শামিল, চারটি প্রশাসনিক পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। একটি ছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষে অন্যটি পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে, তৃতীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শেষটি ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। এর মধ্যে প্রথম দুটি কমিটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা অভিযোগের তীর তাদেরই দিকে এবং তাই প্রথম থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি। তা না হওয়ায় এই মহান দায়িত্বটি মহামান্য হাই কোর্টকেই পালন করতে হলো উল্লিখিত তিনজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক আইনজীবীর প্রার্থনা মতে।

অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে ঘৃণিতভাবে অপদস্থ করা যে কোনো বিক্ষিপ্ত, স্থানীয় ঘটনা নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালের কয়েকটি একই ধরনের অপপ্রয়াস থেকে পরিষ্কার এটি ধর্মান্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ’৭১ এবং ২০১৩ সালের ৫ মে পরাজিত অপশক্তির দীর্ঘ, ঐক্যবদ্ধ এবং সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল যে কথা অধ্যাপক মুনতাসির মামুন অধ্যক্ষ বিশ্বাসকে অপমান করার পরই বহুলভাবে প্রশংসিত, জ্ঞানগর্ভ এবং গবেষণাভিত্তিক একটি প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন, যে কথা পরবর্তীতে অধ্যাপক মান্নান, সাংবাদিক স্বদেশ রায় এবং আমি নিজেও প্রবন্ধের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়েছি। এর পরপরই আরও যে দুটি হিংসাত্মক ঘটনা ধর্মান্ধরা ঘটাল, তা বলা প্রয়োজন। প্রথমটি ছিল প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক দৃঢ় ব্যক্তি শিক্ষাবিদ রতন সিদ্দিকি এবং তার স্ত্রীকে উত্তরার কতিপয় মাদরাসা শিক্ষক-ছাত্রের আক্রমণ যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেদিন র‌্যাব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে হয়তো সেই ধর্মান্ধ অনুসরদের হাতেই তাদের জীবনের যবনিকাপাত ঘটত। এ জন্য র‌্যাব প্রশংসার দাবিদার যে বিষয়টি মার্কিন কর্তৃপক্ষের নজরে নেওয়া উচিত। এখানে উল্লেখযোগ্য, রতন সিদ্দিকি সাহেব শুধু একজন মুক্তমনা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায়ই নিবেদিত নন, আপসহীন আদর্শবাদ হচ্ছে তার গোটা পরিবারের ঐতিহ্য। তার অনুজ অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকি একজন বিরল প্রজ্ঞাসম্পন্ন আইনজ্ঞ। তার আদর্শবাদ এতই অনড় যে, প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের জীবদ্দশাই তাকে এই পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হলে তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, যেহেতু তার সন্তানগণ অধ্যয়নরত তাই সীমিত বেতনের পদ গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েও তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন, এমনটি বলা হলে অ্যাডভোকেট সিদ্দিকির জবাব ছিল- অ্যাটর্নি জেনারেল হলে তিনি ব্যক্তিগত মামলা করবেন না। আরও উল্লেখ্য যে, সিদ্দিকি ভ্রাতৃদ্বয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মুখ্য কৌঁসুলি, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক সাহেবের আপন ফুপাতো ভাই, অর্থাৎ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাহেবের চাচা, যে কথা তারা কখনো প্রচার করেন না বলে খুব কম লোকই তা জানেন। এ ধরনের এক আদর্শিক দম্পতিকে আক্রমণের উদ্দেশ্য একই সূত্রে গাঁথা, একই ষড়যন্ত্রের অংশ যা হলো দেশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে উচ্ছেদ করে তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। 

গত দুই বছরে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সবগুলো অঘটনই করা হয়েছে সংঘবদ্ধ, উঁচু পর্যায়ের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। ঘটনার এলাকাগুলো ভিন্ন হলেও তাদের ষড়যন্ত্র অভিন্ন এবং একত্রীভূত যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সবগুলো ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ মর্মে গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে, এসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করেছে। এর পর মুহূর্তের মধ্যে শত শত ধর্মান্ধের জমায়েত থেকে পরিষ্কার যে, এলাকা ভিন্ন হলেও তাদের যোগাযোগ সার্বক্ষণিক এবং অবিচ্ছিন্ন, তারা আগে থেকে জেনেশুনে তৈরি থাকে হিন্দু নাগরিক, তাদের মন্দির এবং বাসস্থান আক্রমণের জন্য। সবকটি জায়গায়ই বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ প্রমাণিত। কক্সবাজারের রামুর ঘটনা, নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির, বাড়িঘর ধ্বংস, দুর্গাপূজার সময়ে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি একইভাবে করা হয়েছে মিথ্যা কথা প্রচার করে যে কোনো অমুসলিম তার ফেসবুকে ইসলামবিরোধী কথা ব্যক্ত করেছে, অথবা কোনো হিন্দু দুর্গা দেবীর পায়ে কোরআন রেখে দিয়ে ইসলাম অবমাননা করেছে। অথচ এ সবকটি ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে যে, কিছু ধর্মান্ধ মুসলমানই এগুলো ঘটিয়েছে সম্প্রীতি নস্যাৎ করার জন্য। নাসিরনগরের চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা জেলে মনোরঞ্জন যে ফেসবুক চালাতে অক্ষম এ কথা সেদিন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার সাহেবই লিখেছিলেন, যিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছেন। আমাদের সরেজমিন তদন্তেও তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ভোলায় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সময় স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন, এক হিন্দুর ফেসবুক হ্যাক করে এক মুসলমানই এটি প্রচার করেছিল। কুমিল্লায় দুর্গার মূর্তিতে যে ইকবাল নামক এক মুসলমান কোরআন রেখেছিল, সেটি নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত, যে কথা সে ধর্মান্ধ ইকবালও স্বীকার করেছে। সুনামগঞ্জের ঝুমন দাসকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছিল তা সত্যিই হতভম্ব করার মতো। কেননা সে স্বীকৃত মিথ্যাচারী এবং ধর্ষণ মামলার আসামি মামুনুল হকের সম্পর্কে কিছু সত্য কথা প্রকাশ করায় অভিযোগ ওঠে সে নাকি ধর্মবিরোধী কথা বলেছে। একজন ধর্ষণ মামলার আসামির বিরুদ্ধে কিছু বলা যদি ধর্ম বিরোধিতা হয় তাহলে সবকিছুই ওলট-পালট করে দেখতে হবে সর্বশেষ আবিষ্কৃত জেমস ওয়েব নামক দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে। সুনামগঞ্জের জেলা জজের বদৌলতে ঝুমনকে এক বছর কারাবাস করতে হয়েছে, যে কারণে সুনামগঞ্জের সেই জেলা এবং দায়রা জজের নাম সব সময়ই ঘৃণাভরে উচ্চারিত হবে, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদানোর জন্য। পরবর্তীকালে মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশে প্রমাণিত হলো যে, সেই জেলা জজের আদেশটি ছিল অবৈধ। মুন্সীগঞ্জের অধ্যাপক হৃদয় মন্ডলকে গ্রেফতার করা হলো অথচ তিনি এমন কিছুই বলেননি যা ধর্ম অবমাননার সংজ্ঞাভুক্ত। এটা সবাই জানে যে কিছু ছাত্র তাদের কর্তাদের প্ররোচনায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। অধ্যাপক মন্ডলকে গ্রেফতার করা হলো অথচ যারা সেখানে বহুবিদ অপরাধ করল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। তাজরিয়ান শিকদার নামক যে তথাকথিত বিজ্ঞান শিক্ষক দৃশ্যত বহিরাগতদের আইন ভঙ্গ করতে লেলিয়ে দিয়েছিল, আলাউদ্দিন নামক যে তথাকথিত প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে একটি বেআইনি এজাহার করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি। মুন্সীগঞ্জ সফরকালে পুলিশ সুপার এসব বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল সে নিজেও ধর্মান্ধ গোত্রের লোক, কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য মৃণাল বাবু বললেন সেই এসপি ছাত্রলীগ করা মানুষ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল ছাত্রলীগের মানুষটি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজ করলেন? অল্প সময়ের ব্যবধানে ধর্মান্ধরা নড়াইলে দুটি ঘৃণ্য ঘটনা ঘটিয়ে প্রমাণ করল তারা কত সংঘবদ্ধ, সংগঠিত, তাদের অর্থের থলে কত বিশাল এবং তাদের প্রভুরা কত করিৎকর্মা। মুহূর্তের ডাকেই শত শত ধর্মান্ধ একত্রিত, অনেক বহিরাগতসহ। কোনো ইসলাম ধর্মীয় নেতাও বললেন না যে তারা যা করছে তা অন্যায়, অপরাধ এবং ধর্মবিরোধী, যে কথা কয়েক সপ্তাহ আগে পশ্চিমবাংলার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেম বলেছিলেন। যে গুটিকয়েককে গ্রেফতার করা হয়েছে, আক্রমণকারীদের তুলনায় তাদের সংখ্যা নগণ্য। সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে অধ্যক্ষ বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হলো? কীভাবেই বা পরবর্তী ঘটনায় শত শত হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বা কী করছিলেন? এটি অজানা নয় যে, গত কয়েক বছর বহু জামায়াত-বিএনপির লোক আওয়ামী লীগের খোলা দরজা নীতির সুযোগে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এদের সংখ্যা তো সত্যিকার আওয়ামী লীগারদের চেয়ে বেশি নয়। নরসিংদী স্টেশনে এক মহিলাকে মারধর করার ঘটনা প্রমাণ করল জামায়াত-হেফাজতিরা প্রচুর মহিলাকে তাদের দলভুক্ত করেছে।

 

যে কনস্টেবল ড. লতা সমাদ্দারকে হেস্তনেস্ত করল, নির্লজ্জ মিথ্যা কথা বলল, তাকে এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করা হয়নি। সবকিছু বাদ দিলেও যে পুলিশ সদস্য বাইকের পেছনে রাখা বাজারের ব্যাগকে স্ত্রী বলে মিথ্যা বক্তব্য দিতে পারে তাকে পুলিশের চাকরিতে বহাল রাখলে সে যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আরও অনেক জঘন্য অন্যায় করতে পারে, সেটা কি কেউ উপলব্ধি করল না? ধর্মান্ধদের সংখ্যা বেশি নয়। নির্বাচনে এরা ৪% বেশি ভোট পায় না। এরা ’৭১ এবং পরে ২০১৩-এর ৫ মে চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। তারপরও মনে হচ্ছে কেউ কেউ তাদের ভয়ে অকারণে ভীত। ২০১৩-এর ৫ মে তারা দৌড়ে পালিয়েছিল, কিন্তু তারপরও তাদের বহু দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে ছিলেন সে সময়ের মন্ত্রী নাহিদ সাহেব, যার কারণে বহু কোমলমতি ছাত্রছাত্রী সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছে। পরাজিতদের দাবি মানার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।

 

এসব অঘটন যেমন দেশের মানুষ দেখছেন, তেমনি দেখছেন বিদেশিরাও। সাম্প্রতিক বিলেত সফরকালে পূর্বপরিচিত বহু সংসদ সদস্য, লর্ড, অধিকারকর্মী, মূলধারার সাংবাদিক, ব্যারিস্টারদের কাছ থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান এবং হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাসের বিষয়ে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে (আমার জীবনের বড় অংশ বিলেতে কেটেছে বলে পরিচিতজন অনেক)। একদিকে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা অন্যদিকে সত্য প্রকাশ করা এই দুয়ের দ্বন্দ্বে পড়ে অবশেষে সতর্ক জবাব দিয়ে দেশের ভাবমূর্তির পক্ষেই কথা বলেছি। বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে সম্প্রীতি রক্ষায়, ধর্ম ব্যবসায়ীদের পরাজিত করতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। কিন্তু এভাবে শাক দিয়ে কদিন মাছ ঢাকা যাবে।

 

কিছু লোক মনে করছেন নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ধর্মান্ধদের হাতে রাখা প্রয়োজন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, তারা এ সত্যটি অনুধাবন করতে ভুল করছেন যে, এই ধর্মান্ধদের মূল উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে তালেবানি-পাকিস্তানি শাসন প্রতিষ্ঠা, যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেশকে হিন্দুশূন্য করার জন্য প্রলয় তান্ডবে মেতে উঠেছে। সুতরাং তারা আওয়ামী নেতৃত্বের সরকারের পক্ষে থাকবে এটা ভাবা যুক্তির কোনো মাপকাঠিতেই পড়ে না। এসব ধর্মান্ধ মামাবাড়ি আবদারের মতো দাবি তুলেছে মুমিনুল হকসহ সব ধর্মান্ধ আসামিকে মুক্তি দেওয়ার। মুমিনুল হককে মুক্তি দিলে অন্য সব ধর্ষণ মামলার আসামিদেরও মুক্তি না দিলে তা হবে সংবিধান লঙ্ঘন। কেননা সংবিধান বলছে আইনের চোখে সবাই সমান। গত কয়েক বছরে প্রমাণিত হয়েছে বহু ধর্মান্ধ জামায়াত-হেফাজতি পুলিশে, প্রশাসনে এবং এমনকি নিম্ন আদালতেও ঘাঁপটি মেরে আছে। এদের রাহু গ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অতীতে যারা তান্ডব সৃষ্টি করেছে তাদের গ্রেফতার করা হলে সম্ভবত নড়াইলের ঘটনা ঘটত না। যে কথাটি বারবার বলতে হচ্ছে তা হলো, আমরা যদি এখনই এই সংখ্যালঘিষ্ঠ, বারবার পরাজিত ধর্মান্ধ অপশক্তিকে না রুখি, তা হলে ভবিষ্যতে এটা আরও কঠিন হবে। যে জন্য জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি লালনের একটি লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন-‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ লেখাটি শুরু করেছিলাম তিনজন মানবতাবাদী বিজ্ঞ আইনজীবীর প্রশংসা করে।  এভাবে যদি সমাজের বিবেকবান বহু মানুষ এগিয়ে আসেন তাহলে ধর্মান্ধ অপশক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। আসুন আমরা এ ব্যাপারে একত্রিত এবং সোচ্চার হয়ে এসব অসুরকে প্রতিরোধ করি সময় থাকা অবস্থায়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com