অহনার কথাতে শুভ্র কোন উত্তর দিল না। আবার একই প্রশ্ন করার পর শুভ্র বলল ‘ ব্যস্ত ছিলাম। ‘
— কিন্তু ফোনের সুইচ অফ করার কারণ কি?
— ওঃ আমি ফোনের সুইচ অফ রাখিনি। চার্জ ছিল না। তাছাড়া আমার অতো খেয়াল থাকে না।
শুভ্রের গলায় বিরক্তি পরিস্কার।
— এত রেগে যাচ্ছ কেন শুভ্র? আজ কয় পেগ খেলে ?
— মানে ! আচ্ছা তুমি কি একটু স্বাভাবিক দেখতে চাও না আমাকে ! একই কথা কেন বলো তুমি?
— না খেলে তো খুব ভালো সোনা, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় তুমি রোজ খাও। আসলে তোমার বন্ধুরা তো ঠিক নেই। এই বন্ধু সঙ্গটাই সব নষ্ট করে দিল।
— আমি ফোনটা রাখলাম।
— না না প্লিজ । এই শোনো না কাল বেড়াতে যাবে?
— কোথায় ?
— এই তোমার একই প্রশ্ন। আগে তো চলো। তারপর ভাবা যাবে। কাছাকাছি কোথাও যাব, পার্ক স্ট্রিটের কাছাকাছি কোথাও চলো, কোনো রেস্তরাঁয় কিছুক্ষণ বসা যেতে পারে।
— অত বড় বড় জায়গায় বসে খাবার খাওয়ার মতো টাকা আমার নেই।
— তুমি ওসব নিয়ে চিন্তা করো না সোনা, চলো না প্লিজ।
— কাল জানাব, এখন রাখি। ভালো লাগছে না শরীরটা।
শুভ্র আচমকাই ফোনটা কেটে দিল। অহনার মনটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছিল। আসলে শুভ্রের একাকীত্ব কাটানোর জন্যই তো ওকে সঙ্গ দেওয়া। এমনও হয়েছে অহনার হাতে টাকা নেই কিন্তু শুভ্রকে রোজ এমন পোষাকে দেখতে দেখতে ওকে নতুন একটা শার্ট বা শুভ্রের খুব প্রিয় রং নীলের ওপর দু একটা ড্রেস কিনে দেবার জন্য মনটা সারাদিন কি ব্যাকুলই না হয়েছে। আসলে শুভ্রের কাছে শুনেছিল ওর বর্তমান পরিস্থিতির কথা, ব্যবসাতে এক্কেবারে চোট খেয়েছে। কিন্তু একটা সময় দারুণ ব্যবসা ছিল।
কি যে হল ওদের সংসারে। শ্বেতাও চলে গেল ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি। ডিভোর্সের কেসটাও সেই থেকে চলছে। তারপর থেকেই শুভ্র কেমন যেন বিষন্ন। বড় অসহায়, অবসাদগ্রস্ত দেখায় সবসময়।
সেদিন হঠাৎ কত কথাই না বলল শ্বেতাকে নিয়ে। নিজেদের ফুলশয্যার গল্প থেকে হানিমুনের কাহিনি। হাসতে হাসতে উজাড় করে সে সব পুরনো গল্প শোনাচ্ছিল। বিয়ের পর কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছে, কখন কি দুষ্টুমি করেছে শ্বেতার সাথে, একের পর এক বলে যাচ্ছিল। অহনার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলেও, শুভ্রের সতেজ মুখটা দেখে অহনার কিন্তু বেশ ভালোই লাগছিল। বড্ড ছেলেমানুষ দেখাচ্ছিল সেদিন শুভ্রকে। মাঝেমাঝেই শ্বেতার জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল অহনা। আর কেন জানি অহনার মনে হল শুভ্র আজও ভালবাসে শ্বেতাকে। শুভ্র আর অহনার এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মূল বিষয় ছিল শুভ্রের ছেলে। একমনে ছেলের কথা বলে যায়, আর নিবিষ্টচিত্তে অহনা শুনতে থাকে শুভ্র আর শ্বেতার একমাত্র ছেলের গল্প । আসলে একটা শিশুর মুখের ছবি অহনার হৃদয়ে কেমনভাবে যেন জায়গা করে নেয়। যদিও একটা সময় পর, ছেলেকে নিয়ে অবান্তর কথা বলতে থাকে কিন্তু শুভ্রকে থামিয়ে দিতে মন চায় না, কষ্ট হয় শুভ্রের মুখটা দেখলে। অদ্ভুত করুন দুটো চোখ অহনার হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা দেয়। শুভ্রের মধ্যে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব আছে, তবুও শুভ্র বড় একা। অহনার বারবার মনে হয় ওর নিঃসঙ্গতাকে যদি কিছুটা কাটানো যায়।
দুই .
শুভ্র একসময় ছিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে, কিম্বা বলা যেতে পারে ভাগ্যচক্রে ব্যবসা এখন খারাপ অবস্থায়। ভালবেসেই বিয়ে করেছিল শ্বেতাকে। একই কলেজে, একই সাথে পড়ত। জীবন বেশ স্রোতের মতো এগিয়ে চলছিল, হঠাৎ কিভাবে যেন জীবনের রংটা পাল্টে গেল। সন্তান, স্ত্রী, বাবা, মা নিয়ে জীবন ভালোই কাটছিল কিন্তু দিনের পর দিন শ্বেতার পরিবর্তন শুভ্রের নজরে এলেও, অতটা গুরুত্ব দেয়নি। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎই ঘরে ঢুকে চমকে যায় শুভ্র। অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে পায় শ্বেতাকে, তারই এক বন্ধুর সাথে, যে একসময় ওদের দুজনেরই কাছের বন্ধু ছিল। নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি শুভ্র। ঐদিনের পর আর স্পর্শ করেনি শ্বেতাকে। মানসিক দিক থেকে এক ঝটকায় অনেকটাই দূরে চলে গেছিল। অথচ প্রতিটি বিষয়ে শুভ্র ছিল শ্বেতার ওপর নির্ভরশীল। শ্বেতা ছাড়া শুভ্র এক মুহূর্ত ছিল অচল। কষ্ট হয় ছোট্ট গাবলুটার জন্যে। গোলগাল নাদুসনুদুস বলে ওর ডাকনাম গাবলু। বাবা মায়ের এই সম্পর্কের দোলাচল বাচ্চাটার জীবনে যেন কোন দাগ না পড়ে, সবসময় শুভ্রের মাথায় এই কথাটাই ঘুরপাক খেত ।
শ্বেতা চলে গিয়েছিল ছেলেকে নিয়ে। শুভ্রকে বলার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি, কিংবা নিজের ভুলটাকে শোধরানোর কোনও তাগিদও অনুভব করেনি মনেপ্রাণে। জীবন চলছিল কিভাবে যেন।
হঠাৎ পরিচয় হয় অহনার সঙ্গে, পরে সুন্দর বন্ধুত্ব। ওর মার্জিত ব্যবহার, চলাফেরার লাবণ্য শুভ্রের বড় ভালো লাগে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়। বন্ধুত্বের পরের পর্যায়ে পৌঁছতেও বেশি দেরি হল না, যার নাম সম্পর্ক।
কিন্তু একটা সময় পর দেখা গেল, সম্পর্কের ভিতটা কখনও বেশ সাবলীল, কখনও বেশ নড়বড়ে। সত্যিই কি অহনাকে ভালোবাসে শুভ্র? একে কি ভালোবাসা বলে? নাকি ভালোলাগা? নাকি সবটাই মোহ। অহনা বুঝতে পারে না।
অন্যদিকে অহনার জীবন নিয়ে চিন্তার জাল বোনে শুভ্র। স্বামী-সংসার নিয়ে খারাপ থাকার মতো তো কিছু নয়। একমাত্র সন্তান, বাইরে থাকে, বড় স্কুলে পড়ছে। এমন একটা স্কুলে ছেলেকে পড়ানোর স্বপ্ন দেখত অহনা। ছেলে অনেক দূরে থাকে বলে অহনার মনটা যদিও খারাপ থাকে। “এটুকু ছেলেকে কেন যে হোস্টেলে পাঠায়, নিজের শহরে ছেলেমানুষ করা কি খুবই কঠিন! বড় বড় স্কুলের নাম ডাক এসবের মোহ কি?” বুঝে উঠতে পারেনা শুভ্র। তাহলে এখন হা হুতাশ করে লাভটাই বা কি।
সৌভিক তো খারাপ ছেলে নয়, মানুষ হিসেবেও যথেষ্ট ভাল,তাহলে? কি এমন সমস্যা? তাহলে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ সব শেষ? অহনার কাছে শুনেছে ওদের রোজকার খিটিমিটি, অশান্তির কথা। অহনাও ভাবছে ডিভোর্সের কথা। কিন্তু অহনার বাচ্চাটার অবস্থাও তাহলে গাবলুর মতোই হবে। ভাবতে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় শুভ্রের। পৃথিবীতে এই শিশুগুলি সবচেয়ে করুণ শিশু, খুব দুর্বল পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে।
তিন.
— আজ আবার কি হলো ?
— না, ভালো লাগছে না রোজ রোজ অশান্তি। চলো না শুভ আমরা বিয়েটা করে ফেলি।
— বিয়েটা করে ফেলি মানে? এখনও তো ডিভোর্সই হলো না। আর তোমার তো এখনও স্বাভাবিক সংসারিক জীবন চলছে। ঝগড়া, মান-অভিমানে এতো হতেই পারে। আমাদের জীবনের কথা আলাদা, সব ঘটনা তো তোমাকে বলেছি, তাছাড়া আমরা অনেকগুলো দিন মাস বছর আলাদা থাকি।
— আচ্ছা তুমি আমাকে ভালোবাসো না? কি হল চুপ কেন শুভ্র ?
শুভ্র তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অন্যান্য কিছু কথার মতো সেই প্রশ্নেও নিশ্চুপ থাকে।
অহনা একা ঘরেই সেদিন খুব কেঁদেছিল। খুব খারাপ লাগছিল মনটা। আসলে বিয়ের কথাটা ওভাবে বলা ঠিক হয়নি সৌভিককে, কেমন যেন আত্মসম্মানে লাগছে বারবার। শুভ্রকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ও ঠিক কি চায়? এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলা ,দেখা করা। তাছাড়া সবকিছুরই তো একটা বয়স আছে। এভাবে এই বয়সে অনেক কিছুই মানায় না। এই লুকোচুরি হাস্যকর মনে হয় নিজের কাছে নিজেরই। তাই অহনার মনে হয়েছিল যা কিছু করার বা যা হবার তা তাড়াতাড়ি হোক।
আরো একটা বিষয় সবসময়ই ভাবায় অহনাকে।
শুভ্র কিন্তু কখনো জড়িয়ে ধরে আদর করেনি অহনাকে। নিজের থেকে কখনই শারীরিক আবেদনের প্রকাশ ঘটায়নি। পরস্পর পাশাপাশি হেঁটেছে। হাত ধরে গল্প করেছে। দুজনের মনের কথা দুজনকে ব্যক্ত করেছে কিন্তু নিজেদের কখনো গভীরতর জায়গায় নিয়ে যায়নি।
অহনা মনে মনে কল্পনা করে কতো কি। মাঝে মাঝে গভীর ভাবে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে কিন্তু শুভ্র বারবার নিজের কাছে নিজেকে সংযত করেছে। অহনার শারীরিক সৌন্দর্য বা আকর্ষণ শুভ্রের মধ্যে যে দোলা দেয়নি তা নয়, নিজেকে কোথায় যেন অপরাধী মনে হয়েছে বারংবার। অহনাকে কাছে টেনে নিয়েও আবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে তাই। নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করেছে। সৌভিকের সঙ্গে অহনার বিছানা অনেকদিন ধরেই আলাদা। এক ছাদের তলায় আছে এটুকুই শুভ্র শ্বেতার সঙ্গে পার্থক্য। একদিন রাগ করে, অভিমান করে ওই যে বিছানা আলাদা করেছে অহনা। কোথায় সৌভিক তো রাগ বা অভিমান ভাঙাবার চেষ্টা করেনি একবারও। দিব্যি আছে নিজের কাজের জগৎ নিয়ে। এমনিতেই ছেলেটাকে দূরে পাঠিয়ে কি ভীষণ শূন্যতা অনুভব করে নিজের মনের মধ্যে। কাছে থাকলে ছেলের সঙ্গেই অনেকটা সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যেত। সারাদিন শুধু নিয়মের মধ্যে জীবন। একটুও ভাঙ্গা যায় না এই রোজকার একঘেয়ে জীবন। কাজ আর কাজ, কিসের জন্য কাজ? কার জন্য কাজ ? যদি এই সংসারটুকুও আর বেঁচে না থাকল। জীবনের জন্য এই সংসার , এই পরিবার? নাকি সংসারের জন্য এই জীবন, এই পরিবার? সারাদিন মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল অহনা, রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ল।
চার.
দুদিন বাদে পাশাপাশি বসলেও অহনা আর শুভ্র। ঠিক করল নতুন করে ওরা ওদের জীবনটাকে শুরু করবে। অহনা এর মধ্যে জানিয়ে দিয়েছিল সৌভিককে, এভাবে একসাথে এই ছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। আইনত যা যা করার এবার শুরু করা যাক। আগামী মাসেই চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে। সৌভিক উচ্চবাচ্য করেনি অর্থাৎ অহনা যা ভালো মনে করে তাই করুক। এবারেও কিছু বলল না সৌভিক, এবারেও নিশ্চুপ? কি পাষান হৃদয় হলে এমনটা করতে পারে তা অহনা পরতে পরতে অনুভব করল। অথচ একদিন এই মানুষটার জন্য সকলের অমতে ঘর ছেড়েছিল। মা-বাবার মুখটা একবারও মনে পড়েনি সেদিন।
কত সহজে সবকিছু ত্যাগ করা যায় জীবনে শুধুমাত্র নিজের কথাটুকু ভেবে। একমাত্র নিজের ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সেদিন কি করেনি অহনা। যাই হোক আজ সবকিছু খোলাখুলি বলবে শুভ্রকে। নিজেকে আরও কিছুটা খুলে ধরবে।
ডিভোর্সটা কেন? এই প্রশ্নটা দুজনেই দুজনের দিকে আরো একবার ছুঁড়ে দিল। শুরুটা শুভ্রই করল।
ভীষণ দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা ওর বরাবরের অভ্যেস। তারপর কোনোদিন বাজার, কোনদিন কিছুই না। ইচ্ছে হলে শুভ্র বাজার যায়, সবটাই যেন এক মর্জির খেলা। কোথাও গিয়ে বসলে বাড়ির কথা মনে পড়ে না। বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ করে কখন যে কোথায় চলে যায়। এ নিয়েই অশান্তির সূত্রপাত। গাড়ি নিয়ে কখনো অচেনা কোন নদীর ধারে, কখনো সমুদ্রের উদ্দেশ্যে, কখনো গভীর জঙ্গলে। নদীতে স্নান , মদ্যপান, বিলাসবহুল হোটেলে রাত্রি যাপন, বউকে জানানোর কোনো প্রয়োজনই বোধ করেনি কোনদিন। আর সত্যি কথা বলতে কি শারীরিক চাওয়া পাওয়াকেও গুরুত্বই দেয়নি কোনোদিন। নিজের মর্জিকেই প্রাধান্য দিয়েছে বরাবর। শ্বেতারও যে কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে বা ভালোলাগা থাকতে পারে, সেই বিষয়টি ভাবার মতো মানসিকতা কখনোই ছিল না শুভ্রের একবারও জানতে চায়নি ওর আশা প্রত্যাশা বা চাহিদাকে। রাতে বাড়ি ফেরার পথে নিয়মিত মদ্যপান, তারপর হঠাৎই কোনো এক সন্ধ্যায় স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে দেখে তার মধ্যে পুরুষের আদিম নেশা জেগে উঠেছিল, কিন্তু তাকে জ্বলতে দিয়েও আবার নিভিয়ে দিয়েছিল নিমেষেই নিজের আত্ম মর্যাদার অহংকারে, নীরব প্রতিবাদকেই বেছে নিয়েছিল সেদিন থেকেই।
শেষ হয়েছিল শুভ্রের কথা। একের পর এক ছবি ভেসে উঠছে ওদের দুজনের চোখের সামনে। ভেঙে যাওয়া যাপনের ছবি ধরা দিচ্ছে ধীর লয়ে। শান্ত চোখে শুভ্র প্রতীক্ষা করছে অহনার কথা শুনবে বলে। অহনা বলল ‘ হ্যাঁ এবার আমি বলি।’ নিরুত্তর শুভ্র। অহনার জীবন ঠিক কেমন, অবিন্যস্ত মন নিয়ে শুরু করল অহনা।
স্বামী সৌভিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে। সারাদিন মিটিং আর মিটিং এমনিতে খুব রোমান্টিক কিন্তু বাড়িতে সময় কম দেয়। অহনা কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে তার সময় নেই। অহনা ভীষণ ফুল ভালোবাসে কিন্তু মনে পড়ে না হাতে করে কোন ফুল এনেছে কোনদিন। অহনা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে কারণ অনেক রাত অবধি টিভিতে মগ্ন। সিনেমা সিরিয়াল ফোন। এই নিয়ে ভীষন অশান্তি শুরু হয়। সৌভিক আবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠবে, জিমে যাবে। বাইরের খাবার না পসন্দ। অনন্যার আবার জীবনকে জীবনের মতো চলতে দিতে পছন্দ। রোজ রোজ বাড়ির রান্না একদম ভালো লাগে না। হোম ডেলিভারি মাঝে মাঝেই, তাই একটু বিরক্ত সৌভিক। হাত ধরে একটু গল্প বা হাঁটা এসবে সময় নেই। ছেলেকে হোস্টেলে পাঠাতে একেবারে আপত্তি ছিল সৌভিকের। এই নিয়েই মূল অশান্তির সূত্রপাত। অনন্যার স্বপ্ন ছেলেকে ঘিরে অনেক কিছু। এমন একটা স্কুলে সুযোগ পাওয়া কি মুখের কথা! রাত্রে সৌভিক এত তাড়াতাড়ি শুতে ডাকে যে বিরক্ত হয়ে আলাদা ঘরে নিজের মতো করে অনন্যা একটা জগৎ তৈরি করেছে। দূরত্ব এরপর ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয়। কখন যে ঘুম থেকে ওঠে, ততক্ষণে সৌভিক অফিস যাবার জন্য তৈরি। একা একাই জ্যাম জেলি দিয়ে পাউরুটি লাগিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। কখনো বা কিছুই খায় না। অফিস ক্যান্টিনে একমাত্র ভরসা। অনন্যার নিজের জন্য হোম ডেলিভেরিই ঠিক আছে। রাত্রে দুজনের জন্যে চারটৈ রুটি আর চিকেন করে নেয়, কোনদিন বা চাউমিন বা দুধরুটি। সৌভিক আবার ডাল, ভাত, মাছের ঝোল পছন্দ করে। রবিবার নিজেই রান্না করে তাই। এই হল জীবন…
অনন্যা শেষ করে ওর জীবনের কথা। সূর্য কখন অস্ত গেছে খেয়াল করেনি। হঠাৎ অনন্যা একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসে, উল্টোদিক থেকে একটা বাস দেখতে পায় শুভ্র ওরই পথের। সময় নষ্ট না করে ওপারে গিয়ে বাসটাতে উঠে পড়ে। ফিরতে থাকে নিজের গতিপথে।
পাঁচ.
রাতে বিছানায় নিজের মতো অহনা, আর শুভ্রও যথারীতি নিজের বিছানায়। দুজনের ভাবনার জায়গাটা সেই রাতে কেমন ভাবে যেন এসে এক বিন্দুতে মিলে যায়। দুজনেই মনে মনে বলল ‘একসাথে যদি আমরা দু’জন জীবন শুরু করি তাহলে আমাদের তৈরি সংসারে ঢেউ আসতে তো মুহূর্তের ব্যাপার।’
অহনা ভাবল সৌভিক আর যাই হোক, সৌভিক কিন্তু মদ খায় না। কোনো অনুষ্ঠানে হালকা চুমুক মাত্র। নিজের কাজ নিয়েই থাকে। সংসারটা এতো সুন্দর ভাবে চলছে ওর পরিশ্রমের উপার্জনে। অহনাকে ছেড়ে কোথাও বেড়াতে যাবার কথা ভাবতেও পারে না। কতবার সৌভিক বলেছে ‘ রাত জেগো না অহনা। তার চেয়ে চলো না সকালবেলা আমার সাথে মর্নিং ওয়াকে। এসো না আমার কাছে, প্লিজ।’
তখন টিভি, ফোন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। শুভ্রের মতো চালচুলোহীন জীবন নয় সৌভিকের, বরং একটা সুন্দর নিয়মের মধ্যে, অনুশাসনের মধ্যে থাকতে অভ্যস্ত বরাবরই ।
অন্যদিকে শুভ্র ভাবছে একাকীত্ব থেকেই হয়তো একজন বন্ধু এসেছে শ্বেতার জীবনে। অহনার মতো হোম ডেলিভারি থেকে কখনো খাবার আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। নিজের হাতে রান্না করতেই শ্বেতা ভালোবাসে।
সবসময় অপেক্ষা করত শুভ্রের সাথে একসঙ্গে খাবে বলে। শুধুমাত্র শুভ্রকে নয়, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে আনন্দ করে চলতে চেয়েছে বরাবর। অহনার মতো রাত জেগে টিভি দেখা বা ফোনের সাথে সময় কাটানোর কথা কল্পনাও করতে পারে না শ্বেতা। বরং শুভ্রকে কাছে পেতে চেয়েছে কতোটা আকুলভাবে। রাতে নিয়মিত মদ্য পান, তারপরেই ঘুমের সাগরে ভেসে থাকা শুভ্র জানতেও পারেনি শ্বেতার বিনিদ্র রাতগুলোর কথা।
ভাবনাগুলো এসে জট পাকাচ্ছে একের পর এক, বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে অহনা। অন্যপ্রান্তে শুভ্র ভাবছে জীবন বোধ হয় এমনই। সংসার মানেই তো ভাঙ্গা গড়ার খেলা। সংসার মানেই তো মান -অভিমান , রাগ অনুরাগ আরো কত কি। সংসার মানেই তো প্রতিদিনের হিসেব-নিকেশ, যোগ আর বিয়োগের প্রতিধ্বনি। কে ঠিক আর কে বেঠিক তা ভাবতে ভাবতেই চলে গেছে এতটা সময়। একটা ভাঙনের পর আবার অন্য এক নতুন কিছুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা, তারপর আবার সেই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তার চেয়ে আরও একবার নিজেকেই টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে, নতুন করে নিজেকে পাল্টে, নিজের মানুষটির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করলে হয় না?
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল অহনারও। কতদিন ভালো কিছু রান্না করে সৌভিককে নিজের হাতে খেতে দেয়নি। একবার ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পর। টিভিটা বন্ধ করে গভীর রাতে সৌভিকের ঘরের দিকে পা বাড়াল অহনা। অনেকদিন একা ঘরে সৌভিক,একা বিছানায়। অহনার দুচোখ জলে ভিজে উঠল।
অন্য আর এক প্রান্তে শুভ্রও কেমন ছটফট করছে নিজের কাছে নিজেই। শ্বেতার মুখটা ভেসে উঠছে ক্রমাগত। মাথার পাশে রাখা সেলফোনটা তুলে নিল। দেখাই যাক না একটা সরি বলে …।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, ভারত
সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডিডটকম