সমাজ রাষ্ট্রের অধীনে চলে গেছে

ছবি সংগৃহীত
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে সমাজ এখন আর সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে। কথাটা যে অসত্য, তা নয়। রাষ্ট্রই তো প্রধান। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা আছে; তার আছে বাহিনী, আছে তার আইন-আদালত।

দিনকে রাত করে দিতে পারে, রাতকে দিন। কিন্তু একালে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করাটা কি আদৌ সম্ভব? না, সম্ভব নয়। ওই চেষ্টাটা আমরা ব্রিটিশ যুগে করতাম; আমাদের মনীষীরা আমাদের শেখাতেন যে রাষ্ট্র তো আসবে যাবে, ভাঙবে গড়বে, কিন্তু সমাজ রয়ে যাবে প্রবহমান। রাষ্ট্র বহিরাগতদের হতে পারে, সমাজ তো আমাদেরই।

 

কিন্তু সমাজ যে রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়, অর্থাৎ বাধ্য হয় চলে যেতে, তার কী হবে? আর রাষ্ট্রের শাসকদের আদর্শই যে সমাজের ওপর নাজিল হয়ে থাকে, তারই বা প্রতিকার কী? রাষ্ট্রকে বৈরী হিসেবে দেখাটা বেঠিক নয়; ঠিকই আছে, তাকে বদলানোর দায়টা কিন্তু সমাজেরই, অর্থাৎ সমাজের অগ্রসর মানুষদেরই। মুশকিল হলো ওই অগ্রসর মানুষদের এখন খুঁজে পাওয়াটা ভার হয়েছে। পুঁজিবাদ তাদের চেনে, সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে জানে এবং দমন করতে চায়। দমন করার কাজে রাষ্ট্রের বিশেষ রকমের অস্ত্র হচ্ছে দুটি—ভীতি ও প্রলোভন।

 

রাষ্ট্র ভয় দেখায়, শাস্তি দেবে বলে জানায়, শাস্তি দিতে কসুরও করে না। এ ব্যাপারে সদাজাগ্রতই থাকে। রাষ্ট্র আবার প্রলোভনও দেখায় পুরস্কার দেবে বলে। দেয়ও। অগ্রসর মানুষরা নত হয়ে পড়ে—ভীতিতে এবং প্রলোভনে।

 

ভীতি প্রদর্শন ও পুরস্কার প্রদানের জন্য আবশ্যক টাকাটা রাষ্ট্র কিন্তু নিজে উৎপাদন করে না, সে ক্ষমতা তার নেই; টাকা আসে লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনের টাকা আবার জনগণের শ্রম ও ঘামেই উৎপাদিত হয়। জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করে ব্যবহার করা হয় জনগণকে তো বটেই, জনগণের পক্ষে বলার সম্ভাব্য শক্তিকেও দমনের জন্য। এমনটা আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে। এখন অবশ্য এর তৎপরতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে; রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এখন আগের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। যেমন তার বিস্তার, তেমন তার নিষ্ঠুরতা।

 

আব্রাহাম লিংকন তাঁর গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সংজ্ঞা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সংজ্ঞায়িত ওই গণতন্ত্র, অর্থাৎ জনগণের জন্য গঠিত, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের পক্ষের সরকার, পৃথিবী থেকে কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না। সরকার ও রাষ্ট্রকে সেদিন তিনি পৃথক করেননি। সরকার ও রাষ্ট্র যে এক নয়, এটা এখন সর্বদাই বলা হচ্ছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দিব্যি তারা এক হয়ে যায়; সরকারে যারা থাকে পারলে রাষ্ট্রকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সরকারকে নয়, রাষ্ট্রকেও জনগণের কর্তৃত্বাধীন করা চাই। কেননা রাষ্ট্র সরকারের চেয়েও শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। স্থূল সত্য বরং এটাই যে রাষ্ট্রকেই গণতান্ত্রিক করা দরকার, তাহলে সরকারও বাধ্য হবে গণতান্ত্রিক হতে; কান ধরে টান দিলে মাথাও চলে আসবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সেই গণতন্ত্রীকরণটা কি সম্ভব? না, মোটেই সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক শর্তটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা। ওদিকে পুঁজিবাদের প্রধান কাজই হলো মানুষে-মানুষে বৈষম্য বাড়ানো। একের সন্ধ্যা আর অপরের সকাল; তারা মিলবে কী করে? মিলছে না।

 

তা যথার্থ গণতন্ত্র তো লিংকনের নিজের দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানকার ‘অগণতান্ত্রিক’ সহিংসতা এখন অনেক দেশকে লজ্জায় ফেলে দেয়। ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে, কয়েক বছর আগে শিকাগো শহরে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয় ১৬ জন, আহত ২৪ জন। এবং আব্রাহাম লিংকন নিজেই তো তাঁর ওই বক্তৃতাদানের দুই বছরের মধ্যেই নিহত হন আততায়ীর হাতে। লিংকন নিহত হওয়ার পর ১৬০ বছর পার হতে চলেছে, দ্বিদলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা তাঁর ‘গণতান্ত্রিক’ যুক্তরাষ্ট্রে এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে; ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে কি না সে বিষয়েই এখন সংশয়। একটি জরিপ বলছে, তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে এখন শতকরা ৯৩ জনই মনে করে যে তাদের দেশে ‘সুস্থ’ গণতন্ত্র নেই। লিংকন জ্ঞানী এবং আশাবাদী মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ধারণা করতে পারেননি যে তাঁর দেশে পুঁজিবাদ এভাবে বিকশিত হবে এবং হওয়ার ফলে তাঁর সেই দেশ উপনিবেশবাদী গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায়ও বড় রকমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে। অপেক্ষা থাকবে কেবল সময় ও সুযোগের।

 

বিশ্বযুদ্ধকালে জাপান কিছু কম নৃশংসতার পরিচয় দেয়নি, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে তারা শান্তিপ্রিয় বলেই পরিচিত; যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক উল্টো। জাপানে বন্দুক আইন রীতিমতো কঠোর—রাজনৈতিক হিংস্রতার খবর পাওয়া যায় না, গোলাগুলির ঘটনা বিরল। সেই জাপানের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। দুই দফায় তিনি ৯ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আততায়ীটা বিক্ষুব্ধ ছিল, ওইভাবে তার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। ডেনমার্কও শান্তিপ্রিয় দেশ বলে খ্যাত। ছাড় দিয়ে দিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। সেই ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরের শপিং মলে এক বন্দুকধারীর গুলিতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছিল।

 

মায়ানমারে একসময়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন বেশ ভালো রকমের শক্তিশালী ছিল; কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নেবে এমনও মনে হয়েছে। সেই দেশে সামরিক বাহিনী যে তাণ্ডব ঘটিয়েছে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নির্যাতিত, নিহত ও দেশান্তরিত রোহিঙ্গারা। অং সান সু চি সামরিক বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিলেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে টুঁ শব্দটাও করেননি, তাদের ওপর সামরিক ও সামাজিক নিপীড়নকে নীরবে সমর্থনই করেছেন। এখন টের পাচ্ছেন সেনাবাহিনী কতটা নৃশংস হতে পারে। প্রতিবাদকারীদের সেখানে নিয়মিত হত্যা করা হচ্ছে; চারজন সুপরিচিত গণতন্ত্রপন্থীকে প্রহসনের বিচারে প্রাণদণ্ডাদেশ দিয়েছে, দণ্ডাদেশ কার্যকরও করে ফেলেছে। বিশ্ব কী বলবে তার তোয়াক্কা করেনি। আর বিশ্ব তো তেমন কিছু বলেও না। দেশটার প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর পুঁজিবাদীদের চোখ রয়েছে।

 

আমরা টাকার শাসনের কথা বলছিলাম। গণচীন যে এখন আর কমিউনিস্ট নেই তার নানা ধরনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে কিছু মানুষ অতি দ্রুত অসম্ভব রকমের ধনী হয়ে গেছে; তাদের অনেকেই দেশে থাকতে চাচ্ছে না, বিদেশে চলে গেছে বা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে চলে যাওয়ার। খবর পাওয়া যায় যে চীনের একজন সাবেক বিচারমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

 

আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মোটেই কমিউনিস্ট নন, কখনো ছিলেন না, ভবিষ্যতেও হবেন না; উল্টো ঘোরতর কমিউনিস্টবিরোধী বলেই তিনি সুপরিচিত। তবে ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মতোই তিনি যে খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেন, সেটা তো সুবিদিত। তাই টাকা-পয়সার দিকে ঝুঁকবেন না এটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু তাঁর দলের মস্ত বড় নেতা পার্থ চক্রবর্তী তো দেখা যাচ্ছে ঘুষ গ্রহণে পুঁজিবাদী নেতাদেরও হার মানিয়ে ছেড়েছেন। কানাঘুষা ছিল যে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী থাকার সময়ে তিনি শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগদানের বেলায় টাকা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো রকম বাছবিচার করেননি, দুই হাতে তো বটেই, থাকলে ১০ হাতকেই কাজে লাগাতেন; আর এ ধরনের উপার্জনের স্বভাবটাই এ রকমের যে কেবল একজনের সেবাদাস হয়েই সে সন্তুষ্ট থাকে না, ওপরের দিকেও চলে যায়; এ ক্ষেত্রেও সে রকমের চলমানতার সন্দেহের গুঞ্জন যে নেই, তা নয়। সে যা-ই হোক, পার্থ চক্রবর্তী, যিনি দোর্দণ্ড প্রতাপের নেতা, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং নেত্রীর ডান হাত বলেই সুপরিচিত, তাঁর সংগৃহীত নগদ ৫০ কোটি রুপি, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকার ও স্থাবর সম্পত্তি যে ধরা পড়ল তার ব্যাখ্যাটা কী? শোনা যাচ্ছে, টাকা নাকি বিদেশেও পাচার হয়েছে। এই টাকা নিশ্চয়ই মাটি ফুঁড়ে গজায়নি কিংবা আকাশ থেকে ঝরে পড়েনি, এটা জনগণেরই টাকা; তৃণমূল যে জনগণের ‘রক্ষক’ বলে

পরিচিত।

বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মোটেই সুবিধায় নেই। তারা আস্থা রেখেছিল মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। ওই দল ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু দেখা গেল দলটা শেষ পর্যন্ত আর কমিউনিস্ট থাকেনি, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে’ বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এবং বুর্জোয়াদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে পিছু হটেছে। ভোট সংগ্রাহক ও জনসমর্থক সেজে সংগঠনের স্থানীয় স্তরে সুবিধালোভীরা দলে ঢুকে পড়েছে এবং যখন দেখেছে দল (মূলত তাদের কারণেই) জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তখন তৃণমূলে গিয়ে শামিল হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা শক্ত হাতে উচ্চে তুলে ধরেছেন, কিন্তু তিনি যে কতটা বাঙালিপ্রেমিক, তা তো বোঝা যায় রাজ্যে পেশিশক্তি ও আর্থিক দুর্নীতিকেই তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া থেকেই। অতিরিক্ত প্রমাণও অবশ্য রয়েছে বেশির ভাগ বাঙালির বাসভূমি বাংলাদেশকে তার পাওনা পানি দিতে তাঁর জোরালো অসম্মতির ভেতরে। তিনি কেমন বাঙালিপ্রেমিক, যিনি বিপুলসংখ্যক বাঙালির জলকষ্ট বৃদ্ধি করেন? ভালো কথা, বাম জোট ছেড়ে অনেকে বুদ্ধিজীবী কিন্তু মমতার স্কুলে নাম লিখিয়েছিলেন; তাঁদের জন্য টানটা নিশ্চয়ই মতবাদগত ছিল না। ওদিকে পার্থ বলছেন যে টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন দলের অজান্তে নয়, দলের জ্ঞাতসারেই। এবং দলের নির্দেশেই টাকা তাঁর হেফাজতে রেখেছিলেন। আর যে টাকা ধরা পড়েছে, সেটা নাকি আসলের ভগ্নাংশ মাত্র। এবং তিনি একা নন, সংগ্রহ অন্যরাও করেছেন।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক  ।  সূএ:বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ‘কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় জাতীয় পার্টি’

» জাতীয় নির্বাচনের সময় জানালেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত

» মালয়েশিয়ায় স্থানীয়ভাবে পাসপোর্ট প্রিন্টের দাবি প্রবাসীদের

» মহাখালীতে রিকশাচালকদের অবরোধ, ট্রেন চলাচল বন্ধ

» ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা ৬ মামলা বাতিল

» সশস্ত্র বাহিনী সাহস, শৌর্য ও শৃঙ্খলার প্রতীক: তারেক রহমান

» ভুটান বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে : আমির খসরু

» দেশে ফিরেছেন জামায়াত আমির

» সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর গ্রেফতার

» দায়িত্ব নিয়েছেন নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সমাজ রাষ্ট্রের অধীনে চলে গেছে

ছবি সংগৃহীত
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে সমাজ এখন আর সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে। কথাটা যে অসত্য, তা নয়। রাষ্ট্রই তো প্রধান। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা আছে; তার আছে বাহিনী, আছে তার আইন-আদালত।

দিনকে রাত করে দিতে পারে, রাতকে দিন। কিন্তু একালে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করাটা কি আদৌ সম্ভব? না, সম্ভব নয়। ওই চেষ্টাটা আমরা ব্রিটিশ যুগে করতাম; আমাদের মনীষীরা আমাদের শেখাতেন যে রাষ্ট্র তো আসবে যাবে, ভাঙবে গড়বে, কিন্তু সমাজ রয়ে যাবে প্রবহমান। রাষ্ট্র বহিরাগতদের হতে পারে, সমাজ তো আমাদেরই।

 

কিন্তু সমাজ যে রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়, অর্থাৎ বাধ্য হয় চলে যেতে, তার কী হবে? আর রাষ্ট্রের শাসকদের আদর্শই যে সমাজের ওপর নাজিল হয়ে থাকে, তারই বা প্রতিকার কী? রাষ্ট্রকে বৈরী হিসেবে দেখাটা বেঠিক নয়; ঠিকই আছে, তাকে বদলানোর দায়টা কিন্তু সমাজেরই, অর্থাৎ সমাজের অগ্রসর মানুষদেরই। মুশকিল হলো ওই অগ্রসর মানুষদের এখন খুঁজে পাওয়াটা ভার হয়েছে। পুঁজিবাদ তাদের চেনে, সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে জানে এবং দমন করতে চায়। দমন করার কাজে রাষ্ট্রের বিশেষ রকমের অস্ত্র হচ্ছে দুটি—ভীতি ও প্রলোভন।

 

রাষ্ট্র ভয় দেখায়, শাস্তি দেবে বলে জানায়, শাস্তি দিতে কসুরও করে না। এ ব্যাপারে সদাজাগ্রতই থাকে। রাষ্ট্র আবার প্রলোভনও দেখায় পুরস্কার দেবে বলে। দেয়ও। অগ্রসর মানুষরা নত হয়ে পড়ে—ভীতিতে এবং প্রলোভনে।

 

ভীতি প্রদর্শন ও পুরস্কার প্রদানের জন্য আবশ্যক টাকাটা রাষ্ট্র কিন্তু নিজে উৎপাদন করে না, সে ক্ষমতা তার নেই; টাকা আসে লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনের টাকা আবার জনগণের শ্রম ও ঘামেই উৎপাদিত হয়। জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করে ব্যবহার করা হয় জনগণকে তো বটেই, জনগণের পক্ষে বলার সম্ভাব্য শক্তিকেও দমনের জন্য। এমনটা আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে। এখন অবশ্য এর তৎপরতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে; রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এখন আগের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। যেমন তার বিস্তার, তেমন তার নিষ্ঠুরতা।

 

আব্রাহাম লিংকন তাঁর গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সংজ্ঞা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সংজ্ঞায়িত ওই গণতন্ত্র, অর্থাৎ জনগণের জন্য গঠিত, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের পক্ষের সরকার, পৃথিবী থেকে কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না। সরকার ও রাষ্ট্রকে সেদিন তিনি পৃথক করেননি। সরকার ও রাষ্ট্র যে এক নয়, এটা এখন সর্বদাই বলা হচ্ছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দিব্যি তারা এক হয়ে যায়; সরকারে যারা থাকে পারলে রাষ্ট্রকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সরকারকে নয়, রাষ্ট্রকেও জনগণের কর্তৃত্বাধীন করা চাই। কেননা রাষ্ট্র সরকারের চেয়েও শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। স্থূল সত্য বরং এটাই যে রাষ্ট্রকেই গণতান্ত্রিক করা দরকার, তাহলে সরকারও বাধ্য হবে গণতান্ত্রিক হতে; কান ধরে টান দিলে মাথাও চলে আসবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সেই গণতন্ত্রীকরণটা কি সম্ভব? না, মোটেই সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক শর্তটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা। ওদিকে পুঁজিবাদের প্রধান কাজই হলো মানুষে-মানুষে বৈষম্য বাড়ানো। একের সন্ধ্যা আর অপরের সকাল; তারা মিলবে কী করে? মিলছে না।

 

তা যথার্থ গণতন্ত্র তো লিংকনের নিজের দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানকার ‘অগণতান্ত্রিক’ সহিংসতা এখন অনেক দেশকে লজ্জায় ফেলে দেয়। ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে, কয়েক বছর আগে শিকাগো শহরে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয় ১৬ জন, আহত ২৪ জন। এবং আব্রাহাম লিংকন নিজেই তো তাঁর ওই বক্তৃতাদানের দুই বছরের মধ্যেই নিহত হন আততায়ীর হাতে। লিংকন নিহত হওয়ার পর ১৬০ বছর পার হতে চলেছে, দ্বিদলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা তাঁর ‘গণতান্ত্রিক’ যুক্তরাষ্ট্রে এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে; ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে কি না সে বিষয়েই এখন সংশয়। একটি জরিপ বলছে, তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে এখন শতকরা ৯৩ জনই মনে করে যে তাদের দেশে ‘সুস্থ’ গণতন্ত্র নেই। লিংকন জ্ঞানী এবং আশাবাদী মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ধারণা করতে পারেননি যে তাঁর দেশে পুঁজিবাদ এভাবে বিকশিত হবে এবং হওয়ার ফলে তাঁর সেই দেশ উপনিবেশবাদী গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায়ও বড় রকমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে। অপেক্ষা থাকবে কেবল সময় ও সুযোগের।

 

বিশ্বযুদ্ধকালে জাপান কিছু কম নৃশংসতার পরিচয় দেয়নি, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে তারা শান্তিপ্রিয় বলেই পরিচিত; যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক উল্টো। জাপানে বন্দুক আইন রীতিমতো কঠোর—রাজনৈতিক হিংস্রতার খবর পাওয়া যায় না, গোলাগুলির ঘটনা বিরল। সেই জাপানের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। দুই দফায় তিনি ৯ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আততায়ীটা বিক্ষুব্ধ ছিল, ওইভাবে তার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। ডেনমার্কও শান্তিপ্রিয় দেশ বলে খ্যাত। ছাড় দিয়ে দিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। সেই ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরের শপিং মলে এক বন্দুকধারীর গুলিতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছিল।

 

মায়ানমারে একসময়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন বেশ ভালো রকমের শক্তিশালী ছিল; কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নেবে এমনও মনে হয়েছে। সেই দেশে সামরিক বাহিনী যে তাণ্ডব ঘটিয়েছে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নির্যাতিত, নিহত ও দেশান্তরিত রোহিঙ্গারা। অং সান সু চি সামরিক বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিলেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে টুঁ শব্দটাও করেননি, তাদের ওপর সামরিক ও সামাজিক নিপীড়নকে নীরবে সমর্থনই করেছেন। এখন টের পাচ্ছেন সেনাবাহিনী কতটা নৃশংস হতে পারে। প্রতিবাদকারীদের সেখানে নিয়মিত হত্যা করা হচ্ছে; চারজন সুপরিচিত গণতন্ত্রপন্থীকে প্রহসনের বিচারে প্রাণদণ্ডাদেশ দিয়েছে, দণ্ডাদেশ কার্যকরও করে ফেলেছে। বিশ্ব কী বলবে তার তোয়াক্কা করেনি। আর বিশ্ব তো তেমন কিছু বলেও না। দেশটার প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর পুঁজিবাদীদের চোখ রয়েছে।

 

আমরা টাকার শাসনের কথা বলছিলাম। গণচীন যে এখন আর কমিউনিস্ট নেই তার নানা ধরনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে কিছু মানুষ অতি দ্রুত অসম্ভব রকমের ধনী হয়ে গেছে; তাদের অনেকেই দেশে থাকতে চাচ্ছে না, বিদেশে চলে গেছে বা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে চলে যাওয়ার। খবর পাওয়া যায় যে চীনের একজন সাবেক বিচারমন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

 

আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মোটেই কমিউনিস্ট নন, কখনো ছিলেন না, ভবিষ্যতেও হবেন না; উল্টো ঘোরতর কমিউনিস্টবিরোধী বলেই তিনি সুপরিচিত। তবে ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মতোই তিনি যে খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেন, সেটা তো সুবিদিত। তাই টাকা-পয়সার দিকে ঝুঁকবেন না এটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু তাঁর দলের মস্ত বড় নেতা পার্থ চক্রবর্তী তো দেখা যাচ্ছে ঘুষ গ্রহণে পুঁজিবাদী নেতাদেরও হার মানিয়ে ছেড়েছেন। কানাঘুষা ছিল যে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী থাকার সময়ে তিনি শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগদানের বেলায় টাকা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো রকম বাছবিচার করেননি, দুই হাতে তো বটেই, থাকলে ১০ হাতকেই কাজে লাগাতেন; আর এ ধরনের উপার্জনের স্বভাবটাই এ রকমের যে কেবল একজনের সেবাদাস হয়েই সে সন্তুষ্ট থাকে না, ওপরের দিকেও চলে যায়; এ ক্ষেত্রেও সে রকমের চলমানতার সন্দেহের গুঞ্জন যে নেই, তা নয়। সে যা-ই হোক, পার্থ চক্রবর্তী, যিনি দোর্দণ্ড প্রতাপের নেতা, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং নেত্রীর ডান হাত বলেই সুপরিচিত, তাঁর সংগৃহীত নগদ ৫০ কোটি রুপি, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকার ও স্থাবর সম্পত্তি যে ধরা পড়ল তার ব্যাখ্যাটা কী? শোনা যাচ্ছে, টাকা নাকি বিদেশেও পাচার হয়েছে। এই টাকা নিশ্চয়ই মাটি ফুঁড়ে গজায়নি কিংবা আকাশ থেকে ঝরে পড়েনি, এটা জনগণেরই টাকা; তৃণমূল যে জনগণের ‘রক্ষক’ বলে

পরিচিত।

বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মোটেই সুবিধায় নেই। তারা আস্থা রেখেছিল মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। ওই দল ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু দেখা গেল দলটা শেষ পর্যন্ত আর কমিউনিস্ট থাকেনি, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে’ বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এবং বুর্জোয়াদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে পিছু হটেছে। ভোট সংগ্রাহক ও জনসমর্থক সেজে সংগঠনের স্থানীয় স্তরে সুবিধালোভীরা দলে ঢুকে পড়েছে এবং যখন দেখেছে দল (মূলত তাদের কারণেই) জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, তখন তৃণমূলে গিয়ে শামিল হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা শক্ত হাতে উচ্চে তুলে ধরেছেন, কিন্তু তিনি যে কতটা বাঙালিপ্রেমিক, তা তো বোঝা যায় রাজ্যে পেশিশক্তি ও আর্থিক দুর্নীতিকেই তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া থেকেই। অতিরিক্ত প্রমাণও অবশ্য রয়েছে বেশির ভাগ বাঙালির বাসভূমি বাংলাদেশকে তার পাওনা পানি দিতে তাঁর জোরালো অসম্মতির ভেতরে। তিনি কেমন বাঙালিপ্রেমিক, যিনি বিপুলসংখ্যক বাঙালির জলকষ্ট বৃদ্ধি করেন? ভালো কথা, বাম জোট ছেড়ে অনেকে বুদ্ধিজীবী কিন্তু মমতার স্কুলে নাম লিখিয়েছিলেন; তাঁদের জন্য টানটা নিশ্চয়ই মতবাদগত ছিল না। ওদিকে পার্থ বলছেন যে টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন দলের অজান্তে নয়, দলের জ্ঞাতসারেই। এবং দলের নির্দেশেই টাকা তাঁর হেফাজতে রেখেছিলেন। আর যে টাকা ধরা পড়েছে, সেটা নাকি আসলের ভগ্নাংশ মাত্র। এবং তিনি একা নন, সংগ্রহ অন্যরাও করেছেন।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক  ।  সূএ:বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com