সংগৃহীত ছবি
হাসিনা আকতার নিগার :ছোটবেলার দেখা সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ এখন অনেকটাই কবির কাল্পনিক কবিতা বলেই মনে হয়। চোখের সামনে উজাড় হয়ে গেছে শহর গ্রামের বৃক্ষরাজি। উন্নয়নের নামে সরকারি বেসরকারিভাবে সবুজ ধ্বংস হচ্ছে নানাভাবে। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার একটি যে বৃক্ষ নিধন তা বুঝা যায় ঋতুর বৈপরীত্যেতা থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা হতে তা বাংলাদেশের জনগণ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে সাম্প্রতিক সময়ের তীব্র তাপদাহ থেকে। নির্বিচারে গাছ কেটে অবকাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত উন্নয়ন কোন দেশের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
একটি উন্নত জাতি তার দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরনের সাথে সাথে পরিবেশের উন্নয়নকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে তা জানা দরকার বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে। কারণ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা দেশ ও জনগণকে সুস্থ জীবন দিতে পারে না। উন্নয়ন কেবল ইট পাথরের কথা বলে। আর্থ সামাজিক ও পরিবেশ গত উন্নয়ন পেলেই জনগণ পায় সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা।
সাম্প্রতিককালে ঢাকার সুপরিচিত এলাকা ধানমন্ডিতে গাছ কাটার প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নেমেছে। এ প্রতিবাদ দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন নীতির কথা বলে বাংলাদেশ। একদিকে বলা হয় ‘একটি গাছ কাটলে দশটি গাছ লাগান।’ অন্যদিকে উন্নয়ন আর ইট-পাথরের শহর তৈরি করতে গাছ কাটা হয় অবলীলায়। রাস্তা কিংবা মহাসড়কের পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে গাছ সুরক্ষা করা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না পরিকল্পনাবিদরা তার প্রমাণ বর্তমানের অবকাঠামো সমূহ।
ধানমন্ডির ঘটনার ধারাবাহিকতায় উন্নত দেশের রাস্তার দুপাশ আর কমিউনিটির গাছের যত্ন দেখে বিস্মিত হই। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে বাংলাদেশের সবুজ ধ্বংসের কথা ভেবে। বিধাতা অপার হাতে বাংলাকে দিয়েছিল অপরুপ এক পরিবেশ। আর সে দেশের জনগণ পরিবেশ রক্ষার সকল বিধি বিধান উপেক্ষা করে নানাভাবে পরিবেশকে বিনষ্ট করছে অবলীলায়। ধানমন্ডি বলতেই আজো স্মৃতিতে ভেসে উঠে সবুজ ছায়ায় ঘেরা সুশীতল এক পরিবেশ। ৯০ দশকের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সবুজ ছায়ায় ঘেরা সে ধানমন্ডি। সেখানে ব্যক্তিগতভাবে বৃক্ষরাজি কেটে বহুতল ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে পরিবেশ আইন কেবল কথার কথা। অন্যদিকে উন্নয়নের স্বার্থে একই কাজ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ চিত্র যে কেবল রাজধানীর তা কিন্তু নয়।
পাহাড় আর সমুদ্র ঘেরা চট্রগ্রামেও পাহাড়ী সবুজ এখন নেই বললে চলে। উন্নয়নের পথ কেড়ে নিয়েছে পতেংগা সমুদ্র সৈকতের বিস্তৃত ঝাউবন। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির আগে বৃক্ষকে রক্ষা করার পরিকল্পনার বড় অভাব এখন বাংলায়। বিশাল ভবনের উপর ছাদবাগানের জন্য উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু গাছ না কেটে ভবন নির্মাণের কথা বলার কেউ নেই।
মানুষের প্রাত্যহিক জীবন কেবল যন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয় না তা বোধ করি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিজ্ঞজনরা বুঝেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রতি তাদের চিন্তা ভাবনা থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। তারা নিজেদের জনগণের সুস্থ জীবন সুরক্ষায় সবার আগে প্রাধান্য দিয়ে থাকে পরিবেশের ভারসাম্যকে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের ইচ্ছে মত পরিবেশে ধ্বংস করে বাড়ি ঘর বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে না। তবে এসব দেশে সরকার ও জনগণ উভয়ের জন্য জবাবদিহিতার নীতি রয়েছে বলেই হয়ত বা তারা গড়ে তুলতে পারছে সবুজ পৃথিবী। আর বাংলাদেশে জবাবদিহিতার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা।
জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য বিশাল অংকের ফান্ড নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন এনজিও। তবে সে সব কাজের দৃশ্যত চিত্র জনজীবনে আজও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর কারণ হলো জবাবদিহিতার অভাব।
গাছ পালার মতই নদ নদীর বর্তমান অবস্থা। বাংলাদেশের অনেক নদীর নাম এখন আছে কেবল বই পুস্তকে। সে সব নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে মানুষের লোভাতুর চাওয়ার কাছে। নদী ভরাট করে ও গড়ে তোলা হচ্ছে ঘর বাড়ি শিল্প প্রতিষ্ঠান। যার ফলে জলাবদ্ধতাসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশে। এখানে ও সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণই দায়ী। গাছ নদী বন মানুষের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় তা বোধগম্য করার সময় চলে এসেছে। ধবংস করার আগে ভাবুন শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য গাছের হাওয়া আর নদীর আর্দ্রতা না থাকলে নগরায়ণ বা বিশ্বায়ন থমকে যাবে।কারণ সুস্থ মানুষই পারে তার শ্রম ও সেবা দিয়ে উন্নত জাতি দিতে।
আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে সরকার ও জনগণ। তবে সে বাংলাদেশ ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে সুশীতল ছায়া ঘেরা আর নদীর কলতানের বাংলাদেশ। সুদূর প্রবাসে যখন দেখি আমার ঘরের পাশের বিশাল চেরি গাছকে প্রাকৃতিক সার আর পানি দিয়ে পরিচর্যা করছে সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠান, তখন অবাক হই। কারণ বাংলাদেশে এ চিত্র কল্পনাতীত। একশত বছরের বটবৃক্ষকে সার বা পানি দেয়ার কথা ভাবতে পারে না বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ। গাছের ও প্রাণ আছে এটা কেবল পুথিগত বিদ্যা থেকে জানা আমাদের। আমরা তাদের সজীব রাখার দায়িত্ব নিতে শিখিনি।
তাই উন্নত বিশ্ব থেকে আমাদের ধারণ করতে হবে পরিবেশ রক্ষা মানসিকতা সৃষ্টি করা। বিশ্বায়নের নামে পরিবেশ ধবংস না করে একবার যদি অনুভব করা যায়, যত বেশি গাছ আর নদী বেঁচে থাকে তত বেশি জনগণ পাবে সুস্থ জীবন; তবেই পরিবেশ পাবে রক্ষা রাহুরগ্রাস থেকে। এই বোধই পারবে কেবল আবার সবুজ শ্যামল নদ নদীর বাংলাদেশ তৈরি করতে। অন্যথায় অসুস্থ নগরায়ণ জনগণকে বঞ্চিত করবে তাদের সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তাকে।
লেখক: কলামিস্ট । সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন