সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

নূরে আলম সিদ্দিকী: অসীম সাহসী মসিযোদ্ধা পীর হাবিবুর রহমান ৫৯ বছর বয়সেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। জীবনটাকে সহজ করে নেওয়ার চরম উদ্যম তাঁর মাঝে ছিল। দুঃখ-কষ্ট এমনকি চাকরি হারানোর বা অভাব-অনটনের জীবনের বেদনাসিক্ত স্বাদও তাঁকে নিতে হয়েছে একাধিকবার। করুণ ম্লান এক অদ্ভুত হাসি ছিল তাঁর জীবনের আঙ্গিক- যা সবসময় আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যেত। একবার সুনামগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সত্যিই প্রচন্ড উপভোগ করেছিলাম। হাসন রাজার দেশ, হাওর-বাঁওড়ের দেশ, মাছে-ভরা দেশ যে সুনামগঞ্জ- তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয়নি। তাঁর ভাই জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর মিসবাহ মিশুক ও খোলামনের মানুষ। অতিথিপরায়ণতায় তাঁর গোটা পরিবারটাই নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো। স্রোতস্বিনী নদীর মতো জীবনের সময় তো বয়েই যায়। সেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের সময়ের দুরন্ত-দুর্বিনীত যৌবনের উত্তাল জনসমুদ্র এবং উচ্ছ্বসিত জীবনের স্বপ্নীল সময়গুলো পেরিয়ে এসেছি। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এলেও আমার সামাজিক জীবনের পরিধিও ছিল দিগন্তবিস্তৃত। সব দলের সঙ্গে ওঠাবসা সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সম্পর্কের রাখিবন্ধনে বেঁধে রাখা আমার মজ্জাগত অভ্যাস। পীর হাবিবের প্রযত্নে ও তাঁর সমগ্র পরিবারের আতিথেয়তায় বিভিন্ন দলের বহু চেনা ব্যক্তিত্বের সমাহার সুনামগঞ্জের তাঁর সমাবেশের আয়োজনস্থলকে সারাটা দিনের জন্য রমরমা করে তুলেছিল। দিনে দিনে মতপার্থক্য সত্ত্বেও ভিন্নমতের মানুষদের একত্রে ওঠাবসার ও সৌহার্দ্যরে সেই পরিবেশ আজকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

বিস্মিত হলেও সত্যি, আশ্চর্যান্বিত হলেও বাস্তব, ক্ষমতাসীনরা সবসময় সর্বাবস্থায় উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকেন, সরকারের স্থায়িত্বই হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দীর্ঘমেয়াদি সরকারই কেবল পারে উন্নয়নের স্রোতধারা প্রবাহিত করাতে। পল্টনের গর্জন, রাজপথের স্লোগান- এগুলো আবেগতাড়িত হলেও মূলত এটি কোনো ইতিবাচক সাফল্য দেয় না। গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় যে মুখ ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে, তা কেবল গতিশীল জাতীয় বিবর্তনের ধারাকেই পথভ্রষ্ট করে, একটা অন্ধ উন্মাদনা রক্তে শিহরণ ধরায়। কিন্তু উন্নয়নের প্রয়োজনে আবেগকে প্রশমিত করে মিছিলের অগ্রভাগে উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাতকে অবদমিত রেখে সুবোধ ঋষিবালকের মতো জীবনকে উৎসর্গ করতে পারলেই রাষ্ট্রীয় বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়। যারা একদিন অনেকটা মিছিলের পথ হেঁটেছেন, যৌবন যাদের রক্তাক্ত মিছিলে উদ্বেলিত সত্তায় উজ্জীবিত ছিল, তারাও যেন একটা পর্যায়ে এসে ক্ষমতার কিছুটা বিচ্ছিন্ন স্বাদ পেতে কেমন যেন নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠেন। অকাতরে সোনাঝরা প্রদীপ্ত অতীতকে বিস্মৃত হয়ে এমন সব আজ্ঞাবত গতানুগতিক কথা বলেন, যা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। আশ্চর্যান্বিত হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে, ইনিই কী তিনি- যাকে চার যুগ আগে গণতন্ত্রের সূর্যসেনা হিসেবে উদ্ভাসিত হতে দেখেছি? কৌতূহলের বিষয় হলো এই যে, সে দিনের মিছিলের সেই চেনামুখটি যতই স্বৈরাচারের মনোতুষ্টির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন না কেন, স্বৈরাচারের মনোতুষ্টিতে ভরাতে পারেন না। একি তার নিয়তির বিধান যে, জীবনসায়াহ্নের একটি পর্যায়ে এসে তিনি মুখ-থুবড়ে পড়েন? কেউ কেউ আবার কক্ষচ্যুত হয়ে যান।

যে কোনো স্বৈরাচারী শাসক তাদের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পচন ধরায়। পাকিস্তান আমলে এনএসএফ-এর মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনকে অবদমিত রাখার জন্য কুটিল ষড়যন্ত্রের অবতারণা হয়েছিল। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ছাত্র রাজনীতিকে দূষিত ও দুর্নীতির আবর্তে জড়ানোর জন্য বিলাসী প্রমোদতরীতে ছাত্রনেতৃত্ব ও প্রতিভাপ্রদীপ্ত ছাত্রদের নিয়ে গিয়ে অভি-নীরুর মাধ্যমে ধোঁয়াশা সৃষ্টির উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনই তার দুঃসাহসের যবনিকা টেনেছে। 

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হলেও বলতে হয়, ছাত্র সংগঠনকে আজ্ঞাবহ ও মোসাহেবি সংগঠনে রূপান্তরিত করার উন্মত্ততায় বর্তমান সরকারও মেতে উঠেছে। অজ্ঞানে কি সজ্ঞানে অবচেতনে অথবা সচেতন মননশীলতায় এই দুঃসহ ও দুর্বিষহ আত্মঘাতী খেলায় এই সরকারের পোড়খাওয়া নেতৃত্ব কেন যে মেতে উঠলেন- ভেবে তার সুরাহা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঐতিহাসিকের কষ্টিপাথরে গবেষণা ও বিশ্লেষণের ঝঙ্কারে সঠিক তথ্য একদিন উঠে আসবে। বাংলাদেশের সরকার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। ২৩ বছরের সংগ্রামের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা পাশবিক শক্তির দোসরদের দ্বারা নিহত হয়ে শাহাদাত লাভও করেছেন। রাজনীতির পথ-পরিক্রমণের মহালগ্নে তিনি যেমন কণ্টকাকীর্ণ পথে হেঁটেছেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের ধসে পড়া অর্থনীতিকে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তখনকার রাজনীতিক সিরাজ সিকদার ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লেবাসধারী উ™£ান্ত জাসদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। জাসদের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল পতিত রাজনীতির ফসিল ছিল যারা- মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানপন্থি রথী-মহারথীরা। স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মিতে উদ্ভাসিত দেশের অন্তরালে চলে গিয়েছিল কায়েমি স্বার্থবাদীরা। তবুও তাদের কুটিল রাজনীতির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি হয়নি। অতি কৌশলে তারা উগ্র রাজনীতির যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সামাজিক বিপ্লবের দুঃস্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকতেন (তাদের অনেকের অনুতপ্ত হৃদয়ের অনুশোচনা আমি শুনেছি) তারা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক উ™£ান্ত ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শুরু করেন। মুখে জয় বাংলা স্লোগান দিলেও সিরাজ সিকদারের পাশবিকতার উ™£ান্ত মন্ত্রে তারা দীক্ষিত হয়ে যান। খাদ্যগুদামে আগুন, পাটের গুদামে আগুন, থানা হতে শুরু করে বিভিন্ন স্থান হতে অস্ত্র লুণ্ঠন তাদের নৈমত্তিক কর্মকান্ডের আবর্তে ঢুকে পড়ে। একটা সময় পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান তাদের আদর্শের মূর্তপ্রতীক ছিলেন, চেতনার স্পন্দন ছিলেন। আর মজার বিষয় হলো এই, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিরাজুল আলম খানের হৃদয়ের পাদপীঠে শ্রদ্ধার বেদিমূল অনেক শক্ত ছিল। তাই তিনি বিপ্লবের চেতনা ও শেখ মুজিবের প্রতি আকর্ষণের দোটানায় মারাত্মকভাবে ভুগছিলেন। জাসদের উত্তেজিত মিছিল যখন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসভবন দখলের চেষ্টায় ব্যাপৃত, বিক্ষিপ্ত মিছিল নিয়ে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন দখলের চেষ্টা করছে- তখন সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অত্যন্ত আবেগতাড়িতভাবে জলিল-তাহেরের বংশনিপাত করছেন। এটি কি তাঁর রাজনৈতিক অপকৌশল না দোটানার রাজনীতির ফলশ্রুতি- তা আজও আমি নিশ্চিত নই। সিরাজ ভাই আমারও নেতা ছিলেন। তিনি যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, আমি তখন একজন সাধারণ কর্মী। এটা বাস্তব, কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব হিসেবেই তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি অসাধারণ পরিশ্রমী একজন নেতা। উত্তপ্ত মিছিল থেকে পোস্টার লাগানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই তাঁর সরব উপস্থিতি কর্মীদের হৃদয়কে নাড়া দিত, উদ্দীপ্ত করত, উৎসাহিত করত। বঙ্গবন্ধুর কাছেও তাঁর অবস্থান এতখানি নিগুঢ় ছিল যে, তিনি সংগঠক হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের যে কোনো স্থান বঙ্গবন্ধুর কাছে চেয়ে নিতে পারতেন। কর্মী হিসেবে তাঁর প্রতি আমারও শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তিনি জাসদের একটি খন্ডিত অংশের আনুগত্যের অংশীদার। তিনি ধৈর্য ধরলে, সুদূরপ্রসারী হলে ইতিবাচক ও সৃজনশীল রাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাস করলে- দেশে সত্যিকার বিরোধী দল গড়ে তোলা তো বটেই, কালে কালে বাম রাজনীতির মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গ, কেরালার মতো বাংলাদেশে সরকার গঠন করতেও পারতেন। আমাদের প্রজন্ম থেকে শুরু করে আমার পরের প্রজন্মের অনেকেই তাঁকে সিরাজ সিকদারের চাইতেও ভয়ংকর ধ্বংসলীলার স্রষ্টা মনে করেন। তবে আমি মনে করি না। তিনি যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখনকার কর্মী হিসেবে আমি তাঁকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি আগাগোড়াই নৈরাজ্যবাদী। তিনি আসলে কী চান, তা তিনি নিজেই জানেন না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জাসদ সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও তখনকার থানা লুট, খাদ্যগুদামে অগ্নিসংযোগ, ঈদের জামাতে গুলি করে সংসদ সদস্য হত্যা প্রভৃতি নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল, ১৫ আগস্টের দুরাচার শক্তি সেখান থেকে উৎসাহ ও প্রণোদনা পেয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।

 

আমি যেটা বলি, সেটিই শেষ সত্য, তা আমি মনে করি না। তবে আমার বিশ্বাসের আঙ্গিকটাকে তুলে ধরার প্রশ্নে আমি নিঃসংকোচ, নির্মোহ ও অকুতোভয়। অসংকোচে নিজেকে প্রকাশ করার সততা ও সৎসাহস আমি লালন করি। সত্য- তা যত কঠিনই হোক, তাকে আমি ভালোবাসি। এখনো কবিগুরুর ভাষায় চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে হয়- ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সে কখনো করে না বঞ্চনা।’

 

আমার সেকালের অনেক বন্ধু, যারা আমাকে সেকালে পুঁজিবাদের ধারক ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে গালিগালাজ করতেন, তাদের কেউ কেউ অনুশোচনা করেন- বিপ্লবের নেশায় বুঁদ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি না করার জন্য এবং রাজনীতির অভিন্ন ধারাবাহিকতার অনুসরণের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সামাজিক বিপ্লবের রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে যারা সশস্ত্র রাজনীতির ভ্রান্তির অতলান্তে ডুবে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আমার মৌলিক পার্থক্য অনেকেই আজ অনুধাবন করেন। কেউ কেউ ধারাবাহিকতা অনুসরণের জন্য আমার সুস্থির মননশীলতাকে সাধুবাদও জানান। এতে একদিকে আমি পরম তৃপ্তিলাভ যেমন করি, অন্যদিকে তেমনি ভাবী, আজকের এই মানসিক স্থিরতা তাদের সেদিনের রাজনীতিতে যদি থাকত, তাহলে নৈরাজ্যের নিষ্ঠুর দহনের নির্দয় আগুনে বাংলাদেশকে পলে পলে দগ্ধীভূত হতে হতো না।

 

আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, তখন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অতি বিপ্লবীদের সমাহার ছিল প্রবল। অনেক কষ্টে ও ধৈর্যসহকারে তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা রাজনীতি করতাম। ১৯৬৯-এর শেষার্র্ধ্বে আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলাম, তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার সমর্থকদের সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ। কাউন্সিলকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে নিঃসন্দেহে আমার কমিটির চেহারা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য জাতির- সর্বোপরি দুর্ভাগ্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর, তিনিই নিজহাতে এই প্যানেলটি আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বাসভবনে ডেকে তিনি অত্যন্ত নির্মম কণ্ঠে আমাকে বললেন- এই প্যানেলটি সম্পূর্ণ তোমাকে মেনে নিতে হবে। নইলে শেখ মুজিবকে ছাড়তে হবে। এত নিষ্ঠুর উক্তির পরও প্যানেলটি আমি কাউন্সিলে পাস করাতে রাজি হইনি। রাজ্জাক ভাই ইকবাল হলের মাঠে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে প্যানেলটি পড়েছিলেন। আমি মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমার পিতা ঢাকায় বেড়াতে এলে যশোর বোর্ডিংয়ে উঠতেন। সেই সুবাদে তখনকার ইকবাল হল ছেড়ে দিয়ে আমি যশোর বোর্ডিংয়ে গিয়ে অবস্থান নিই। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে যশোরের মোর্শেদ সাহেবের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন- কে তোর কাছে বেশি নির্ভরযোগ্য? কমিটিতে সিরাজুল আলম খানের লোক বেশি আছে কিন্তু তোর তো আমি আছি। তুই কী চাস? প্যানেল না আমাকে? তখনো বুঝেছিলাম, বঙ্গবন্ধু মোহাচ্ছন্ন হয়ে আত্মঘাতী কিছু একটা করছেন। কিন্তু প্রতিকারের কোনো উপায় ছিল না। সে দিন যদি বঙ্গবন্ধু সরলতার আবর্তে এই ভুলটা না করতেন, তাহলে জাসদ সৃষ্টি হতো না। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে, বারুদের গন্ধে, নৈরাজ্যবাদের অগ্নিশিখায় গণতন্ত্র জ্বলেপুড়ে খাঁক হতো না। প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদ সম্পৃক্ত ছিল না কিন্তু তার পাদপীঠ রচনায় আপন অজ্ঞাতসারেই জাসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটাই নিষ্ঠুর- এটাই নিরেট বাস্তব। এই নিবন্ধে আমি খন্ড-বিখন্ড ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষুপ্রায় জাসদের সমালোচনা করার জন্য কলম ধরিনি। বরং বুঝেছি এবং বোঝাতে চেষ্টা করছি, মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত ও গণতন্ত্রবিহীন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ দেশ জাতি এমনকি প্রতিষ্ঠিত সরকারের জন্যও কল্যাণকর নয়।

 

মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির সুযোগে রাজনীতির অঙ্গনে যে কোনো অপশক্তির অনুপ্রবেশ হয়ে যেতে পারে। শেখ হাসিনা সর্বসাকুল্যে উনিশ বছর ক্ষমতায় আছেন। দেশের অভ্যন্তরে নানাবিধ উন্নয়নের ছাপ পরিলক্ষিত। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, মাথাপিছু আয় ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি- সবকিছুই দৃশ্যমান। এটা না দেখলে তাকে জ্ঞানপাপী বলা হবে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেশে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন প্রায়। ইনসেনটিভ কেয়ারে মুমূর্ষু রোগীর মতো বিরোধী দল আজ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। দেশ আজ পরিপূর্ণভাবে আমলা-শাসিত। গণতান্ত্রিক না বলে আমলাতান্ত্রিক বলাই প্রণিধানযোগ্য। এই নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ বাংলাদেশ একটা অজানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত। নরেন্দ্র মোদির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি সেখানে ক্ষমতায়। তবুও গণতন্ত্রের সম্ভাবনার দুয়ার সেখানে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি। শত বছরের ঐতিহ্যের আবিরমাখা ভারতবর্ষকে অনন্তকালের জন্য প্রতিক্রিয়াশীলরা অবদমিত রাখতে পারবে না। বিশাল ভারত তার উদ্গত উদ্যত উদ্ধত মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেই। কিন্তু আমাদের দেশে কেন জানি না, গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে এক নায়কতন্ত্রের শাসনেই আচ্ছাদিত প্রায়। সর্বদলীয় রাজনীতির শাসনতান্ত্রিক অবাধ ব্যবস্থা এ দেশে রয়েছে কিন্তু কার্যত দেশ আজ একব্যক্তির সোনার শিকলে বাঁধা। দেশের ১৮ কোটি মানুষ মøান মূক মুখে চেয়ে আছে অনাগত সূর্যস্নাত ভবিষ্যতের দিকে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।  সূএ:বাংলাদে প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» মিরপুর থানার ৩ নং বিট পুলিশ নিয়ে আলোচনা সভা

» রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম

» শালিস করা নিয়ে ইউপি সদস্যেল ওপর হামলার চেষ্টার অভিযোগ অস্ত্র সহ তিনজন আটক

» শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কঠোর হতে চায় না সরকার: উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম

» চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর

» জনগণ প্রত্যাশা মতো গণমাধ্যমের সহায়তা পাচ্ছি না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

» ওমরা করার উত্তম সময় কোনটি

» মোবাইল ফোন চার্জ দিতে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়?

» টি-টেন লিগে ফের ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন!

» উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপির ৬২ প্রস্তাবনা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

নূরে আলম সিদ্দিকী: অসীম সাহসী মসিযোদ্ধা পীর হাবিবুর রহমান ৫৯ বছর বয়সেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। জীবনটাকে সহজ করে নেওয়ার চরম উদ্যম তাঁর মাঝে ছিল। দুঃখ-কষ্ট এমনকি চাকরি হারানোর বা অভাব-অনটনের জীবনের বেদনাসিক্ত স্বাদও তাঁকে নিতে হয়েছে একাধিকবার। করুণ ম্লান এক অদ্ভুত হাসি ছিল তাঁর জীবনের আঙ্গিক- যা সবসময় আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যেত। একবার সুনামগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সত্যিই প্রচন্ড উপভোগ করেছিলাম। হাসন রাজার দেশ, হাওর-বাঁওড়ের দেশ, মাছে-ভরা দেশ যে সুনামগঞ্জ- তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয়নি। তাঁর ভাই জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর মিসবাহ মিশুক ও খোলামনের মানুষ। অতিথিপরায়ণতায় তাঁর গোটা পরিবারটাই নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো। স্রোতস্বিনী নদীর মতো জীবনের সময় তো বয়েই যায়। সেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের সময়ের দুরন্ত-দুর্বিনীত যৌবনের উত্তাল জনসমুদ্র এবং উচ্ছ্বসিত জীবনের স্বপ্নীল সময়গুলো পেরিয়ে এসেছি। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এলেও আমার সামাজিক জীবনের পরিধিও ছিল দিগন্তবিস্তৃত। সব দলের সঙ্গে ওঠাবসা সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সম্পর্কের রাখিবন্ধনে বেঁধে রাখা আমার মজ্জাগত অভ্যাস। পীর হাবিবের প্রযত্নে ও তাঁর সমগ্র পরিবারের আতিথেয়তায় বিভিন্ন দলের বহু চেনা ব্যক্তিত্বের সমাহার সুনামগঞ্জের তাঁর সমাবেশের আয়োজনস্থলকে সারাটা দিনের জন্য রমরমা করে তুলেছিল। দিনে দিনে মতপার্থক্য সত্ত্বেও ভিন্নমতের মানুষদের একত্রে ওঠাবসার ও সৌহার্দ্যরে সেই পরিবেশ আজকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

বিস্মিত হলেও সত্যি, আশ্চর্যান্বিত হলেও বাস্তব, ক্ষমতাসীনরা সবসময় সর্বাবস্থায় উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকেন, সরকারের স্থায়িত্বই হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দীর্ঘমেয়াদি সরকারই কেবল পারে উন্নয়নের স্রোতধারা প্রবাহিত করাতে। পল্টনের গর্জন, রাজপথের স্লোগান- এগুলো আবেগতাড়িত হলেও মূলত এটি কোনো ইতিবাচক সাফল্য দেয় না। গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় যে মুখ ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে, তা কেবল গতিশীল জাতীয় বিবর্তনের ধারাকেই পথভ্রষ্ট করে, একটা অন্ধ উন্মাদনা রক্তে শিহরণ ধরায়। কিন্তু উন্নয়নের প্রয়োজনে আবেগকে প্রশমিত করে মিছিলের অগ্রভাগে উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাতকে অবদমিত রেখে সুবোধ ঋষিবালকের মতো জীবনকে উৎসর্গ করতে পারলেই রাষ্ট্রীয় বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়। যারা একদিন অনেকটা মিছিলের পথ হেঁটেছেন, যৌবন যাদের রক্তাক্ত মিছিলে উদ্বেলিত সত্তায় উজ্জীবিত ছিল, তারাও যেন একটা পর্যায়ে এসে ক্ষমতার কিছুটা বিচ্ছিন্ন স্বাদ পেতে কেমন যেন নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠেন। অকাতরে সোনাঝরা প্রদীপ্ত অতীতকে বিস্মৃত হয়ে এমন সব আজ্ঞাবত গতানুগতিক কথা বলেন, যা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। আশ্চর্যান্বিত হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে, ইনিই কী তিনি- যাকে চার যুগ আগে গণতন্ত্রের সূর্যসেনা হিসেবে উদ্ভাসিত হতে দেখেছি? কৌতূহলের বিষয় হলো এই যে, সে দিনের মিছিলের সেই চেনামুখটি যতই স্বৈরাচারের মনোতুষ্টির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন না কেন, স্বৈরাচারের মনোতুষ্টিতে ভরাতে পারেন না। একি তার নিয়তির বিধান যে, জীবনসায়াহ্নের একটি পর্যায়ে এসে তিনি মুখ-থুবড়ে পড়েন? কেউ কেউ আবার কক্ষচ্যুত হয়ে যান।

যে কোনো স্বৈরাচারী শাসক তাদের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পচন ধরায়। পাকিস্তান আমলে এনএসএফ-এর মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনকে অবদমিত রাখার জন্য কুটিল ষড়যন্ত্রের অবতারণা হয়েছিল। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ছাত্র রাজনীতিকে দূষিত ও দুর্নীতির আবর্তে জড়ানোর জন্য বিলাসী প্রমোদতরীতে ছাত্রনেতৃত্ব ও প্রতিভাপ্রদীপ্ত ছাত্রদের নিয়ে গিয়ে অভি-নীরুর মাধ্যমে ধোঁয়াশা সৃষ্টির উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনই তার দুঃসাহসের যবনিকা টেনেছে। 

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হলেও বলতে হয়, ছাত্র সংগঠনকে আজ্ঞাবহ ও মোসাহেবি সংগঠনে রূপান্তরিত করার উন্মত্ততায় বর্তমান সরকারও মেতে উঠেছে। অজ্ঞানে কি সজ্ঞানে অবচেতনে অথবা সচেতন মননশীলতায় এই দুঃসহ ও দুর্বিষহ আত্মঘাতী খেলায় এই সরকারের পোড়খাওয়া নেতৃত্ব কেন যে মেতে উঠলেন- ভেবে তার সুরাহা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঐতিহাসিকের কষ্টিপাথরে গবেষণা ও বিশ্লেষণের ঝঙ্কারে সঠিক তথ্য একদিন উঠে আসবে। বাংলাদেশের সরকার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। ২৩ বছরের সংগ্রামের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা পাশবিক শক্তির দোসরদের দ্বারা নিহত হয়ে শাহাদাত লাভও করেছেন। রাজনীতির পথ-পরিক্রমণের মহালগ্নে তিনি যেমন কণ্টকাকীর্ণ পথে হেঁটেছেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের ধসে পড়া অর্থনীতিকে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তখনকার রাজনীতিক সিরাজ সিকদার ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লেবাসধারী উ™£ান্ত জাসদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। জাসদের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল পতিত রাজনীতির ফসিল ছিল যারা- মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানপন্থি রথী-মহারথীরা। স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মিতে উদ্ভাসিত দেশের অন্তরালে চলে গিয়েছিল কায়েমি স্বার্থবাদীরা। তবুও তাদের কুটিল রাজনীতির সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি হয়নি। অতি কৌশলে তারা উগ্র রাজনীতির যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সামাজিক বিপ্লবের দুঃস্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকতেন (তাদের অনেকের অনুতপ্ত হৃদয়ের অনুশোচনা আমি শুনেছি) তারা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক উ™£ান্ত ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শুরু করেন। মুখে জয় বাংলা স্লোগান দিলেও সিরাজ সিকদারের পাশবিকতার উ™£ান্ত মন্ত্রে তারা দীক্ষিত হয়ে যান। খাদ্যগুদামে আগুন, পাটের গুদামে আগুন, থানা হতে শুরু করে বিভিন্ন স্থান হতে অস্ত্র লুণ্ঠন তাদের নৈমত্তিক কর্মকান্ডের আবর্তে ঢুকে পড়ে। একটা সময় পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান তাদের আদর্শের মূর্তপ্রতীক ছিলেন, চেতনার স্পন্দন ছিলেন। আর মজার বিষয় হলো এই, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিরাজুল আলম খানের হৃদয়ের পাদপীঠে শ্রদ্ধার বেদিমূল অনেক শক্ত ছিল। তাই তিনি বিপ্লবের চেতনা ও শেখ মুজিবের প্রতি আকর্ষণের দোটানায় মারাত্মকভাবে ভুগছিলেন। জাসদের উত্তেজিত মিছিল যখন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসভবন দখলের চেষ্টায় ব্যাপৃত, বিক্ষিপ্ত মিছিল নিয়ে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন দখলের চেষ্টা করছে- তখন সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে অত্যন্ত আবেগতাড়িতভাবে জলিল-তাহেরের বংশনিপাত করছেন। এটি কি তাঁর রাজনৈতিক অপকৌশল না দোটানার রাজনীতির ফলশ্রুতি- তা আজও আমি নিশ্চিত নই। সিরাজ ভাই আমারও নেতা ছিলেন। তিনি যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, আমি তখন একজন সাধারণ কর্মী। এটা বাস্তব, কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব হিসেবেই তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি অসাধারণ পরিশ্রমী একজন নেতা। উত্তপ্ত মিছিল থেকে পোস্টার লাগানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই তাঁর সরব উপস্থিতি কর্মীদের হৃদয়কে নাড়া দিত, উদ্দীপ্ত করত, উৎসাহিত করত। বঙ্গবন্ধুর কাছেও তাঁর অবস্থান এতখানি নিগুঢ় ছিল যে, তিনি সংগঠক হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের যে কোনো স্থান বঙ্গবন্ধুর কাছে চেয়ে নিতে পারতেন। কর্মী হিসেবে তাঁর প্রতি আমারও শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তিনি জাসদের একটি খন্ডিত অংশের আনুগত্যের অংশীদার। তিনি ধৈর্য ধরলে, সুদূরপ্রসারী হলে ইতিবাচক ও সৃজনশীল রাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাস করলে- দেশে সত্যিকার বিরোধী দল গড়ে তোলা তো বটেই, কালে কালে বাম রাজনীতির মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গ, কেরালার মতো বাংলাদেশে সরকার গঠন করতেও পারতেন। আমাদের প্রজন্ম থেকে শুরু করে আমার পরের প্রজন্মের অনেকেই তাঁকে সিরাজ সিকদারের চাইতেও ভয়ংকর ধ্বংসলীলার স্রষ্টা মনে করেন। তবে আমি মনে করি না। তিনি যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখনকার কর্মী হিসেবে আমি তাঁকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি আগাগোড়াই নৈরাজ্যবাদী। তিনি আসলে কী চান, তা তিনি নিজেই জানেন না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জাসদ সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও তখনকার থানা লুট, খাদ্যগুদামে অগ্নিসংযোগ, ঈদের জামাতে গুলি করে সংসদ সদস্য হত্যা প্রভৃতি নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল, ১৫ আগস্টের দুরাচার শক্তি সেখান থেকে উৎসাহ ও প্রণোদনা পেয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।

 

আমি যেটা বলি, সেটিই শেষ সত্য, তা আমি মনে করি না। তবে আমার বিশ্বাসের আঙ্গিকটাকে তুলে ধরার প্রশ্নে আমি নিঃসংকোচ, নির্মোহ ও অকুতোভয়। অসংকোচে নিজেকে প্রকাশ করার সততা ও সৎসাহস আমি লালন করি। সত্য- তা যত কঠিনই হোক, তাকে আমি ভালোবাসি। এখনো কবিগুরুর ভাষায় চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে হয়- ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সে কখনো করে না বঞ্চনা।’

 

আমার সেকালের অনেক বন্ধু, যারা আমাকে সেকালে পুঁজিবাদের ধারক ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে গালিগালাজ করতেন, তাদের কেউ কেউ অনুশোচনা করেন- বিপ্লবের নেশায় বুঁদ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি না করার জন্য এবং রাজনীতির অভিন্ন ধারাবাহিকতার অনুসরণের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সামাজিক বিপ্লবের রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে যারা সশস্ত্র রাজনীতির ভ্রান্তির অতলান্তে ডুবে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আমার মৌলিক পার্থক্য অনেকেই আজ অনুধাবন করেন। কেউ কেউ ধারাবাহিকতা অনুসরণের জন্য আমার সুস্থির মননশীলতাকে সাধুবাদও জানান। এতে একদিকে আমি পরম তৃপ্তিলাভ যেমন করি, অন্যদিকে তেমনি ভাবী, আজকের এই মানসিক স্থিরতা তাদের সেদিনের রাজনীতিতে যদি থাকত, তাহলে নৈরাজ্যের নিষ্ঠুর দহনের নির্দয় আগুনে বাংলাদেশকে পলে পলে দগ্ধীভূত হতে হতো না।

 

আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, তখন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অতি বিপ্লবীদের সমাহার ছিল প্রবল। অনেক কষ্টে ও ধৈর্যসহকারে তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা রাজনীতি করতাম। ১৯৬৯-এর শেষার্র্ধ্বে আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলাম, তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার সমর্থকদের সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ। কাউন্সিলকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে নিঃসন্দেহে আমার কমিটির চেহারা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য জাতির- সর্বোপরি দুর্ভাগ্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর, তিনিই নিজহাতে এই প্যানেলটি আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বাসভবনে ডেকে তিনি অত্যন্ত নির্মম কণ্ঠে আমাকে বললেন- এই প্যানেলটি সম্পূর্ণ তোমাকে মেনে নিতে হবে। নইলে শেখ মুজিবকে ছাড়তে হবে। এত নিষ্ঠুর উক্তির পরও প্যানেলটি আমি কাউন্সিলে পাস করাতে রাজি হইনি। রাজ্জাক ভাই ইকবাল হলের মাঠে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে প্যানেলটি পড়েছিলেন। আমি মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমার পিতা ঢাকায় বেড়াতে এলে যশোর বোর্ডিংয়ে উঠতেন। সেই সুবাদে তখনকার ইকবাল হল ছেড়ে দিয়ে আমি যশোর বোর্ডিংয়ে গিয়ে অবস্থান নিই। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে যশোরের মোর্শেদ সাহেবের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন- কে তোর কাছে বেশি নির্ভরযোগ্য? কমিটিতে সিরাজুল আলম খানের লোক বেশি আছে কিন্তু তোর তো আমি আছি। তুই কী চাস? প্যানেল না আমাকে? তখনো বুঝেছিলাম, বঙ্গবন্ধু মোহাচ্ছন্ন হয়ে আত্মঘাতী কিছু একটা করছেন। কিন্তু প্রতিকারের কোনো উপায় ছিল না। সে দিন যদি বঙ্গবন্ধু সরলতার আবর্তে এই ভুলটা না করতেন, তাহলে জাসদ সৃষ্টি হতো না। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে, বারুদের গন্ধে, নৈরাজ্যবাদের অগ্নিশিখায় গণতন্ত্র জ্বলেপুড়ে খাঁক হতো না। প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদ সম্পৃক্ত ছিল না কিন্তু তার পাদপীঠ রচনায় আপন অজ্ঞাতসারেই জাসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটাই নিষ্ঠুর- এটাই নিরেট বাস্তব। এই নিবন্ধে আমি খন্ড-বিখন্ড ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষুপ্রায় জাসদের সমালোচনা করার জন্য কলম ধরিনি। বরং বুঝেছি এবং বোঝাতে চেষ্টা করছি, মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত ও গণতন্ত্রবিহীন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ দেশ জাতি এমনকি প্রতিষ্ঠিত সরকারের জন্যও কল্যাণকর নয়।

 

মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির সুযোগে রাজনীতির অঙ্গনে যে কোনো অপশক্তির অনুপ্রবেশ হয়ে যেতে পারে। শেখ হাসিনা সর্বসাকুল্যে উনিশ বছর ক্ষমতায় আছেন। দেশের অভ্যন্তরে নানাবিধ উন্নয়নের ছাপ পরিলক্ষিত। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, মাথাপিছু আয় ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি- সবকিছুই দৃশ্যমান। এটা না দেখলে তাকে জ্ঞানপাপী বলা হবে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেশে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন প্রায়। ইনসেনটিভ কেয়ারে মুমূর্ষু রোগীর মতো বিরোধী দল আজ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। দেশ আজ পরিপূর্ণভাবে আমলা-শাসিত। গণতান্ত্রিক না বলে আমলাতান্ত্রিক বলাই প্রণিধানযোগ্য। এই নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ বাংলাদেশ একটা অজানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত। নরেন্দ্র মোদির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি সেখানে ক্ষমতায়। তবুও গণতন্ত্রের সম্ভাবনার দুয়ার সেখানে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি। শত বছরের ঐতিহ্যের আবিরমাখা ভারতবর্ষকে অনন্তকালের জন্য প্রতিক্রিয়াশীলরা অবদমিত রাখতে পারবে না। বিশাল ভারত তার উদ্গত উদ্যত উদ্ধত মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেই। কিন্তু আমাদের দেশে কেন জানি না, গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে এক নায়কতন্ত্রের শাসনেই আচ্ছাদিত প্রায়। সর্বদলীয় রাজনীতির শাসনতান্ত্রিক অবাধ ব্যবস্থা এ দেশে রয়েছে কিন্তু কার্যত দেশ আজ একব্যক্তির সোনার শিকলে বাঁধা। দেশের ১৮ কোটি মানুষ মøান মূক মুখে চেয়ে আছে অনাগত সূর্যস্নাত ভবিষ্যতের দিকে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।  সূএ:বাংলাদে প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com