সকলি গরল ভেল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :স্কুল জীবনে দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ‘সকলি গরল ভেল’ নামক উপন্যাসটি পড়েছিলাম। এর পর বেশ কয়েক যুগ পার হয়ে যাওয়ায় সেটি ভুলেও গিয়েছিলাম। সকলি গরল ভেল শব্দ তিনটি ছিল মৈথুনি ভাষায়। চর্যাপদ বাংলায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে এটি অস্তিত্বে ছিল। বৈষ্ণব সাহিত্যের ব্রজবলি ভাষার সঙ্গে এর নৈকট্য রয়েছে। ‘অমিয় সাগরে স্নান করে সকলি গরল ভেল’ ছিল বইটির মূল কথা, যার অর্থ দুধের সমুদ্রে গোসল করে সব বিষাক্ত হয়ে গেল। বিগত কয়েক মাসে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের অনুগতদের আস্ফালন এবং সেদিন মার্কিন সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর শেষে দেওয়া বাণী শোনার পর হঠাৎ করেই সেই বইটির কথা মনে হলো। মনে হলো তাদের আস্ফালনের সমাপ্তি ঘটল ‘সকলি গরল ভেলে’।

 

সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ল বহু বছর ভারতে কংগ্রেস দলের শাসন শেষে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে মিঠাই বিলিয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং সমমনা দলগুলোর বন্ধু কংগ্রেসের যবনিকা পতনের পর বিজেপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করায় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকারের পতন হবে। কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল তাদের সেই আশা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখিত ‘আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়’, এর মতোই মরীচিকা সম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ওই লোকগুলো, যাদের রাজনীতির মূল মন্ত্র ভারত বিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতা, তাদের চিনতে বিজেপি নেতাদের কষ্ট হয়নি, তাই দল পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন ঘটেনি। সাম্প্রতিককালে এরা ভাবতে শুরু করল, ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে বিদেশিদের হাত-পা ধরেই সে পথে এগোতে হবে। আর তাই তারা বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি দূতদের দ্বারস্থ হওয়া এবং বিদেশি রাষ্ট্রসমূহে ধরনা দেওয়া শুরু করল। এ মর্মে কিছুটা ইঙ্গিতও পেল যে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। এসব ইঙ্গিতের পেছনে ছিল গত বছর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের সফল আইন রক্ষাকারী সংস্থা র‌্যাবের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটি যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরামহীন ধরনার ফসল তা মার্কিনিদের মুখ থেকেই জানা গিয়েছিল। জিয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই অপশক্তির লোকেরা সম্পদের পাহাড় গড়তে সমর্থ হয়। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের জন্য তাদের রয়েছে অগণিত মূলধন। সবশেষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব সুমন নামে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির বাড়িতে গমন করা এবং তার পরবর্তী বক্তব্যের পর এই নির্বোধ লোকগুলোর আশা বহু গুণ বেড়ে যায়। বোকার স্বর্গে বাস করা এই গোষ্ঠী ধরে নেয় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে ছাড়বেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘটনার পর খবর এলো সে দেশের সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু সাহেব, যার দায়িত্ব এ অঞ্চলের বিষয় দেখাশোনা করা, ঢাকায় আসবেন। এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠী তখন খবর ছড়াল লু সাহেব আসবেন বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের শাসন করতে, যাতে করে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমমনাদের ক্ষমতায় বসানো যায়। লু সাহেবের ঢাকা সফরের খবরে তাদের বুকের ছাতি প্রশস্ত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল এই ভেবে যে, মাহেন্দ্রক্ষণ এলো প্রায়। কিন্তু হায়, আবার সেই ‘সকলি গরল ভেল’। লু সাহেব ঢাকায় এসে যা বললেন তাতে এদের হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসায় যেমন পঞ্চমুখ ছিলেন, তেমনি র‌্যাব বাহিনীর প্রশংসায়ও। লু সাহেবের বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করার কারণে আমার মতো অনেকেরই সুযোগ হয়েছিল তার বক্তব্য শোনার। সে কারণে তার পরিষ্কার এবং বোধগম্য ইংরেজি ভাষায় দেওয়া ভাষ্যকে বিকৃত করার সুযোগ নেই। তিনি বাংলাদেশে এক যুগ ধরে উন্নয়নের কথার পাশাপাশি র‌্যাব বাহিনীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে ‘tremandeus’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, বাংলায় যার অর্থ ‘দুর্দান্ত’। তিনি র‌্যাবের অগ্রগতির প্রশংসায় আরও একটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন যা ছিল, ‘amazing’ অর্থাৎ ‘বিস্ময়করভাবে অপূর্ব’। এ কথাগুলো শোনার পর ’৭১-এ পাকিস্তানের খুনি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে সে সময়ে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তিটি মনে হলো। কিসিঞ্জার সাহেব, যিনি পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন, তার বই ‘হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’-এ লিখেছেন, ‘ইয়াহিয়া আহম্মক বৈ কিছু না।’ কিসিঞ্জারের এ মন্তব্য বাংলাদেশে বর্তমান ইয়াহিয়াপন্থিদের বেলায়ও প্রযোজ্য। কিছুদিন আগে যখন এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র আরও অনেকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, তখনো এই কুচক্রী গোষ্ঠী আশায় বুক বেঁধে ছিল এটা মনে করে যে র‌্যাবসহ আরও অনেক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার পথে। কিন্তু হায়, তাদের সেই গুড়েবালি পাওয়া গেল। সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের কারও নাম আসেনি। বিএনপি-জামায়াতওয়ালাদের চরম হতাশার আর একটি কারণ ছিল এই যে, লু সাহেব তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বা দেখা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি, যেটির জন্য তারা অতি আগ্রহভরে মুখিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর থেকে আগে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রত্যাহার করেনি বটে, কিন্তু লু সাহেবের বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এটি তুলে নেওয়া হবে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেবও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এসব থেকে ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে, লাখ লাখ ডলার ঢেলে এরা আলজাজিরায় লোক ভাড়া করে যে অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং মার্কিন রাজনীতিকদের প্রভাবিত করার জন্য যেসব লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন, তা এমনভাবেই ব্যর্থ হয়েছে যে, তারা এখন মনে করছে ডলারগুলো জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যে দলটির জন্ম হয়েছে ভারতবিরোধী স্লোগান দিয়ে, ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে দলের নেতারা ভারতের দ্বারস্থ হচ্ছে থুক্কু দিয়ে। কিন্তু তাতেও লাভ হবে না। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের এক প্রভাবশালী নেতা, এম জে আকবর সাহেব গত ১৬ ডিসেম্বর, অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় দিবসে কলকাতায় এক সমাবেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের নিজস্ব উপলব্ধি রয়েছে, কেননা তাঁর বাবা যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনিও তেমনি তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের পরাজিত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। আকবর সাহেব আরও বলেছেন, বাংলাদেশের কারও কারও ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় ভারত তার ভূমিকা পালন করবে। ‘ইন্ডিয়া নেরেটিভ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেই অনুষ্ঠানে এম জে আকবর সাহেব গুরুত্বসহকারে বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। আকবর সাহেবের কথা শোনার পর পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের নাগালে আনতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, ভারতের ব্যাপারেও তাই।

 

ইংরেজি ভাষার স্বনামধন্য উপন্যাসিক জনাথন সুইফট সামাজিক বৈষম্য এবং অনাচারের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ‘গেলিভারস জার্নি’ নামক এক বিদ্রƒপধর্মী উপন্যাসে লিখেছিলেন গেলিভার নামক স্বাভাবিক উচ্চতার ব্যক্তিটি পিপীলিকাসম মানুষের দেশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সে দেশের খুদে মানুষগুলো তাকে বেঁধে ফেলে এই ভেবে উল্লাস প্রকাশ করে যে, তারা দৈত্যসম সে মানুষটিকে আটকাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু গেলিভারের ঘুম ভাঙার পর সে যখন এক মোচড়েই বাঁধন ছিন্ন করে ফেলেছিল তখন লিলিপুট নামক খুদে মানুষগুলো বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পেরে হা-হুতাশ করতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের লিলিপুটদের সময় হয়েছে বাস্তবকে মেনে নেওয়ার। পঞ্চাশ দশকে বাংলা সংগীত জগতের জনপ্রিয় শ্যামা সংগীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের গান, ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’ গানটি শোনেননি এমন বাঙালি কমই রয়েছেন। তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত নেতারাও সম্ভবত গাইতে শুরু করেছেন, ‘অনেক কেঁদেছি, কাঁদিতে পারি না, বুক ফেটে ভেঙে যায় মা, সকলি ফুরায় যায় মা-কোলে তুলে নিতে আয় মা।’

 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, দাবির সত্যতা নিয়ে যা জানা গেল

» জানুয়ারি থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের এমপিও ইএফটিতে

» সাত দাবিতে রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ

» স্মার্টফোনের আয়ু একটি স্মার্টফোন কতদিন চালানো যায়?

» পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, মামলাও হচ্ছে

» জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে : রাষ্ট্রদূত

» রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে আ.লীগ: উপদেষ্টা নাহিদ

» বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুল, দুর্গন্ধে কাছে ঘেঁষা যায় না

» ঘুমের মধ্যে পায়ের পেশিতে টান পড়ে কেন, করণীয় কী?

» গাইবান্ধায় জন্ম নিল ছয় পা বিশিষ্ট বাছুর

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সকলি গরল ভেল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :স্কুল জীবনে দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ‘সকলি গরল ভেল’ নামক উপন্যাসটি পড়েছিলাম। এর পর বেশ কয়েক যুগ পার হয়ে যাওয়ায় সেটি ভুলেও গিয়েছিলাম। সকলি গরল ভেল শব্দ তিনটি ছিল মৈথুনি ভাষায়। চর্যাপদ বাংলায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে এটি অস্তিত্বে ছিল। বৈষ্ণব সাহিত্যের ব্রজবলি ভাষার সঙ্গে এর নৈকট্য রয়েছে। ‘অমিয় সাগরে স্নান করে সকলি গরল ভেল’ ছিল বইটির মূল কথা, যার অর্থ দুধের সমুদ্রে গোসল করে সব বিষাক্ত হয়ে গেল। বিগত কয়েক মাসে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের অনুগতদের আস্ফালন এবং সেদিন মার্কিন সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর শেষে দেওয়া বাণী শোনার পর হঠাৎ করেই সেই বইটির কথা মনে হলো। মনে হলো তাদের আস্ফালনের সমাপ্তি ঘটল ‘সকলি গরল ভেলে’।

 

সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ল বহু বছর ভারতে কংগ্রেস দলের শাসন শেষে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে মিঠাই বিলিয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং সমমনা দলগুলোর বন্ধু কংগ্রেসের যবনিকা পতনের পর বিজেপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করায় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকারের পতন হবে। কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল তাদের সেই আশা ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখিত ‘আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়’, এর মতোই মরীচিকা সম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ওই লোকগুলো, যাদের রাজনীতির মূল মন্ত্র ভারত বিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতা, তাদের চিনতে বিজেপি নেতাদের কষ্ট হয়নি, তাই দল পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন ঘটেনি। সাম্প্রতিককালে এরা ভাবতে শুরু করল, ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয় বলে বিদেশিদের হাত-পা ধরেই সে পথে এগোতে হবে। আর তাই তারা বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি দূতদের দ্বারস্থ হওয়া এবং বিদেশি রাষ্ট্রসমূহে ধরনা দেওয়া শুরু করল। এ মর্মে কিছুটা ইঙ্গিতও পেল যে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। এসব ইঙ্গিতের পেছনে ছিল গত বছর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের সফল আইন রক্ষাকারী সংস্থা র‌্যাবের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটি যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরামহীন ধরনার ফসল তা মার্কিনিদের মুখ থেকেই জানা গিয়েছিল। জিয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই অপশক্তির লোকেরা সম্পদের পাহাড় গড়তে সমর্থ হয়। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের জন্য তাদের রয়েছে অগণিত মূলধন। সবশেষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব সুমন নামে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির বাড়িতে গমন করা এবং তার পরবর্তী বক্তব্যের পর এই নির্বোধ লোকগুলোর আশা বহু গুণ বেড়ে যায়। বোকার স্বর্গে বাস করা এই গোষ্ঠী ধরে নেয় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে ছাড়বেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘটনার পর খবর এলো সে দেশের সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু সাহেব, যার দায়িত্ব এ অঞ্চলের বিষয় দেখাশোনা করা, ঢাকায় আসবেন। এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠী তখন খবর ছড়াল লু সাহেব আসবেন বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের শাসন করতে, যাতে করে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমমনাদের ক্ষমতায় বসানো যায়। লু সাহেবের ঢাকা সফরের খবরে তাদের বুকের ছাতি প্রশস্ত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল এই ভেবে যে, মাহেন্দ্রক্ষণ এলো প্রায়। কিন্তু হায়, আবার সেই ‘সকলি গরল ভেল’। লু সাহেব ঢাকায় এসে যা বললেন তাতে এদের হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসায় যেমন পঞ্চমুখ ছিলেন, তেমনি র‌্যাব বাহিনীর প্রশংসায়ও। লু সাহেবের বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করার কারণে আমার মতো অনেকেরই সুযোগ হয়েছিল তার বক্তব্য শোনার। সে কারণে তার পরিষ্কার এবং বোধগম্য ইংরেজি ভাষায় দেওয়া ভাষ্যকে বিকৃত করার সুযোগ নেই। তিনি বাংলাদেশে এক যুগ ধরে উন্নয়নের কথার পাশাপাশি র‌্যাব বাহিনীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে ‘tremandeus’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, বাংলায় যার অর্থ ‘দুর্দান্ত’। তিনি র‌্যাবের অগ্রগতির প্রশংসায় আরও একটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন যা ছিল, ‘amazing’ অর্থাৎ ‘বিস্ময়করভাবে অপূর্ব’। এ কথাগুলো শোনার পর ’৭১-এ পাকিস্তানের খুনি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে সে সময়ে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তিটি মনে হলো। কিসিঞ্জার সাহেব, যিনি পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন, তার বই ‘হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’-এ লিখেছেন, ‘ইয়াহিয়া আহম্মক বৈ কিছু না।’ কিসিঞ্জারের এ মন্তব্য বাংলাদেশে বর্তমান ইয়াহিয়াপন্থিদের বেলায়ও প্রযোজ্য। কিছুদিন আগে যখন এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র আরও অনেকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, তখনো এই কুচক্রী গোষ্ঠী আশায় বুক বেঁধে ছিল এটা মনে করে যে র‌্যাবসহ আরও অনেক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার পথে। কিন্তু হায়, তাদের সেই গুড়েবালি পাওয়া গেল। সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের কারও নাম আসেনি। বিএনপি-জামায়াতওয়ালাদের চরম হতাশার আর একটি কারণ ছিল এই যে, লু সাহেব তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বা দেখা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি, যেটির জন্য তারা অতি আগ্রহভরে মুখিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর থেকে আগে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রত্যাহার করেনি বটে, কিন্তু লু সাহেবের বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এটি তুলে নেওয়া হবে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেবও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এসব থেকে ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে, লাখ লাখ ডলার ঢেলে এরা আলজাজিরায় লোক ভাড়া করে যে অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং মার্কিন রাজনীতিকদের প্রভাবিত করার জন্য যেসব লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন, তা এমনভাবেই ব্যর্থ হয়েছে যে, তারা এখন মনে করছে ডলারগুলো জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যে দলটির জন্ম হয়েছে ভারতবিরোধী স্লোগান দিয়ে, ইদানীং দেখা যাচ্ছে সে দলের নেতারা ভারতের দ্বারস্থ হচ্ছে থুক্কু দিয়ে। কিন্তু তাতেও লাভ হবে না। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের এক প্রভাবশালী নেতা, এম জে আকবর সাহেব গত ১৬ ডিসেম্বর, অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় দিবসে কলকাতায় এক সমাবেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের নিজস্ব উপলব্ধি রয়েছে, কেননা তাঁর বাবা যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনিও তেমনি তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের পরাজিত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। আকবর সাহেব আরও বলেছেন, বাংলাদেশের কারও কারও ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় ভারত তার ভূমিকা পালন করবে। ‘ইন্ডিয়া নেরেটিভ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেই অনুষ্ঠানে এম জে আকবর সাহেব গুরুত্বসহকারে বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। আকবর সাহেবের কথা শোনার পর পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের নাগালে আনতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, ভারতের ব্যাপারেও তাই।

 

ইংরেজি ভাষার স্বনামধন্য উপন্যাসিক জনাথন সুইফট সামাজিক বৈষম্য এবং অনাচারের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ‘গেলিভারস জার্নি’ নামক এক বিদ্রƒপধর্মী উপন্যাসে লিখেছিলেন গেলিভার নামক স্বাভাবিক উচ্চতার ব্যক্তিটি পিপীলিকাসম মানুষের দেশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সে দেশের খুদে মানুষগুলো তাকে বেঁধে ফেলে এই ভেবে উল্লাস প্রকাশ করে যে, তারা দৈত্যসম সে মানুষটিকে আটকাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু গেলিভারের ঘুম ভাঙার পর সে যখন এক মোচড়েই বাঁধন ছিন্ন করে ফেলেছিল তখন লিলিপুট নামক খুদে মানুষগুলো বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পেরে হা-হুতাশ করতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের লিলিপুটদের সময় হয়েছে বাস্তবকে মেনে নেওয়ার। পঞ্চাশ দশকে বাংলা সংগীত জগতের জনপ্রিয় শ্যামা সংগীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের গান, ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’ গানটি শোনেননি এমন বাঙালি কমই রয়েছেন। তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত নেতারাও সম্ভবত গাইতে শুরু করেছেন, ‘অনেক কেঁদেছি, কাঁদিতে পারি না, বুক ফেটে ভেঙে যায় মা, সকলি ফুরায় যায় মা-কোলে তুলে নিতে আয় মা।’

 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com