সংগৃহীত ছবি
লাইফস্টাইল ডেস্ক :
সানজানা রহমান যুথী
মা, এই শব্দটির মাঝে জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, নিরন্তর মমতা ও নিঃস্বার্থ সেবা। একটি শিশুর জন্মের পর তার জীবনের প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধুর নাম ‘মা’। জন্ম থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিকাশের প্রতিটি ধাপে মায়ের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মা-ই পারেন শিশুর মনে নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তুলতে। শিশুর মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক বিকাশে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে হয় একেবারেই অসহায়। মায়ের দেহের উষ্ণতা, বুকের দুধ এবং স্নেহময় চাহনিই তাকে প্রথম জীবনের নিরাপত্তা দেয়। বুকের দুধ শুধু পুষ্টিকর খাদ্যই নয়, এটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং তাকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া শিশুর চোখে চোখ রেখে কথা বলা, কোলে নেওয়া, গান শোনানো এসব ছোট ছোট কাজ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে এবং আবেগীয় সংবেদনশীলতা তৈরিতে সহায়তা করে।
একজন মা-ই সবচেয়ে আগে বুঝতে পারেন তার শিশুর চাহিদা। সে কাঁদলে কেন কাঁদছে, খিদে পাচ্ছে নাকি কিছুতে অস্বস্তি হচ্ছে এসব মা-ই সহজে বুঝে ফেলেন। তাই শিশুর প্রাথমিক যত্নে মায়ের বিকল্প কেউ হতে পারে না। শিশুর ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, গানের সুর কিংবা গল্প বলার ভঙ্গি শিশুর শ্রবণশক্তি ও ভাষা শেখার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে তোলে।
শুধু শারীরিক ও মানসিক যত্নই নয়, নৈতিক শিক্ষার সূচনাও মায়ের হাত ধরেই হয়। ছোটবেলা থেকেই মা সন্তানকে সত্য বলা, ভালো-মন্দের পার্থক্য শেখানো, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, শৃঙ্খলা মেনে চলা এসব শিক্ষায় অভ্যস্ত করে তোলেন। একজন মা সন্তানের মধ্যে মূল্যবোধ ও চরিত্র গঠনের বীজ বপন করেন যা ভবিষ্যতে তার ব্যক্তিত্ব গঠনে দারুণভাবে সাহায্য করে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে কর্মজীবী অনেক মায়েরা কাজের ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের যথাযথ সময় দিতে পারছেন না। সমাজে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে অনেক মা চাকরি, ব্যবসা বা পড়াশোনার কারণে দিনের একটি বড় অংশ বাইরে কাটাতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় অনেকেই শিশুদের ডে কেয়ারে রেখে যান বা অন্য কারো হাতে তুলে দেন। যদিও এটা বর্তমান বাস্তবতা, তবুও বলা যায়, মা থেকে শিশুর যে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ও আবেগের বন্ধন পাওয়া যায় তা ডে কেয়ার বা অন্য কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়।
অনেক সময় দেখা যায়, শিশুর আচরণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে শুধুমাত্র মায়ের উপস্থিতির অভাবে। যেমন-আত্মবিশ্বাসের অভাব, অতিরিক্ত জেদি হয়ে ওঠা, মুড সুইং, ভয় বা নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। শিশুরা যখন মায়ের আদর, গল্প, হাসিমুখ, বা স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তারা ধীরে ধীরে মনের মধ্যে খালি অনুভব করে যা ভবিষ্যতে তার আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তবে কর্মজীবী মায়েদের জন্য একান্ত দোষ দেওয়া ঠিক নয়। তারা সন্তান ও কাজ-দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। অনেক মা কর্মস্থল থেকে ফিরেও সন্তানকে সময় দেন, তাকে নিয়ে পড়েন, খাওয়ান, খেলেন এবং ভালোবাসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। এতে করে কর্মজীবী মায়েরাও কষ্ট পান।
তাই পরিবার ও সমাজকেও মায়েদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কর্মস্থলে ‘চাইল্ড কেয়ার রুম’ থাকা, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে ফ্লেক্সিবল টাইমিং চালু করা কিংবা বাবা-মায়ের যৌথ অংশগ্রহণে সন্তানের যত্ন নেওয়া-এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। একজন বাবাকেও সমানভাবে শিশু পালনে জড়িত হতে হবে। তাহলে শিশুটি মায়ের অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণ একা বোধ করবে না। তাছাড়া মা যখন সন্তানকে সময় দেবেন, তখন যেন সেই সময়টি হয় মনোযোগপূর্ণ, মোবাইল-মুক্ত ও আন্তরিক ভালোবাসায় ভরা। যা অত্যন্ত জরুরি।
আবার একজন মা যদি গৃহিণী হন, তাহলেও শিশুর যত্নে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গৃহিণী মায়েরা সারা দিন সন্তানকে সময় দিতে পারেন, তার খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা, খেলা সব কিছুতে অংশ নিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও সচেতনতা জরুরি। শুধু খাওয়ানো বা গোসল করিয়ে দেওয়া নয়, শিশুর সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে তোলাও জরুরি। গল্প বলা, আঁকা শেখানো, গান গাওয়া, প্রাকৃতিক জগৎ পরিচয় করানো এসব কার্যক্রম শিশুর সৃজনশীলতা ও আবেগ বিকাশে ভূমিকা রাখে।
একটি শিশুর জীবনে মায়ের ভূমিকা শুধুই একজন পরিচর্যাকারী নয়, বরং একজন আদর্শ, একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু ও সবচেয়ে বড় কথা নিরাপত্তার আশ্রয়। সমাজ যতই আধুনিক হোক না কেন, প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক, মায়ের স্পর্শের বিকল্প কিছু হতে পারে না। মা-ই সন্তানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। তাই মায়েদের উচিত, যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় সন্তানের জন্য সংরক্ষণ করা।
সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম